শিবিরনামা [পর্ব-এক]
জিয়াউর রহমান নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা তথা সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্য তিনি বাংলাদেশে মৌলবাদী রাজনীতির সূচনা করার সুযোগ করে দেন। বিশেষত রাজাকার, আল বদর, আল শামসদের শুধু ক্ষমাই করেনি; ভবিষ্যতে এসব দেশবিরোধী শক্তিকে যেন বিচারের মুখোমুখি না দাঁড়াতে হয় তার জন্য ১৯৭২ সালে প্রণীত দালাল আইন ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে বাতিল করেন। জিয়াউর রহমানের দালাল আইন বাতিলের ফলে জেলে আটক প্রায় ১১ হাজার রাজাকার সেসময় মুক্ত হয়। তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে রাজাকার, আল বদর, আল শামসদের রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে রাজনীতিকে ধর্ম ব্যবসায়ী আর মৌলবাদীদের লিজ দেয়া হয় এভাবে। একাত্তরের আলবদর রাজাকারদের অনেকেই জেল থেকে বের হয়ে এসে শুরু করে আনন্দ-উল্লাস। যারা পালিয়ে ছিল তারাও জনসম্মুখে বের হয়ে এলো। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সিদ্দিক বাজার কমিউনিটি সেন্টারে আলবদর রাজাকাররা একটি সভায় মিলিত হয়। আলবদরদের সেই সমাবেশে আবার রাজনীতির মাঠে প্রকাশ্যে নামার প্রস্তুতি নেয় ইসলামি ছাত্রসংঘ নামের একাত্তরের ঘাতক সংগঠনটি। কিন্তু জামায়াতের নীতি নির্ধারকদের মনে এই ভয় ছিল যে, ছাত্রসংঘ নামটাকে মানুষ একাত্তরে তাদের পৈশাচিক কর্মকান্ডের জন্য ভুলে যাবে না। এই চিন্তা থেকেই তারা ছাত্রসংঘের 'সংঘ' কেটে সেখানে 'শিবির' যোগ করে দেয়। পাকিস্তান আমলে জামায়াতের শিশু কিশোরদের একটা সংগঠন ছিল 'শাহিন শিবির' নামে, সেখান থেকেই ইসলামি ছাত্রসংঘের নাম হয়ে যায় ইসলামি ছাত্রশিবির। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল ও তাদের উত্তরসূরিদের নিয়ে ইসলামি ছাত্রশিবির নামে বর্বর পৈশাচিক সংগঠনের। ইসলামি ছাত্রসংঘ বাদ দিয়ে শুধু শিবির করা হয়, আর সবকিছুই একই থাকে। পতাকা, মনোগ্রাম সবই এক। প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, পাঠক্রম, এমনকি জেলা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তৃত নেতৃত্ব কাঠামো সবই এক থাকে ইসলামি ছাত্রসংঘের মতোই। ইসলামি ছাত্রশিবির মানে ইসলামি ছাত্রসংঘ, ইসলামি ছাত্রসংঘ মানে আলবদর রাজাকার, আলবদর রাজাকার মানে একাত্তরে লাখ লাখ মানুষের খুনী, লুটপাটকারী, দালাল।
নাম বদলের কারণ
প্রথমত, আলবদর বাহিনীর সাথে ইসলামি ছাত্রসংঘের সম্পর্ক ছিল আনুষ্ঠানিক। জামায়াতের প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় পাকিস্তানের সামরিক সরকার এই বাহিনী গঠন করে। পরবর্তীতে বদর বাহিনীর মূল নেতৃত্ব ন্যস্ত হয় ইসলামি ছাত্রসংঘের হাতে।
দ্বিতীয়ত, বদর বাহিনীর হিংস্র এবং পৈশাচিক কার্যকলাপ বাংলাদেশের মানুষের মনে স্থায়ী ঘৃণার ভাব সৃষ্টি করেছিল। জামায়াত তখন ভালো করেই জানতো এই ঘৃণা কখনো দূর হবে না। ইসলামি ছাত্রসংঘের কথা উঠলেই অবধারিতভাবে আলবদর বাহিনীর কথা চলে আসবে। এর ফলে সংগঠনের সম্প্রসারণ ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
তৃতীয়ত, যদি কখনো স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে তখন আইনগতভাবে ফেঁসে যেতে পারে ইসলামি ছাত্র সংঘ। সেক্ষেত্রে যাতে সংগঠনের কাজ ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেজন্য জামাতিরা এই নাম বদলের কাজটা প্রথম সুযোগেই সম্পাদন করে ফেলে।
চতুর্থত, কর্মী সংগ্রহের ক্ষেত্রে যদি আলবদর এবং ইসলামি ছাত্রসংঘের সম্পর্কের বিষয়টি নতুন কর্মীদের মনে প্রশ্ন ও সন্দেহ জাগায় তাহলে সেটা সংগঠনের জন্য ক্ষতিকর হবে।
ইসলামি ছাত্রসংঘ নাম বদলে ইসলামি ছাত্রশিবির নামে তাদের কার্যক্রম শুরু করার পর শিবিরের প্রথম সভাপতি হয় মীর কাশেম আলী ও সেক্রেটারি হয় মোহাম্মদ কামরুজ্জামান।
মীর কাশেম আলীর ডাক নাম ছিল পিয়ার। ১৯৭১ সালের প্রথমদিকে মীর কাশেম আলী ছিল জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামি ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি, পরে রাজাকারি কর্মে কৃতিত্বের পুরস্কার হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামি ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদকের পদ দেয়া হয় তাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই সে পালিয়ে যায় সৌদি আরব। ফিরে আসে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর। তারপর জিয়াউর রহমান সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। শিবিরের প্রথম সভাপতি হওয়ার পর সে মহানগর জামায়াতের আমির হয়। 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়' বইটি থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২রা আগস্ট চট্টগ্রাম শহরে ইসলামি ছাত্রসংঘের উদ্যোগে মুসলিম ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক সমাবেশে সভাপতির ভাষণে মীর কাশেম আলী বলেছিল-
"গ্রামগঞ্জের প্রত্যেকটি এলাকায় খুঁজে খুঁজে শক্রর শেষ চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে।"
https://doc.liberationwarbangladesh.net/books/mgqs/
প্রথমদিকে মীর কাশেম আলী চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনীর প্রধান কমান্ডার ছিল। পরে তার অত্যাচার-নির্যাতনে খুশি হয়ে ঊর্ধ্বতন নেতারা তাকে আলবদর বাহিনীর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তিন নম্বরে পদোন্নতি দেয়।
অন্যদিকে কামারুজ্জামান ১৯৭১ সালে ইসলামি ছাত্রসংঘের ময়মংসিংহ জেলার নেতা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামালপুরে যে প্রথম আলবদর বাহিনী গড়ে উঠে, তার প্রধান সংগঠক ছিল এই কামারুজ্জামান। শহিদ বদিউজ্জামানকে ধরে এনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার জঘন্য কর্মটি কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে হয়েছিল। এ ব্যাপারে আরও কয়েকজন সহ তার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পর মামলা দায়ের হয়েছিল। শেরপুর জেলার শহিদ গোলাম মোস্তফার হত্যাকাণ্ডও সংঘটিত হয়েছিল কামারুজ্জামানের নির্দেশে। তার হাত-পায়ের রগ কেটে, গায়ের মাংস তুলে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল কামরুজ্জামানের বাহিনী৷ তাছাড়া বাড়ি পোড়ানো, লুটপাট, নারী নির্যাতনসহ আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়' বইটি থেকে থেকে জানা যায়, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বেই ময়মনসিংহ জেলার সব ছাত্রসংঘ কর্মীকে আলবদর বাহিনীর অন্তভুক্ত করা হয়।
এই দুই আলবদর শিবিরের নেতৃত্বে আসার পর নতুন করে গতি পায় তাদের বাংলাদেশ বিরোধী কার্যকলাপ। এক বছরের মধ্যেই তারা শুরু করে তাদের প্রথম অভিযান। ১৯৭৮ সালে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য 'অপরাজেয় বাংলা' ভেঙ্গে ফেলার জন্য সাক্ষর সংগ্রহ শুরু করে। এতে ছাত্র সমাজ ক্ষুন্ধ হয়ে উঠলে রাতের অন্ধকারে তারা ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু সচেতন ছাত্র সমাজের প্রতিরোধের মুখে তারা পিছু হটে। এরপর একইভাবে তারা জয়দেবপুরে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। সেখানেও তারা ব্যর্থ হয়। তারপর তারা ঢাকা ছেড়ে নিজেদের সারাদেশে বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করে। শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দখলের লড়াই। একাত্তরে মুক্তিবাহিনীর হাতে যেসব আলবদর রাজাকার নিহত হয় তাদের নামানুসারে বিভিন্ন সেল গঠন করে তারা তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে শুরু করে। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে তারা একদিকে যেমন অস্ত্র ও অর্থভান্ডার গড়ে তুলে, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক যেকোনো স্মৃতি মুছে ফেলার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। শুরু হয় চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের দখলদারিত্বের রাজনীতি। এদেশে আবার নতুন করে শুরু হয় আলবদর রাজাকার স্টাইলে তাদের খুনের রাজনীতি।
Comments