পুঁজিবাদী সমাজে নারী


সাধারণত মানব শরীরকে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ধরা হলেও শরীরের গঠনের সাথে সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পৃথিবী জুড়ে যেসব সংস্কৃতি আছে সবগুলোই মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, মানুষের শরীর কিভাবে নতুন করে ঢেলে সাজানো উচিৎ। নারীদের উপর এর কুপ্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। কখনো আদর্শ শারীরিক গঠন দিয়ে সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয়েছে, কখনো নারীকে বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতীক দিয়ে আদর্শ নারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, আবার কখনো শুধুমাত্র নিজ স্বার্থ চরিতার্থের জন্য এই নোংরা ধারণাটির প্রচার করা হয়েছে। নারীদের শরীরের আকার কেমন হওয়া উচিৎ তা পশ্চিমা ফ্যাশন দুনিয়া শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের পোশাক অন্তর্বাসের ধরনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নির্দেশ করে আসছে। রুচিসম্মত শারীরিক গঠন বা আদর্শ শারীরিক গঠন বলে যা যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে, তা মূলত সংস্কৃতির ভ্রান্ত চিন্তার ফলাফল। ১৮ শতকের দিকে পশ্চিমা বিশ্বে ফ্যাশনেবল শরীর এর ব্যাপারটা কেবল অভিজাতদের মাথাব্যাথার কারণ ছিলো। ফিতাযুক্ত শরীরবন্ধনী Stays অপরিহার্য পরিধেয় হিসেবে গণ্য করা হতো। 
 
 
বিশ্লেষকদের মতে, শুধুমাত্র সরু দেখানোর জন্য এটি পরা হতো না, বরং এর পেছনে জাতিগত ও নারীর শরীরের সাথে সম্পর্কিত জটিল কিছু সাংস্কৃতিক ধারণা জড়িয়ে আছে। একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস সবসময় ছিলো যে, নারী শরীর সহজাতভাবে দুর্বল এবং তার সহায়তা প্রয়োজন, Stays তার শরীরের জন্য এক স্বতন্ত্র দৃঢ় বাহনের সৃষ্টি করে! অস্বস্তিদায়ক পোশাকটি পরা অবস্থায় বেশ আভিজাত্যপূর্ণ চলনভঙ্গি আয়ত্ত করতে পারাকে শিষ্টাচারের লক্ষণ হিসেবে ধরা হতো। বেশ কয়েকজন প্রসিদ্ধ লেখক ও চিন্তাবিদদের দ্বারা ব্যাপারটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিলো সেসময়। সামাজিক প্রথা দ্বারা ব্যক্তি বিশেষকে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে রাখাকে রূপকঅর্থে পোশাকটির সাথে তুলনা করা হতো। তবে এসব চিন্তাধারার সমাজের ওপর তেমন বিশেষ প্রভাব পড়েনি। শরীরের উপরের অংশে মনযোগ আকর্ষণের সবচেয়ে সুবিধাজনক পদ্ধতি ছিলো নিচের অংশ অর্থাৎ পায়ের দিকটা যথাযথভাবে ঢেকে রাখা। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে নারী শরীরের উপরিভাগকে মূল্যবান হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ১৮৪৫-৭০ সাল পর্যন্ত প্রচলন ছিলো বৃহদায়তনের Crinoline, যা শরীরের নীচের অংশকে সম্পূর্ণভাবে চোখের আড়াল করে রাখতো। 
 
 
পোশাকের এই  ধারণাটি মধ্যবিত্ত থেকে উপর দিকে উঠতি সম্প্রদায়ের জন্য তাদের নতুন সম্পদ জাহির করার উপযুক্ত উপায় ছিলো। পুরুষদের বেশভূষা এসময় অপেক্ষাকৃত সাদামাটা হলেও যদি কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে ক্রিনোলিনে সজ্জিত করতে পারতো এবং যাতে অনেক বেশি পরিমাণে কাপড় ও তা ধরে রাখার জন্য ভৃত্য নিযুক্ত করতে পারতো, তবে সেটি ঐ ব্যক্তির প্রচুর পরিমাণে উপার্জনকে নির্দেশ করতো। ১৮৭০ এর পরের সময়ে নারীরা পোশাকের নিচে পেছন দিকে এক ধরণের উঁচু প্যাড ব্যবহার শুরু করে, যা Bustle নামে পরিচিত। ততদিনে পোশাকের বিভিন্ন ধরণ অভিজাত শ্রেণী থেকে সাধারণ শ্রেণীতে প্রচলিত হতে শুরু করে। নারী শরীরের আদর্শ মাপকাঠি অভিজাত থেকে সাধারণের মনে ঢুকতে শুরু করে। অনেক সক্রিয় কর্মী ও ডাক্তারদের সাবধানবাণীর তোয়াক্কা না করে ক্ষতিকর শরীরবন্ধনী কেনা শুরু করলো সাধারণ নারীরা।  
 
 
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে শরীরবন্ধনী থেকে নারীদের মুক্তি দিতে ঢোলা গাউনের আবির্ভাব ঘটে। শিল্প মহলে পোশাকের এই ধরণ বেশ সমাদৃত হলেও সাধারণ জনগণের কাছে তা অদ্ভুত হিসেবে গণ্য হলো। কেননা ততদিনে তাদের মাথায় নারী শরীরের একটি নির্দিষ্ট নমুনা গেঁথে গেছে। যারা আগ্রহী হয়ে নতুন ধরনের পোশাকটি ক্রয় করতো, তারাও এটি বাসার ভেতর পরিধানে সীমাবদ্ধ রাখতো। ১৯২০ সালের দিকে Flapper Style আসার পর শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে রাখা পোশাক আবেদন হারাতে শুরু করে। Flapper Style মূলত তুলনামূলক চওড়া কাঁধ আর অপেক্ষাকৃত সরু কোমরের সন্নিবেশ। কিন্তু নতুন ধরনের এই স্টাইলেও শরীরের আকৃতি কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্টি করা হতো কোমরে আটোসাটো বন্ধনী দিয়ে কোমরকে যতটা সম্ভব সরু করার মাধ্যমে। তবে এই পদ্ধতি শরীরবন্ধনীর চেয়ে আরামদায়ক ছিলো।  
 
 
১৯৩০ এর দিকে সরু কোমরের জনপ্রিয়তা থাকলেও কিছু পোশাক শিল্পী চিরাচরিত ফ্যাশনেবল শরীরের বাইরে অপেক্ষাকৃত স্থুল শরীরের নারীদের জন্য পোশাক তৈরী করতেন। তখনকার সময়ের কিছু পোশাকে ৩১ ইঞ্চি কোমরের মাপ দেখে ব্যাপারটা বোঝা যায়। ১৯৪০ ও ১৯৫০ সালের দিকে সরু কোমরের চল কমে গিয়ে নতুন ভঙ্গিতে নারী শরীরকে দেখা শুরু করে পোশাক শিল্পীরা, যে ধারণানুযায়ী শরীরের উর্ধাংশ ও কোমরের মাপে আগের চেয়ে পার্থক্য চোখে পড়ে। ১৯৬০ সালের দিকে পুনরায় চওড়া কাঁধ ও বালকসুলভ পোশাকের চল শুরু হয় এবং সেটাই ফ্যাশন হিসেবে গণ্য হয়। এই সময়ের মধ্যে শরীরবন্ধনী ও কটিবন্ধনীর ব্যবহার কমতে কমতে বিলুপ্তপ্রায় হলেও ১৯৭০ ও ‘৮০ এর দিকে নারীদের শারীরিক সৌন্দর্য বর্ধনের উপায় হিসেবে শুরু হয় খাবার নিয়ন্ত্রণ ও শারীরিক কসরতের চল। এর সাথে যুক্ত হয় ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলোর আদর্শ শরীরের নিজস্ব ধারণা। তারা মডেল হিসেবে এমন মেয়েদের ছবি প্রকাশ করতে থাকে, যাদের শরীর ও বক্ষের আকারের অনুপাতে উল্লেখযোগ্য অসামঞ্জস্যতা দেখা যেতো। এই ধরণের শারীরিক আকৃতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্লাস্টিক সার্জারি দ্বারা পাওয়া সম্ভব। যার কারণে সেসময় অবস্থাসম্পন্ন নারী এবং গণমাধ্যমে কাজ করা মডেল ও নায়িকাদের মধ্যে প্লাস্টিক সার্জারির প্রচলন শুরু হয়। সাধারণ মেয়েরা ভুগতে থাকে আদর্শ শারীরিক আকৃতি না পাওয়ার হতাশায়। ১৯৯০ থেকে শুরু হয় অতিরিক্ত পাতলা শারীরিক আকৃতির ফ্যাশন, গণমাধ্যমের কল্যাণে যা ‘জিরো ফিগার’ নামে পরিচিত। মূলত পশ্চিমা পোশাক শিল্পের নারী শরীরের এহেন চিন্তা ধারা যুগের পর যুগ ধরে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সমাজকে নারী শরীরের আদর্শ রূপের ভ্রান্তিমূলক ধারণা দিয়ে আসছে। সমাজের প্রতিষ্ঠিত এই ধারণা থেকে ন্যূনতম বিচ্যুতি নারীদের জন্য বিপুল পরিমাণ হতাশা ও প্রত্যাখ্যানের গল্প তৈরী করেছে সমাজে। ২০১৬ তে Dove একটি জরিপ করে ১৩ টি দেশের নির্দিষ্ট সংখ্যক নারীর উপর, যাদের বয়স ১৩ থেকে ৬০ এর মধ্যে। জরিপের বিষয় ছিলো কতজন নারী তাদের শারীরিক সৌন্দর্য ও আকৃতি নিয়ে সন্তুষ্ট ও আত্মবিশ্বাসী। দেখা যায়, সেই সংখ্যা ২০ শতাংশের বেশি নয়। বিশ্বব্যাপী নারীরা তথাকথিত আদর্শ শরীরের জন্য হতাশায় ভুগছে, নিজের উপর আত্মবিশ্বাস রাখতে পারছে না, কারণ সমাজের চোখে সে ‘আদর্শ নারী’ হয়ে উঠতে পারেনি।  
 
 
দিনের পর দিন পোশাকের বৈচিত্র্যের আড়ালে নিজের শারীরিক আকৃতি নিয়ে প্রতিনিয়ত হীনম্মন্য করা হয়েছে নারীদের। নারী যে শারীরিক সৌন্দর্যের বাইরেও এক আলাদা স্বত্ত্বা, সেই ধারণা কেড়ে নেয়া হয়। এখনো অনেকে সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এমন ধারণা সমাজের মধ্যে ঢোকানোর পেছনে পশ্চিমাদের ভূমিকা বরাবরই মূখ্য।


Comments

নারীর আত্মবিশ্বাসকে এভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে ।
পাঠক said…
খুবই ভালো লিখেছেন।

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]