১৯৩৩ সালে জার্মানিতে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে তা পরবর্তী দশকগুলোতে পৃথিবীর ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ছাপ রেখে যায়। ঐ বছরের ৩০ জানুয়ারি হিটলার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সাথে সাথেই নৈরাজ্য আর আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর শাসনের সূত্রপাত হয়। ক্ষমতা বৈধকরণের জন্য তার সরকার নতুন করে নির্বাচনের ডাক দেয় এবং বিজয় নিশ্চিত করতে অসংখ্য প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টার ত্রুটি করেনি। নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে ২৭ শে ফেব্রুয়ারি নাৎসিরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আইনসভায় আগুন লাগিয়ে কম্যুনিস্টদের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়। ঘটনাটি ইতিহাসে 'রাইখস্টাগ ফায়ার' হিসেবে পরিচিত।
ফলশ্রুতিতে, নাৎসিরা ১৭۔৩ মিলিয়ন ভোট লাভের মাধ্যমে ২৮৮ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি পায়, সংখ্যাটি মোট ভোটারের ৪৮% (নভেম্বরে তারা ১১.৭ মিলিয়ন ভোট এবং এর মাধ্যমে ১৯৬ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি পায়)।
কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করার পর পরই তারা সোশ্যাল ডেমোক্রেট এবং ট্রেড ইউনিয়নের উপর নিপীড়ন শুরু করে। তাদের রাজনৈতিক বন্দিশিবিরগুলো বামপন্থী নারী-পুরুষ দ্বারা ভর্তি হতে থাকে। ইত্যবসরে দক্ষিনপন্থীদের
সহায়তায় আইনসভায় হিটলারের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। মার্চের ২৪ তারিখ হিটলার আইনসভাকে আইন পাশ করতে বাধ্য করে, যেই আইনে তাকে পরবর্তী চার বছরের জন্য আইনসভার হস্তক্ষেপ ছাড়া জার্মানি শাসনের একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
তখন থেকেই প্রকাশ্যে ইহুদি নিপীড়ন শুরু হয়। হিটলার ক্রমাগত ১৯১৮ সালের আন্তর্জাতিক চুক্তি ভঙ্গ করছিলেন, যেখানে জার্মানিতে যুদ্ধোপকরণ মজুদ ও সামরিকায়ন এর উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছিল।
চুক্তির তোয়াক্কা না করে জার্মানির সামরিকায়ন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে লাগলো। এটাই ছিলো তৎকালীন রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রকৃত অবস্থা। অথচ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বানানো প্রোপাগান্ডাগুলো
এই পরিস্থিতির সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছিলো ইচ্ছাকৃতভাবে। গোয়েবলস ছিলেন নাৎসিদের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী, যার কাজই ছিলো নাৎসিদের উচ্চাভিলাসী আর অবাস্তব স্বপ্ন সাধারণ জার্মানদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেয়া।
এটা ছিল এমন এক বর্ণবাদী পরিকল্পনা যেখানে শুধুমাত্র জাতিগতভাবে বিশুদ্ধ লোকেরা বৃহত্তর জার্মানিতে থাকতে পারবে। তথাকথিত বৃহত্তর জার্মানির পূর্বের অংশ ছিলো মূল জার্মান ভূখণ্ডের চেয়েও বিশাল, যা তখনও নাৎসিদের দখলে আসেনি। ১৯২৫ সালে হিটলার তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'মাইন
ক্যাম্ফ' এ ইউক্রেনকে বৃহত্তর জার্মানির অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, ইউক্রেন এবং পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলকে জার্মান জাতির অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি, যেন অঞ্চলগুলো সঠিক পন্থায় পরিচালিত হতে পারে।
নাৎসি প্রোপাগান্ডা অনুযায়ী, নাৎসি তলোয়ার এই অঞ্চলগুলোকে শিক্ষিত করে তুলবে একীভূত জার্মান জাতির স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে! জার্মান প্রযুক্তি এবং শিল্পের মাধ্যমে ইউক্রেন পরিণত হবে এমন এক অঞ্চলে যা কিনা জার্মানিতে খাদ্যশস্যের অন্যতম যোগানদাতা হবে! কিন্তু নাৎসি জার্মানিকে প্রথমে ইউক্রেনের 'নিকৃষ্ট' জনগণকে অন্য আরেকটা ব্যাপারে শিক্ষিত বানাতে হতো! নাৎসি প্রোপাগান্ডা অনুযায়ী, ইউক্রেনিয়ানরা শ্রমিক হিসেবে জার্মানদের ঘরবাড়ি, কলকারখানা, কৃষিক্ষেত্র থেকে শুরু করে জার্মান অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার জন্যে যেখানেই প্রয়োজন হবে সেখানেই অবদান রাখবে! জার্মানি কর্তৃক ইউক্রেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য অঞ্চল দখল করা জার্মানির সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী করে তুলে এবং শক্তিশালী জার্মানদের বিরুদ্ধে এই অপরিহার্য যুদ্ধের জন্য আগে থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির দরকার ছিল। এমতাবস্থায় জার্মান প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী গোয়েবলস ইউক্রেনে বলশেভিকদের দ্বারা সংঘঠিত গণহত্যার কাল্পনিক প্রচারণা চালাতে থাকে এভাবে যে, স্তালিন জবরদস্তি করে ইউক্রেনের চাষীদের সমাজতান্ত্রিক নীতি গ্রহণে বাধ্য করায় সেখানে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই ধরণের প্রচারণার উদ্দেশ্য ছিলো বিশ্ব জনমত নিজেদের দিকে নিয়ে আসা। তিনি এটাও ছড়াতে থাকেন যে, জার্মান সেনারা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইউক্রেনকে স্বাধীনতা উপহার দিবে! এতো আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও এসব প্রোপাগান্ডা সাধারণ জনগণকে তেমন প্রভাবিত করতে পারেনি ঐ আমলে। নাৎসিদের এসব প্রোপাগান্ডা ব্রিটিশদের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল তখন।
হিটলার এবং গোয়েবলস এর সোভিয়েত ইউনিয়ন এর বিরুদ্ধে মিথ্যা গুজব ছড়ানোর জন্যে সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দেয়, যা তারা মার্কিনীদের কাছ থেকে ভালোমতোই পেয়েছিল।
উইলিয়াম হার্স্ট ছিলেন এমন এক মার্কিন ধনকুবের যিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে নাৎসিদের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে সাহায্য করতে সর্বদা এক পায়ে খাড়া।
তিনি অত্যন্ত পরিচিত ছিলেন সংবাদপত্রের মালিক হিসেবে, যাকে বলা হতো 'হলুদ সাংবাদিকতার জনক'। বাবা জর্জ হার্স্ট এর হাত ধরে ১৮৮৫ সালে 'সানফ্রান্সিসকো ডেইলি এক্সামিনার' এর
সম্পাদক হিসেবে উইলিয়াম হার্স্ট এর ক্যারিয়ার শুরু হয়। তার বাবা ছিলেন ধনী খনি শিল্পপতি, সিনেটর এবং সংবাদপত্রের মালিক। সম্পাদক হিসেবে তার দায়িত্ব প্রাপ্তির পর থেকেই শুরু হয় সংবাদপত্রের জগতে সাম্রাজ্য বিস্তার, যেগুলো উত্তর আমেরিকার অধিবাসীদের জীবনযাত্রা এবং চিন্তাধারার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। বাবার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে
প্রাপ্ত খনি শিল্পের সমস্ত শেয়ার বিক্রি করে দেন হার্স্ট এবং প্রাপ্ত পুঁজি সংবাদমাধ্যমে বিনিয়োগ করতে থাকেন। তিনি সর্বপ্রথম 'নিউইয়র্ক মর্নিং জার্নাল' কিনে
নেন। ঐতিহ্যবাহী পত্রিকাটি কিনে নেয়ার পর হার্স্ট এটি সম্পূর্ণরূপে পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদমাধ্যমে পাল্টে ফেলেন। পত্রিকাটির কাটতি বাড়াতে তিনি দেদারসে ডলার খরচ করতেন খবর কেনার পিছনে। আর যখন কোনো নৃশংস অপরাধের খবর ছাপানোর জন্য পাওয়া যেতো না, তখন তার অধীনস্থ সাংবাদিক এবং আলোকচিত্রকাররা খবর বানিয়ে নিতো। এই নোংরামিগুলো তাকে শীঘ্রই মিলিয়নিয়ারে পরিণত করে এবং তিনি হয়ে যান গণমাধ্যম জগতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ১৯৩৫ সালেই তিনি হয়ে উঠেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ধনী, ফরচুন ম্যাগাজিনের হিসাব অনুযায়ী ঐসময় তার সম্পদের মোট মূল্য ছিল দুইশ মিলিয়ন ডলার! 'নিউইয়র্ক মর্নিং জার্নাল' কেনার
পর হার্স্ট একের পর এক দৈনিক এবং সাপ্তাহিক পত্রিকা কিনে তার প্রোপাগান্ডাগুলো
মার্কিন সমাজের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে থাকেন। ১৯৪০ সালের মধ্যেই উইলিয়াম হার্স্ট ২৫টি দৈনিক পত্রিকা, ২৪টি সাপ্তাহিক পত্রিকা, ১২টি রেডিও স্টেশন, ২টি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা, ১টি চলচ্চিত্র শিল্পের খবর প্রচারকারী পত্রিকা, কসমোপলিটান ফিল্ম কোম্পানি এবং আরো অনেক কিছুর মালিক বনে যান। ১৯৪৮ সালে বাল্টিমোরে হার্স্ট যুক্তরাষ্ট্রের
একেবারে প্রথমদিকের টিভি স্টেশন 'বিডাব্লিউএএম টিভি' কিনে নেন। হার্স্ট এর পত্রিকাগুলো দৈনিক ১৩ মিলিয়ন কপি বিক্রি হতো এবং ৪০ মিলিয়ন পাঠক প্রতিদিন এগুলো পড়তো, যা যুক্তরাষ্ট্রের
মোট প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ! অধিকন্তু সারাবিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে এসব নোংরামি তথা প্রোপাগান্ডাগুলো তার অধীনের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, সিনেমা আর অনুবাদ করা সংবাদপত্রসমূহ দ্বারা পৌঁছে যেতো। তিনি প্রোপাগান্ডাগুলো সারা বিশ্বে প্রচারের জন্য প্রকাশনার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন অনেক। উপরে উল্লিখিত সংখ্যাগুলোর বিশালতাই প্রমাণ করে দেয়, হার্স্ট এর সাম্রাজ্য মার্কিন তথা বিশ্ব রাজনীতিতে কতটা প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল বছরের পর বছর ধরে। সেগুলোর অনেকাংশ জুড়ে থাকতো সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে ভর্তি এবং ১৯৫০ সালের ম্যাকার্থিজম এর পক্ষে প্রচারণা।
উইলিয়াম হার্স্ট ছিলেন উগ্র ডানপন্থি, যিনি উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং কম্যুনিস্ট বিরোধিতা প্রচারকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৩৪ সালে জার্মানি ভ্রমণকালে হিটলার হার্স্টকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে বরণ করে 'বন্ধু' হিসেবে আখ্যায়িত করেন! এই ভ্রমণের পর হার্স্ট সমাজতন্ত্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং স্তালিনের বিরুদ্ধে কুৎসা আরো আগ্রাসী হয়ে রটাতে থাকেন। তার অধীনস্থ সংবাদপত্রগুলোতে
স্তালিনের বিরুদ্ধে সর্বক্ষণ আর্টিকেল ছাপানো হতো ঐসময়। হার্স্ট পাশাপাশি নাৎসিদের মহান উদ্দেশ্যগুলোও
(!) প্রচার করতে লাগলেন। তিনি হারমান গোয়েরিং এর প্রোপাগান্ডাগুলোর
উপর অনেক আর্টিকেল সিরিজ আকারে প্রকাশ করেছিলেন।
পরবর্তীতে কিছু পাঠক প্রতিবাদ জানালে তিনি এই কাজে ক্ষান্ত দেন! তার সংবাদপত্রগুলো প্রতিদিন ভর্তি থাকতো সোভিয়েত ইউনিয়নে সংঘটিত কাল্পনিক হত্যা, গণহত্যা, সাধারণ জনগণের দাসত্ব, সোভিয়েত নেতাদের বিলাসী জীবনযাপন আর অনাহারে আক্রান্ত জনতার করুণ (!) বিবরণ দিয়ে!
এসব খবরের উপাদানগুলো হার্স্টকে সরবরাহ করতো নাৎসি জার্মানির গেস্টাপো পুলিশ।
হার্স্ট এর সংবাদপত্রগুলোর একেবারে প্রথম পৃষ্ঠায় থাকতো সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে নানা ব্যঙ্গচিত্র, যেখানে দেখানো হতো স্তালিন খঞ্জর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হার্স্ট এর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রথম দিকের প্রোপাগান্ডাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ইউক্রেনের দুর্ভিক্ষের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যর ঘটনাটি! এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত
নোংরা প্রচারণাটি ১৯৩৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি 'শিকাগো আমেরিকান' পত্রিকায় প্রথম পাতার শিরোনাম "সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্ষুধায় ছয় মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু" আকারে
শুরু হয়। নাৎসিদের প্রতি অনুরক্ত মিডিয়া মুঘল উইলিয়াম হার্স্ট নাৎসি জার্মানি থেকে সরবরাহকৃত ভুয়া তথ্যগুলো দিয়ে একের পর এক মনগড়া কাহিনী ছাপাতে লাগলেন যে, বলশেভিকরা জেনেশুনে ইউক্রেনে গণহত্যা সংঘঠিত করেছিল এবং এর ফলে সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেয়ে মারা যায়। অথচ আসল সত্যটা একেবারেই ভিন্ন। ১৯৩০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের প্রথমদিকে ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকরা ধনী কুলাক চাষীদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল এবং যৌথ সমবায় ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম শুরু করেছিল।
প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই মহান শ্রেণী সংগ্রামে ১২০ মিলিয়ন কৃষক অংশ নেয় ধনী কৃষকদের শস্যের মজুদকরণ এর মাধ্যমে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি সহ আরো অনেক অত্যাচারের বিরুদ্ধে। এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে খাদ্য সংকট দেখা দিলে পুষ্টিহীনতায় আক্রান্ত ইউক্রেনিয়ান কৃষকদের মধ্যে নানান মহামারী রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে, এই মহামারী রোগগুলো তৎকালীন সময়ে বিশ্বের সর্বত্র দেখা যেতো। শুধুমাত্র ১৯১৮-১৯২০ সালের মধ্যেই 'স্প্যানিশ ফ্লু' দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ২০ মিলিয়ন মার্কিনী এবং ইউরোপিয়ান মারা যায়। অথচ মানবতাবাদীরা
(!) এসব দেশের সরকারগুলোকে তাদের নাগরিকদের মেরে ফেলার জন্য আজ পর্যন্ত দোষারোপ করেনি! প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, ঐসময় এসব দেশের সরকারগুলোর ক্ষমতা ছিলো না ভয়াবহ মহামারীগুলো প্রতিরোধের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পেনিসিলিন এর উন্নতি সাধনের মাধ্যমে এসব মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনা গিয়েছিল। আর ১৯৪০ সালের আগে তো পেনিসিলিন এর এই উন্নত ভার্সনটি সাধারণের নাগালের বাইরে ছিল।
হার্স্টের পত্রিকাগুলোর আর্টিকেলসমূহে বারবার দাবী করা হতো যে, কম্যুনিস্টদের দ্বারা সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে ইউক্রেনে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে। হার্স্টের পুতুল সাংবাদিক আর আলোকচিত্রকাররা আবার ছবি সংযুক্ত করার মধ্যে আর্টিকেলগুলো করুণভাবে উপস্থাপন করতো সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমতকে বিগড়ানোর উদ্দেশ্যে। হার্স্ট তার অন্তর্গত সব ধরণের গণমাধ্যমগুলো দিয়ে মিথ্যা প্রোপাগান্ডাগুলোকে সত্য হিসেবে তুলে ধরতে মরিয়া হয়ে পড়েছিল। ফলশ্রুতিতে, পুঁজিবাদী বিশ্বের নাগরিকরাও এসব মিথ্যাগুলো বিশ্বাস করতে লাগলো। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের তরফ থেকে এসব ব্যাপারে কিছুই শুনতে রাজি ছিল না। এসব পুঁজিবাদী জোঁকরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এভাবেই সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে গিয়েছে। যার ফলে অসংখ্য মানুষের মনে সমাজতন্ত্র তথা সাম্যবাদের প্রতি ঘৃণা জন্মেছে প্রকৃত সত্য না জেনেই।
উইলিয়াম হার্স্ট ক্যালিফোর্নিয়ার বেভারলি হিলসে নিজ বাড়িতে ১৯৫১ সালে মারা যান। আর রেখে যান গণমাধ্যমের এক বিশাল সাম্রাজ্য, যেগুলো এখনো সমাজতন্ত্র তথা সাম্যবাদের বিরুদ্ধে হার্স্ট এর প্রতিক্রিয়াশীলতা প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর সর্বত্র। হার্স্ট কর্পোরেশন হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান, যেটির অন্তর্ভুক্ত ১০০টি কোম্পানি আর ১৫,০০০ কর্মী নিষ্ঠার সাথে (!) হার্স্ট এর এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়ন করে চলেছে। হার্স্টের এই সাম্রাজ্যে সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, বই, রেডিও, টিভি, ক্যাবল টিভি, সংবাদ সংস্থা, মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশন থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছুই আছে। নাৎসিদের ইউক্রেন নিয়ে স্তালিনের বিরুদ্ধে ছড়ানো মিথ্যা প্রোপাগান্ডা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের পরাজিত করার মধ্য দিয়ে ফুরিয়ে গিয়েছে ভাবলে চরম ভুল হবে। এক্ষেত্রে নাৎসিদের আসন অলংকৃত করেছে সিআইএ এবং এমআইফাইভ এর মতো সংস্থাগুলো, যারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর মহান দায়িত্বে (!) নিয়োজিত ক্রিমিনালদের সারিতে একেবারে প্রথমদিকে অবস্থান করছে। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ম্যাকার্থিজম দ্বারা কম্যুনিস্ট বিরোধী নোংরামিগুলো ইউক্রেনের হলোদোমোর নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দায়ী করার ব্যাপারটা অন্য মাত্রা লাভ করে।
 |
The Black Deeds of
the Kremlin |
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে হলোদোমোর বিষয়ক একটি বই প্রকাশিত হয় যার শিরোনাম ছিল 'The Black Deeds of
the Kremlin', বইটি প্রকাশে অর্থায়ন করেছিল কিছু ইউক্রেনিয়ান দালাল যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের সাথে হাত মিলিয়ে পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকার আবার এদের পুরো বিশ্বের কাছে 'গণতান্ত্রিক' হিসেবে পরিচিত করানোর ঠেকা নিয়েছিল। রোনাল্ড রিগ্যান ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর পরই কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা প্রচারকে রীতিমতো ক্রুসেডের পর্যায়ে নিয়ে যান। ঐসময় নতুন করে হলোদোমোর এর ব্যাপারটা আলোচনায় আসে। ১৯৩৬ সালে এস্তোনিয়ার এক সাংবাদিক 'Human life in Russia' শিরোনামে ১৯৩৪ সালের দিকে হার্স্টের বানানো মিথ্যা তথ্যগুলোর পুনরাবৃত্তি করেছিলেন।
 |
Human life in Russia |
১৯৮৪ সালে আমেরিকার স্বনামধন্য (!)
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় বইটি অনুবাদ এর মাধ্যমে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার মহান দায়িত্ব (!) কাঁধে তুলে নিয়েছিল। কিন্তু কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে নোংরামি তখনও শেষ হয়ে যায়নি। ১৯৮৬ সালে 'Harvest of Sorrow' শিরোনামে আরেকটি বই বের হয়, যেটি লিখেছিলেন রবার্ট কনকুয়েস্ট নামে এক সাবেক ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য এবং যিনি পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শুধুমাত্র এই একটা বইয়ের জন্যই তিনি 'ইউক্রেন ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন' এর
তরফ থেকে ৮০ হাজার মার্কিন ডলার পেয়েছিলেন। সংগঠনটি ১৯৮৬ সালে তৈরী 'Harvest of Despair' ফিল্ম এর সমস্ত খরচ বহন করেছিল, যেখানে কনকুয়েস্ট এর বই থেকেই অনেক মনগড়া তথ্য নেয়া হয়েছিল।
ঐ ফিল্মে আবার মার্কিনীদের এই তথ্য গেলানো হয়েছিল যে, হলোদোমোর এর ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১৫ মিলিয়ন! অর্থাৎ প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর গতির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মৃত ব্যক্তিদের বিশাল সব কাল্পনিক সংখ্যা! ইউক্রেনের লক্ষ লক্ষ মানুষের ক্ষুধায় মৃত্যুর ব্যাপারটি, যেগুলো কিনা হার্স্টের সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে এবং তোতাপাখির মতো বিভিন্ন বইপত্র আর চলচ্চিত্রে আওড়ানো হয়েছে সেগুলো ছিলো সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্যে ভর্তি।
 |
নির্লজ্জতার নমুনা |
কানাডিয়ান লেখক ডগলাস টটল অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ফাঁস করে দিয়েছেন হলোদোমোর এর ঘটনা নিয়ে পুঁজিবাদীদের নোংরামিগুলো তার 'Fraud, famine and fascism-the Ukrainian genocide myth from Hitler to
Harvard' শিরোনামের বইটিতে।
বইটি ১৯৮৭ সালে টরেন্টো শহর থেকে প্রকাশিত হয়। অন্যান্য বহু মিথ্যার সাথে টটল সাহেব এটাও প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর সময় ব্যবহৃত হৃদয়বিদারক ছবিগুলো ১৯২২ সালে প্রকাশিত ছবি যেগুলো ১৯১৮-১৯২১ সালের রুশ সাম্রাজ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধের! এসময় বলশেভিকদের বিরুদ্ধে আটটি বহিরাগত সৈন্যবাহিনী একজোট হয়ে আক্রমণ করে। তখন অসংখ্য মানুষ গৃহযুদ্ধের ফলে অনাহারে মারা যায়। এই ছবিগুলোই পুঁজিবাদীরা তাদের নোংরা কৌশল দিয়ে হলোদোমোর এর ঘটনার সাথে জুড়ে দেয়।
ডগলাস টটল খুব সুন্দরভাবে ১৯৩৪ সালে স্তালিনের দ্বারা সংঘটিত তথাকথিত দুর্ভিক্ষের উপর প্রকাশিত হাজারো মিথ্যা রিপোর্টের তথ্যগুলোর বিশ্লেষণ করেছেন। রিপোর্টগুলো যারা পাঠাতেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল থমাস ওয়াকার (কেন 'তুমি' বলে সম্বোধন করা হচ্ছে, একটু পর পরিষ্কার হবে)। এই মানুষটিই জীবনে কোনোদিন নিজের পবিত্র পদধূলি দিয়ে ইউক্রেনের মাটিকে ধন্য করেনি এবং মস্কোতে সে ছিল মাত্র ৫ দিন! আর এই ব্যক্তিই কিনা দীর্ঘ একটা সময় ধরে ইউক্রেনের উপর রিপোর্ট করেছে! ডগলাস সাহেবের এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন মার্কিন পত্রিকা 'দ্য
নেশন' এর
মস্কো প্রতিনিধি লুই ফিশার। ফিশার সাহেব আরো একটা ব্যাপার ফাঁস করেছিলেন যে, সাংবাদিক এম. প্যারট যিনি কিনা হার্স্ট প্রেস এর মস্কো প্রতিনিধি ছিলেন, তিনি ১৯৩৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কৃষিক্ষেত্রে অসাধারণ বিপ্লব এবং সেই সাথে ইউক্রেনের প্রগতির যেসব রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন সেগুলো কখনো প্রকাশিত হতে দেয়া হয়নি।
টটল সাহেব প্রমাণ করে দেন যে, সেই তথাকথিত সাংবাদিক থমাস ওয়াকার এর আসল নাম রবার্ট গ্রিন, যে কলোরাডোর এক জেলের আসামি ছিল এবং পরবর্তীতে জেল থেকে পালিয়েও গিয়েছিল। ওয়াকার ওরফে গ্রিন আমেরিকা ফিরে আসার পর গ্রেফতার হয় এবং সে আদালতে স্বীকারও করে যে, সে কোনোদিন ইউক্রেনে যায়নি। ১৯৩০ এর দশকে স্তালিন কর্তৃক ইউক্রেনে সংঘটিত তথাকথিত গণহত্যার পিছনের প্রকৃত সত্য প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে! ততদিনে পুঁজিবাদের দালালরা মিলে পুরো বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে তাদের নির্লজ্জ মিথ্যাগুলো দিয়ে স্তালিনের বিরুদ্ধে ব্রেইন ওয়াশ করে দিয়েছে। বর্তমানেও ডানপন্থী পুঁজিবাদীদের অর্থে অসংখ্য বই বের হচ্ছে প্রতিনিয়ত। হার্স্টের গণমাধ্যম সাম্রাজ্য এখনো একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছে পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে,
আর তার আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো পুরো বিশ্বে একচেটিয়া ব্যবসা তথা নোংরামিগুলো করে যাচ্ছে। হার্স্ট ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গেস্টাপোর মেগাফোন হিসেবে কাজ করা এমন একজন ক্রিমিনাল যার অধীনের সংবাদপত্র, রেডিও স্টেশন আর টিভি চ্যানেলগুলো সারা বিশ্বে সত্য (!) প্রচারে নিষ্ঠার সাথে বর্তমানেও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে! গেস্টাপো হয়তো পৃথিবী থেকে মুছে গিয়েছে। কিন্তু এর আসন অলংকৃত করেছে সিআইএ আর এর পৃষ্ঠপোষকরা, যারা চব্বিশ ঘন্টাই লিপ্ত আছে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো আর নোংরা ষড়যন্ত্রগুলো বাস্তবায়নের কাজে। আজ পর্যন্ত মার্কিন গণমাধ্যমের কম্যুনিস্ট বিরোধিতা সামান্য পরিমাণেও কমেনি। প্রোপাগান্ডা ব্যবসায় ডলার বিনিয়োগ ঠিকই চলে আসছে, সেই গেস্টাপো থেকে শুরু করে একুশ শতকের পুঁজিবাদী বিশ্বের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, বিশেষ করে সিআইএ অবধি। বুর্জোয়া
প্রেসগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয় রবার্ট কনকুয়েস্ট সম্পর্কে একটু বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন আছে। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কাজে যেসব লেখক জড়িত ছিলো, তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে আছে এই লোক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যতো মিথ্যা ছড়ানো হয়েছে পুরো বিশ্বে, এর পেছনে কনকুয়েস্ট এর অবদান অনেক। কনকুয়েস্ট 'The Great Terror' আর 'Harvest of Sorrow' বই দু'টো লিখে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। কনকুয়েস্ট বই দু'টো (প্রফেসর হওয়ার পরও কেন 'তুমি' করে সম্বোধন করছি!) ভর্তি করেছিল ইউক্রেনের দুর্ভিক্ষে মারা যাওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের কাল্পনিক সংখ্যা, গুলাগ শ্রমিক শিবিরের অবর্ণনীয় অবস্থা (!) আর ১৯৩৬-৩৮ সালের মস্কো ট্রায়ালের বর্ণনা দ্বারা।
উৎস হিসেবে সে পুরো বিশ্বকে দেখিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউক্রেনিয়ান দালালদের, যারা দক্ষিনপন্থীদের
সাথে ভিড়েছিল সেখানে এবং এরাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের সাহায্যে জান কুরবান করেছিল!
কনকুয়েস্ট এর এই তথাকথিত প্রত্যক্ষদর্শী নায়কদের (!) অনেকেই ছিল যুদ্ধাপরাধী, যারা ১৯৪২ সালে ইউক্রেনের ইহুদি গণহত্যার সাথে জড়িত ছিল।
এই যুদ্ধাপরাধীদের
মধ্যে অন্যতম ছিল মাইকোলা লেবেড, যাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের দখলে থাকা ইউক্রেনের লুভভ শহরের নিরাপত্তা প্রধান এবং এই ব্যক্তিই ১৯৪২ সালের ইহুদি নিধনে নেতৃত্ব দিয়েছিল।
১৯৪৯ সালে সিআইএ লেবেডকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসে এবং তখন থেকেই সে তাদের প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর সহযোগী হয়ে যায়।
কনকুয়েস্ট এর প্রতিটি বইয়ের প্যাটার্ন এ সাম্যবাদের দৃষ্টিকটু বিরোধিতা আর বিদ্বেষ যে কারো নজরে আসবে বইগুলো পড়ার সময়। কনকুয়েস্ট তার ১৯৬৯ সালের বইটিতে উল্লেখ করেছিল যে, ইউক্রেনের তথাকথিত গণহত্যায় ৫-৬ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়! অথচ ১৯৮৩ সালে রোনাল্ড রিগ্যান এর কম্যুনিস্ট বিরোধী ক্রুসেডের সময় এই সংখ্যা হাস্যকরভাবে এক লাফে গিয়ে পৌঁছায় ১৪ মিলিয়নে! মৃতের সংখ্যা যতো বাড়তে লাগলো, এই দালালদের ঝুড়িতে পুরস্কারের সংখ্যাও ততো জমতে লাগলো। এই লোককে ১৯৮৬ সালে রিগ্যান তার নির্বাচনী প্রচারণার কাজে নিয়োগ দিয়েছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে মার্কিনীদের মন আরও বিষিয়ে দিতে। সে সোভিয়েতদের সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে কি কি প্রস্তুতি নেয়া উচিত সেসব নিয়ে সচেতনতামূলক (!) অনেক কিছু লিখে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতো রিগ্যানের পক্ষে! ইতিহাসের এই অধ্যাপকের লেখাগুলোর অন্যতম নমুনা হচ্ছে 'What to do when the Russians come!'
কনকুয়েস্ট এর এসব কাজকারবার মোটেও অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার ছিল না। কারণ এই কান্ডগুলো এমন একজনের দ্বারা সম্পন্ন হতো যিনি কিনা তার সমগ্র জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন স্তালিন আর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মিথ্যা বানিয়ে এবং বিষোদ্গার করে, প্রথমদিকে সিক্রেট সার্ভিসের একজন এজেন্ট এবং পরবর্তীতে লেখক ও ক্যালিফোর্নিয়ার
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যাপক হিসেবে।
 |
কত নিচে নামা যায়? |
কনকুয়েস্ট
এর অতীত
ইতিহাস ফাঁস
হয়ে যায়
গার্ডিয়ান পত্রিকার
১৯৭৮ সালের
২৭ শে
জানুয়ারির সংখ্যায়,
যেখানে প্রকাশিত
হয় যে
তিনি ছিলেন
ব্রিটিশ সিক্রেট
সার্ভিসের 'ইনফরমেশন
রিসার্স ডিপার্টমেন্ট' এর এজেন্ট!
ব্রিটিশ সিক্রেট
সার্ভিসের এই
শাখাটি ১৯৪৭
সালে প্রতিষ্ঠিত
হয়, যেটির
প্রকৃত নাম
ছিল 'কম্যুনিস্ট
ইনফরমেশন ব্যুরো'। শাখাটির মূল
কাজই ছিল কম্যুনিস্ট রাজনীতিবিদ,
সাংবাদিক এবং
সাম্যবাদের অনুসারী
বিখ্যাত মানুষদের
বিরুদ্ধে মিথ্যা
কাহিনী বানিয়ে
সেগুলো পুরো
বিশ্বে ছড়িয়ে
দেয়া যেন
বিশ্বের কোথাও
সাম্যবাদ সাধারণ
জনগণকে প্রভাবিত
করতে না
পারে। শাখাটির
কাজের পরিধি
যুক্তরাজ্য ছাড়িয়ে
বিশ্বের বহু
দেশে ছিল।
ব্রিটিশদের এস্পিওনাজ
জগতের এই
বিশেষ শাখাটি
আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৭
সালে বন্ধ
হয়ে যায়,
যখন এর
সাথে উগ্র
ডানপন্থীদের গোপন
সংযোগের কথা
ফাঁস হয়ে
গিয়েছিল। সেসময়
আরও প্রকাশিত
হয়েছিল যে,
শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যেই
বিখ্যাত ১০০
জন ব্রিটিশ
সাংবাদিকের সাথে
ইনফরমেশন রিসার্স
ডিপার্টমেন্ট এর
নিয়মিত যোগাযোগ
হতো গোপনে
এবং এই
শাখাটি এসব
সাংবাদিককে প্রতিনিয়ত
মিথ্যা প্রোপাগান্ডা
সরবরাহ করতো
সোভিয়েত ইউনিয়নের
বিরুদ্ধে আর্টিকেল
লেখার জন্য।
বিখ্যাত সব
ব্রিটিশ পত্রিকার
জন্য এসব
বানানো কাহিনী
প্রকাশ করা
রীতিমতো রুটিনে
পরিণত হয়েছিল।
এসব পত্রিকার
মধ্যে শীর্ষস্থানীয়
ছিল 'ফিনান্সিয়াল
টাইমস', 'দ্য
টাইমস', 'ইকোনোমিস্ট', 'ডেইলি মেইল', 'ডেইলি মিরর', 'দ্য এক্সপ্রেস', 'দ্য গার্ডিয়ান' প্রভৃতি। পরবর্তীতে
গার্ডিয়ান পত্রিকায়
ফাঁস হওয়া
রিপোর্টটি থেকেই
উপলব্ধি করা
যায়, পুঁজিবাদী
বিশ্বের সিক্রেট
সার্ভিসগুলো কিভাবে
গণমাধ্যমগুলোকে সাম্যবাদ
আর সমাজতান্ত্রিক
দেশগুলোর বিরুদ্ধে
প্রতিনিয়ত প্রভাবিত
করে যাচ্ছে।
রবার্ট কনকুয়েস্ট
ইনফরমেশন রিসার্স
ডিপার্টমেন্টে এটি
প্রতিষ্ঠার শুরু
থেকেই জড়িত
ছিলেন। তিনি
সেখানে ১৯৫৬
সাল অবধি
কাজ করেছিলেন।
সেখানে তার
কাজই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন
সম্পর্কে মিথ্যা
প্রোপাগান্ডা তৈরী
করে সেগুলো
তাদের দালাল
সাংবাদিকদের কাছে
প্রচারের জন্য
বিতরণ করা।
সাংবাদিক ছাড়াও
গোপন এই
শাখাটির এজেন্টরা
আরও অনেকের
কাছে এসব
প্রোপাগান্ডা বিলি
করতো সাধারণ
জনগণকে প্রভাবিত
করতে। কনকুয়েস্ট
আনুষ্ঠানিকভাবে এস্পিওনাজ
জগৎ ছাড়লেও
এটা ছিল সম্পূর্ণরূপে লোক
দেখানো ভণ্ডামি।
তিনি এরপর
ব্রিটিশ আর
মার্কিনী এস্পিওনাজ
সংস্থাগুলোর নির্দেশে
বই লিখতে
শুরু করেন।
তার 'The Great Terror' বইটিতে
১৯৩৭ সালে
সোভিয়েত ইউনিয়নে
সংঘঠিত তথাকথিত
ক্ষমতার দ্বন্দ্বের
যে কল্পিত
বর্ণনা দিয়েছেন,
সেগুলো ছিল ব্রিটিশ সিক্রেট
সার্ভিসে কাজ
করার সময়
তিনি তার
হর্তাকর্তাদের নির্দেশে
সোভিয়েত ইউনিয়নের
বিরুদ্ধে বানিয়ে
বানিয়ে মিথ্যা
প্রচার এর
যেসব নোংরামি
করেছিলেন ঐ
লেখাগুলোর হুবহু
সংকলন। তার
এই বইটি
প্রকাশে অর্থায়নও
করেছিলো ব্রিটিশ
গোয়েন্দা সংস্থার
ঐ বিশেষ
শাখাটি। আর
বইটির এক-তৃতীয়াংশ
ছাপানো হয়েছিল প্রিগার প্রেসে,
যেটি কিনা
সিআইএ কর্তৃক
সরবরাহকৃত সোর্স
এর উপর
ভিত্তি করে
যতো কিছু
প্রকাশিত হয়
সেগুলোর প্রকাশনার
দায়িত্বে নিয়োজিত।
কনকুয়েস্ট
এর বইগুলো
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
থেকে শুরু
করে বিভিন্ন
প্রেসে কর্মরত
চাকরিজীবী, রেডিও
আর টেলিভিশনের
চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে
ডানপন্থীরা প্রচারের
ব্যবস্থা করতো
যেন বিশাল
সংখ্যক সাধারণ
জনগণের ব্রেইন
স্বল্প সময়ের
মধ্যে দ্রুতগতিতে
ওয়াশ করা
যায়। আলেকজান্ডার
সলজেনিৎসিন নামে এক বিখ্যাত রুশ
লেখক আছে, যে সারাজীবন বই
আর আর্টিকেল লিখে সোভিয়েত বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে জড়িত ছিল। এসব বই আর আর্টিকেলে
সে সোভিয়েত ইউনিয়নে তথাকথিত অসংখ্য মানুষের মৃত্যু কিংবা স্বাধীনতা হারানোর কথা ব্যক্ত করেছে। ১৯৬০ সালে তার লেখা 'The Gulag
Archipelago' বইটির
মাধ্যমে সে পুঁজিবাদী বিশ্বের
সর্বত্র জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
লেখক নিজেই ১৯৪৬ সালের দিকে ৮ বছরের জন্য
এক শ্রমিক শিবিরে দণ্ডপ্রাপ্ত হয় মহান রুশ
বিপ্লবের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কারণে।
সলজেনিৎসিন
এর
মতে,
সোভিয়েত
সরকার
ইচ্ছা
করলে
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধে
নাৎসি
জার্মানির
বিরুদ্ধে
লড়াইটা
এড়িয়ে
যেতে
পারতো
হিটলারের
সাথে
আপোষ
করে!
সে
এজন্য
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধে
লক্ষ
লক্ষ
সোভিয়েতবাসীর
মৃত্যুর
জন্য
সোভিয়েত
সরকার
আর
স্তালিনকে
দায়ী
করে!
সে
নিজের
নাৎসিপ্রীতি
লুকায়নি।
এজন্য
সে
পুরো
সোভিয়েত
ইউনিয়ন
জুড়ে
পরিচিত
ছিল বিশ্বাসঘাতক
হিসেবে।
নিকিতা
ক্রুশ্চেভ
এর
সম্মতি
আর
সহযোগিতায়
এই
লেখক
১৯৬২
সাল
থেকে
তার
বইগুলো
প্রকাশ
করতে
থাকে।
তার
প্রথম
বইটি
ছিলো 'One Day in the Life of Ivan Denisovich', যা
ছিল এক
কাল্পনিক
চরিত্রের
বন্দিজীবন
নিয়ে
রচিত।
ক্রুশ্চেভ মূলত
সলজেনিৎসিন
এর
লেখাগুলো
ব্যবহার
করেছিল স্তালিন
এর
সময়ের
সমাজতন্ত্রের
মহান
ঐতিহ্যগুলো
নিচু
করে
দেখাতে,
সে
মূলত
খাল
কেটে
কুমির
এনেছিল এক্ষেত্রে।
১৯৭০
সালে
সলজেনিৎসিন 'The Gulag Archipelago' বইটির জন্য
সাহিত্যে
নোবেল
পুরস্কার
লাভ
করে। তখন
থেকেই
সে
সোভিয়েত
ইউনিয়নের
মহান
সমাজতন্ত্রের
বিরুদ্ধে
সাম্রাজ্যবাদীদের
সবচেয়ে
বড়ো
অস্ত্রে
পরিণত
হয়।
পুঁজিবাদী
বিশ্বের
গণমাধ্যমগুলোতে
এই
লেখকের
লেখাগুলো
ফলাও
করে
প্রচার
করা
হতো।
১৯৭৪
সালে
এই
বেঈমান
সোভিয়েত
ইউনিয়নের
নাগরিকত্ব
ত্যাগ
করে
প্রথমে
সুইজারল্যান্ড
এবং
পরে
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে
চলে
যায়।
পুঁজিবাদী
বিশ্বের
হলুদ
সাংবাদিকতার
সাথে
জড়িত
ক্রিমিনালরা
এই
বেঈমানকে 'স্বাধীনতা
আর
গণতন্ত্রের
মহান
যোদ্ধা' হিসেবে
আখ্যা
দেয়!
 |
মার্কিনিদের মগজ ধোলাই এর সময় |
এই
ক্রিমিনালরা
সলজেনিৎসিন
এর
নাৎসিপ্রীতির
দিকটি
রাতারাতি
গায়েব
করে
দেয়
সাধারণ
মানুষের
ব্রেইন
ওয়াশ
আর
এই
বেঈমানকে
সমাজতন্ত্রের
বিরুদ্ধে
প্রোপাগান্ডা
ছড়ানোর
কাজে
ব্যবহারের
উদ্দেশ্যে।
সলজেনিৎসিনকে
মার্কিনীরা প্রায় সময় গুরুত্বপূর্ণ সভাগুলোতে আমন্ত্রণ করতো বক্তৃতা দেয়ার জন্য। উদাহরণস্বরূপ, এই লেখক ১৯৭৫
সালের AFL-CIO ইউনিয়ন কংগ্রেস এর প্রধান বক্তা
ছিল।
আর ১৯৭৫ সালের ১৫ জুলাই তাকে মার্কিন সিনেটে আমন্ত্রণ জানানো হয় বিশ্ব পরিস্থিতির উপর বক্তৃতা দেয়ার জন্য! তার বক্তৃতাগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণায় ভর্তি থাকতো।
মার্কিনীদের ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধারা নাস্তানাবুদ করলে এই কুলাঙ্গারটা মার্কিনীদের পুনরায় ভিয়েতনামে হামলার জন্য বলেছিল! ১৯৭৪ সালে সাধারণ জনতার সম্পূর্ণ সমর্থন আর সহায়তায় কিছু বামপন্থী সেনা কর্মকর্তা ক্ষমতা গ্রহণ করলে পর্তুগালে ৪০ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান হয়। সেসময় সলজেনিৎসিন মার্কিন সেনাবাহিনী কর্তৃক পর্তুগালের ব্যাপারে নাক গলানোকে বৈধতা দিতে ব্যাপক প্রচারণা চালাতো।
তার মতে, আমেরিকা যদি তখন হস্তক্ষেপ না করতো, তাহলে পর্তুগাল অবশ্যই 'ওয়ারশ
প্যাক্ট' এ যোগ দিতো!
পর্তুগালের আফ্রিকান কলোনীগুলোর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এই শয়তান তার লেকচারগুলোতে সবসময় বিষোদ্গার করতো।
এটা সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান যে, সলজেনিৎসিন এর বক্তব্যগুলোর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর নোংরা যুদ্ধে সামিল হওয়া পুঁজিবাদী বদমাইশদের ব্যাকআপ দেয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু কিংবা উত্তর ভিয়েতনামে হাজার হাজার মার্কিনীর বন্দিত্ব - সে কোনো কিছুই ছাড় দেয়নি কাল্পনিক ফিগারগুলো বানানোর সময়। মার্কিনীরা ভিয়েতনাম সংক্রান্ত হলিউডের ফিল্মগুলোতে এই বদমাইশটার কাল্পনিক ফিগারগুলোসহ মনের মাধুরী মিশিয়ে কাহিনী বানিয়ে সাধারণ জনগণের সামনে বহুবার প্রচার করেছে। যেসমস্ত মার্কিন সাংবাদিকগণ যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শান্তি স্থাপনের কথা বলার সাহস দেখিয়েছে, সলজেনিৎসিন তাদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে! শুধু তাই নয়, এই বদমাইশ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণা চালাতো। যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে যতটা না সামরিক ক্ষেত্রের বিভিন্ন সেক্টরে সক্ষম, সলজেনিৎসিন এর চেয়ে বেশি সংখ্যক ফিগার এর কথা বলতো বিভিন্ন বক্তৃতায়। যেমন- সে বলতো যুক্তরাষ্ট্রের
ট্যাংক আর এরোপ্লেন এর সংখ্যা সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় পাঁচ থেকে সাত গুন বেশি! আণবিক অস্ত্র সোভিয়েতদের তুলনায় মার্কিনীদের দ্বিগুণ, তিনগুণ এমনকি পাঁচগুণ বেশি! এরকম আরও অনেক কিছু বানিয়ে প্রচার করতো সে বিভিন্ন বক্তৃতায়। সে প্রকাশ্যে সাম্রাজ্যবাদীদের
প্রতি সহানুভূতি দেখানো কিংবা সোভিয়েত বিরোধিতার ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থে পুঁজিবাদী ডানপন্থীদেরও অতিক্রম করেছিল!
১৯৭৫ সালে ফ্রাঙ্কো মারা যাওয়ার পর স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা স্পেনের সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থার উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করে এবং ১৯৭৬ সালের শুরুর দিকে স্পেনে সংঘঠিত হওয়া কিছু ঘটনা সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
 |
Juan Carlos I of Spain |
হরতাল আর সমাবেশ এর মাধ্যমে জনতা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার দাবী জানাতে থাকে। ফ্রাঙ্কোর উত্তরাধিকারী রাজা জুয়ান কার্লোস জনতার ক্ষোভ প্রশমিত করতে কৌশলগতভাবে কিছু ক্ষেত্রে উদারনীতি অবলম্বন করে।
 |
Francisco Franco |
স্পেনের রাজনৈতিক ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে আলেকজান্ডার সলজেনিৎসিনকে রাজধানী মাদ্রিদে দেখা গিয়েছে মার্চের ২০ তারিখের এক শনিবারের রাতে 'Directísimo' টেলিভিশন প্রোগ্রামে সাক্ষাৎকার দিতে।
 |
Directísimo প্রোগ্রামে | |
এই প্রোগ্রামে সাক্ষাৎকার দেয়ার আগে তাকে আগেভাগেই প্রশ্নগুলো জানিয়ে দেয়া হয়, যেন সে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য সকল প্রকার পূর্বপ্রস্তুতি নেয়ার সময় পায়। রাজা কার্লোস এর কৌশলগত তথাকথিত উদারনীতিগুলোর প্রতি সমর্থন প্রদর্শনের কোনো ইচ্ছাই ছিল না এই শয়তানের। সে উল্টো হুঁশিয়ারি দিয়ে বলে যে, গণতন্ত্র স্পেনকে বিপদের দিকে ঠেলে দিবে ভবিষ্যতে। টেলিভিশনের ঐ সাক্ষাৎকারে সে ঘোষণা দেয় যে, ১১০ মিলিয়ন রুশ সমাজতন্ত্রের কারণে মারা যায় এবং স্পেনের অধিবাসীরাও একই পরিণতি দেখবে। শুধু তাই নয়, সে স্পেনের প্রগতিশীলদের ভর্ৎসনা করে স্পেনকে স্বৈরাচারী রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করায়! সে সরকার বিরোধী বলতে লিবারেল, সোশ্যাল ডেমোক্রেট, কম্যুনিস্ট - সবাইকে বোঝাতো। ফ্রাঙ্কোর সময়ে অসংখ্য স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হয়েছিল। এই বদমাইশটা বলেছিল-
"পৃথিবীর মানুষ চিন্তিত ছিলো স্পেনিশ সন্ত্রাসীদের শেষ পরিণতি দেখার জন্য। একদিকে এরা গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক সংস্কার চায়, আর আরেকদিকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে সমর্থন দিচ্ছে। যারা চাইছে এখনই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক, তারা কি উপলব্ধি করতে পারছে কাল কিংবা এর পরের দিন স্পেনে কি ঘটতে চলেছে? স্পেনে হয়তো আগামীকাল গণতন্ত্র আসবে, কিন্তু এর পরের দিন গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুত হয়ে স্পেন একনায়কতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হবে।"
সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেছিল-
"ক্ষমতাসীনদের সমর্থনে এই ধরণের বক্তব্য তো সাধারণত কোনো দেশে শোনা যায় না, যেখানে স্বাধীনতা নেই।"
উত্তরে সলজেনিৎসিন বলেছিল-
"আমি শুধু একটা স্থান জানি যেখানে কোনো স্বাধীনতা নেই, আর সেটা হচ্ছে রাশিয়া।"
স্পেনের গণমাধ্যমে দেয়া সলজেনিৎসিন এর সাক্ষাৎকারটি ছিল স্পেনের স্বৈরতন্ত্রের প্রতি তার সুস্পষ্ট সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ, যেই মতবাদ সে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সমর্থন করেছিল।
 |
স্পেন এর পত্রিকায় |
স্পেন এর স্বৈরাচারী শাসনের প্রতি সমর্থনের ব্যাপারটা ছিল সলজেনিৎসিন এর দীর্ঘ আঠারো বছর যাবৎ যুক্তরাষ্ট্রে আত্মগোপন করে থাকার অন্যতম কারণ। এমনকি পুঁজিবাদী দেশগুলোর সরকারগুলোও তার প্রতি আস্তে আস্তে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিল। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে নোংরা যুদ্ধে সলজেনিৎসিন পুঁজিবাদী জোঁকেদের কাছে অনেকটা স্বর্গ থেকে আসা উপহার সদৃশ ছিল। কিন্তু সবকিছুর একটা সীমা আছে। বর্তমান রাশিয়ায় পশ্চিমা বিশ্ব শুধুমাত্র ঐসমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোকেই সমর্থন দেয়, যেগুলো মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের সাধারণ জনগণের রক্ত চুষতে সাহায্য করবে। কিন্তু তৎকালীন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যদি সমাজতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে পুঁজিবাদীদের ষড়যন্ত্রে স্বৈরতন্ত্র বাস্তবায়িত হতো, তাহলেও সেটা তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে অনুকূল হতো না। এজন্য পুঁজিবাদীদের সলজেনিৎসিনকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়াটা ছিল ব্যর্থ এক প্রজেক্ট। সলজেনিৎসিন চেয়েছিল রাশিয়ায় পুনরায় জার শাসন ফিরিয়ে আনতে, সেই সাথে রাশিয়ার অর্থোডক্স গির্জাগুলোর আধিপত্য। একসময় গোঁয়ার সাম্রাজ্যবাদীরাও এই বদমাইশটাকে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালানোর বোকামি করার আগ্রহটুকু হারিয়ে ফেলে।
সুস্পষ্টভাবেই নাৎসি (উইলিয়াম হার্স্ট), পুলিশ (সিক্রেট এজেন্ট রবার্ট কনকুয়েস্ট) এবং ফ্যাসিস্ট (আলেকজান্ডার সলজেনিৎসিন) ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে মারা যাওয়া কিংবা কারাবরণ করা লক্ষ লক্ষ মানুষের কাল্পনিক কাহিনীগুলোর মুখ্য কারিগর। কনকুয়েস্ট এর বানানো তথ্যগুলোই পুঁজিবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলো সারা পৃথিবীতে ফলাও করে প্রচার করে। এমনকি নির্দিষ্ট কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা বিস্তৃতির নোংরা উদ্দেশ্যে রীতিমতো গবেষণা করা হতো! কনকুয়েস্ট এর কাজগুলো ছিল নিঃসন্দেহে সর্বোচ্চ মাত্রার তথ্য বিকৃতি, যেগুলো গাধার সামনে মুলা ঝুলানোর মতো জনগণের সামনে 'অবাধ তথ্য প্রবাহ' নামের মুলা হিসেবে ঝোলানো হয়। ১৯৭০ এর দশকে কনকুয়েস্ট নামের এই ক্রিমিনাল সলঝেনিৎসিন ছাড়াও আন্দ্রে শাখারভ আর রয় আলেকজান্দ্রোভিচ মেদভেদেভ এর মতো 'দালালে দালালে মাসতুতো ভাইদের' কাছ থেকে অনেক সহযোগিতা লাভ করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Andrei_Sakharov
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Roy_Medvedev
এদের
মতো আরও অগণিত অর্থের বিনিময়ে পা চাটতে রাজি হওয়া বদমাইশদের পুঁজিবাদী
জোঁকেরা সারা দুনিয়ায় তৈরী করে রেখেছে, যাদের বুর্জোয়া গণমাধ্যমগুলো
আমজনতার কাছে মহিমান্বিত করার দায়িত্ব নেয়! অবশেষে প্রকৃত সত্য প্রকাশিত
হয়ে পড়ে এবং এই বদমাইশদের আসল চেহারাও বের হয়ে আসে জনসম্মুখে। গর্বাচেভ এর
নির্দেশে পার্টির গোপন দলিলগুলো ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ তদন্তের উদ্দেশ্যকে
সামনে রেখে প্রকাশ করা হলে এমন সব সত্য বের হয়ে আসে, যেগুলো পুরো বিশ্ব
ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের
মৃত্যুর রটনা ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারটি ছিল সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে নোংরা
প্রচারণার অন্যতম অংশ। সঙ্গত কারণেই এই ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে দেয়া সোভিয়েত
সরকারের ব্যাখ্যা পুঁজিবাদীদের পক্ষপাতদুষ্ট গণমাধ্যমগুলো প্রকাশ করার
প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। উল্টো তারা পুঁজিবাদীদের বিশেষজ্ঞ দালালদের
ইচ্ছামতো বানানো কাহিনীগুলো প্রচারের সুযোগ করে দেয়, আর এই কাহিনীগুলোর
কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও এগুলোতে সংযোজিত হয়েছিল মিথ্যা
পরিসংখ্যানের পাহাড়। কনকুয়েস্ট, সলজেনিৎসিন, মেদভেদেভ আর অন্য শয়তানরা
সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক প্রকাশিত পরিসংখ্যান ব্যবহার করেছিল ঠিকই, তবে
এক্ষেত্রে তারা নিজেদের বানানো কাহিনী ছড়ানোর সময় গায়েবি সংখ্যা যোগ করে!
আর সোভিয়েত ইউনিয়নের আদমশুমারি দেখিয়ে প্রচারণা চালাতে থাকে যে, হিসেবে না
থাকা বাড়তি লোকগুলো সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় হয় মারা গিয়েছে, নয়তো
কারাবন্দি হিসেবে জেলে গিয়েছে!

জালিয়াতির
এই পদ্ধতি একেবারেই সোজাসাপ্টা হলেও ব্যাপারটা যদি পশ্চিমা বিশ্বের সাথে
সংশ্লিষ্ট হতো, তবে সেটা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতো না! এটা নিশ্চিতভাবেই ধরে
নেয়া যায় যে, পশ্চিমা বিশ্বের অধ্যাপক আর ঐতিহাসিকরা তখন এই ধরণের জালিয়াতি
রুখে দিতো। কিন্তু জালিয়াতিগুলো করার সময় যেহেতু টার্গেট ছিলো সোভিয়েত
ইউনিয়ন, তাই এসব জ্ঞানপাপী বুদ্ধিজীবীদের কাছেও এসব মিথ্যাচার অনায়াসে
গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়। এসব অধ্যাপক আর ঐতিহাসিকরা নিজেদের পেশাগত সততাকে
বিসর্জন দিয়ে পেশাকেই ঢাল বানিয়ে নোংরামিতে লিপ্ত হয়েছিল। রবার্ট
কনকুয়েস্ট ১৯৬১ সালে যে হিসাব দেখায়, সেখানে ১৯৩০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ৬
মিলিয়ন লোক না খেয়ে মারা যায়! আবার এই কনকুয়েস্টই ১৯৮৬ সালে একই ঘটনার কথা
বলতে গিয়ে মৃতের সংখ্যা এক লাফে ১৪ মিলিয়নে তুলে দেয়! প্রসঙ্গক্রমে,
কনকুয়েস্ট এর দাবী অনুযায়ী ১৯৩৭ সালে পার্টির অভ্যন্তরীণ সংশোধন প্রক্রিয়া
শুরুর আগেই ৫ মিলিয়ন বন্দি ছিলো গুলাগ শ্রম শিবিরে! কনকুয়েস্ট ঘোষণা দেয়
যে, ১৯৩৭-৩৮ সালে অতিরিক্ত ৭ মিলিয়ন লোক যোগ হয়ে ১৯৩৯ সালে বন্দির সংখ্যা
গিয়ে ঠেকে ১২ মিলিয়নে! আর কনকুয়েস্ট এর এই ১২ মিলিয়নের বিপুল সংখ্যক লোকেরা
ছিল রাজনৈতিক বন্দি এবং এদের সংখ্যা অন্যান্য অপরাধের জন্য আটক করা হয়েছে
এমন বন্দিদের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায়! কনকুয়েস্ট এর দাবী অনুযায়ী, সোভিয়েত
ইউনিয়নের শ্রম শিবিরগুলোতে ২৫-৩০ মিলিয়ন লোককে বন্দি বানানো হয়েছিল! শুধু
তাই নয়, কনকুয়েস্ট আরও দাবী করে ১৯৩৭-১৯৩৯ সালের মধ্যে এক মিলিয়ন রাজনৈতিক
বন্দিকে মেরে ফেলা হয় এবং আরও ২ মিলিয়ন রাজনৈতিক বন্দি মারা যায় খাবারের
অভাবে! এই কাল্পনিক পরিসংখ্যানগুলো দেখিয়ে কনকুয়েস্ট ঘোষণা দেয় ১৯৩০-১৯৫৩
সালের মধ্যে বলশেভিকরা ১২ মিলিয়নের কাছাকাছি রাজনৈতিক বন্দিকে হত্যা করে!
তাছাড়া কনকুয়েস্ট ১৯৩০ এর দশকের দুর্ভিক্ষে মারা যাওয়া লোকেদের বিশাল
কাল্পনিক সংখ্যার সাথে তথাকথিত মৃত বন্দিদের সংখ্যা যোগ করে উপসংহার টানে
যে, বলশেভিকরা ২৬ মিলিয়নের মতো মানুষ মেরে ফেলেছিল! কনকুয়েস্ট তার সর্বশেষ
পরিসংখ্যানগুলোর একটিতে দাবী করেছিল, এসব বন্দিদের মৃত্যুর পরও ১৯৫০ সালে
সোভিয়েত ইউনিয়নে ১২ মিলিয়ন রাজনৈতিক বন্দির অস্তিত্ব ছিল! সলজেনিৎসিন
বদমাইশটাও কনকুয়েস্ট এর ফর্মুলা ব্যবহার করে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর
সময়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে কাল্পনিক ফিগার বানানোর বেলায় কনকুয়েস্টকেও
ছাড়িয়ে যায়। সে কনকুয়েস্ট এর ঘোষিত ১৯৩২-৩৩ সালের দুর্ভিক্ষে মারা যাওয়া ৬
মিলিয়ন লোকের মৃত্যুর সংখ্যাটা মেনে নেয়া ছাড়াও ঘোষণা দেয়, ১৯৩৬-১৯৩৯ সালের
মধ্যে পার্টির অভ্যন্তরীণ সংশোধন প্রক্রিয়া চলাকালীন প্রতি বছর ১ মিলিয়ন
লোক মারা গিয়েছিলো! সলজেনিৎসিন এটাও বলে বেড়াতে লাগলো, কৃষি সমবায় ব্যবস্থা
চালু হওয়ার পর থেকে ১৯৫৩ সালে স্তালিনের মৃত্যুর পরের সময় পর্যন্ত
সাম্যবাদীরা ৬৬ মিলিয়ন সোভিয়েতবাসীকে মেরে ফেলে! সে আরও দাবী করে, দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত সরকারের ব্যর্থতার কারণে ৪৪ মিলিয়ন সোভিয়েতবাসী মারা
যায়! সবশেষে সলজেনিৎসিন এই সিদ্ধান্তে আসে, ১১০ মিলিয়ন সোভিয়েতবাসী
সমাজতন্ত্রের শিকার হয়! সলজেনিৎসিন তার কল্পনা বিস্তারের মাধ্যমে
বিশ্ববাসীকে এটাও জানায়, ১৯৫৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিক শিবিরগুলোতে ২৫
মিলিয়ন লোক বন্দি ছিলো! ১৯৬০ সালের বুর্জোয়া গণমাধ্যমগুলোর যে কাল্পনিক
ফিগারগুলোর নমুনা উপরে দেখানো হলো, সেগুলো যে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ
করে প্রকাশিত হয়েছে তা সবসময় দাবী করা হতো। রটনাগুলোর পেছনের মদদদাতা ছিলো
পশ্চিমা সিক্রেট সার্ভিসগুলো, বিশেষত সিআইএ এবং এমআই ফাইভ। হলুদ
সাংবাদিকতার মাধ্যমে ছড়ানো এসব কাল্পনিক তথ্যগুলো এখনো পশ্চিমা বিশ্বের
একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করে। সলজেনিৎসিন, আন্দ্রেই শাখারভ, রয়
মেদভেদেভ এর মতো পশ্চিমা দালালরা লজ্জাজনক অবস্থায় পড়ে, যখন খোদ সোভিয়েত
ইউনিয়নে তাদের এই কাল্পনিক ফিগারগুলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক
দালাল খুঁজে পায়নি সেসময়। ১৯৯০ সালে এক তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা ঘটে।
গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা নীতির অধীনে গণমাধ্যমে গর্বাচেভ এর দ্বারা
উন্মুক্ত করা তথ্যগুলো সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে রটানো সব ধরণের কুৎসার মোক্ষম
জবাব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Glasnost
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Perestroika
তাদের বানানো ফিগারগুলো রাতারাতি ১০ মিলিয়নে নেমে আসে, যারা কিনা সাম্যবাদীদের দ্বারা বন্দি হয়েছে কিংবা হত্যার শিকার হয়েছে! গর্বাচেভ এর ফ্রি প্রেস নীতি কনকুয়েস্ট আর সলজেনিৎসিন এর মিথ্যাগুলো আমজনতার সামনে প্রকাশ করে দেয়। একই সময়ে গর্বাচেভ কেন্দ্রীয় কমিটির গোপন নথিগুলোও তার নতুন নীতির কারণে উন্মুক্ত করে দেয় সবার সামনে। ঐ সময়ের জটিল পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এসব গোপন নথি জনসম্মুখে উন্মুক্ত করে দেয়ার গুরুত্ব ছিল মূলত দু'টো কারণে। প্রথমত, পার্টির সাথে জড়িত মিথ্যা রটনাগুলো ভুল প্রমাণিত হয়। দ্বিতীয়ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে, এতে করে বছরের পর বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মিলিয়ন মিলিয়ন লোককে মেরে ফেলার কিংবা রাজবন্দী বানানোর কাল্পনিক ফিগারগুলো মিথ্যা সাব্যস্ত হয়। আর্কাইভগুলো প্রকাশের পর মূল ডকুমেন্টগুলোর উপর অনেক গবেষণার রিপোর্ট পরবর্তীতে প্রকাশিত হলে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। হঠাৎ করে গর্বাচেভ এর ফ্রি প্রেস এবং রটনা ছড়ানোর কাজে নিয়োজিত বদমাইশরা এসব রিপোর্টগুলো এড়িয়ে যেতে শুরু করে। জেমসকোভ, ডগিন এবং অন্যান্য রুশ ঐতিহাসিকদের রিপোর্টগুলো মূলত ১৯৯০ সালে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হতে শুরু করে যেগুলো সম্পূর্ণরূপে বুর্জোয়া গণমাধ্যমগুলো উপেক্ষা করে। গর্বাচেভ এর ফ্রি প্রেস আর পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর দাবীকৃত কমিউনিস্টদের দ্বারা সংঘটিত তথাকথিত হত্যা কিংবা কারারুদ্ধ করা মাসুম (!) মানুষদের বিশাল সংখ্যার বানোয়াট কাহিনীর রচয়িতাদের চোখে আঙুল দিয়ে বদমাইশি খুব ভালো করে দেখিয়ে দেয়া হয় এসব রিপোর্টে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Viktor_Zemskov
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Aleksandr_Dugin
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Oleg_Khlevniuk
গর্বাচেভ সরকারের এই ধরণের অসহযোগিতার পরও গবেষণাগুলোর রিপোর্ট অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত বৈজ্ঞানিক জার্নালগুলোতে প্রকাশ করে এই পরিশ্রমী আর সত্যের প্রতি অটল ঐতিহাসিকরা। জার্নালগুলোর কম পরিচিতির সুযোগে খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক অধিবাসীও মিথ্যা প্রোপাগান্ডার ফাঁদে পা দেয়। এমনকি পশ্চিমা দুনিয়ার গণমাধ্যমেও এসব রিপোর্টে স্তালিনের সময়ের প্যানেল সিস্টেমের উপর আলোকপাত করা তথ্যগুলো সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কেন?
সোভিয়েত
প্যানেল সিস্টেমের উপর তৈরি করা গবেষণাপত্রটি মোটামুটি ৯৹৹৹ পৃষ্ঠার
বিশাল এক রিপোর্ট। এই রিপোর্টটি সম্মিলিতভাবে অনেক লেখক তৈরি করলেও এদের মধ্যে
অধিকতর বিখ্যাত হচ্ছেন রুশ ঐতিহাসিক জেমসকোভ, ডগিন এবং খ্লেভনিয়াক। তাঁদের কাজগুলো ১৯৯৹
সালের দিকে প্রকাশিত হওয়া শুরু করে এবং ১৯৯৩ সালের মধ্যে প্রায়
সম্পূর্ণ গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হয়। তাদের গবেষণাগুলো পশ্চিমাদের নজরে আসে মূলত বিভিন্ন পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যকার
গবেষকদের গবেষণাগুলো পারস্পরিক বিনিময়ের সূত্র ধরে। গবেষণাগুলোর মধ্যে যে দু’টি
কাজ অধিক পরিচিত সেগুলোর মধ্যে প্রথমটি ফরাসী জার্নাল L’Histoire এ ১৯৯৩
সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিকোলাস ওয়ার্থ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। [যিনি ছিলেন French National Center for Scientific Research এর প্রধান গবেষক]
https://en.wikipedia.org/wiki/French_National_Centre_for_Scientific_Research
https://en.wikipedia.org/wiki/L%27Histoire
https://en.wikipedia.org/wiki/Nicolas_Werth
আর দ্বিতীয়টি
মার্কিন জার্নাল আমেরিকান হিস্টোরিক্যাল রিভিউ‘তে জে. আর্চ গ্যাটির সম্পাদনায় প্রকাশিত
হয়। [যিনি ছিলেন রিভারসাইড এর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক]
https://en.wikipedia.org/wiki/The_American_Historical_Review
https://en.wikipedia.org/wiki/J._Arch_Getty
অন্যান্য
লেখকদ্বয় ছিলেন French
National Centre for Scientific Research এর গবেষক জি.টি রিটারস্পর্ন এবং রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেস এর অন্তর্গত ইন্সটিটিউট
অব রাশিয়ান হিস্ট্রি শাখার গবেষক জেমসকোভ। এই গবেষণায় নিয়োজিত গবেষকদের কেউ কিন্ত সমাজতান্ত্রিক
আদর্শের অনুসারী ছিলেন না। অন্যদিকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো বুর্জোয়াদের অনুরূপ
এবং সমাজতন্ত্রের বিরোধী। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল।
https://drive.google.com/file/d/1x4jqyVnPIzxfhMwvW7Jfh1kGVnYhani9/view?usp=sharing
অথচ উপরে
উল্লিখিত গবেষকগণ কনকুয়েস্ট, সলজেনিৎসিন, মেদভেদেভ সহ অন্যান্য বদমাইশদের
মিথ্যাগুলো সবার সামনে তুলে ধরেছিলেন শুধুমাত্র পেশাদারিত্বের প্রতি সৎ আর
দায়িত্বশীল থাকার কারণে এবং অন্যদের মতো এরা পুঁজিবাদীদের কাছে নিজেদের বিক্রি
করেননি।
১৯৩৹
সালের পর থেকে সোভিয়েত প্যানাল সিস্টেমে কারাগার, শ্রম শিবির, গুলাগ এর শ্রমিক
কলোনী, বিশেষ মুক্তাঞ্চল এবং জরিমানা পরিশোধের বাধ্যবাধকতা অন্তর্ভূক্ত হয়। যাদের
রিমান্ডে নেয়া হতো তাদের সাধারণ কারাগারে পাঠিয়ে তদন্ত করে দেখা হতো সে
আসলেই দোষী কিনা। তদন্ত শেষে নির্দোষ ব্যক্তিকে মুক্ত করে দেয়া হতো এবং দোষীদের
বিচারের ব্যবস্থা করা হতো। অপরাধের ধরণ অনুযায়ী দোষী ব্যক্তিকে জরিমানা পরিশোধ
করতে হতো কিংবা হাজতবাস ও মৃত্যুদন্ডের শাস্তি দেয়া হতো। জরিমানাগুলো দোষী
ব্যক্তির বেতন থেকে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত কেটে নেয়া হতো। যাদের হাজতবাসের শাস্তি হতো, তাদেরকে অপরাধের
মাত্রা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের জেলে প্রেরণ করা হতো। গুলাগে শুধুমাত্র তাদেরই
পাঠানো হতো যারা ভয়াবহ পর্যায়ের অপরাধ করেছিলো। যেমন- হত্যা, ডাকাতি, ধর্ষণ ইত্যাদি।
আবার গুলাগের অনেকেই ছিল প্রতিবিপ্লবী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত দালালশ্রেণী। গুলাগের
বাইরে যেসকল কয়েদীর তিন বছরের বেশি হাজতবাসের সাজা হতো, তাদের কিছু সময়ের জন্য
গুলাগ ও অন্যান্য শ্রম শিবিরগুলোতে রাখা হতো। এরপর তাদের বিভিন্ন শ্রমিক কলোনী
কিংবা বিশেষ মুক্তাঞ্চলগুলোতে পাঠিয়ে দেয়া হতো। শ্রম শিবিরগুলো বিশাল এলাকা নিয়ে
তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে শাস্তিপ্রাপ্তরা কড়া পর্যবেক্ষণে থাকতো এবং কাজ করতো। বর্তমান
সময়ে অনেকেই ভেবে বসতে পারে যে, সিস্টেমটা ছিল অমানবিক। অথচ এদের বসিয়ে বসিয়ে
খাওয়ানোর অর্থ ছিল সমাজের জন্য বোঝা বানিয়ে ফেলা। ১৯৪৹ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নে শ্রম শিবির ছিল ৫৩টি, গুলাগে শ্রমিক কলোনী ছিল ৪২৫টি। শ্রমিক কলোনীগুলো শ্রম
শিবিরগুলো থেকে আকারে অনেক ছোট ছিলো এবং এগুলোতে নজরদারিও ছিলে তুলনামূলকভাবে কম।
এই কলোনীগুলোতে যারা অপেক্ষাকৃত কম মাত্রার অপরাধের জন্য অভিযুক্ত এবং
যাদের হাজতবাসের সময়সীমা অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত, তাদের প্রেরণ করা হতো। এরা
স্বাধীনভাবে কারখানা আর কৃষি জমিতে কাজ করার এবং আংশিকভাবে সাধারণ জনগণের সাথে
সংশ্লিষ্ট থাকার অনুমতি পেতো। সাধারণ শ্রমিকদের মতোই এদের সমান পরিমাণে পারিশ্রমিক
দেয়া হতো কৃষিকাজে আর কারখানাগুলোতে। অপরদিকে বিশেষ মুক্তাঞ্চলগুলো ছিল সাধারণত
কৃষিকাজের সাথে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলো নিয়ে গঠিত, যেগুলোতে নির্বাসন এর দন্ডপ্রাপ্তদের
পাঠানো হতো। যেমন- কুলাকদের, এরা সেই জোঁক যাদের জমি যৌথ মালিকানা ব্যবস্থা
প্রবর্তনের সময় কেড়ে নিয়ে গরীব কৃষকদের উপর যুগের পর যুগ ধরে চালানো শোষণ বন্ধ করা
হয়েছিল। ছোটখাটো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত
কিছু অপরাধীকেও বিশেষ মুক্তাঞ্চলগুলোতে প্রেরণ করা হতো।
নিচের তথ্যগুলো আমেরিকান হিস্টোরিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত হয়েছিলো,
যেগুলো ১৯৩৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এর কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি
কর্তৃক প্যানাল সিস্টেমটি সুসংবদ্ধ করার পর থেকে ১৯৫৩ সালে স্তালিন এর
মৃত্যুর বছর পর্যন্ত বিশ বছরের ডাটার হিসাব। আমরা এসর ডাটার সাথে রবার্ট
কনকুয়েস্টের দেয়া ডাটাগুলোর তুলনা করতে পারি এক্ষেত্রে। কনকুয়েস্ট দাবি
করেছিল যে ১৯৩৯ সালে শ্রম শিবিরে ৯ মিলিয়ন রাজনৈতিক বন্দি ছিল এবং
১৯৩৭-১৯৩৯ সময়কালে ৩ মিলিয়ন বন্দি মারা গিয়েছিল। কনকুয়েস্ট এখানে কেবল
রাজনৈতিক বন্দিদের নিয়েই কথা বলছে! তার মতে এগুলি ছাড়াও সাধারণ অপরাধী
ছিল যারা রাজনৈতিক বন্দীদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল! কনকুয়েস্ট এর
মতে ১৯৫০ সালে ১২ কোটি রাজনৈতিক বন্দী ছিল! আমরা সহজেই দেখতে পাচ্ছি যে
কনকুয়েস্ট আসলে কোন পর্যায়ের প্রতারক। তার কোনও পরিসংখ্যান সত্যের
ধারেকাছেও নেই। ১৯৩৯ সালে প্রায় দুই মিলিয়ন মোট বন্দী সমস্ত শিবির, কলোনী
এবং কারাগারে ছিল। এই ৪,৫৪,০০০ ছিল রাজনৈতিক বন্দি, কনকুয়েস্ট এর বানানো ৯
মিলিয়ন নয়। ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে যারা শ্রম শিবিরে মারা গিয়েছিল
তাদের সংখ্যা প্রায় ১,৬০,০০০; কনকুয়েস্ট এর দাবি অনুযায়ী ৩ মিলিয়ন নয়।
১৯৫০ সালে শ্রম শিবিরে ৫,৭৮,০০০ রাজনৈতিক বন্দী ছিল; ১২ মিলিয়ন নয়। আজ
অবধি রবার্ট কনকুয়েস্ট সাম্যবাদের বিরুদ্ধে ডানপন্থী প্রচারণার অন্যতম
প্রধান উৎস হিসাবে রয়ে গেছে। ডানপন্থী ছদ্ম বুদ্ধিজীবীদের কাছে রবার্ট
কনকুয়েস্টকে ঈশ্বর মানা হয়। আলেকজান্ডার সলজেনিৎসিন উদ্ধৃত পরিসংখ্যান
অনুযায়ী যেই ৬৹ মিলিয়ন লোক শ্রম শিবিরে মারা গেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে, এ
সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করার প্রয়োজন নেই! এ জাতীয় অভিযোগের অযৌক্তিকতা
সুস্পষ্ট। শুধুমাত্র মানসিকভাবে অসুস্থদের পক্ষেই এই ধরণের বিভ্রান্তি
প্রচার সম্ভব।
প্যানাল সিস্টেমে আটককৃত লোকের সংখ্যা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার। জারদের
প্রাচীন ব্যবস্থাতে শ্রমিকদের গভীর দারিদ্র্যে ঠেলে দেয়া হয়েছিল এবং
মানুষের জীবনের খুব একটা মূল্য ছিল না। সেসময় ডাকাতি ও সহিংস অপরাধের ভযাবহ
শাস্তি দেয়া হতো। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহগুলি সাধারণত গণহত্যা,
মৃত্যুদণ্ড এবং দীর্ঘ কারাবাসের দন্ডের মাধ্যমে দমন করা হতো। এই অভ্যাসগুলি
পরিবর্তিত হতে দীর্ঘ সময় নেয়, এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজ বিকাশের
পাশাপাশি অপরাধীদের প্রতি মনোভাবকে প্রভাবিত করেছিল। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন
স্তালিনের সময়ে এমন একটি দেশ ছিল যা সম্প্রতি সামন্ততন্ত্রকে উৎখাত করে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন, যে দেশটির ১৯৩০ এর দশকে প্রায় ১৬০-১৭০ মিলিয়ন বাসিন্দা
ছিল, বিদেশী শক্তির দ্বারা মারাত্মক হুমকির মধ্যে ছিল। ১৯৩০ এর দশকে
ইউরোপে যে বিরাট রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছিল তার ফলস্বরূপ নাৎসি জার্মানির
দিক থেকে যুদ্ধের একটি বড় আশঙ্কা ছিল যা স্লাভ জনগণের বেঁচে থাকার জন্য
হুমকিস্বরূপ, আর পশ্চিমাদের সোভিয়েত আক্রমণের আকাঙ্খার ব্যাপারটা তো আছেই।
এই পরিস্থিতির সারসংক্ষেপ ১৯৩১ সালে স্তালিন এর বলা একটি বাক্য থেকে বোঝা
যায়- "আমরা উন্নত দেশগুলির চেয়ে ৫০-১০০ বছর পিছিয়ে আছি। ১০ বছরের মধ্যে
আমাদের সেই ব্যবধানটি পূরণ করতে হবে। হয় আমদের এটি করতে হবে, নয়তো আমরা
নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো।” এর দশ বছর পর, ১৯৪১ সালের ২২ জুন সোভিয়েত ইউনিয়ন
নাৎসি জার্মানি এবং এটির মিত্রদের দ্বারা আক্রমণ এর শিকার হয়। সোভিয়েত
সরকার ১৯৩০-৪০ এর দশকে নাৎসিদের বিরুদ্ধে আসন্ন যুদ্ধের জন্য তাদের
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারে নিয়োজিত ছিল। সোভিয়েতবাসী কঠোর পরিশ্রম করেছিল
মাতৃভূমি পুনর্গঠনে, তা সত্ত্বেও উৎপাদন আশানুরূপ ছিল না।। এজন্য দৈনিক ৭
ঘন্টা কর্মঘন্টার নিয়মটি ১৯৩৭ সালে প্রত্যাহার করা হয়েছিল এবং ১৯৩৯ সালে
রবিবারও ছুটির দিন হিসেবে বাতিল করা হয়। স্তালিনের অধীনে সোভিয়েত ইউনিয়ন
দুই দশক (১৯৩০ এবং ১৯৪০ এর দশক) ধরে বিকশিত হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে এক
ভয়াবহ যুদ্ধের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ২৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়, বিশাল
সোভিয়েত এর অর্ধেক অংশই জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এই অবর্ণনীয় পরিস্থিতিতে
সোভিয়েত ইউনিয়নে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। এই অত্যন্ত
কঠিন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন কারাগারগুলোতে আড়াই মিলিয়ন লোককে বন্দি
হিসেবে আটক রেখেছিল, যা ছিল প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ২.৪%!
২৹১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ৩২৮.২ মিলিয়ন যা
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ।
https://web.nmsu.edu/~araxtina/ict460/five/Stats5.html
এটি এমন এক দেশ যেটি কোন যুদ্ধের ফলে হুমকির মুখে পড়েনি এবং যেখানে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করে এমন গভীর সামাজিক পরিবর্তন নেই। তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারগুলোতে বন্দির সংখ্যা কত?
https://en.wikipedia.org/wiki/Incarceration_in_the_United_States https://www.statista.com/statistics/262961/countries-with-the-most-prisoners/ https://www.prisonpolicy.org/blog/2020/01/16/percent-incarcerated/
উপরের লিঙ্কগুলোতে ক্লিক করলেই যে কেউ টের পাবে বিশ্বকে উদ্ধার এর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়া বদমাইশদের গলাবাজি আর প্রকৃত বাস্তবতার মাঝের তফাতটা।
#সোভিয়েত
শ্রম শিবিরে ঠিক কত লোক মারা গিয়েছিল?
শতকরা হার বিভিন্ন বছরে বিভিন্ন মাত্রায় ছিল। যেমন- ১৯৩৪ সালে ৫.২%, ১৯৫৩
সালে ০.৩%। শ্রম শিবিরে মৃত্যুর কারণ ছিল বিশেষত মহামারীর বিরুদ্ধে
লড়াইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের ঘাটতি। সমস্যাটি কেবল সোভিয়েত শ্রম
শিবিরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল সমগ্র সোভিয়েত সমাজ এবং পাশাপাশি
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অ্যান্টিবায়োটিক
আবিষ্কার ও ব্যবহারে পরিস্থিতি আমূল বদলে যায়। সবচেয়ে খারাপ বছরগুলি ছিল
যুদ্ধের বছরগুলি যখন নাৎসি বর্বররা সোভিয়েত নাগরিকদের অত্যন্ত কঠোর
জীবনযাপনে বাধ্য করে। এই ৪ বছরে শ্রম শিবিরে অর্ধ মিলিয়নের বেশি লোক মারা
গিয়েছিল। আর যুদ্ধের বছরগুলিতে ২৫ মিলিয়ন মুক্ত সোভিয়েতবাসী মারা
গিয়েছিল কেবল যুদ্ধের কারণে। ১৯৫০ সালে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থার
উন্নতি হয়েছিল এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ শুরু হয়েছিল, সেসময় কারাগারে
বন্দী অবস্থায় মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল ০.৩%।
#১৯৫৩
এর আগে কত লোককে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল?
বিশেষত ১৯৩৭-৩৮ এর শুদ্ধি
অভিযানের পূর্বে?
ইতিমধ্যে রবার্ট কনকুয়েস্টের দাবিটি উল্লেখ করা হয়েছে যে বলশেভিকরা
১৯৩০-১৯৫৩ সালের মধ্যে শ্রম শিবিরে ১২ মিলিয়ন রাজনৈতিক বন্দিকে হত্যা
করেছিল। এদের মধ্যে ১ মিলিয়ন বন্দিকে ১৯৩৭-৩৮ সালে হত্যা করা হয়েছিল বলে
মনে করা হয়। অন্যদিকে সলজেনিৎসিন এর পরিসংখ্যান দশ মিলিয়ন লোকে পৌঁছে যায়
যারা শ্রম শিবিরে মারা গিয়েছিল বলে মনে করা হয়, এদের মধ্যে ১৯৩৭-৩৮
সালেই তার দাবী অনুযায়ী মারা যায় ৩ মিলিয়ন! এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের
বিরুদ্ধে নোংরা প্রচারণা যুদ্ধ চলাকালীন এমনকি এগুলোর চেয়েও বেশি পরিমাণে
কাল্পনিক মৃত্যুর সংখ্যা উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ওলগা
শাতুনোভস্কায়া ১৯৩৭-৩৮ সালের শুদ্ধি অভিযানে ৭ মিলিয়ন লোকের মৃত্যুর কথা
উল্লেখ করেছেন!
https://en.wikipedia.org/wiki/Olga_Shatunovskaya
আনুমানিক
পরিসংখ্যানের জন্য গবেষকদের বিভিন্ন আর্কাইভ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে
হয়েছিল, এতে একই ফিগার একাধিকবার গণনা করা হয় এবং ফলস্বরূপ বাস্তবের চেয়ে
বেশি কাল্পনিক ফিগার তৈরি হয় (এসব কর্মকান্ডের অধিকাংশই যদিও ছিল
ইচ্ছাকৃত)। বরিস ইয়েলৎসিন কর্তৃক নিযুক্ত পুরানো সোভিয়েত আর্কাইভগুলির
দায়িত্বে নিয়োজিত দিমিত্রি ভোলকোগনভের মতে, ১৯৩৬ সালের ১ অক্টোবর থেকে ৩০
সেপ্টেম্বর ১৯৩৮ এর মধ্যে সামরিক ট্রাইব্যুনালগুলোর দ্বারা মৃত্যুর জন্য
দোষী সাব্যস্ত হওয়া ব্যক্তি ছিল ৩০,৫১৪ জন।
https://en.wikipedia.org/wiki/Boris_Yeltsin
https://en.wikipedia.org/wiki/Dmitri_Volkogonov
ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ সালে কেজিবি কর্তৃক সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে,
১৯৩০-১৯৫৩ সাল অর্থাৎ এই ২৩ বছরের মধ্যে বিপ্লববিরোধী অপরাধের জন্য মৃত্যুর
জন্য দণ্ডিত ব্যক্তি ৭,৮৬,০৯৮ জন লোক ছিল। কেজিবি‘র তথ্য অনুসারে
দণ্ডিতদের মধ্যে ৬,৮১,৬৯২ জনকে ১৯৩৭-১৯৩৮ সালের মধ্যে মৃত্যুদন্ড দেয়া
হয়েছিল। কেজিবির পরিসংখ্যানগুলি দ্বিগুণ করা সম্ভব নয়, তবে তথ্যের এই শেষ
অংশটির বিকৃতি ঘটানো হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। কারণ এতো লোকের মাত্র
দু'বছরে মৃত্যুদণ্ডের রায় হওয়াটা খুব আজব বিষয়। ইয়েলৎসিন এর সময়ের
কেজিবি কি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত এর কেজিবি’র মতো আচরণ করবে? কেজিবি’র
তথ্যে যে পরিসংখ্যানগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল সেগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ২৩
বছর ধরে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত অন্যান্য অপরাধীদের পাশাপাশি বিপ্লব বিরোধীরা,
কিন্ত পুঁজিবাদী কেজিবি ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে শুধু
প্রতিবিপ্লবীদের কথা উল্লেখ করে। আর্কাইভগুলি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে,
মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত সাধারণ অপরাধী এবং প্রতিবিপ্লবীদের সংখ্যা প্রায় সমান
ছিল। এ থেকে সহজেই উপসংহারে আসা যায় যে, ১৯৩৭-৩৮ সালে মৃত্যুর জন্য
দণ্ডিতদের সংখ্যা এক লক্ষের কাছাকাছি ছিল এবং পশ্চিমাদের দাবিকৃত মিলিয়ন
মিলিয়ন নয়। এটাও মনে রাখা দরকার যে সোভিয়েত ইউনিয়নে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত
সকলের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়নি। মৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্তদের একটি বৃহৎ
অংশের শাস্তি লঘু করে শ্রম শিবিরগুলিতে পাঠানো হয়েছিল। সাধারণ অপরাধী এবং
প্রতিবিপ্লবীদের মধ্যে পার্থক্য বোঝাটাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে অনেকে হত্যাকাণ্ড বা ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধ
করেছিল। আর তৎকালীন সময়ে এ জাতীয় অপরাধে পৃথিবীর অনেক দেশেই মৃত্যুদন্ডের
শাস্তি দেয়া হতো। এখনো বহু দেশে মৃত্যুদন্ড প্রথা চালু আছে।
https://www.thesun.co.uk/news/2525739/countries-death-penalty-how-many-people-executed-world/
খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনো মৃত্যুদন্ড প্রথা প্রচলিত আছে।
https://drive.google.com/file/d/1Y4RQaNyvj1ohsxlkH-j9z3I3njLFry_x/view?usp=drivesdk
#কারাবাস গড়ে কতদিন ছিল?
সোভিয়েতে
দীর্ঘ সময় ধরে কারাবাসের ব্যাপারটা পশ্চিমা প্রচারণার কল্যাণে সর্বাধিক
ভয়াবহ গুজবে পরিণত হয়েছিল পুরো বিশ্বে। প্রোপাগান্ডাটি হলো সোভিয়েত
ইউনিয়নে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর যেকেউ অনন্তকাল ধরে কারাগারে থাকে, যে
এগুলোর ভিতরে একবার যায় সে আর কখনই বের হয়না! এটি সম্পূর্ণ বানোয়াট কথা।
যারা স্তালিনের সময়ে কারাগারে গিয়েছিল তাদের বেশিরভাগই বাস্তবে সর্বোচ্চ ৫
বছরের জন্য দণ্ডিত ছিল। আমেরিকান হিস্টোরিক্যাল রিভিউ’তে প্রকাশিত
পরিসংখ্যানগুলি প্রকৃত সত্য সবার সামনে নিয়ে আসে।
১৯৩৬ সালে রাশিয়ান
ফেডারেশনের সাধারণ অপরাধীরা নিম্নলিখিত সাজাগুলি ভোগ করেছিল-
৫ বছর পর্যন্ত: ৮২.৪%
৫-১০ বছরের মধ্যে: ১৭.৬%
১৯৩৭ সালের আগে সর্বোচ্চ সম্ভাব্য
কারাবাস ছিল দশ বছর।
১৯৩৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বেসামরিক
আদালতে দণ্ডিত রাজনৈতিক বন্দিরা নিম্নরূপ শাস্তি পেয়েছিল-
৫ বছর পর্যন্ত: ৪৪.২%
৫-১০ বছরের মধ্যে: ৫০.৭%
১৯৪০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী-
৫ বছর পর্যন্ত: ৫৬.৮%
৫-১০ বছরের মধ্যে: ৪২.২%
শুধুমাত্র ১% কে ১০ বছরের বেশি কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল।
সোভিয়েত আদালত এর ১৯৩৯ সালের পরিসংখ্যান
অনুযায়ী-
৫ বছর পর্যন্ত: ৯৫.৯%
৫-১০ বছরের মধ্যে: ৪%
১০ বছরের বেশি সময়: ০.১%
সোভিয়েত
ইউনিয়নের কারাগারের অনন্তকাল সাজার রটনা ছিল মূলত সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে
নোংরা লড়াই এর তালিকায় পশ্চিমাদের আরেকটি ফ্যাক্টর সংযোগ করা। সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো দোষী সাব্যস্ত হওয়া লোকেরা যেসব অপরাধ করেছে
সেগুলো কখনই আগ্রহের বিষয় ছিল না পশ্চিমাদের কাছে। পুঁজিবাদী রাজনৈতিক
প্রচারণা সর্বদা সোভিয়েত বন্দীদের নিরীহ হিসাবে উপস্থাপন করে এবং গবেষকরা
এটিকে প্রশ্নবিদ্ধ না করেই ধারণাটি গ্রহণ করেছেন। গবেষকরা যখন তাদের
পরিসংখ্যানের কলাম থেকে লাফিয়ে ঘটনাগুলোর ব্যাপারে তাদের ভাষ্যে চলে যান,
তখন তাদের বুর্জোয়া চরিত্র সামনে এসে পড়ে তাদের বানানো ভয়াবহ আকারের
ফলাফলের মাধ্যমে। সোভিয়েত প্যানাল ব্যবস্থার অধীনে যাদের দোষী সাব্যস্ত
করা হয়েছিল তাদের বেশিরভাগই চোর, খুনি আর ধর্ষক ছিল। ইউরোপ বা
যুক্তরাষ্ট্রে এসব অপরাধ সংঘটিত হলে এই ধরণের অপরাধীরা কখনই তাদের প্রেসের
দ্বারা নিগৃহিত হিসাবে বিবেচিত হতো না। যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়নে অপরাধ
সংঘটিত হয়েছিল, তাই এগুলো আলাদা হিসেবে গণ্য তো হবেই নিষ্পাপদের জন্য ভেবে
ভেবে নাকের আর চোখের জল এক করে ফেলা বদমাইশদের কাছে! একজন খুনি বা যে
ব্যক্তি একাধিকবার ধর্ষণ করেছে তাকে নিরীহ ভুক্তভোগী হিসেবে প্রচার করা কোন
পর্যায়ের নোংরামির মধ্যে পড়ে?প্রতিবিপ্লবীদের ক্ষেত্রেও তাদের বিরুদ্ধে
যেসব অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল সেগুলি বিবেচনা করা দরকার। এটির গুরুত্ব
সঠিকভাবে উপলব্ধির জন্য দু’টি উদাহরণ দেয়া যাক এক্ষেত্রে- প্রথমটি হলো
কুলাকরা ১৯৩০ এর দশকের শুরুতে সাজা পেয়েছিল এবং দ্বিতীয়টি হলো
ষড়যন্ত্রকারী ও প্রতিবিপ্লবীরা যারা ১৯৩৬-৩৮ সালে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল।
গবেষকদের রিপোর্ট অনুযায়ী ১.৮ মিলিয়ন ধনী কুলাকদের নির্বাসনে পাঠানো
হয়েছিল। এদের শ্রম শিবির আর কলোনীগুলোতে শর্ত সাপেক্ষে সাজা দেয়া
হয়েছিল। কিন্ত এই শাস্তি দেয়ার পেছনের কারণ কি? ধনী কুলাকরা কয়েকশ বছর
ধরে দরিদ্র কৃষকদের সীমাহীন নিপীড়ন এবং নিরবচ্ছিন্ন শোষণ করেছিল। ১৯২৭
সালে ১২০ কোটি কৃষকের মধ্যে ১০ কোটি কুলাক বিলাসবহুল জীবনযাপন করতো এবং
বাকি ১১০ মিলিয়ন কৃষক দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করতো। বিপ্লবের আগে এরা
অত্যন্ত শোচনীয় পরিবেশে কোনরকমে বেঁচে থাকতো। কুলাকদের সম্পদের পাহাড় গড়ে
উঠেছিল হতদরিদ্র কৃষকদের নামমাত্র বেতনে শ্রমের উপর ভিত্তি করে। দরিদ্র
কৃষকরা যখন যৌথ খামারে একসাথে যোগদান শুরু করে, কুলাকদের সম্পদের মূল উৎসই
তখন ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্ত কুলাকরা হাল ছাড়েনি। দুর্ভিক্ষ তৈরি করে তারা
শোষণ এর রাস্তাটা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছিল। সশস্ত্র কুলাকরা যৌথ
খামারে আক্রমণ করেছিল, দরিদ্র কৃষক ও দলীয় কর্মীদের হত্যা করেছিল, ক্ষেতে
আগুন দিয়েছিল এবং কৃষিক্ষেতে ব্যবহৃত প্রাণীগুলো হত্যা করেছিল। দরিদ্র
কৃষকদের মধ্যে অনাহার বজায় রেখে কুলাকরা তাদের অবস্থান সুরক্ষিত করার
চেষ্টা করেছিল। এরা নিজেদের বদমাইশি বন্ধ করতে নেয়া পরবর্তী পদক্ষেপগুলো
প্রত্যাশা করেনি। এবার দরিদ্র কৃষকদের বিপ্লবের প্রতি পরিপূর্ণ সমর্থন ছিল
এবং তারা কুলাকদের চেয়ে শক্তিশালী প্রমাণিত হয়েছিল। কুলাক জোঁকেরা এসব
দরিদ্র কৃষকদের বিপ্লবের আগুনের সামনে টিকতে পারেনি। এদের নির্বাসনে প্রেরণ
করা হয়েছিল কিংবা শ্রম শিবিরে বিভিন্ন পরিমাণে সাজা পেয়েছিল। ১০ কোটি
কুলাকের মধ্যে ১.৮ মিলিয়ন নির্বাসিত বা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল। সোভিয়েত
এর গ্রামগুলোতে এই বিশাল শ্রেণি সংগ্রাম চলাকালীন সেখানে অন্যায় কিছুটা
ঘটেছে সেটা কেউ অস্বীকার করবে না, যা ছিল ১২০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যকার
সংগ্রাম। দরিদ্র ও নিপীড়িত কৃষকরা একটা শালীন জীবনের জন্য, তাদের সন্তানরা
নিরক্ষর হয়ে কিংবা না খেয়ে যেন মারা না যায় তা নিশ্চিত করতে এই লড়াই
করেছিল রক্তচোষা কুলাকদের বিরুদ্ধে। এজন্য কি গণআদালতগুলিতে কুলাকদের
পর্যাপ্ত করুণা প্রদর্শন না করার জন্য আমরা তাদের দোষ দিতে পারি? যুগ যুগ
ধরে সভ্যতার সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত এই অসহায় কৃষকদের দিকে অভিযোগের আঙুল
তুলতে পারে একমাত্র পশুরাই, মানুষ না। আর বছরের পর বছর অবিরাম শোষণের সময়
দরিদ্র কৃষকদের সাথে কুলাকদের আচরণ কি সভ্য ছিল? অন্যদিকে ১৯৩৬-৩৮ সালের
বিচারে যেসব প্রতিবিপ্লবীরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল; অর্থাৎ পার্টি,
সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র যে সংশোধন প্রক্রিয়া চলেছিল এর শিকড়
খুঁজতে হবে রুশ বিপ্লবের ইতিহাসে। জার এবং রাশিয়ান বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে
লক্ষ লক্ষ মানুষ সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকেই রাশিয়ান
কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রলেতারিয়েত এবং
সমাজতন্ত্রের পক্ষে লড়াই ছাড়াও অন্য উদ্দেশ্যে দলে প্রবেশ করেছিল। শ্রেণি
সংগ্রামের তীব্রতা সেসময় এত বেশি ছিল যে প্রায়শই দলের নতুন কর্মীদের
পরীক্ষা করার সময় বা সুযোগ হতো না। এমনকি অন্য দল থেকে বহিরাগত যারা
নিজেকে সমাজতান্ত্রিক বলতো এবং যারা বলশেভিক দলের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল
তাদেরকেও কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে বাধা দেয়া হয়নি। শ্রেণি সংগ্রাম
পরিচালনা করার স্বতন্ত্র দক্ষতার উপর নির্ভর করে এই নতুন কর্মীদের
বেশিরভাগকে বলশেভিক পার্টি, রাষ্ট্র এবং সশস্ত্র বাহিনীগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ
পদ দেয়া হয়েছিল। নবীন সোভিয়েত রাষ্ট্রের জন্য এটা ছিল অত্যন্ত কঠিন
সময়। শিক্ষিত কর্মীদের প্রচুর সংকট নতুন কর্মীদের যাচাইয়ের ক্ষেত্রে
শিথিলতা দেখাতে কমিউনিস্ট পার্টিকে বাধ্য করেছিল। একসময় দ্বন্দ্ব দেখা দেয়
যা দলকে দু’টি শিবিরে বিভক্ত করেছিল- একদল সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের
সংগ্রামে এগিয়ে যেতে চেয়েছিল এবং অন্যদিকে আরেকদল মনে করতো পরিস্থিতি
এখনও সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত না, এরা সামাজিক গণতন্ত্র
বাস্তবায়নের পক্ষে ছিল। দ্বিতীয় দলের নেতা ছিল ট্রটস্কি, যে ১৯১৭ সালের
জুলাই মাসে দলে যোগ দিয়েছিল। ট্রটস্কি সময়ের সাথে সাথে বিখ্যাত কিছু
বলশেভিক নেতাদের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল। এই বিরোধীরা, মূল বলশেভিক
পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিকল্প পরিকল্পনাগুলির একটি প্রদান
করেছিল যা ১৯২৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর এর ভোটাভুটির বিষয় ছিল। এই ভোট গ্রহণের
আগে অনেক বছর ধরে দলে জোর বিতর্ক চলেছিল এবং ফলাফল হিসেবে এই ভোটাভুটিতে
৭,২৫,০০০ ভোটের মধ্যে বিরোধীরা পেয়েছিল ৬,০০০ ভোট; অর্থাৎ ১% এরও কম দলীয়
কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ বিরোধী দলকে সমর্থন করেছিল! ভোটের পর কমিউনিস্ট পার্টির
কেন্দ্রীয় কমিটি ঐক্যবদ্ধ বিরোধী দলের প্রধান নেতাদের দল থেকে বহিষ্কার
করার সিদ্ধান্ত নেয়। ট্রটস্কিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কার করা
হয়েছিল।
https://en.wikipedia.org/wiki/Grigory_Zinoviev
https://en.wikipedia.org/wiki/Lev_Kamenev
https://en.wikipedia.org/wiki/Karl_Radek
https://en.wikipedia.org/wiki/Yevgeni_Preobrazhensky
https://en.wikipedia.org/wiki/Vladimir_Smirnov_(politician)
কিন্তু
এদের বিরোধিতা এখানেই শেষ হয়নি। জিনোভিয়েভ, কামেনেভ ছাড়াও আরও অনেক
ট্রটস্কির অনুসারীরা পরবর্তীতে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। তাদের সবাইকে
আবারও কর্মী হিসাবে দলে গ্রহণ করা হয়েছিল এবং আরও একবার তারা পূর্বের দলীয়
ও রাষ্ট্রীয় পদ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্ত পরে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ট্রটস্কিপন্থীরা যে ভুল বুঝতে পারার নাটক করেছিল এর পিছনে ছিল অন্য উদ্দেশ্য। প্রতিবারই বিরোধী নেতারা প্রতিবিপ্লবের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে শ্রেণি সংগ্রামকে তীব্র করে তুলেছিল। ১৯৩৭-৩৮
সালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এদের প্রতি কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আগে
বেশিরভাগ বিরোধীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এবং কয়েকবার পুনরায় দলে
নেয়া হয়েছিল। ১৯৩৪ সালের
ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কিরভের
হত্যাকান্ডের তদন্ত শুরুর পর একটি গোপন সংস্থার কথা বেরিয়ে আসে, যেটি
চেয়েছিল সহিংসতার মাধ্যমে দলীয় ও রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ পদটি কব্জা
করতে।
https://en.wikipedia.org/wiki/Sergei_Kirov
বিরোধী
দল ১৯২৭ সালে রাজনৈতিক লড়াইয়ে হেরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ সহিংসতার
মাধ্যমে জয়লাভের আশা করেছিল। তাদের প্রধান অস্ত্র ছিল শিল্পক্ষেত্রে
নাশকতা, সন্ত্রাসবাদ এবং দুর্নীতি। বিরোধী দলের মূল অনুপ্রেরণা ট্রটস্কি বিদেশ থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতো।
https://marxists.architexturez.net/archive/pollitt-marjorie/1937/xx/trotskyism.htm
https://internationalstalinsociety.wordpress.com/trotsky-the-anti-communist/
https://www.marxists.org/history/usa/parties/cpusa/anti-trotsky/Trotsky%20the%20Traitor%20-%20Bittleman.pdf
শিল্পক্ষেত্রে
নাশকতার কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ,
গুরুত্বপূর্ণ মেশিনগুলো এত বাজেভাবে ক্ষতি করা হতো যে সেগুলো আর মেরামত করা
সম্বব হতো না। খনি এবং কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হতো।
১৯৩৪ সালে যেসব বিদেশী বিশেষজ্ঞ এই সমস্যাটির ব্যাপারে উল্লেখ করেছিলেন,
তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মার্কিন ইঞ্জিনিয়ার জন লিটলপেজ। লিটলপেজ সোভিয়েত
খনি শিল্পে ১০ বছর কাজ করেছিলেন (১৯২৭-৩৭)।
https://en.wikipedia.org/wiki/Jack_Littlepage
তিনি নিজের লেখা 'In Search of Soviet Gold' বইটিতে এই ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছেন।
https://drive.google.com/file/d/17p0MnW7QPxCfloIm9fxBJoWnSotWLi5Q/view?usp=sharing
লিটলপেজ
আরও লিখেছিলেন যে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এটাই বলছে, বিদেশ থেকে একটি
ভয়াবহ ষড়যন্ত্র পরিচালিত হচ্ছে যা সোভিয়েত সরকার এর পতন ঘটাতে পরিকল্পনার
অংশ হিসাবে বড় বড় শিল্পক্ষেত্রে নাশকতা করে যাচ্ছে। এই মার্কিন
ইন্জিনিয়ারের বক্তব্য সোভিয়েত সরকার এর বিবৃতিকেই সমর্থন করছে পুরোপুরি।
১৯৩১ সালে লিটলপেজ ইতিমধ্যে উরাল পর্বতমালা এবং কাজাখস্তানের তামা এবং
ব্রোঞ্জের খনিতে কাজ করার সময় এই ব্যাপারে নোট নিয়েছিলেন। খনিগুলো ছিল
আরেকটি বৃহৎ তামা/ব্রোঞ্জ কমপ্লেক্সের অংশ, যেটির দায়িত্বে ছিল ভারী
শিল্পক্ষেত্রের People’s Vice Commissar for Heavy Industry পদে দায়িত্বরত
পায়াতাকভ।
https://en.wikipedia.org/wiki/Georgy_Pyatakov
খনিগুলোর
উন্নত উত্তোলন ব্যবস্থা আর শ্রমিকদের জন্য সুষ্ঠূ কাজের পরিবেশ থাকার পরও
সেসময়ের বিপর্যয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে লিটলপেজ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে
তামা/ব্রোঞ্জ কমপ্লেক্সের শীর্ষস্থানীয় ব্যবস্থাপনা থেকে নাশকতাগুলো ঘটানো
হচ্ছে। লিটলপেজের বইটি এটাও জানায় যে ট্রটস্কিপন্থী এই প্রতিবিপ্লবীরা
তাদের ক্রিয়াকলাপের জন্য অর্থ কাদের কাছ থেকে পেয়েছিল। সরকারী কর্মকর্তার
আড়ালে লুকিয়ে থাকা এসব বিরোধীদের অনেক সদস্য বিদেশ থেকে নির্দিষ্ট কারখানার
কাছ থেকে মেশিন কেনার অনুমোদন লাভের জন্য তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিল।
সোভিয়েত সরকার প্রকৃতপক্ষে যে অর্থ দিয়েছিল তার চেয়ে অনেক নিম্নমানের
হতো পণ্যগুলো। বিদেশী প্রস্তুতকারীরা ট্রটস্কির সংগঠনকে এই জাতীয় লেনদেন
থেকে পার্সেন্টেজ দিতো, ফলস্বরূপ ট্রটস্কি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে
তার ষড়যন্ত্রকারীরা দোস্তরা এই প্রস্তুতকারীদের সাথে লেনদেন অব্যাহত
রেখেছিল। ১৯৩১ সালের বসন্তে বার্লিনে খনিগুলোর জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল লিফট
কেনার সময় লিটলপেজ এর নজরে আসে এই মেশিন সংক্রান্ত দূর্নীতির ব্যাপারটি।
এই সফরে সোভিয়েত প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন পায়াতাকভ। আর লিটলপেজকে
সাথে নেয়া হয়েছিল যেন তিনি লিফটগুলোর গুণমান যাচাই করে পণ্যগুলো ক্রয়ের
ব্যাপারে অনুমোদন প্রদানের জন্য সোভিয়েত সরকারকে ভালো রিপোর্ট দেন। যখন
তিনি পায়াতাকভ এবং সোভিয়েত প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যদের ব্যাপারটি
জানালেন, তখন তাঁর সাথে শীতল আচরণ করা হলো। তারা এই ঘটনাকে সম্পূর্ণ
উপেক্ষা করেছিল এবং মার্কিন এই ইন্জিনিয়ারকে চাপ দিয়েছিল যেন তিনি লিফটগুলো
কেনার অনুমোদন প্রদান করেন বিনা প্রশ্নে। লিটলপেজ তাদের কথায় রাজি হননি।
সেসময় তিনি ভেবেছিলেন যা ঘটছে তা ব্যক্তিগত দুর্নীতির সাথে জড়িত এবং
প্রতিনিধি দলের সদস্যরা লিফট প্রস্তুতকারীদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছিল।
কিন্তু ১৯৩৭ সালের বিচারে পায়াতাকভ ট্রটস্কির নেতৃত্বে বিরোধী জোটের
বদমাইশদের সাথে তার যোগসূত্র স্বীকার করার পর লিটলপেজ এই সিদ্ধান্তে
পৌঁছেছিলেন যে, তিনি বার্লিনে যা দেখেছিলেন তা ব্যক্তিগত স্তরে দুর্নীতির
চেয়ে অনেক বেশি কিছু ছিল। সরকারী তহবিল থেকে মেরে দেয়া অর্থ গোপনে ব্যবহৃত
হতো সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীন প্রতিবিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদ এবং
প্রোপাগান্ডা প্রচারের জন্য। চুরি, নাশকতা এবং দুর্নীতির মতো অপরাধকেও
অতিক্রম করে বিরোধীদের কার্যকলাপ আরও অনেক বেশি এগিয়ে যায়। কমিউনিস্ট
পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের হত্যার মধ্য
দিয়ে সমগ্র সোভিয়েত নেতৃত্বকে নির্মূল করা হবে, এমন একটি অভ্যুত্থানের
মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণের লক্ষ্য নিয়ে একটি প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্র
তৈরি করা হয়েছিল। এই অভ্যুত্থানের সামরিক দিক মার্শাল তুখাচেভস্কির
নেতৃত্বে একদল জেনারেল দ্বারা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
https://en.wikipedia.org/wiki/Mikhail_Tukhachevsky
স্তালিন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লিখিত একাধিক বইয়ের লেখক ট্রটস্কিপন্থী
আইজাক ডয়চারের মতে ক্রেমলিন ছাড়াও লেনিনগ্রাডের মতো বড় শহরগুলোর
গুরুত্বপূর্ণ সেনা ঘাাঁটিগুলোতে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে এই অভ্যুত্থান
শুরু করা হয়েছিল।
https://en.wikipedia.org/wiki/Isaac_Deutscher
তুখাচেভস্কির নেতৃত্বে army political commissariat এর প্রধান গামারনিক, লেনিনগ্রাদের কমান্ডার জেনারেল ইয়াকির, মস্কোর সামরিক একাডেমির কমান্ডার জেনারেল উবোরেভিচ এবং অশ্বারোহী বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল প্রিমাকভ এই ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিল।
https://en.wikipedia.org/wiki/Yan_Gamarnik
https://en.wikipedia.org/wiki/Iona_Yakir
https://en.wikipedia.org/wiki/Ieronim_Uborevich
https://en.wikipedia.org/wiki/Vitaly_Primakov
মার্শাল
তুখাচেভস্কি লাল ফৌজের আগে জার এর সেনাবাহিনীর অফিসার ছিল। ১৯৩০ সালে
প্রায় ১০% লাল ফৌজের অফিসার (প্রায় ৪,৫০০ এর কাছাকাছি) পূর্বে জার এর
সেনাবাহিনীর অফিসার ছিল। এদের মধ্যে অনেকে কখনও তাদের বুর্জোয়া
দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করেনি এবং কেবল নিজেদের প্রতিপত্তি ফিরে পাওয়ার সুযোগের
অপেক্ষায় ছিল। বিরোধী দলগুলো যখন অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন
তারা এই সুযোগটি পায়। বলশেভিকদের এত সতর্কতার পরও সামরিক-বেসামরিক উভয়
পক্ষের ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নোংরা উদ্দেশ্য সফল করতে নিজেদের দল গোপনে
গোপনে ভারী করেছিল। ১৯৩৮ সালের বিচারে বুখারিন কর্তৃক প্রদত্ত
স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ট্রটস্কি এবং নাৎসি জার্মানির মধ্যে একটি গোপন চুক্তি হয়েছিল, এই চুক্তি অনুসারে প্রতিবিপ্লবীদের অভ্যুত্থানের পর ইউক্রেনসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বড় একটা অংশ নাৎসি জার্মানিকে দেয়া হবে!
https://en.wikipedia.org/wiki/Nikolai_Bukharin
নাৎসি জার্মানি প্রতিবিপ্লবীদের সমর্থন দেয়ার বিনিময়ে এই দাবী করেছিল! বুখারিনকে এই চুক্তির বিষয়ে রাদেক জানিয়েছিল, যে কিনা আবার ট্রটস্কির কাছ থেকে এই বিষয়ে নির্দেশ পেয়েছিল।
https://en.wikipedia.org/wiki/Karl_Radek
এই
ষড়যন্ত্রকারীদের সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে রক্ষার জন্য প্রশাসনের
উচ্চ পদে বসানো হয়েছিল, অথচ তারাই কিনা সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য কাজ
করেছিল! ১৯৩০ এর দশকে এই সব ঘটেছিল, যখন নাৎসি বাহিনী ইউরোপ এর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
ষড়যন্ত্রকারীদের
প্রকাশ্যে বিচারের পর বিশ্বাসঘাতক হিসাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। যারা
নাশকতা, সন্ত্রাসবাদ, দুর্নীতি, হত্যার চেষ্টা এবং দেশের কিছু অংশ নাৎসিদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল তারা দোষী বলে প্রমাণিত হয়েছিল তারা এর
চেয়ে ভালো কিছু আশা করার যোগ্য না। এদের নির্দোষ হিসেবে প্রচার করার পেছনের
উদ্দেশ্য একটা বাচ্চাও বুঝবে! রবার্ট কনকুয়েস্টের মাধ্যমে পশ্চিমা
প্রোপাগান্ডা যেভাবে লাল ফৌজের শুদ্ধি অভিযান সম্পর্কে মিথ্যাচার করেছে তা
হাস্যকর। কনকুয়েস্ট শয়তানটা তার 'দ্য গ্রেট টেরর' বইটিতে বলেছিল ১৯৩৭ সালে
লাল ফৌজে ৭০,০০০ কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক প্রতিনিধি ছিল এবং তাদের মধ্যে ৫০%
(১৫,০০০ কর্মকর্তা এবং ২০,০০০ প্রতিনিধি) পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়। তাদের
অনেকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল কিংবা তাদের কারাবন্দি করা হয়েছিল
শ্রম শিবিরে। কনকুয়েস্টের পুরো বইয়ের প্রতিটা অভিযোগই মিথ্যা। ঐতিহাসিক
রজার রিস তার রচিত বইগুলোতে এমন সব তথ্য দিয়েছেন যা ১৯৩৭-৩৮ সালে
লালফৌজের শুদ্ধি অভিযানের সত্যিকার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।
লাল ফৌজ, বিমান বাহিনীর অফিসার এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের সংখ্যা ১৯৩৭ সালে ছিল ১,৪৪,৩০০; ১৯৩৯ সালে তা বেড়ে হয় ২,৮২,৩০০।
১৯৩৭-৩৮
সালের শুদ্ধি অভিযানের সময় রাজনৈতিক কারণে ৩৪,৩০০ জন অফিসার এবং রাজনৈতিক
প্রতিনিধিকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। কিন্ত ১৯৪০ সালের মে মাসের মধ্যেই এসব বহিষ্কৃতদের মধ্য থেকে ১১,৫৯৬ জনকে নিজ নিজ পদে পুনর্বহাল করা হয়েছিল। এর অর্থ হচ্ছে ১৯৩৭-৩৮ সালের শুদ্ধি অভিযানে ২২,৭০৫ জন অফিসার ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছিল (১৩,০০০ আর্মি অফিসার; ৪,৭০০ বিমান বাহিনীর অফিসার এবং ৫,০০০ রাজনৈতিক প্রতিনিধি), যা
সকল অফিসার ও প্রতিনিধিদের ৭.৭%। কনকুয়েস্ট ক্রিমিনালটার বানানো ৫০% নয়।
অভিযুক্ত এই ৭.৭% এর মধ্যে একটা নির্দিষ্ট অংশকে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে দোষী
সাব্যস্ত করা হয়েছিল, তবে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বেসামরিক জীবনে ফিরে যায়। মস্কোয়
প্রখ্যাত আইনজীবী এবং তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রদূত জোসেফ ডেভিস বুখারিনের
বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন পুরোটা সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি পরবর্তীতে
বলেছিলেন বুখারিনকে বিচার চলাকালীন নির্দ্বিধায় কথা বলার অনুমতি দেয়া
হয়েছিল এবং বিচার প্রক্রিয়ার পুরো সময়টা কোনও প্রকার বাধার সৃষ্টি করা
হয়নি রাষ্ট্রীয়ভাবে।
https://en.wikipedia.org/wiki/Joseph_E._Davies
জোসেফ
ডেভিস ওয়াশিংটনে বার্তা পঠিয়েছিলেন এই বলে যে বিচার চলাকালীন প্রমাণিত
হয়েছিল অভিযুক্তরা যেসব অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল সেগুলো সত্য
এবং এই মামলায় উপস্থিত বিদেশী কূটনীতিকদের মধ্যে সাধারণ মতামতটি ছিল যে,
খুব গুরুতর ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছিল। পুঁজিবাদী জোঁকেরা এখনো মিথ্যাচারগুলোর পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে যাতে শ্রমিকরা পুঁজিবাদ এবং নব্যউদারবাদের বিকল্প খুঁজে না পায়।
Comments