আম্বানি হতে চাইলে তোদের সমস্যা কোথায়?

পুঁজিবাদ মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগতকে এমনভাবে তৈরী করে ফেলেছে যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে তথাকথিত শখ মেটাতে নিজেদের ক্রয়ক্ষমতার থেকে অনেক বেশি অর্থ খরচ করে। এটি এমন একটি অবস্থা, যা মানুষকে বাধ্য করে নিজেদের মালিকানাধীন বস্তু বা দ্রব্যের মতো করে নিজেদের ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে। আইফোনকে মনে করা হয় আভিজাত্যের প্রতীক। যারা আইফোন ব্যবহার করে, তাদের সমাজে অনেকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে। শুরুতে এর কারণ ছিলো আইফোনের উচ্চমূল্য। হাতে একটি আইফোন থাকলে সমাজে নিজের 'স্ট্যাটাস' বেড়ে যায় বলে অনেকে আগ্রহী হতো আইফোন কেনার জন্য। এখন আইফোনের থেকেও দামি অনেক মোবাইল বাজারে রয়েছে। তবুও অধিকাংশ মানুষ সেসব মোবাইলের কথা জানে না বলে এখনো সেসব দামি মোবাইলের চেয়ে আইফোনের মালিককে বেশি অভিজাত শ্রেণীর বলে মনে করে। এভাবে একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস যেমন কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে সমাজের অন্যান্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে দিতে পারে, তেমনটা পরিলক্ষিত হয় প্রায় সকল ক্ষেত্রে। মনে করুন, আপনি খুব দামি কোনো দোকান থেকে অনেক টাকা খরচ করে ভালো মানের একটি পাঞ্জাবি কিনেছেন। অপরদিকে আপনার এক বন্ধু দেশের সবচেয়ে নামকরা ব্যান্ডের পাঞ্জাবি কিনেছে, যেটি গুণগত মানের দিক থেকে আপনার পাঞ্জাবির ধারেকাছে নেই। তবুও আপনারা দু'জন পাঞ্জাবি পরে লোকসম্মুখে গেলে বেশিরভাগ মানুষ আপনার বন্ধুর পাঞ্জাবিকে বাহবা দিবে। কারণ সেটিতে একটি নামকরা ব্র্যান্ডের সিল রয়েছে! সাধারণ মানুষ নামকরা ব্র্যান্ডের প্রতি এতটাই ঝুঁকে পড়েছে যে, সকল ক্ষেত্রে তারা একে বেশি প্রাধান্য দিয়ে ফেলে। সুযোগটি লুটতে পিছপা হয়না নামকরা ব্র্যান্ডগুলো। তারা জানে তাদের পণ্যের মানের চেয়ে নাম বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই তারা চাইলে একটি পণ্যের গায়ে দুই হাজার টাকা মূল্যমানের প্রাইস ট্যাগ সেঁটে দিতে পারে, অন্য কোনো দোকান থেকে যেটি কিনতে এতো টাকা লাগতো না।



আগে মানুষ কোনো পণ্যের গুণগতমান কতটা তা বিবেচনা করতো। এখন তারা পণ্যটির বাহ্যিক চাকচিক্যকে প্রাধান্য দেয় এবং কোনো নামকরা ব্র্যান্ডের সিল বাহ্যিক চাকচিক্যের অংশ। তারা প্রয়োজনের তুলনায় বহুগুণ বেশি অর্থ খরচ করে হলেও ব্র্যান্ডের জিনিসটির পেছনে ছোটে। আর বাজার ব্যবস্থায় অসাম্যের সৃষ্টি হয়। উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রায় সমান খরচ করেও একটি সাধারণ ব্র্যান্ড যে পরিমাণ লাভ করে, একটি নামকরা ব্র্যান্ড তার থেকে অনেক বেশি লাভ করে। সাধারণ ব্র্যান্ডটি ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে এবং একসময় সে প্রতিযোগিতা থেকে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এভাবে নামকরা ব্র্যান্ডের আধিপত্যের কারণে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনা সাধারণ ব্র্যান্ডগুলো। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ থরস্টেইন এর তত্ত্ব হলো-


"বিলাসদ্রব্যের দাম যদি কমানো হয় এবং সেগুলো যদি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ভেতরে চলে আসে, তাহলে সেগুলো আর 'এক্সক্লুসিভ' থাকে না, ধনশালীরা নিজেদের "স্ট্যাটাস" প্রদর্শনের জন্য আর সেগুলো কিনতে উৎসাহী হয়না।"

ধনীদের হাতে অঢেল টাকা আছে দেখে তারা তাদের "স্ট্যাটাস" প্রদর্শনের জন্য দুই হাতে টাকা উড়ায়! কিন্তু যাদের সামর্থ্য নেই, তারাও চায় টাকা খরচ করে কোনো নামকরা ব্র্যান্ডের বিলাসদ্রব্য কিনে নিজেদের "স্ট্যাটাস" জাহির করতে! যে মানুষটি ঈদ উপলক্ষ্যে তার ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী নিউ মার্কেট থেকে খুব ভালো ভালো জামাকাপড় কিনতে পারতো, "স্ট্যাটাস" এর সন্ধানে সে চলে যায় বড় ব্র্যান্ডের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শো-রুমে আর সেখানে মূল দামের কয়েকগুণ বেশি দিয়ে জামাকাপড় কিনে। ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষও যখন নামকরা ব্র্যান্ডগুলোর ক্রেতা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে নামকরা ব্র্যান্ডগুলোর তাদের পণ্যের দাম কমানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। ১৯২০ সালে ব্রিটিশ অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ আর এইচ টনি তার "The Acquisitive Society" নামক বইয়ে সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে গেছেন।



যতদিন সমাজের গুটিকতক মানুষের হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ থাকবে এবং তারা তুচ্ছাতিতুচ্ছ দ্রব্যাদি কিনতে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করবে, ততদিন এই অসাম্য দূর হবে না। পুঁজিবাদের শোষণে পিষ্ট তথাকথিত ছদ্ম গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো এমন যে, আগামী কয়েক দশকে বাজারে মামুলি বিলাসদ্রব্যও মূল দামের দশ-পনেরো-বিশ এমনকি একশো গুণ বেশি দামে বিক্রি হওয়া বন্ধের কোনো সম্ভাবনা নেই।


Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]