পুঁজিবাদ বিশ্বকে যেভাবে রক্ষা করছে!



পুঁজিবাদের বীজ রোপিত হয়েছিলো ১৬ শতকের ‘ব্ল্যাক ডেথ’ থেকে। 

 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Black_Death

 

এতে প্রাণ হারিয়েছিলো ইউরোপের ৬০% এর অধিক মানুষ! মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়াদের একটা অংশ পরিবর্তিত সমাজ কাঠামোয় ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছিল। তারা দেশের বাইরেও নিজেদের বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে শুরু করলো। সামন্ত সমাজের পতন ঘটলো; ব্যবসায়ী ও বণিক শ্রেণীর হাত ধরে এলো উপনিবেশবাদ, দাসত্ব এবং সাম্রাজ্যবাদ। ১৮ শতক শুরু হতে হতে ইংল্যান্ডে শিল্পায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। পুঁজিবাদ এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে বড় বড় পুঁজিপতিরা ব্যাপক পুঁজির মালিক হয়ে থাকে। তারা তাদের পুঁজি বিনিয়োগ করে শ্রমিকদের উদ্বৃত্ত শ্রম থেকে অতিরিক্ত মুনাফা আয় করে এবং ধীরে ধীরে আরো ফুলে-ফেঁপে ওঠে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক হয়ে থাকে। বাজারকে অবাধ স্বাধীনতা দেয়া হলে পুঁজিপতিরা ব্যক্তিগত বিনিয়োগ করতে পারে সহজে। ২০০০ সালে পৃথিবীতে বিলিয়ন ডলার অর্থের মালিক ছিলো ৩২২ জন। ২০১৫ সালে সেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছিলো ১৮২৬ জনে! ২০১৮ সালে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ২,৭৫৪ তে! মাত্র ৬৭ জন ব্যক্তি বিশ্বের অর্ধেক সম্পদের মালিক! বাকি অর্ধেক সম্পত্তি নিয়ে অসীম যুদ্ধে মেতে আছে পৃথিবীর সাড়ে সাতশো কোটি মানুষ। ১০০ কোটির অধিক মানুষ প্রতিদিন ২ ডলারের কম অর্থে বেঁচে আছে। এই বৈষম্য পৃথিবীর তাবৎ অপরাধ, যুদ্ধ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, অশান্তির মূল কারণ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক মাইকেল সান্ডেল তার ‘হোয়াট মানি কান্ট বাই: দ্য মোরাল লিমিটস অব মার্কেটস’ বইয়ে দেখিয়েছেন পুঁজিবাদ কীভাবে আমাদের নৈতিকতাকে ধ্বংস করছে।



শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তারক্ষা সহ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রের বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, গণপরিবহন, রাস্তাঘাট, দোকানপাট- সর্বত্র চোখে পড়বে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন সম্বলিত পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ড। বাজার ব্যবস্থা উন্মুক্ত হওয়ায় বড় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো বাজারে পণ্যের দাম আর সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। এই পদ্ধতি থেকে কেবল হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী ছাড়া ছোট ব্যবসায়ী কিংবা নতুন উদ্যোক্তা আর ক্রেতা কেউ লাভবান হয় না। শিক্ষা, চিকিৎসা, ঔষধ থেকে শুরু করে বৈদেশিক ত্রাণ পর্যন্ত পণ্যে রুপান্তরিত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় দর্শকরা পণ্যে পরিণত হচ্ছে, যাদের মিডিয়া মালিকগণ বিভিন্ন স্পন্সরদাতার কাছে বিক্রি করে। প্রযুক্তির কল্যাণে প্রচলিত যোগাযোগ ও উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তিত হতে বাধ্য। পুরাতন উৎপাদনযন্ত্র নতুন উৎপাদনযন্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার সাথে সাথে সেখানকার পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, শ্রমবিভাজন, অর্থনৈতিক বণ্টন, বিলি-ব্যবস্থা সবকিছুতে পরিবর্তন আসে। এসব পরিবর্তন সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কগুলোকে প্রভাবিত করছে। পুঁজিবাদের সমর্থক অনেক দালাল পুঁজিবাদের এরূপ প্রভাবকে 'সৃজনশীল বিনাশ' বলে অভিহিত করে। কিন্তু পুঁজিবাদের খপ্পরে পড়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন আসছে, তা চিরতরে ধ্বংস করে দিচ্ছে নানাবিধ ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ কুটিরশিল্প আর হস্তশিল্পকে। পুঁজিবাদী মিডিয়ার স্রোতে ভেসে যাচ্ছে লোকজ সংস্কৃতি, বাউল গান, মঞ্চ নাটক, যাত্রা আর পালাগানের মতো ঐতিহ্যগুলো। সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে পুঁজিবাদী দেশগুলো তাদের স্বীয় সংস্কৃতি, ধ্যান ধারণা আর দৃষ্টিভঙ্গি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছে। শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশগুলো সহায়তার নাম করে অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নানাবিধ কার্যক্রম চালায়। বিভিন্ন বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান কিংবা নানা এনজিও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনসংখ্যা রোধে পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন মুখরোচক প্রচারণা চালিয়ে আসছে। এসব প্রচারণায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আসছে লক্ষ লক্ষ কন্যা শিশুর প্রাণের বিনিময়ে। প্রতিবছর পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিতে আকৃষ্ট হয়ে বিশ্বে লক্ষাধিক মানব শিশুকে গর্ভপাত করিয়ে হত্যা করছে অশিক্ষিত পরিবারগুলো। এর ফলে নারী-পুরুষের অনুপাতে যে অসামঞ্জস্য দেখা দিচ্ছে, নিউইয়র্ক টাইমস এর নাম দিয়েছে ‘ডটার ডেফিসিট’।

 

https://www.nytimes.com/2009/08/23/magazine/23FOB-idealab-t.html


ইকোনমিস্ট একে অভিহিত করেছে ‘জেন্ডারসাইড’ হিসেবে।

 

https://www.economist.com/leaders/2010/03/04/gendercide


উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে কিছু উৎপন্ন করেনা। কোনো একটি পণ্য ক্রেতা কিনবে কি কিনবে না, তা ক্রেতার মর্জির উপর নির্ভরশীল নয়। উৎপাদনযন্ত্রের মালিকরা যা বিক্রয় করতে চায়, তাই ক্রেতার চাহিদায় পরিণত হয়। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন খরচ ছিল ৫৮১ বিলিয়ন ডলার! বিশ্বের বহু দেশের জিডিপির চেয়েও বড় আকারের অর্থ বিজ্ঞাপনের পেছনে ব্যয় করা হয়। ক্রেতা ভোগে উৎসাহী না হলে কিংবা ক্রেতার চাহিদা না থাকলেও বিজ্ঞাপন, প্রচারণা আর কৃত্রিম চাকচিক্যের মাধ্যমে ক্রেতাকে নিজেদের পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট করে ফেলছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো। একসময় সমাজব্যবস্থা ছিলো সমমাত্রিক, চাহিদা ছিলো সীমিত, উৎপাদন ছিলো পরিমিত, ভোগের পরিমাণ ছিলো কম। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোতে প্রতিটি উৎপাদিত দ্রব্য পণ্যে পরিণত হয়, তৈরি হয় তাদের অর্থমূল্য। উৎপাদনের সাথে মুনাফার নগদ সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার ফলে উৎপাদনযন্ত্রের মালিকগণ চাহিদার চেয়ে অধিক পণ্য উৎপাদন করছে অতিরিক্ত মুনাফার জন্য। আবার উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রির জন্য তারা টাকা ঢালছে বিজ্ঞাপনের পেছনে। সমাজ ভোগবাদী হয়ে গেলে বাজারের চাহিদা আপনাআপনি বৃদ্ধি পেতে থাকে। চাহিদার চেয়ে অধিক গতিতে বাড়ে উৎপাদন এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভোগবাদকে আরেক ধাপ উপরে তোলার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। উৎপাদন যতো বেশি, কাঁচামালের ব্যবহার ততো বেশি, পরিবেশ দূষণের পরিমাণও হয় অনুরূপ। এই ব্যবস্থায় একজন ধনী পুঁজিপতি মৃত্যুকালে তার সম্পদ উত্তরাধিকারীদের কাছে সহজে প্রেরণ করে যেতে পারে। শিক্ষাজীবনে একই শ্রেণীতে একই শিক্ষায় সমরূপ শিক্ষিত হওয়া দু'জন মানুষ যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করে, তখন প্রথমজনের হাতে তার পিতার রেখে যাওয়া ১০ কোটি টাকা পুঁজি থাকলেও দ্বিতীয়জনকে শুরু করতে হবে শূন্য থেকে। প্রতিযোগিতামূলক এবং সরকারি হস্তক্ষেপমুক্ত বাজার অর্থনীতিতে এরকম অসমতা নিয়ে বাজারে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনেকাংশে শেয়ারবাজার, বন্ড, মুদ্রাবাজারের মতো অর্থবাজারের উপর নির্ভরশীল। শেয়ারবাজার বা মুদ্রাবাজার যেকোনো সময়, যেকোনো পরিস্থিতিতে নিম্নমুখী হতে পারে এবং কখনো কখনো বড় রকমের ধ্বস নামতে দেখা যায়। ধ্বসের প্রভাব পড়ে সমগ্র অর্থনীতিতে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, জাতীয় প্রবৃদ্ধি কমে যায়, বেড়ে যায় বেকারত্বের হার। বিশ্ব এরকম অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছিল ১৯৩০ সালে। এরপর আরও বেশকিছু ছোটখাট অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছে বিশ্ব। বাজারের সূচনালগ্নে দেখা গেলো বেশ কয়েকজন ছোট পরিসরের উদ্যোক্তার সাথে প্রতিযোগিতায় নামলো উত্তরাধিকার সূত্রে ব্যাপক পুঁজি লাভ করা কোনো উদ্যোক্তা। এই অবস্থায় বড় পুঁজির উদ্যোক্তার বিপরীতে টিকতে না পেরে দ্রুত বাজার ত্যাগ করবে ছোট পুঁজির উদ্যোক্তারা। ঐ নির্দিষ্ট পণ্যের বাজারে একচেটিয়াত্ব কায়েম হবে। একচেটিয়া বাজারের উৎপাদক নিজের মর্জিমাফিক পণ্যের দাম বৃদ্ধি করতে পারে। বিকল্প না থাকায় ক্রেতারা সেই পণ্য ক্রয় করতে বাধ্য হয়। একচেটিয়া বাজারে একজন বিক্রেতা আর একাধিক ক্রেতা থাকে। অপরদিকে মনোপসনি বাজারে একজন ক্রেতা আর একাধিক বিক্রেতা থাকে। ধরা যাক, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে তিনটি কয়লাখনি আছে। প্রতিটি খনির মালিক একজন। মালিক যদি চায় শ্রমিকের পারিশ্রমিক কমিয়ে দিবে তাহলে সে তা করতে পারে, কেননা শ্রমিকদের নিকট আর কোনো পথ খোলা থাকেনা। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যাপারে মালিক মাথা ঘামায় না যখন মনোপসনি ক্ষমতা পায়। প্রতিটি দেশের সরকার আমলা নিয়োগ, পুলিশ নিয়োগের মতো ব্যাপারগুলোতে মনোপসনি ক্ষমতার চর্চা করে থাকে।


Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]