যে ব্যবস্থা গিলে খাচ্ছে আমাদের
বিলিয়নিয়ারের পরিমাণ বাড়তে থাকা, অর্থনৈতিক মন্দা, দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে সম্পদ বিদেশে পাচার হওয়া, জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষার মান কমতে থাকা, দারিদ্রতা বৃদ্ধি, শরণার্থী সমস্যা, পরিবেশ বিপর্যয়- সবকিছুর জন্য দায়ী হচ্ছে নিওলিবারেলিজম। রাষ্ট্র আর সমাজের কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিকায়ন করে, মানুষের সম্পর্ক নির্ধারণ করে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে, রাষ্ট্রের নাগরিককে পরিণত করে ভোক্তায়, সবকিছুর মূলে স্থাপন করে বাজারকে, মানুষের গণতান্ত্রিক ক্ষমতার চর্চাকে করে কেনাবেচাকেন্দ্রিক! এটি মুক্তবাজারের কথা বলে, সকলের সমান অধিকার নিয়ে প্রতিযোগিতার কথা বলে! এটি বাজার স্বাধীনতার কথা বলে এমন এক ব্যবস্থার সৃষ্টি করে যেখানে দুর্বলদের সাহায্য দিয়ে এগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়, যেখানে সকল প্রকার কর কমিয়ে আনতে হয়, জনসেবামূলক খাতগুলোকে বেসরকারিকরণ করা হয়, যেখানে ট্রেড ইউনিয়নকে দেখা হয় বাজার অর্থনীতির শত্রু হিসেবে! ধনীর যাবতীয় সম্পদ ও সুবিধাকে স্বাভাবিক আর গরীবের অবস্থার জন্য তার ভাগ্য ও অযোগ্যতাকে দায়ী করা হয় এই ব্যবস্থায়! নিওলিবারেলিজম এমন এক বাজারের কথা বলে, যে বাজারে কোনো সরকারি হস্তক্ষেপ থাকবে না। ধরা যাক, বাংলাদেশে কোনো নতুন পণ্যের বাজার খোলা হলো। সেই বাজারে বাংলাদেশী অনেক ছোট উদ্যোক্তার পাশাপাশি অংশ নিলো ভারতের বিলিয়নিয়ার কিছু ব্যবসায়ী। বাজারে যদি সরকারি হস্তক্ষেপ না থাকে, তাহলে ভারতীয় বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ীদের সামনে বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা টিকতে পারবে না। বিলিয়নিয়াররা তাদের বিপুল পুঁজির কল্যাণে অধিক মানসম্পন্ন পণ্য অল্প খরচে উৎপাদন করতে পারবে, পণ্য অধিক বিক্রির জন্য দিবে নানা অফার। এমন অবস্থায় ছোট ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে সরকার বিদেশী ব্যবসায়ীদের পণ্যে অধিক করারোপ করে যেন সেই পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায় এবং ক্রেতারা দেশীয় পণ্যের দিকে ঝোঁকে। এই ব্যবস্থা সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ রাখে না। ফলে ছোট ব্যবসায়ীদের বাজার ছেড়ে দিতে হয়! এই ব্যবস্থায় জাকারবার্গের অঢেল সম্পত্তির জন্য মেধার প্রশংসা করা হয়, আর ব্যর্থতার কারণে আত্মহত্যা করা মানুষকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। অথচ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষগুলো পর্যাপ্ত শিক্ষা, পরিচর্যা, শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ পেলে তাদের অবস্থার পরিবর্তন হতো। কাঠামোগত সমস্যাকে চিহ্নিত না করে বেকারত্বের জন্য তরুণদের উপর অযোগ্যতার দায় চাপায় এই ব্যবস্থা। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী, বাড়িভাড়া, পরিবহন ভাড়া সবকিছুর বৃদ্ধি আর বেতন স্থির থাকার পর যখন মধ্যবিত্ত সমাজ সঞ্চয় করতে ব্যর্থ হয়, নিওলিবারেলিজম বলে এটি তাদের অপরিণামদর্শিতার ফল! এগিয়ে যাওয়া মানুষগুলো এই ব্যবস্থায় পিছিয়ে পড়াদের সাহায্য করতে হাত না বাড়িয়ে অসীম প্রতিযোগিতার এই সমাজে নিজেকে কতদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই চিন্তায় মত্ত থাকে। পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো যখন হতাশ হয়ে বিষণ্ণতায় ভোগে এবং কেউ কেউ আত্মহত্যা করে, এই ব্যবস্থা তাদের ‘লুজার’ বলে আখ্যায়িত করে! পল ভারহেগ তার বই ‘হোয়াট অ্যাবাউট মি’-তে লিখেছিলেন, "বিষণ্ণতা, একাকিত্ব, উদ্বেগ, হতাশাসহ নানাবিধ মানসিক ব্যাধিও নব্যউদারবাদের ফসল।"
নিওলিবারেলিজম অর্থনৈতিক কাঠামোর সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ ব্রিটেনকে বলা হয় ‘ইউরোপের একাকিত্বের রাজধানী’! ১৮৯৮ সালে এক ইতালিয়ান অর্থনীতিবিদ ইতালির অর্থনৈতিক অবস্থাকে বোঝাতে প্রথম "নিওলিবারেলিজম" শব্দটি ব্যবহার করেন। নিওলিবারেলিজম একটি অর্থনৈতিক ভাবধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৩৮ সালে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত ‘ওয়াল্টার লিপম্যান কনফারেন্সে’ লুডভিগ মাইজেজ এবং ফ্রেডরিখ হায়েকের বক্তৃতায় নিওলিবারেলিজম প্রথম এর আনুষ্ঠানিক আকৃতি পায়। তারা ঐ সম্মেলনে ব্রিটেনে রুজভেল্টের হাত ধরে ‘সামাজিক গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা এবং কল্যাণ রাষ্ট্রমুখী চিন্তাভাবনাকে নাম দেন ‘কালেক্টিভিজম’, যার সাথে নাৎসি জার্মানির সামঞ্জস্য দেখানো হয়! ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয় হায়েকের ‘দ্য রোড টু সার্ফডম’, যেখানে দাবি করা হয় প্রচলিত ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করা হয় এবং রাষ্ট্রকে সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়!
ব্রিটেন আর আমেরিকার ধনীরা লক্ষ্য করলো হায়েকের ব্যবস্থার সমর্থন করলে তারা কর ও অন্যান্য সরকারি সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে! সর্বপ্রথম ‘মন্ট পেলেরিন সোসাইটি' নিওলিবারেলিজমের প্রচারণা প্রত্যক্ষভাবে শুরু করে।
সংগঠনটি সমাজের সর্বোচ্চ ধনীদের অর্থায়নে চলতো! প্রথমে এটি বিশ্বব্যাপী নিওলিবারেলিজমের সমর্থকগোষ্ঠীকে সংযুক্ত করলো, যাদের মাঝে বড় বড় ব্যবসায়ী ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর নামকরা সাংবাদিকরা ছিল। পরের ধাপে আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট, হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, কাটো ইনস্টিটিউটের মতো আরো বেশ কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন করলো এই সংগঠন যেন নতুন সৃষ্ট এই অর্থনৈতিক ধারা নিয়ে আরো গবেষণার করা হয়।
https://www.aei.org/
https://www.heritage.org/
https://www.cato.org/
এতকিছুর পরও জন মেনার্ড কেইনসের অর্থনৈতিক ভাবাদর্শের কাছে কোণঠাসা হয়ে ছিলো এই নতুন মতবাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপের যুদ্ধপীড়িত দেশগুলোর পাশাপাশি আমেরিকা অর্থনৈতিক মুক্তির সমাধান খুঁজে পেলো কেনেসিয়ান অর্থনীতিতে। একসময় একটি শক্তিশালী ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে শুরু করে নিওলিবারেলিজম। সত্তরের দশকে কেনেসিয়ান অর্থনীতির ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়ে দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দা। সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য বিকল্প প্যাকেজ হিসেবে প্রস্তুত হয়ে ছিলো নিওলিবারেলিজম। যুক্তরাষ্ট্রে জিমি কার্টার সরকার প্রথমবারের মতো সেই প্যাকেজে হাত দেয়। সম্পূর্ণ নিওলিবারেলিজম অর্থনৈতিক কাঠামো গ্রহণ না করলেও তিনি প্যাকেজের বেশ কিছু নীতি গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে সিআইএ’র প্রত্যক্ষ সহায়তায় চিলির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দেকে ক্ষমতাচ্যুত করে গদিনসীন হয় জেনারেল পিনোশে। মার্কিনিদের ইচ্ছা ছিলো পিনোশের মাধ্যমে সেখানে নিওলিবারেলিজমের বৃহৎ পরিসরে পরীক্ষা চালানো। চিলির অর্থনৈতিক কাঠামো আমূল পাল্টে দিল পিনোশে। পিনোশের ক্ষমতা গ্রহণে ভীত হয়ে পড়েছিলো দেশের মানুষ। এমতাবস্থায় বাজার ব্যবস্থায় নিওলিবারেলিজমের আগমনে সর্বসাধারণের মাঝে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। কোনো দেশের চূড়ান্ত সংকটের মুখে যখন মানুষের সকল মনোযোগ সেই সংকটের দিকে থাকে, তখন নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো বসিয়ে দেয়াকে নাওমি ক্লেইন ‘শক ডকট্রিন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
শক ডকট্রিন প্রয়োগের মাধ্যমে চিলি হয়ে যায় নিওলিবারেলিজম অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করা প্রথম দেশ। ৮০’র দশকে ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচার এবং আমেরিকায় রোনাল্ড রিগ্যান ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের দেশকে পরিপূর্ণ নিওলিবারেল করে তোলার ঘোষণা দেন। শুরু হলো ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার, ব্যাপক হারে কমে গেলো কর, বাজার ব্যবস্থায় সরকারি আইনকানুন শিথিল কিংবা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিলুপ্ত হলো, সকল প্রকার জনসেবামূলক কাজ বেসরকারিকরণ করা হলো। বিশ্বব্যাপী শুরু হলো আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর তৎপরতা, যারা দরিদ্র আর উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিওলিবারেলিজমের ছায়াতলে নিয়ে আসার জন্য কাজ শুরু করে। মাসট্রিশট ট্রিটি’র মাধ্যমে ইউরোপে ছোঁয়া লাগলো এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার।
নিওলিবারেলিজম বাজার অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনে, বেসরকারিকরণ, সরকারি ভর্তুকি হ্রাস, কর ব্যবস্থার সংস্কার ও সংকোচন, মুক্তবাজার, অবাধ ব্যক্তিমালিকানার অধিকারসহ নানাবিধ একমুখী অর্থনৈতিক সংস্কারের সমর্থন করে। স্বাধীনতার নাম করে দেশে দেশে বাজারগুলো দখল করতে থাকলো গুটিকয়েক বিত্তশালী দেশের বড় বড় কোম্পানি ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। যেখানে দেশীয়ভাবে নয়া এই নীতির প্রয়োগ সুবিধাজনক হচ্ছিলো না সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে নানাবিধ অর্থনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করা হলো, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আদালত তৈরি হলো যেগুলো দ্বারা দেশীয় কাঠামোকে চেপে ধরা যায়। কোনো দেশের সংসদ যখন বহিরাগত পণ্যের উপর করারোপ করতে চাইলো, জ্বালানির মূল্য সহনীয় মাত্রায় রাখতে বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর আইন প্রয়োগ করতে চাইলো, দেশীয় খনিজ সম্পদ বিদেশী প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করলো, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বহুজাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করে সংসদকে হার মানতে বাধ্য করলো। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, রেলের মতো সরকারি জনসেবামূলক খাতগুলোকে বেসরকারিকরণ করে সেগুলোতে বৈশ্বিক পুঁজিপতিদের টোল ওঠানোর সুযোগ করে দিয়েছে নিওলিবারেলিজম। এই টোল শুধু জনগণ দিচ্ছে না, সরকারও দিচ্ছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এর ফলে একটি দেশের সামগ্রিক সম্পদ ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। সরকারকে একটি বড় প্রজেক্টের কাজ করে দিয়ে বছরের পর বছর বিভিন্ন শর্তে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে বিদেশী কোম্পানিগুলো। একারণে রেলের মতো পরিবহন খাত আর তেল-গ্যাসে মোটা অংকের লোকসান গুনতে হয় সরকারকে। নব্যউদারবাদী ব্যবস্থায় ছোট-বড়, দেশী-বিদেশী, সকলের জন্য সম শর্তের বাজার ব্যবস্থায় সকল প্রতিযোগীকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যায় বিদেশী বিত্তবান প্রতিযোগী। এরূপ একচেটিয়াত্ব বৈশ্বিক সম্পদকে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে আবদ্ধ করে দিচ্ছে। মেক্সিকোর কার্লোস স্লিম বেসরকারিকরণের সময় মেক্সিকোর সিংহভাগ টেলিফোন আর মোবাইল নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ পান এবং কয়েক বছরের মধ্যে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন। নিওলিবারেলিজম ভোটের ক্ষমতাকেও সংকুচিত করে এনেছে। এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ক্ষমতা কমে আসছে, সব চলে যাচ্ছে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান আর ধনী ব্যবসায়ীদের হাতে। নির্বাচন আর ভোট এখন কেনাবেচা হয়। অধিক ক্রয় ক্ষমতাসম্পন্ন ধনী ব্যবসায়ী শ্রেণী নিয়ন্ত্রণ করছে নির্বাচন ব্যবস্থা, বেছে নিচ্ছে এমন কোনো সরকার যারা তাদের স্বার্থে কাজ করবে। দিন দিন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণী তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। ফলে সরকারগুলো জনগণের সাথে নৈতিকভাবে সম্পর্কচ্যুত হয়, প্রশাসন আর আমলাতন্ত্র দুর্নীতিগ্রস্ত হয় এবং আমলাতন্ত্র নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে জনবিচ্ছিন্ন সরকারকে সমর্থন দিয়ে পুনরায় নির্বাচিত করে, সৃষ্টি হয় একদলীয় শাসন কাঠামো। তুরস্ক, মিসর এই অবস্থার সর্বোত্তম উদাহরণ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী সমাজ- সর্বত্র রয়েছে এই ব্যবস্থার সমর্থক, যাদের কলম এই ব্যবস্থার সমর্থনে সরব! ইনস্টিটিউট অব ইকোনোমিক অ্যাফেয়ার্স বরাবরই নানা যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে তামাকশিল্পের উপর সরকারি আইন কঠোর হলে তামাকশিল্প অধিক বিকশিত হবে, মানুষ বেশি মাত্রায় ধূমপায়ী হবে।
https://iea.org.uk/
২০১৪ সালে ফাঁস হয়ে যায় ১৯৬৩ সাল থেকে তামাকের পক্ষে ইতিবাচক গবেষণার জন্য ‘ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো’ অর্থায়ন করে আসছে আইইএ'কে!
নিওলিবারেলিজম মুক্তবাণিজ্য আর বিশ্বায়নের প্রচারক। মুক্তবাণিজ্য ও বিশ্বায়নের সুযোগ কাজে লাগিয়ে বৈদেশিক কর, কোটা ও অন্যান্য সরকারি শর্ত ছাড়া উন্নত দেশের বড় বড় বহুজাতিক কর্পোরেশন ও কোম্পানি প্রবেশ করছে অনুন্নত আর উন্নয়নশীল দেশের বাজারে। এদের প্রভাবে সেখানকার বাজারে প্রাযুক্তিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন আসলেও সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে কর্পোরেশনগুলো। নিওলিবারেলিজমের সুযোগ নিয়ে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়া ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো সেসব দেশের স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। আইএমএফ আর বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বব্যাপী নিওলিবারেলিজমের মূল প্রচারক, যারা বিভিন্ন দেশের সাথে শর্তাধীন বাণিজ্যের মাধ্যমে সেসব দেশের বাজার দখল করে নিচ্ছে। নিওলিবারেলিজমের বড় সফলতা হিসেবে ধরা হয় অসীম ব্যক্তি স্বাধীনতাকে। এই স্বাধীনতা বাজার ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, শিক্ষা থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সংস্কৃতিতে নিওলিবারেলিজম কর্তৃক কোনো বিদেশী সংস্কৃতি ও ভাবধারার অবাধ প্রবেশাধিকার দেয়ায় দেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিদেশী সংস্কৃতি, বিশেষ করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে দেশী সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটছে, যাকে নিওলিবারেলরা ‘আধুনিকায়ন’ বলে অভিহিত করে। একইভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানায় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠায় জনসেবামূলক এই খাতটি লাভজনক বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিযোগিতামূলকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুনত্ব আনয়ন করলেও কাজটি করছে বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের চেয়ে অধিক সুবিধা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। চিকিৎসা খাত ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়ার পর প্রচুর বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে ওঠায় সরকার এই খাতে যতটা মনোযোগ দেয়া উচিত ততটা দিচ্ছে না। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যেসব উন্নত প্রযুক্তি আসছে, তা আসছে না সরকারি হাসপাতালগুলোতে। একই রোগে কেউ সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করছে, কেউ বেসরকারি হাসপাতালে মোটা অংকের অর্থ খরচ করে আরোগ্য লাভ করছে। বেসরকারি ক্লিনিকে অধিক আয়ের আশায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের দায়িত্বে অনীহার অভিযোগ অতি সাধারণ ঘটনা। বিশ্বজুড়ে অনুষ্ঠিত হওয়া সুন্দরী প্রতিযোগিতাগুলো নিওলিবারেলিজমের ফসল। এসব প্রতিযোগিতায় নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে বলে গলা ফাটানো হলেও আদতে এর মাধ্যমে নারীকে যৌন সুড়সুড়ি দানের পুতুল হিসেবে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মিডিয়া ও পণ্যের মালিকরা। ভারতে ৯০’র দশকে নিওলিবারেলিজম ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিলো নরসীমা রাওয়ের সরকার কর্তৃক।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/P._V._Narasimha_Rao
আর ৯০’র দশকে ঐশ্বরিয়া রাই, লারা দত্ত, প্রিয়াংকা চোপড়াসহ মোট ৬ জন ভারতীয় নারী বিশ্বসুন্দরী নির্বাচিত হয়! এর আগে ভারত থেকে কেবল ১৯৬৬ সালে রিটা ফারিয়া জিতেছিলেন এই খেতাব। নিওলিবারেলিজম গ্রহণের সাথে সাথে বিশ্বের বড় বড় ভোগ্য পণ্য উৎপাদনের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ১০০ কোটি ক্রেতার বাজার তৈরি হয় ভারতে। এই বাজারে পণ্য বিপণনের জন্য প্রয়োজন ছিলো মডেল। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ভারত থেকে একাধিক সুন্দরী নির্বাচিত করে পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিজ্ঞাপনের মোড়ক তৈরি করে দেয় সুন্দরী প্রতিযোগিতা। মিডিয়া এসব তারকার তারকাখ্যাতি কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞাপন থেকে প্রচুর আয় করে নিতে পারে, পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য বিক্রয় করতে পারে, আর সুন্দরী প্রতিযোগিতাগুলো দেশে বিদেশে প্রচুর স্পন্সর পায়। আর সাধারণ ক্রেতারা তারকাদের কৃত্রিম চাকচিক্যে মোহাচ্ছন্ন হয়ে কষ্টার্জিত অর্থ অপ্রয়োজনীয় ভোগে খরচ করে নিজেদের জীবনমান উন্নয়ন করতে ব্যর্থ হয়। একচেটিয়া বাজারে সকল পণ্যের দাম মালিকের ইচ্ছাধীন হয়ে যায়। প্রতিযোগী না থাকায় পণ্যের মান নিয়ে মাথা ঘামায় না মালিক। নিওলিবারেলিজম উন্নয়নের সংজ্ঞায়ন করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তিতে। একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়নের চিত্র ঢাকা পড়ছে প্রবৃদ্ধির নিচে। এই ব্যবস্থায় সম্পদের প্রবাহ সর্বদা ধনীদের দিকে থাকে এবং একটি দেশে কেবল ধনীরা আর তাদের গড়া বেসরকারি ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার হিসাব প্রবৃদ্ধিকে স্বাস্থ্যবান করে।
Comments