শিশুদেরও ছাড় নেই
বর্তমানে সমগ্র দুনিয়াতে বিনোদনের জকি হিসেবে কাজ করছে যেসব শিশু তাদের প্রায় সকলে কাজ করছে স্বেচ্ছায়। তারা জানেও না কীভাবে তারা মিটাচ্ছে অন্যের বিনোদনের খোরাক। ব্যক্তির চালচলন, কথাবার্তা, আচরণের মাধ্যমে তার সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে গুরুজনকে ‘আপনি’, ঘনিষ্ঠজনকে ‘তুমি’ এবং বয়োঃকনিষ্ঠদের ‘তুই’ বলে সম্বোধন করা হয়। পূর্বে সন্তানরা তাদের বাবা-মায়েদের ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করবে এমনটাই স্বাভাবিক ছিল। বর্তমানে উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে সন্তানদের সাথে পিতা-মাতার ঘনিষ্ঠতার দরুন তা ’তুমি’তে পরিণত হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে সংস্কৃতি বদলে যায়। যেকোনো নতুন কিছুকে যদি একটি অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের অংশ করে নেয় তবে কালের বিবর্তনে তা সেই সংস্কৃতির অংশ হয়ে যেতে পারে। সে কারণেই পুঁজিবাদীদের মূল টার্গেটে রয়েছে শিশুরা। শিশুদের যা শেখানো হবে পরবর্তী সময়ে তারা সেই পথেই যাবে। যদি আজকের শিশুদের মধ্যে ভোগের সংস্কৃতি তৈরি করা যায় তাহলে তো কথাই নেই! শিশু জটিলতাকে সাথে নিয়ে জন্ম নেয় না। জন্মানোর পর ধীরে ধীরে সেগুলোর সাথে পরিচিত হয়। তাই প্রাপ্তবয়স্কের তুলনায় তার স্বার্থবোধ কম থাকে। তারা তাকেই ভালো বলে, যা কিছুকে তারা ভালভাবে গ্রহণ করতে শেখে। যা কিছুকে অপছন্দ করে তাকে বলে খারাপ। কোমলমতি শিশুদের এই সরলতা কর্পোরেট গ্যাংদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে। টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে শিশুদের সারল্যকে ব্যবহার করে সার্বিক সারলিকীকরণের বাণিজ্য চলছে। নিষ্পাপ শিশুদের মাধ্যম করে চলছে মানুষের বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা। কারণ ঐ মুনাফা! বিজ্ঞাপন দেখে ছোট্ট শিশুটিকেও পেয়ে বসছে স্টারডমের নেশা। টেলিভিশন চিত্রের পণ্যটির চাহিদা তৈরি হচ্ছে তার নিজের মধ্যেও। মুনাফাবাজরা বুঝে গেছে, প্রাপ্তবয়স্করা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও শিশুরা পারে না। বাবা-মায়েদের বাধ্য হয়ে শিশুর আবদার পূরণ করতে হয়। তাদের চোখে একটি শিশুর জন্ম মানে একটি ভোক্তার জন্ম। শিশুদের মধ্যে ভোগের সংস্কৃতি চালু করতে পারলে তা চলবে আরও যুগ-যুগান্তর ধরে। এতে লাভবান হবে মুনাফাবাজরা। টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন মানেই শিশুদের ছড়াছড়ি। টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রচারিত হচ্ছে রিয়েলিটি শো’র নামে বিভিন্ন নাচ-গানের অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানে প্রতিভা বিকাশের নামে চলছে শিশুদের অবাধ পণ্যায়ন। অভিভাবকরা মনে করছে, আমার সন্তান নাচ-গান নিয়ে ব্যস্ত থাকলে সে রাজনীতি কিংবা মাদকমুক্ত থাকবে। কিন্তু এসব অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ঘটছে তার উল্টোটা। শিশুদের মধ্যে তৈরিকৃত প্রতিযোগিতার নেশা বিধ্বংসী রুপ ধারণ করছে। কেউ কেউ চাপ সহ্য করতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। শিশুদের নাচ-গান করতে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা তখনই তৈরি হয় যখন তা বাণিজ্যিক উদ্দেশে করা হয়। শিশু যখন প্রাপ্তবয়স্ক কোনো নায়িকার পরিবর্তে নিজেকে উপস্থাপন করে কোনো গানের দৃশ্যায়নের ছলে, তখন তা টিভির সামনে উপবিষ্ট বাকি শিশুদের প্রভাবিত করে। শিশুরা তখন নায়ক-নায়িকার জায়গায় নিজেকে ভাবতে চায় এবং প্রাপ্তবয়স্কের স্থলে শিশুর উপস্থাপনের ফলে সেই ভাবনা শিশুর মধ্যে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পায়। এসবের বাইরেও দর্শক মাতানোর জন্য করা হয় কঠোর সমালোচনা, যার স্নায়ুচাপ সহ্য করতে পারে না অনেক শিশু। পশ্চিমবঙ্গের শিঞ্জিনী সেনগুপ্ত এমন এক প্রতিযোগী যে বিচারকের কঠোর সমালোচনা সইতে না পেরে হারিয়েছিল মানসিক ভারসাম্য। বিভিন্ন স্টুডিওতে অনেক প্রতিযোগীর আত্মহত্যার চেষ্টার মতো ঘটনা রয়েছে প্রচুর। রিয়েলিটি শো'তে শিশুদের প্রাপ্তবয়স্ক করে তোলার চেষ্টার ফলে তাদের মধ্যে অল্প বয়সে তৈরি হচ্ছে যৌনবোধ। অল্প শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত মানুষরা শিশুদের মাধ্যমে মেটাতে চাইছে তাদের সুপ্ত অভিলাষ। ফলস্বরূপ পূর্বের যেকোনো সময়ের চাইতে শিশু ধর্ষণের পরিমাণ বর্তমানে সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। নারীদের আগে থেকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সেই তালিকায় বর্তমানে শিশুদের কাজ করতে হচ্ছে মুনাফার জকি হিসেবে। শিশুরা অবশ্যই তাদের পছন্দমতো নাচ-গান শিখবে। কিন্তু যখন তা হয়ে যায় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে, তখন তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অস্ট্রেলিয়ান এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব রিয়েলিটি অনুষ্ঠান দেখার ফলে শিশুদের জীবন স্বাভাবিক শিশুদের মতো থাকে না; তাদের মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়সে জন্মায় যৌনতার অনুভূতি যা যেকোনো শিশুর জন্য ক্ষতিকর এবং বিপদজনক। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় শিশুরা নাম, খ্যাতি, পণ্যকে নিজেদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো লক্ষ্য ভাবতে শুরু করে, ফলে ব্যাহত হয় তার স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা। অস্ট্রেলিয়ায় এসব কর্পোরেট লুটেরাদের দ্বারা শিশুদের পণ্যায়নের বিরুদ্ধে নীতিমালা রয়েছে, যেখানে বলা হয় শিশুদের সম্প্রচারের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে প্রচারে কোনোভাবেই শিশুদের যৌনসামগ্রী হিসেবে প্রচার করা না হয় এবং এমন অস্বাভাবিক কোনো কিছু প্রদর্শন করা না হয় যা অন্য শিশুরা স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করে। ভারতের মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে দাবী উঠেছে শিশুদের এসব প্রতিযোগিতায় অংশ না নেয়ার। বাংলাদেশে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ এসবের ব্যাপারে স্পষ্ট বিধিবিধান আরোপের কথা বললেও সংখ্যাটা নিতান্তই কম হওয়াতে তা সরকারের টনক নড়াতে পারেনি।
Comments