ব্যক্তি স্বাধীনতা


পুঁজিবাদীরা ধার্মিক-অধার্মিক সবার মাথার মধ্যেই 'ব্যক্তি স্বাধীনতা'র ভূত ঢুকিয়ে দিয়েছে ভালোমতোই। ভারতে যখন মুসলিমদের তিন তালাক প্রথার বিরুদ্ধে আইন হলো তখন বাংলাদেশের অনেক মুসলিম বললো যে এটা নাকি ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশের এক স্কুলে কিংবা বিদেশের কিছু স্কুলে বোরখা পড়তে বাধা দিলে ওটাও এদের কাছে ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। আবার বাংলাদেশে হিন্দু নারীদের সম্পত্তিতে সমান অধিকারের আইন করার প্রস্তাব উঠলে ধর্মীয় নেতারা একই অজুহাত দেখালো। বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর নির্যাতনের ঘটনায় ভারতের কিছু রাজনৈতিক নেতা কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভুলে বাংলাদেশ আক্রমণের হুমকি দিয়েছিল। ধার্মিকদের দাবী অনুযায়ী, ধর্মগুলো যার যার সম্প্রদায়ের সব সদস্যকে একই পতাকার নিচে ঐক্য ধরে রাখতে সহায়তা করে যা উপরের ঘটনাগুলো থেকেই বোঝা যায়! ব্যাপারটা এবার আরেকটা দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যাক। ভারতে লক্ষ লক্ষ মেয়েকে স্বামীরা এই তিন তালাক প্রথা ব্যবহার করে (এখানে 'অপব্যবহার' শব্দটা বেমানান, কারণ ধর্মীয় নিয়মই শোষণের সুযোগটা করে দিয়েছে) অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে আরেকটা বিয়ে করেছে, এই মহিলাদের ভরণপোষণ পর্যন্ত দেয়নি এদের স্বামীরা। অন্যদিকে হিন্দু নারীদের সম্পত্তিতে সমান অধিকার দিলে তো মেয়েদের আর পায়ের নিচে রাখা যাবে না! একজন নারী তখনই নিজেকে স্বাধীন হিসেবে দাবী করতে পারে, যখন সে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে পারে। পিতা কিংবা স্বামীর টাকায় বিলাসিতা করা নারীরা পরগাছার সমতুল্য। এই ভোগবাদী সমাজে বহু নারীকে পিতা কিংবা স্বামীর অর্থে বিলাসী দ্রব্য কিনে সেটা ঐ নারীর মতো সমমনা অন্য নারীদের শো অফ করতে দেখা যায়। পিতা কিংবা স্বামীর বিশাল পৃথিবীতে এখানে তার নিজের সত্তার জন্য এক টুকরো জমি রইলো কোথায়? তলস্তয় এর 'সাড়ে তিন হাত জমি' গল্পটার কথা মনে পরে গেলো। এবার আসা যাক বোরখার ক্ষেত্রে 'ব্যক্তি স্বাধীনতা'র যুক্তি দেয়া ব্যক্তিদের প্রসঙ্গে। একটা পুরো স্কুলের শিক্ষার্থীরা ড্রেস কোড অনুসরণ করবে আর কয়েকজন বোরখা পড়বে! ব্যাপারটা অন্যভাবে চিন্তা করা যাক, একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাচ্চারা সবাই খেলছে আর একটা মাত্র বাচ্চা মন খারাপ করে বসে আছে অন্যদিকে, তাকে কেউ খেলায় না নেয়ার কারণে। এক্ষেত্রেও ঐ শিক্ষার্থীরা তাদের অন্য সহপাঠীদের সাথে মিশতে অস্বস্তিবোধ করতে থাকবে। আরও কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। ধরা যাক, কোনো উচ্চাভিলাসী মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের ছেলে কিংবা মেয়েকে সাধারণত উচ্চবিত্তদের সন্তানরা পড়ে এমন কোনো ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়াচ্ছে। ঐ সন্তান যদি তার কোনো উচ্চবিত্ত সহপাঠীর পার্টির নিমন্ত্রণে যায়, সে স্বভাবতই অস্বস্তিবোধ করবে। উপরের কথাগুলো পড়লে যে কেউ বুঝবে যে 'ব্যক্তি স্বাধীনতা', 'ধর্মীয় স্বাধীনতা' কিংবা 'সম্প্রদায়ের ঐক্য' এক্ষেত্রে অজুহাত ছাড়া আর কিছু না, আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে মগজ ধোলাই করে শোষণের রাস্তাকে যুগের পর যুগ ধরে বৈধতা দিয়ে যাওয়া। অনলাইনের তথাকথিত মুক্তমনারা মাদ্রাসার শিক্ষার্থী কিংবা বাংলা মিডিয়ামের পশ্চাৎপদ মানসিকতার শিক্ষার্থীদের টিটকারি দেয়। এসব আচরণ তাদের নিজেদেরই অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু না, কারণ তারা আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করতে অক্ষম। অনলাইনে পরিচয় লুকিয়ে দুই লাইনের টিটকারি দিয়ে এরা ভাবে যে, বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে! মৌলিক অধিকারগুলো যখন রাষ্ট্র পূরণে ব্যর্থ হয়, তখনই রাষ্ট্র মৌলিক অধিকারের খাতগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়। তাছাড়া তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলো ঋণ নেয়ার সময় বিশ্বব্যাংক কিংবা আইএমএফ এর মতো সংস্থাগুলোর এই শর্তটি মানতে বাধ্য হয় যে, হয় সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে নতুবা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। আদমজী জুট মিল ছাড়াও আরও অনেক কারখানা এই শর্তের কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মাদ্রাসায় সাধারণত নিম্নবিত্ত, এতিম বাচ্চারা পড়ে কিংবা মা-বাবা তাদের বুকের ধনকে মাদ্রাসায় দিয়ে দিতে বাধ্য হয় এই আশায় যে তাদের সন্তান অন্তত খাবারটা পাবে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ধর্মের দোহাই দিয়ে সামাজিক অনাচার বহু যুগ আগে থেকেই বিদ্যমান থাকলেও বোমাবাজি কিংবা এই ধরনের নৃশংস পর্যায়ে ধর্ম চর্চার সংস্কৃতি এদেশে ছিল না। অধিকাংশ দরিদ্র মানুষ যারা সন্তানকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে, তারা এই কাজটা করে দারিদ্রতার কারণেই। এসব মাদ্রাসার ভেতরের প্রকৃত চিত্র ভয়াবহ। ইংরেজি মিডিয়ামের স্কুলের মতোই এসব মাদ্রাসায় অনেকগুলো বই ধরিয়ে দেয়া হয় বাচ্চাদের। একটা ছয়-সাত বছরের বাচ্চা যে কিনা নিজের মাতৃভাষার অক্ষরও ঠিকমতো শিখতে পারেনি, ঐ বয়সেই তাকে আরবিতে বাক্য লিখতে আর পড়তে দেয়া হয়! আর না পারলেই অমানুষিক নির্যাতন, আর রাতে যৌন নির্যাতনের ঘটনা তো ওপেন সিক্রেট। বিএনপি সরকারের সময়ে ভুয়া মাদ্রাসার অস্তিত্ব দেখিয়ে সরকারি সহায়তা ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য থেকে ডোনেশন আনা হতো। সেসময়ের পত্রপত্রিকায় এই ব্যাপারে অনেক লেখালেখি হয়েছিল। তাছাড়া ব্যক্তিগত ডোনেশন এর অপব্যবহারও মাদ্রাসাগুলোতে অনেক বেশি। বাচ্চাদের নিম্ন মানের খাবার সরবরাহ করে নিজেদের আখের গোছানোর অভিযোগও মিডিয়ার সামনে এসেছে। এসব মাদ্রাসায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই তো দূরের কথা, সামান্য সংবাদপত্র পড়াকেও পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিক্ষার্থীদের মনের বিকাশের জন্য সাংস্কৃতিক চর্চা তো বহু দূরের কথা, কোনো শিক্ষার্থী ড্রয়িং করা অবস্থায় ধরা পড়লে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়; টিভি দেখতে মানা করা হয়। এবার দেখা যাক বাংলা মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা। সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা সরকারি বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোতে পড়ে। এদেশে একটা চাকরির পিছনে ক্যান্ডিডেট আছে শত শত। তাদের নৈতিক শিক্ষার প্রতি জোর দেয়ার পরিবর্তে অভিভাবকরা জোর দেয় জিপিএ ফাইভ এর উপর; তার উপর কোচিং কিংবা প্রাইভেট তো আছেই। উচ্চবিত্তরা আগের রাতে টাকা দিয়ে ভার্সিটির প্রশ্ন পেয়ে গেলেও মধ্যবিত্তরা এখনো কোচিং কিংবা প্রাইভেট এর উপর ভরসা করে তথাকথিত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। অভিভাবকরা জিপিএ ফাইভ না পেলে অন্যদের সন্তানদের উদাহরণ দেখিয়ে নিজের সন্তানদের তিরস্কার করে, এসব উচ্চাভিলাসী মধ্যবিত্ত মা-বাবারা অন্যদের দেখাদেখি সন্তানদের উপর মানসিক পীড়নটা এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, অনেক শিক্ষার্থীই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তাদের সময় কোথায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই পড়ার? একটা দেশের রাষ্ট্র কাঠামোর সামগ্রিক পরিবর্তন না করলে দেশের প্রতিটা অধিবাসীর মুক্তি সম্ভব কি? গণতান্ত্রিক দেশ মানেই কি প্রতিটা নাগরিক এর মৌলিক অধিকার পূরণ হয়ে যাওয়া? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বাধীনতা দেয়া হয় বলেই কি পুঁজিবাদী কিংবা ধার্মিক সবার পছন্দের শীর্ষে এই ব্যবস্থা? কমিউনিজম এই ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে শোষণগুলো হতে দেয় না দেখেই কি পুঁজিবাদী আর ধার্মিকরা এক জোট হয়ে সাম্যবাদের বিরুদ্ধে দিনরাত প্রোপাগান্ডা বানাতে ব্যস্ত থাকে? তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতার যুক্তি মেনে নিলে বলতে হয় ব্রিটিশরা সতীদাহ প্রথা বন্ধ করে ব্যক্তি স্বাধীনতায় কিংবা হিন্দুদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছিল। সতীদাহ করে এক শতাব্দীতে পাঁচ কোটি মেয়েকে (শুধুমাত্র সরকারি হিসাব অনুযায়ী) স্বর্গে পৌঁছে দেয়ার পুণ্যের কাজে বাধা দিয়ে ব্রিটিশরা গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘন করেছে! আর উচ্চবিত্তদের ব্যাপারে কিছুই বলার নেই। তথাকথিত মুক্তমনারা নিজেরাই ভোগবাদী নানা আচরণকে মুক্তির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে উপস্থাপন করে, এক্ষেত্রে উচ্চবিত্তরা 'মুক্তি'র জায়গায় নিছক আনন্দ কিংবা অন্য কোনো শব্দ প্রতিস্থাপন করে। এজন্যই প্রাইভেট ভার্সিটির কোনো শিক্ষার্থীর জঙ্গি কিংবা ধর্ষক হওয়া অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার না। এদেশে বই পড়ার সংস্কৃতি কোনোকালেই ছিল না ব্যাপকভাবে। নব্যউদারবাদ এর প্রভাবে বর্তমানে এটি প্রায় বিলুপ্ত। ব্যক্তি স্বাধীনতা কিংবা তাদের আবিষ্কৃত অন্য টার্মগুলোর দ্বারা মানুষকে মগজ ধোলাই করে ধর্মীয় নেতাদের মতোই পুঁজিবাদীরা বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ সবাইকে অসীম প্রতিযোগিতার যুদ্ধক্ষেত্রে নামিয়ে দিয়েছে। ধর্ম আর পুঁজিবাদ- দু'টোই মানুষকে সামষ্টিক উন্নতির চিন্তা থেকে কৌশলে সরিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক আর চরম স্বার্থপর করে তৈরী করছে। জার্মানির রাজপরিবার তাদের ব্যক্তিগত জমিকে আগের মতো ব্যবহার করতে পারবে কিনা সেই সম্পর্কে ভোটাভুটির ব্যবস্থা করা হয়েছিল; তখন সেখানকার গির্জা ঘোষণা করে যে, এই ধরণের ব্যবস্থা যার দ্বারা রাজপরিবার বঞ্চিত হবে তা খ্রিষ্টীয় শিক্ষার বিরোধী! দাসপ্রথা বিলোপের সময়ও গির্জাগুলো এর বিরুদ্ধাচরণ করেছিল! (অন্য প্রধান ধর্মগুলোর ধর্মীয় গুরুরাও দাসপ্রথার বিরুদ্ধে কিছুই বলেনি। এমনকি বুদ্ধের কাছে রাজা আর দাস মালিকরা আবেদন জানালে বুদ্ধ সৈন্য আর দাসদের ভিক্ষু হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।) পোপ তীব্রভাবে সেসময় সমাজতন্ত্রের নিন্দা করেছিল। আসলে ধর্মীয় নেতা কিংবা পুঁজিবাদী জোঁকের দল নিজেদের স্বার্থেই এই একটা ক্ষেত্রে একে অন্যের আপনজন। আর সেটা হচ্ছে সাম্যবাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা নোংরামি ছড়ানো, যেন বিশ্বের শোষিত আর নিপীড়িতরা চিরকাল তাদের পায়ের নিচে পিষ্ট হয়। তথাকথিত মুক্ত বিশ্ব অধিকাংশ বিজ্ঞানের গবেষণাপত্র ছাড়াও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক কিছু নিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে, সবাইকে ডলার খরচ করে কিনে তারপর পড়তে হয় এসব। এবার দেখা যাক ধার্মিকরা কি করে। পোপ গ্রেগরি দ্য গ্রেট জনৈক এক বিশপকে লেখা চিঠি শুরু করেন এভাবে-

"আমাদের কাছে এমন একটি সংবাদ এসে পৌঁছেছে যে সম্বন্ধে কথা বলতে গেলে লজ্জায় লাল হয়ে উঠতে হয়। আর তা হলো, আপনি আপনার কিছু বন্ধুর কাছে ল্যাটিন ব্যাকরণের ব্যাখ্যা করেছেন।"

নবজাগরণের আগ পর্যন্ত ইউরোপে ল্যাটিন সাহিত্যের উদ্ধার সম্ভব হয়নি! বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষেরও একই ধারণা যে, ধর্ম বিষয়ক বিদ্যা হচ্ছে মোল্লা কিংবা পুরোহিতদের গুপ্ত বিদ্যা; সাধারণ মানুষ পড়লেও সম্পূর্ণ বোঝার ক্ষমতা নেই। সম্পূর্ণ বোঝার একমাত্র যোগ্যতা হচ্ছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে থেকে অধ্যয়ন! এই অযৌক্তিক সংস্কারই অনেককে সুযোগ করে দিয়েছে শোষণের।

সোভিয়েত আমলের সমৃদ্ধ তাজিকিস্তান এর নারীদের তিন তালাকের কারণে বর্তমান ভয়াবহ অবস্থা উপলব্ধি করতে হলে নিচের ভিডিওটি দেখতে হবে-

https://youtu.be/lgDBk2jWNEM


Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]