ভিয়েতনামে মার্কিন বর্বরতা

১৯৫৫-৭৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধে মারা গিয়েছিল প্রায় ৩৭ লক্ষ মানুষ, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল বেসামরিক লোক। ভিয়েতনাম যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন, তাইওয়ান ও থাইল্যান্ডের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল উত্তর ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে। চীন, উত্তর কোরিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবার সহায়তায় সেই শক্তিশালী সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম একীভূত হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর। ১৯৫৫ সালে উত্তর ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, যুক্তরাষ্ট্র কমিউনিস্ট বিরোধী মনোভাবের জন্য দক্ষিণ ভিয়েতনামকে সহায়তা দেয়া শুরু করে। উত্তর ভিয়েতনাম দক্ষিণে তাদের গেরিলা বাহিনী National front for the liberation of South Vietnam গঠন করে এবং তাদের প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক ও সামরিক সমর্থন দেয়া অব্যাহত রাখে। দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি আগে থেকে ছিল, কিন্তু সম্মুখ যুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করে ১৯৬৪ সালে। এর কারণ হিসাবে তারা গালফ অভ তনকিনে আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজ ইউ. এস. এস ম্যাডক্সের ওপর উত্তর ভিয়েতনামের পেট্রোল বোট হামলাকে দায়ী করে। ঘটনাটি সাজানো নাটক হলেও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিনডন বি. জনসন এই হামলাকে আগ্রাসন হিসাবে আখ্যায়িত করে ভিয়েতনাম যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি এবং নিরাপত্তা মন্ত্রী রবার্ট এস. ম্যাকনামারার অপারেশন রোলিং থান্ডার পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। মার্কিন বিমান বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কার্টিস লিমেয় প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বিমান বাহিনী মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কমিউনিস্টদের প্রস্তর যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে! ১৯৬৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অনুমোদন পেলেও যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্র দক্ষিণ ভিয়েতনামকে নিয়ে প্রথম হামলা চালায় মার্চের ২ তারিখ। উভয় বাহিনীর প্রায় ১০০ বিমান ইয়ন বাং এর একটি অস্ত্রাগারে হামলা চালায়। শুরুতে অপারেশন রোলিং থান্ডার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরিচালনার কথা থাকলেও মার্কিন বিমানবাহিনী এবং ইউ. এস মেরিন (প্যাসিফিক কমান্ড) বিমান হামলা প্রায় তিন বছর অব্যাহত রাখে। তিন বছরে মার্কিন বিমানবাহিনী এবং ইউ এস মেরিন ভিয়েতনামে প্রায় ৪০-৮০ লক্ষ টন বোমা ফেলেছিল, যা ছিল সমগ্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বিস্ফোরকের চেয়েও বেশি। প্রেসিডেন্ট লিনডন বি. জনসন আশা করেছিলেন, অপারেশনের চাপে উত্তর ভিয়েতনাম দক্ষিণ ভিয়েতনামের গেরিলা বাহিনী এন. এল. এফ'কে সহায়তা করা বন্ধ করবে। তিনি মার্কিন সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট নো দিন দিয়েনের পরামর্শে উত্তর ভিয়েতনামে বিমান হামলা জোরদার করেন। অপারেশন রোলিং থান্ডারের আগেও মার্কিন বাহিনী ১৯৬১-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু বম্বিং ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে। যেমন- ১৯৬২ সালে প্রেসিডেন্ট জন ফ্রাঙ্কলিন কেনেডি অনুমোদিত অপারেশন র‍্যাঞ্ছ হ্যান্ড। যুদ্ধে সফলতা পাওয়ার জন্য এবং এন. এল. এফ গেরিলাদের আস্তানা ধ্বংস করার জন্য তারা এজেন্ট অরেঞ্জ এবং এজেন্ট ব্লু নামক রাসায়নিক প্রয়োগ করে প্রায় ১০ লক্ষ হেক্টর বনভূমি এবং প্রায় ৬৮০ লক্ষ একর কৃষি জমি বিনষ্ট করে। এখনো ভিয়েতনামে ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেশি, যার জন্য বিশেষজ্ঞরা এসব রাসায়নিক পদার্থকে দায়ী করেন। এসময় মার্কিনীরা 'নাপাম' ব্যবহার করে, যা হতাহতের সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধের সময় উত্তর ভিয়েতনাম থেকে দক্ষিণ ভিয়েতনামে সেনা, রসদ, অন্যান্য সরঞ্জাম পাঠানোর জন্য এন. এল. এফ পরিচালিত হাজার হাজার সুরঙ্গ ছিল। উত্তর ভিয়েতনামে হামলার পাশাপাশি গহীন জঙ্গলে এন. এল. এফের আস্তানাগুলো ছিল অপারেশন রোলিং থান্ডারের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। উত্তর ভিয়েতনাম প্রযুক্তিগতভাবে মার্কিন বিমান বাহিনী থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন উত্তর ভিয়েতনামকে সামরিক সহায়তা দেয়া শুরু করে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিয়েতনাম যুদ্ধে সরাসরি সেনা প্রেরণ না করলেও মার্কিন বিমান বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রযুক্তি এবং অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করা অব্যাহত রাখে। যুদ্ধের সময় ভিয়েতকং বাহিনীকে সহায়তা প্রদান করার জন্য কয়েক হাজার সোভিয়েত সামরিক বিশেষজ্ঞ ভিয়েতনামে উপস্থিত ছিলেন। অপারেশন রোলিং থান্ডারে মার্কিন বিমান বাহিনী এবং মার্কিন মেরিন আলাদা আলাদা অংশ গ্রহণ করলেও তাদের মধ্যে সমন্বয় করার দায়িত্ব ছিল জনসন প্রশাসনের। সমগ্র ভিয়েতনামকে আলাদা আলাদা অপারেশন জোনে ভাগ করা হয়। ১৯৬৫ সালের শুরু থেকে অপারেশন রোলিং থান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয় মার্কিন বিমান বাহিনীর সেকেন্ড ডিভিশন এবং মার্কিন মেরিনের প্যাসিফিক কমান্ডের টাস্ক ফোর্স-৭৭ এর ওপর। ১৯৬৬ সালে সেকেন্ড ডিভিশনের জায়গায় মার্কিন বিমান বাহিনীর সপ্তম বিমানবহরকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়। শুরুতে বিমান হামলার জন্য মার্কিন বিমান বাহিনীর প্রথম পছন্দ ছিল এফ-১০৫ থান্ডারচিফ। অপারেশন রোলিং থান্ডারের ৭৫% বম্বিং এই বিমানটির সাহায্যে করা হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে এই অপারেশনের শেষে মার্কিন বিমান বাহিনীর অর্ধেক এফ-১০৫ ধ্বংস প্রাপ্ত হয়! এফ-১০৫ থান্ডারচিফ বিধ্বস্ত হওয়ার হার অনেক বেশি হওয়ায় মার্কিন বিমান বাহিনী এফ-৪ ফ্যানটম যুদ্ধবিমান ব্যবহার শুরু করে। অপারেশনের শেষের দিকে সকল এফ-১০৫ থান্ডারচিফ যুদ্ধ বিমানকে এই বিমান দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়। ভিয়েতনামের ঝড়-বৃষ্টি প্রবণ আবহাওয়ার জন্য এফ-৪ সুবিধাজনক ছিল না। বি-৫২ ছিল অপারেশন রোলিং থান্ডারে ব্যবহার হওয়া মার্কিন বাহিনীর সবচেয়ে ভারি বোমারু বিমান। যুদ্ধের সময় ভারি বৃষ্টিপাতের সময় যখন এফ-৪ ফ্যানটম বিমানের ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা দেখা যেতো, তখন বি-৫২ বিমান ছিল তাদের প্রধান বিকল্প। ১৯৫০ সালে বাহিনীতে প্রথম সংযোজনার পর থেকে বোমারু বিমানটি এখনো মার্কিন বিমান বাহিনীর অন্যতম ভরসার প্রতীক। (বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৫৮টি বি-৫২ বিমান সক্রিয় দায়িত্ব পালন করছে এবং আরও প্রায় ১৮-৩০টি বিমান রিজার্ভে রাখা হয়েছে।) মার্কিন মেরিন কোরের ব্যবহৃত বিমানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ডগলাস এ-১ স্কাই রেইডার, ডগলাস এ-৪ স্কাইহক (অপারেশানের পর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত) এবং গ্রামেন এ-৬ ইনট্রুডার। শুরুতে ভিয়েতনাম বিমান বাহিনীর প্রধান ভরসার প্রতীক ছিল সোভিয়েত মিগ-১৭ বিমান, যা পরবর্তী সময়ে মিগ-২১ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। মার্কিন বিমান হামলার বিরুদ্ধে তাদের প্রধান অস্ত্র ছিল বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র এএ গান (anti-aircraft) এবং সোভিয়েত স্যাম সিস্টেম (surface to air missile)। স্যাম মিসাইলের ভেতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এসএ-২ গাইডলাইন (SA-2 Guideline) বা এস-৭৫ দিভিনা, যা মার্কিন গুপ্তচর বিমান ইউ-২ ধ্বংসের জন্য বিখ্যাত। স্যাম সিস্টেম অধিক উচ্চতায় উড্ডয়নরত বিমানের জন্য অধিক কার্যকর বিধায় মার্কিন বিমান তুলনামূলক কম উচ্চতায় অপারেশন পরিচালনা করতো, ফলে তারা উত্তর ভিয়েতনামের বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রের সহজ শিকারে পরিণত হয়। প্রযুক্তির দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও অধিকাংশ মার্কিনী ক্ষয়-ক্ষতির জন্য এই বিমান প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়। মার্কিন বিমান বিধ্বংসী স্যাম সাইটগুলো সোভিয়েত জনবল দ্বারা পরিচালিত হতো- এমন তথ্য প্রেসিডেন্ট জনসন প্রশাসনের কাছে ছিল বিধায় তিনি স্যাম সাইটগুলোতে বিমান হামলা চালানোর বিপক্ষে ছিলেন। তার ধারণা ছিল, সোভিয়েত নাগরিকদের মৃত্যুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। আক্রান্ত হওয়া ছাড়া অথবা খুব জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া তিনি এই বিমান প্রতিরোধ ব্যবস্থার উপর পাল্টা হামলা নিষিদ্ধ করেন। উত্তর ভিয়েতনামের চীনের সীমান্তবর্তী অঞ্চল হানয় এবং হাইপং শহরকে বোমা হামলা থেকে মুক্ত ঘোষণা করা হয়। ভিয়েতকং বাহিনী মার্কিনীদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হলেও বছরের পর বছর এই নির্মম বিমান হামলার প্রকৃত ভুক্তভোগী ছিল ভিয়েতনামের সাধারণ জনগণ। ভিয়েতনাম যুদ্ধে বেসামরিক নাগরিক হতাহতের অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে এরিয়াল রেইডকে দায়ী করা হয়। ১৬৯৫ সাল থেকে অপারেশনের শেষ পর্যন্ত মার্কিন বিমান হামলায় প্রতিপক্ষের প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হলেও তাদের নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। তিন বছরের এরিয়াল রেইডে মার্কিন বিমানবাহিনী এবং মার্কিন মেরিন কোরের প্রায় ৭০০-৯০০ বিমান বিধ্বস্ত হয়। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে অপারেশন রোলিং থান্ডার সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয় এবং দু'মাস পর এর আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৮ সালের নির্বাচনে রিচার্ড নিক্সন ক্ষমতায় আসলে তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে সম্মানজনক বিদায় নেয়ার আশ্বাস দেন। ১৯৭২ সালে তিনি নিজেই অপারেশন লাইনব্যাকার নামক নতুন এরিয়াল ক্যাম্পেইন অনুমোদন করেন! ১৯৭৩ সালের ভিয়েতনাম যুদ্ধে ইতিবাচক ফলাফল অসম্ভব বুঝতে পেরে তিনি চুক্তি সম্পন্ন করেন এবং ১৯৭৪ সালের মধ্যে ভিয়েতনাম থেকে সকল মার্কিন কার্যক্রম ও সৈন্য প্রত্যাহার করেন। দক্ষিণ ভিয়েতনামের সামরিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। উত্তর ভিয়েতনাম ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সাইগন দখল করে নিতে সক্ষম হয়। যুদ্ধের যাবতীয় নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মার্কিন বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করেছিল ভিয়েতনামের নিরস্ত্র, নিরপরাধ মানুষদের। শুধু মি লাই গণহত্যা থেকে যেকেউ বুঝতে পারবে পুরো ভিয়েতনামে কি ঘটেছে। ১ম ব্যাটালিয়ন, ২০তম ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট, ১১তম ব্রিগেড ও ২৩তম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন নিয়ে গঠিত ছিল মার্কিন বাহিনীর ‘চার্লি কোম্পানি’। ৪র্থ ব্যাটালিয়ন ও ৩য় ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত ছিল ‘ব্র্যাভো কোম্পানি’। এই দুই কোম্পানি সৈন্যের মিলিত আক্রমণে ভিয়েতনামের কোয়াং নাগাই প্রদেশে ৫০৪ জন নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছিল মার্কিন সেনারা। ১৯৬৮ সালের ১৬ মার্চ, শনিবার সকাল সাড়ে সাতটায় ক্যাপ্টেন আর্নেস্ট মেডিনার নেতৃত্বে চার্লি কোম্পানি থেকে ১০০ সৈন্যের একটি দল পৌঁছায় সনমি গ্রামে। সাথে ছিল কামান ও অস্ত্রসজ্জিত হেলিকপ্টার। সনমি গ্রামটি গড়ে উঠেছিল অনেকগুলো জনবসতি নিয়ে। এগুলোর মধ্যে মি লাই, কো লুই, মি খে, তু কুং এগুলো ছিল বড় বড় জনবসতি। পরিকল্পনা অনুযায়ী সকাল ৮ টায় উইলিয়াম ক্যালির নেতৃত্বে প্রথম প্লাটুন এবং স্টিফেন ব্রুকসের নেতৃত্বে দ্বিতীয় প্লাটুনের সৈন্যরা প্রবেশ করলো তু কুং পল্লীতে। জেফ্রি ল্যাক্রসের নেতৃত্বে তৃতীয় প্লাটুন এবং ক্যাপ্টেন মেডিনার কমান্ড পোস্ট বাইরে রইলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ধানের ক্ষেতে কিংবা ঝোপের আশেপাশে যে কজন গ্রামবাসীকে দেখা গেলো তাদের দিকে গুলি ছুঁড়ে শুরু হলো হত্যাযজ্ঞ।


হ্যারি স্ট্যানলি নামে এক সৈন্য পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় তার সেদিনের আক্রমণ শুরুর অভিজ্ঞতার কথা। প্রথম আক্রমণের ঘটনা হিসেবে সে দেখে এক মার্কিন সৈন্য একটা লোককে বেয়নেট দিয়ে খোঁচা দিলো। কিছুক্ষণ পর সৈন্যটি আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো একটা কুয়ার মধ্যে। তারপর কুয়ার ভেতরে ছুঁড়ে দিল একটা গ্রেনেড। কিছুক্ষণ পর স্ট্যানলি দেখলো পনের-বিশজন মানুষ, যাদের প্রায় সবাই নারী বা শিশু, হাঁটু গেড়ে বসে আছে একটা মন্দিরের পাশে। তাদের সবার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। কাঁদতে কাঁদতে তারা প্রার্থনা করছিল। এরপর প্রত্যেকের মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা হলো। তু কুং ছিল জম ল্যাং নামক পল্লীর মধ্যকার একটি জনবসতি। এই বসতির অধিবাসী ছিল প্রায় ৭০০ জন। এখানে ঢুকে প্রথম প্লাটুনের সৈন্যরা। এক পর্যায়ে তারা জম ল্যাং এর প্রায় ৭০-৮০ জন গ্রামবাসীকে নিয়ে গেলো গ্রামের পূর্বদিকে, যেখানে সেঁচের জন্য বাঁধ তৈরি করা হয়েছিল। তাদের সবাইকে লাথি দিয়ে ফেলা হল বাঁধের মধ্যে। লেফট্যানেন্ট ক্যালি নির্দেশ দিলো তাদের গুলি করতে। নিজেও শুরু করলো গুলি। অনেক নারীর কোলে ছিল শিশু। তারা কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘নো ভিসি, নো ভিসি!’ তারা বলতে চাইছিল তারা ভিয়েত কং এর কেউ নয়। মার্কিন সেনারা এমনভাবে গুলি করে যাচ্ছিলো যেন মায়েরা আর তাদের কোলের শিশুরাও ভয়ঙ্কর শত্রু।


পল মিডলো নামক এক মার্কিন সেনা পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিল সে তার ‘এম সিক্সটিন’ রাইফেলের কয়েকটা ম্যাগাজিন শেষ করে ফেলেছিল গুলি করতে করতে। [এম সিক্সটিন রাইফেলের ম্যাগাজিনে গুলি থাকে ৩০ রাউন্ড] পল মিডলো এই হত্যাকাণ্ডের পুরো সময় জুড়ে লেফট্যানেন্ট ক্যালির পাশে ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে ডেনিস কন্টি নামক এক সৈন্যের কাছ থেকে জানা যায় সেই হত্যাযজ্ঞের করুণতম কাহিনী। সে জানায়, অনেক নারী তাদের শিশুদের উপর শুয়ে পড়েছিল গুলির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। গুলিতে মায়েদের মৃত্যুর পর নিথর লাশগুলোর নীচ থেকে হাঁটতে শিখেছে এমন শিশুরা বেরিয়ে আসছিল। তারা দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই ক্যালি গুলি ছুঁড়ে হত্যা করছিল একে একে। গরু-ছাগলকে পর্যন্ত গুলি করে মেরেছিল সৈন্যরা।

দলের সাথে এসেও কয়েকজন সৈন্য এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়নি। মাইকেল বার্নহার্ড নামক এক সৈন্য ছিল তেমন একজন। সে দলের পেছনের দিকে ছিল এবং জম ল্যাং গ্রামে প্রবেশ করেছিল অনেকের পরে। বার্নহার্ড বলেছিল-

“আমি গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে সৈন্যদের নিষ্ঠুর সব কর্মকাণ্ড দেখছিলাম। তারা মানুষের কুঁড়েঘরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল। এরপর যখন ঘরের ভেতর থেকে লোকজন বেরিয়ে আসছিল, সাথে সাথে গুলি করে মারছিল তাদের। ঘরের ভেতরে ঢুকেও গুলি করছিল কেউ কেউ। কেউ আবার কিছু গ্রামবাসীকে দল বেঁধে দাঁড় করিয়ে তারপর গুলি করছিল। যেদিকেই যাচ্ছিলাম, শুধু লাশ আর লাশ। কিছু সুস্থ জীবন্ত মানুষকে একসাথে দাঁড় করিয়ে তাদের দিকে ছুঁড়ে মারা হচ্ছিল গ্রেনেড। নারী আর শিশু কিছুই বাছবিচার না করে গুলি চলছিল। গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে সৈন্যরা বিন্দুমাত্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি।”

বার্নহার্ড আরও বলেছিল-

“আমাদের পক্ষের দিকে কোনো ক্ষতিই হয়নি। এটা ছিল খুব সাধারণ একটা গ্রাম। বৃদ্ধ বাবা, সন্তান, নারী, শিশুদের নিয়েই যেমন আর দশটা ভিয়েতনামের গ্রাম তেমনই। সত্যি কথা বলতে, আমার মনেই পড়ে না গোটা গ্রামে সৈন্যদের বয়সী একজন পুরুষও দেখেছি কিনা, না জীবিত না মৃত।”

আরেক মার্কিন সৈন্য রোনাল্ড হিবার্লি বলেছিল নিজের চোখে দেখা নারকীয়তার কথা-

“পনের জনের মত মানুষ, যাদের মধ্যে নারী আর শিশুও ছিল, প্রায় একশ গজ দূরে মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আচমকা সৈন্যরা রাইফেল তাক করে গুলি করা শুরু করলো তাদের দিকে। শুধু গুলি নয়, গ্রেনেড লঞ্চার দিয়ে তারা গ্রেনেডও ছুড়তে লাগলো সেই মানুষগুলোর দিকে। যা দেখছিলাম তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।”

দ্বিতীয় প্লাটুনের সৈন্যরা মি লাই এর উত্তরাংশে অভিযান চালিয়ে ৬০-৭০ জনকে হত্যা করে। মাইন আর বুবি ট্র্যাপের মধ্যে পড়ে নিহত হয় এক মার্কিন সেনা এবং আহত হয় সাত জন। প্রথম ও দ্বিতীয় প্লাটুনের অভিযানের পর তৃতীয় প্লাটুনকে নির্দেশ দেয়া হয় বাকি যারা আছে তাদের নির্মূল করার জন্য। তৃতীয় পাটুনের সদস্যরা আরও সাত থেকে বারো জনকে খুঁজে বের করে হত্যা করে। চার্লি কোম্পানির সেনাদের এই হত্যাযজ্ঞ থেকে তিন কিলোমিটার দূরে সকাল সাড়ে আটটার দিকে পৌঁছেছিল ব্র্যাভো কোম্পানি’র সৈন্যদের একটি দল। দলটি আক্রমণ করে কো লুই পল্লীর মি হোই জনবসতিতে। আক্রমণে নিহত হয় অন্তত ৬০-১৫৫ জন মানুষ। পরদিন পর্যন্ত দুই কোম্পানির সৈন্যরা মিলে গ্রামের বাড়িগুলোতে আগুন লাগায়, তাদের জিনিসপত্র নষ্ট করে এবং বন্দীদের উপর নির্যাতন চালায়।

জর্জিয়া সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম থমাস এলিসন বলেছিলেন, সকাল শেষ হতে না হতে চার্লি কোম্পানির সেনারা কয়েকশ বেসামরিক মানুষ হত্যা করেছিল। তারা ধর্ষণ করে অসংখ্য নারী ও কিশোরীকে। সৈন্যরা শত্রুপক্ষের কোনো অস্ত্রের সম্মুখীন হয়নি এবং মি লাই জনবসতিতে কোনো অস্ত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।

হিউ থম্পসন নামক এক পাইলট হেলিকপ্টার নিয়ে সেনাদলের সাথে এসেছিলেন প্রয়োজনীয় সহায়তা করার জন্য। সনমি গ্রামের উপর হেলিকপ্টার নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি মৃত ও আহত মানুষদের দেখতে পান। সেই বাঁধের পাশে তিনি হেলিকপ্টার নিয়ে অবতরণ করেন যেটা ছিল লাশ দিয়ে পরিপূর্ণ। কোথাও কোথাও একটু আধটু নড়াচড়া দেখা যাচ্ছিলো। থম্পসন সেখানে চার্লি কোম্পানির এক সার্জেন্ট ডেভিড মিশেলের কাছে জিজ্ঞেস করেন আহতদের চিকিৎসার জন্য সাহায্য করবেন কিনা। মিশেল উত্তর দেয়, 

"তাদের কেবল মরে যেতে সাহায্য করতে পারো।" 

হতভম্ব থম্পসন লেফট্যানেন্ট ক্যালির সাথে কথা বলতে গেলে ক্যালি জানায়, সে শুধু নির্দেশ পালন করছে। এরপর হেলিকপ্টার নিয়ে সেখান থেকে সরে যাওয়ার সময় থম্পসন দেখে সার্জেন্ট মিশেল বাঁধের মধ্যে আবার গুলি করছে। থম্পসন হেলিকপ্টার থেকে দেখেছিল ক্যাপ্টেন মেডিনা এক নিরস্ত্র নারীকে লাথি মেরে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তীতে মেডিনা বলেছিল, তার নাকি মনে হয়েছে ওই নারীর কাছে হ্যান্ড গ্রেনেড ছিল! এরপর এক জায়গায় থম্পসন দেখলো, একটা বড় বাঙ্কারের ভেতর লুকিয়ে আছে কতগুলো মানুষ আর একদল সৈন্য এগিয়ে যাচ্ছে সেটার দিকে। থম্পসন সেই জায়গায় অবতরণ করে। সে হেলিকপ্টারের ক্রুদের নির্দেশ দেয়, যদি বাঙ্কার থেকে মানুষগুলোকে বের করে আনার সময় কোনো মার্কিন সেনা এদের গুলি করার চেষ্টা করে তাহলে সেই সেনাদের দিকে গুলি চালাতে। থম্পসন সেখানকার অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট স্টিফেন ব্রুকসকে গিয়ে বলে এই বাঙ্কারে নারী ও শিশু আছে, তাদের বের করে আনতে হবে। ব্রুকস জবাব দেয় তাদের বের করে আনার একটাই উপায়, সেটা হলো বাঙ্কারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা। থম্পসন তাকে বলে সৈন্যদের নির্দেশ দিতে যাতে গুলি চালানো না হয়। এরপর সে গিয়ে বাঙ্কার থেকে লোকগুলোকে বের করে তাদের হেলিকপ্টারে করে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেয়। মি লাইয়ের সেই বাঁধের কাছে আবার ফিরে আসে থম্পসন। বাঁধের মধ্যে তখনও নড়াচড়া দেখতে পেয়ে সেখানে নামে। এক ক্রু সেই বাঁধের মধ্যে নেমে সেখান থেকে তুলে নিয়ে আসে একটা চার বছরের ছোট্ট শিশুকে, যে অক্ষত অবস্থায় ছিল। শিশুটিকে নিরাপদ জায়গায় রেখে আসা হয়। মি-লাই থেকে ফেরার পর থম্পসন বৈমানিক কোম্পানির কমান্ডারের কাছে রিপোর্ট করে সেনাদের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে। হেলিকপ্টারের অন্য পাইলট এবং ক্রুরা থম্পসনের বর্ণনার পক্ষে সাক্ষ্য দেয়।

পুরো হত্যাকাণ্ডকে মার্কিন বাহিনীর বিভিন্ন রিপোর্টে ‘ভিয়েত কংদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। ১২৮ জন ভিয়েত কং সৈন্য এতে নিহত হয়েছে বলে জানানো হয় রিপোর্টে। ক্যাপ্টেন মেডিনাকে সাহসিকতার জন্য একটি প্রশংসাপত্র দেয়া হয়! মার্কিন বাহিনী এমন সব হত্যাকাণ্ড নিয়মিত চালিয়ে যাচ্ছিলো। মি লাই গণহত্যার ছয় মাস পর এক মার্কিন সৈন্য সেনাপ্রধানের নিকট চিঠি লিখেছিল এসব হত্যার বর্ণনা দিয়ে। তৎকালীন মেজর ও পরবর্তীতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল সেই চিঠির ভিত্তিতে রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব পান এবং মার্কিন সেনাদের এমন কর্মকাণ্ডের কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন রিপোর্টে। মি লাই'য়ে থম্পসনের ভূমিকার জন্য তাকে ‘ডিস্টিংগুয়িশড ফ্লাইং ক্রস’ পুরস্কার দেয়া হয়। পুরস্কারের বর্ণনা হিসেবে এক জায়গায় লেখা ছিল, সে নাকি মি লাই'য়ে দুই পক্ষের মধ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চলাকালীন একটি শিশুকে উদ্ধার করেছিল! বর্ণনা দেখে পুরস্কারের মেডেল ছুঁড়ে ফেলে দেয় থম্পসন। ১৯৯৮ সালে মার্কিন সেনাবাহিনী আবার তাকে পুরস্কৃত করতে চায় সোলজার’স মেডেল দিয়ে। এই পুরস্কারের বর্ণনায় ছিল, ‘ভিয়েতনামের বেসামরিক মানুষের উপর মার্কিন বাহিনীর অন্যায় গণহত্যা চালানোর সময় অন্তত ১০ জনের জীবন রক্ষা করে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য’ এই পুরস্কার। মেডেলটি থম্পসনকে গোপনে দিয়ে কাজ সারতে চেয়েছিল সেনাবাহিনী। তখন সে জানায়, সে মেডেলটি নেবে যদি এটি জনসম্মুখে দেয়া হয় এবং যদি তার হেলিকপ্টারের ক্রুদেরও একই পুরস্কার দেয়া হয়।

মি লাই গণহত্যার প্রায় এক বছর আট মাস পর সিমোর হার্শ নামক এক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করেন এসোসিয়েটেড প্রেসের মাধ্যমে। সেই সূত্রে এ নিয়ে রিপোর্ট করে টাইম, লাইফ, নিউজউইক ইত্যাদি ম্যাগাজিন ও সিবিএস টেলিভিশন। ‘প্লেইন ডিলার’ পত্রিকা প্রকাশ করে গণহত্যার কিছু ছবি। এরপর অভিযুক্ত সৈন্যদের বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শালের উদ্যোগ নেয়া হয়। কোর্ট মার্শালে মার্কিন অফিসার ও সৈনিক মিলিয়ে মোট ২৬ জনের বিচার শুরু হয় এবং কেবল লেফট্যানেন্ট ক্যালিকে শাস্তি দেয়া হয়। লেফট্যানেন্ট ক্যালি পরে স্বীকার করেছিল তার জঘন্য কর্মকাণ্ডের কথা। বাঁধের মধ্যে পরে থাকা মানুষগুলোকে ৫ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে গুলি করে মেরেছিল সে। এ সবই ‘আদেশ পালন’ হিসেবে উল্লেখ করে ক্যালি! তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও দু'দিন পর প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দী রাখার নির্দেশ দেন। সব মিলিয়ে সাড়ে তিন বছর গৃহবন্দি ও এর মাঝখানে তিন মাস কারাবন্দী হওয়া ছিল ক্যালির অপরাধের শাস্তি! ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয়।


ভিয়েতকংরা যে ভয়ানক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছিল আমেরিকানদের, তা এখনও দুঃস্বপ্নের মতো পীড়া দেয় তাদের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের কাছে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের কাছে মোট দু'বার আমেরিকার কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছিলেন ভিয়েতনামের স্বাধীনতাকামী নেতারা। ঔপনিবেশিক দেশগুলোর বিপক্ষে ভিয়েতনামের সামরিক সক্ষমতা ছিল অপ্রতুল। কিন্তু দু'বারই আমেরিকার কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাননি তারা। উপরন্তু ভিয়েতনামে ঔপনিবেশিক শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য ফ্রান্সের পেছনে লক্ষ লক্ষ ডলার ঢেলেছে মার্কিনীরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা উপনিবেশগুলোতে স্বাধীনতাকামী আন্দোলন শুরু হয়। বিশ্বযুদ্ধের ব্যয় বহন করা ও শত্রুপক্ষের হামলায় ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হওয়া অর্থনীতি নিয়ে ঔপনিবেশিক শাসক দেশগুলোর সামর্থ্য ছিল না বিদ্রোহ ঠেকানোর। জাপান বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় বরণ করলে ভিয়েতনামকে হারাতে হয় তাদের। ফ্রান্স ভিয়েতনামের উপর পুরনো দাবি নিয়ে হাজির হয়। ভিয়েতনামের স্বাধীনতাকামী নেতারা সেটি মানতে রাজি ছিলেন না। আট বছর যুদ্ধের পর ফ্রান্সকে ভিয়েতনাম ছেড়ে যেতে হয়। ফ্রান্স ভিয়েতনাম ছেড়ে যাওয়ার পর জেনেভা অ্যাকর্ড অনুসারে ভিয়েতনাম দু'ভাগে ভাগ করা হলো। উত্তর ভিয়েতনামের শাসনক্ষমতার দায়িত্ব নিলেন ভিয়েত মিন বিপ্লবীরা, যারা ফ্রান্সকে বিতাড়িত করেছিলেন সম্মুখযুদ্ধে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের দায়িত্ব দেয়া হলো আমেরিকাপন্থী পুতুল সম্রাট বাও দাইকে। উত্তর ভিয়েতনামে প্রতিষ্ঠা করা হলো সমাজতন্ত্র, দক্ষিণ ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবকাঠামো সাজানো হলো পশ্চিমা পুঁজিবাদের আদলে। উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট নেতারা চেয়েছিলেন ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনাম প্রতিষ্ঠা করতে, যেখানে পুঁজিবাদী শ্রেণীবৈষম্য আর শোষণ থাকবে না। স্নায়ুযুদ্ধের সময় দক্ষিণ ভিয়েতনাম আমেরিকার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা লাভ করে। আমেরিকা যুদ্ধে যোগ দেয়ার আগেই প্রায় ১৬ হাজার মার্কিন সামরিক উপদেষ্টা অবস্থান করছিল ভিয়েতনামে। অসংখ্য সিআইএ অফিসারকে পাঠানো হয় ভিয়েতকংদের দমনের জন্য। ডোমিনো তত্ত্ব অনুসারে যেহেতু একটি দেশ কমিউনিস্ট শাসনে চলে গেলে পুরো অঞ্চলটিতে কমিউনিস্ট শাসন গোড়াপত্তন হওয়ার সুযোগ রয়েছে, তাই আমেরিকা সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দক্ষিণ ভিয়েতনাম টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। একটি পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দেশের পরাজয় পক্ষান্তরে আমেরিকার পরাজয় বলে প্রতীয়মান হতো তখন। ষাটের দশকের শুরুতে উত্তর ভিয়েতনামে সিআইএ'র অনেক অফিসারকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ভিয়েতকংদের পার্টির ভেতরের খবর বের করে আনার। অধিকাংশ গোয়েন্দা অফিসার উত্তর ভিয়েতনামে সুবিধা করতে পারেনি। এদের অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছিল কিংবা মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। 


আমেরিকার অনুগত দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট নগু দিন দিয়েমকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গদিছাড়া করা হয় এবং পরে হত্যা করা হয়। আমেরিকার সামরিক কর্মকর্তাদের অনেকে শুধু সম্মানজনক পদক পাওয়ার লোভে ভিয়েতনামে এসেছিলেন। এ অভিযোগের সত্যতাকে জোরালো করে কর্মকর্তাদের মিথ্যা রিপোর্ট পাঠানোর ঘটনা। উচ্চপদস্থ থেকে নিম্নপদস্থ, অসংখ্য কর্মকর্তা যুদ্ধের সময় ভিয়েতকংদের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা বাড়িয়ে বলেছে পেন্টাগনে পাঠানো রিপোর্টে। পরবর্তী সময়ে যখন অনেক অফিসারের মিথ্যাবাদিতা প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন সেই অফিসাররাই বাকিদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল! যুদ্ধে মার্কিনীদের সরাসরি অংশগ্রহণের সময় থেকে মার্কিন যুদ্ধকৌশলের মূলনীতি ছিল 'অ্যাট্রিশন'। এই পদ্ধতির মূল বৈশিষ্ট্য হলো সরাসরি আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে এমনভাবে ধসিয়ে দেয়া যাতে তারা আবার প্রতি আক্রমণ পরিচালনা করতে না পারে। এই কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, শত্রুপক্ষকে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে হবে যাতে তারা নতুন করে প্রস্তুতি নেয়ার সময় না পায়। অথচ ভিয়েতনামে মার্কিন আক্রমণে যে পরিমাণ ভিয়েতকং মারা যাচ্ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ প্রাপ্তবয়স্ক মার্কিন যুবককে প্রতি বছর উত্তর ভিয়েতনামের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছিল। অনবরত বোমা হামলার মাধ্যমে অবকাঠামোগত ক্ষতি করা হয়েছিল উত্তর ভিয়েতনামে, তা দ্রুত কাটিয়ে উঠেছিল ভিয়েতকংরা। ধসে যাওয়া ব্রিজকে এক রাতের মধ্যেই আবার ব্যবহার উপযোগী করে ফেলেছিল কমিউনিস্ট গেরিলারা। আমেরিকার বিপরীতে উত্তর ভিয়েতনাম যে সামরিক যুদ্ধকৌশল গ্রহণ করেছিল তা হচ্ছে 'এনার্ভেশন'। এই কৌশলে নিজেদের যতটা সম্ভব টিকিয়ে রেখে যুদ্ধের সময়ের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে শত্রুপক্ষের যুদ্ধ করার ধৈর্য শেষ করে দিতে হয়, শত্রুকে সরাসরি আক্রমণ না করে গেরিলা কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। যুদ্ধের সময়সীমা বেড়ে যাওয়ায় ও কার্যকরী কোনো ফলাফল আসার সম্ভাবনা না থাকায় আমেরিকার জনগণ ও গণমাধ্যম ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নেয়। মৃত আমেরিকান সৈন্যদের কফিন যতই মার্কিন বিমানবন্দরে ভিড়তে থাকে, ততই সরকারের সমালোচনা বাড়তে থাকে। মার্কিন প্রশাসন শেষ পর্যন্ত সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। 'অপারেশন রোলিং থান্ডার' এ আমেরিকানরা বেসামরিক জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করার ফলে দক্ষিণ ভিয়েতনামের যেসব সাধারণ মানুষ মার্কিনীদের পক্ষে ছিল, তারাও পক্ষত্যাগ করে। ভিয়েতকংরা ব্যাপক হারে মার্কিন বাহিনীর হাতে মারা যাওয়ার পরও রণে ভঙ্গ দেয়নি, লড়াই জারি রেখেছিল সবসময়। অতর্কিত আক্রমণ করে নিরাপদ জায়গায় পালিয়ে যাওয়া- এ কৌশলে আমেরিকানরা নাস্তানাবুদ হতে শুরু করে, প্রচুর সৈন্য মারা পড়তে শুরু করে ভিয়েতকংদের হাতে। কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধে আমেরিকানরা যে সরাসরি আক্রমণ কৌশল প্রয়োগ করেছিল, তা অব্যাহত রেখেছিল ভিয়েতনামে এসে। কিন্তু ভিয়েতনাম ছিল সবদিক থেকে কোরিয়ার চেয়ে আলাদা।





Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]