পুঁজিবাদ নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনবে- মার্ক্স
মর্টগেজ ব্যাকড সিকিউরিটি
'৮০ এবং '৯০ এর দশকে অ্যাসেট সিকিউরিটাইজেশনের মাধ্যমে দ্রুত বিশাল মুনাফা লাভের সম্ভাবনা থাকায় রিয়েল এস্টেট সেক্টরে এই আর্থিক প্রোডাক্টের বহুল প্রচলন শুরু হয়। বিনিয়োগকারীরা হুমড়ি খেয়ে রিয়েল এস্টেট ব্যাকড সিকিউরিটি কিনতে থাকে। যেহেতু স্থাবর সম্পত্তির মূল্যমান বাড়বে, সেহেতু সেই সম্পত্তির বিপরীতে ইস্যু করা সিকিউরিটি ডিফল্ট করার সম্ভাবনা খুব কম। সবাই এটা ধরে নেয় ঋণের টাকায় যে বাড়িটা কেনা হয়েছে সেটির বাজারমূল্য ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। যেহেতু এই বাড়ি থেকে পাওয়া ভাড়ার টাকায় সিকিউরিটি হোল্ডারদের প্রাপ্য পরিশোধ করা হবে, সেহেতু যতক্ষণ পর্যন্ত এটার বাজারমূল্য বাড়ছে কিংবা ভালো টাকায় ভাড়া দেয়া যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ। '৯০ এর দশকের শেষ দিকে মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং পরবর্তিতে শেয়ার মার্কেট ধস "ডটকম বাবল" নামে পরিচিত। সেসময় মানুষ না জেনে তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করা শুরু করে, যার ফলাফল পুঁজিবাজারে প্রথমে একটানা মূল্যবৃদ্ধি এবং হঠাৎ দরপতন। ডটকম বাবল যখন মার্কিন অর্থনীতিকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলো, ঠিক তখন ঘটে টুইন টাওয়ার হামলা। ডটকম বাবলের পর থেকে মার্কিন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের সুদের হার ক্রমাগত কমিয়ে চলছিলো। টুইন টাওয়ারে হামলার পর তারা সুদের হার নির্ধারণ করে ১%! নীতিনির্ধারকরা ভেবেছিলো সুদের কম হারের ফলে যে সস্তা ঋণ পাওয়া যাবে সেটা কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা মার্কিন অর্থনীতির চাকা সচল করবে। নামমাত্র সুদে বিপুল পরিমাণ সস্তা ঋণ নিয়ে লোকজন রিয়েল এস্টেট অ্যাসেট কিনতে লাগলো। যেসব বাড়ি ঋণ নিয়ে কেনা হলো, সেগুলো বন্ধক রাখা হলো ঋণের বিনিময়ে। ব্যাংকগুলো মর্টগেজড রিয়েল এস্টেটগুলো সিকিউরিটাইজ করে বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করতে লাগলো এবং বিনিয়োগকারীরা হুমড়ি খেয়ে সিকিউরিটি কিনে চললো। বাজারে রিয়েল এস্টেট অ্যাসেটের চাহিদার থেকে জোগান বেড়ে গেলো অনেক। সম্পত্তি ভাড়া নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত লোক পাওয়া যেতো না। অনেক যায়গায় যোগান বেশি হওয়ার কারণে সম্পদের বাজার মূল্য কমে যায় অস্বাভাবিকভাবে। সেই সম্পদ থেকে যা আয় হচ্ছিলো সেটাও কমে গেলো অনেক। যারা ঐ সম্পত্তির আয় থেকে ঋণের টাকা পরিশোধ করবে বলে ভেবেছিলো তারা ব্যর্থ হলো। সিকিউরিটাইজেশনের অন্যতম বড় দুর্বলতা হচ্ছে এখানে সব ধরনের অ্যাসেটের বিপরীতে ইস্যু করা সিকিউরিটিগুলো মিলিয়ে একসাথে বিক্রি করা যায়। বিনিয়োগকারী শুধু দেখবে কোন সিকিউরিটির ক্রেডিট রেটিং কেমন। যদি সাবপ্রাইম অ্যাসেটের বিপরীতে ইস্যু করা সিকিউরিটিগুলো ভালো সিকিউরিটির সাথে মিলিয়ে বিক্রি করা যায়, তাহলে সহজে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা যায়। এই ধরনের Pooled প্রোডাক্ট Collateralized Debt Obligation হিসেবে পরিচিত। ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলোর দায়িত্ব ছিলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিশ্লেষণ করে রেটিং দেয়া, তারা এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। অধিকাংশ সময় এজেন্সিগুলো ফি'র লোভে সাবপ্রাইম মর্টগেজ ব্যাকড সিকিউরিটিকে ভালো রেটিং দিয়ে দিতো। বিনিয়োগকারীদের বোঝার কোনো উপায় থাকতো না তারা আসলে এমন সিকিউরিটি কিনছে যেখান থেকে মূলধন পর্যন্ত উঠে আসবে না। মর্টগেজ ব্যাকড সিকিউরিটিস, বিশেষত সিডিও'কে অস্বাভাবিক জনপ্রিয় করার পেছনে ইনভেস্টমেন্ট এবং মার্চেন্ট ব্যাংগুলোর লোভ মূলত দায়ী ছিলো। সিকিউরিটাইজেশনের মাধ্যমে অল্প সময়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়ার জন্য তারা সাবপ্রাইম মর্টগেজড ঋণ দেয়া শুরু করে এবং মর্টগেজগুলোকে সিকিউরিটাইজ করে সিডিও আকারে বিক্রি করে। ব্যাংকগুলো সিকিউরিটি বিক্রি করে সব দায়িত্ব শেষ করে। মর্টগেজড ঋণগুলোকে সিকিউরিটি হিসেবে বিক্রি করে ফেলার সাথে সাথে ঋণের মালিকানা চলে যায় যে বা যারা সেই সিকিউরিটি কিনেছে তাদের কাছে। যদি কোনো কারণে ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দায়ভার নিতে হবে সিকিউরিটি হোল্ডারকে। সাবপ্রাইম মর্টগেজ ব্যাকড সিকিউরিটাইজেশনের দুর্বলতাগুলো ২০০৭ এর শেষ থেকে দৃশ্যমান হওয়া শুরু হয়। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয় ঋণগ্রহীতারা, তাদের বাড়ি কেনার সামর্থ্য না থাকলেও সিকিউরিটাইজেশনের মাধ্যমে অল্প সময়ে বিপুল মুনাফার লোভে জোর করে তাদের ঋণ দিয়েছিলো ব্যাংকগুলো। রিয়েল এস্টেট অ্যাসেটের বাজারমূল্যের অস্বাভাবিক পতন হয় চাহিদার তুলনায় জোগান অনেক বেশি হওয়ার কারণে। এই অবস্থায় যাদের ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য ছিলো তারাও পরিশোধ করা বন্ধ করে দিলো, তারা দেখলো ঋণের যেই টাকা তাদের শোধ করতে হচ্ছে এর তুলনায় ঋণের বিপরীতে থাকা সম্পদের বাজার মূল্য কম। মার্কিনিরা আর সারা দুনিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা যারা মর্টগেজ ব্যাকড সিকিউরিটি কিনেছিলো তারা আবিষ্কার করলো তাদের হাতে থাকা সিকিউরিটিগুলোর কোনো বাজারমূল্য নেই। যাদের পরিশোধ করা টাকায় এই সিকিউরিটির রিটার্ন আসার কথা, তারা আর টাকা দিচ্ছে না! ২০০৮ এর মার্চে লেম্যান ব্রাদার্স এবং বিয়ার স্টার্নস নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করার আবেদন করে। বিয়ার স্টার্নসকে অন্য একটি ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক জেপি মর্গান চেস কিনে নেয়ায় তারা দেউলিয়া হওয়া ঠেকাতে পেরেছিলো, লেম্যান ব্রাদার্সকে কেউ কিনে নিতে রাজি না হওয়ায় কয়েক দিনের ব্যবধানে দেউলিয়া হয়ে গেলো। ওয়াল স্ট্রিট থেকে শুরু হয়ে এই সাবপ্রাইম মর্টগেজ সংকট ছড়িয়ে পড়েছিলো দুনিয়ার সবগুলো আর্থিক কেন্দ্রে। অ্যাসেট সিকিউরিটাইজেশন হচ্ছে অ-তরল সম্পদকে তরল সম্পদে রুপান্তর করার জন্য বিশেষায়িত আর্থিক ব্যবস্থা। অ-তরল সম্পদ হচ্ছে যা সহজে নগদ অর্থে রুপান্তর করা যায় না (যেমন- জমি, ঘর-বাড়ি ইত্যাদি)। কেউ ইচ্ছা করলে সাথে সাথে জমি বিক্রি করে নগদ টাকা নিয়ে নিতে পারবে না। সেজন্য সময় প্রয়োজন হবে ক্রেতা খুঁজে বের করতে এবং যদি ক্রেতা পাওয়া যায়, তখন কিছু সরকারি-বেসরকারি নিয়মকানুন মেনে হাতবদল সম্পন্ন করতে হবে। বিক্রি করার সময় সঠিক বাজারমূল্য নিয়ে চিন্তা থাকে। অন্যদিকে তরল সম্পদ সহজে নগদ অর্থে রুপান্তর করা যায় (যেমন- স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার, মার্কিন ডলার ইত্যাদি)। কেউ ইচ্ছা করলে বাজারমূল্যে শেয়ার স্টক এক্সচেঞ্জে বিক্রি করে দিতে পারে অথবা মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার টাকায় রূপান্তর করে নিতে পারে। সিকিউরিটাইজেশনের মাধ্যমে অ-তরল সম্পদকে তরল সম্পদে রুপান্তর করতে হলে কারো অ-তরল সম্পদকে সহজে বিনিময়যোগ্য আর্থিক উপকরণে রুপান্তর করতে হবে। ধরা যাক, জনৈক ব্যক্তি ব্যাংক থেকে ১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে একটি বাড়ি কিনেছে। ২০ বছর ধরে সুদ-আসল মিলিয়ে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যাংকে পরিশোধ করতে হবে এবং ঋণের টাকা ঐ ব্যক্তি পরিশোধ করবে যে বাড়িটা কিনেছে সেটার ভাড়া থেকে। ১ কোটি টাকার ঋণ ব্যাংকের জন্য একটি অ্যাসেট, যা ২০ বছরে খাটিয়ে ব্যাংক ৫০ লাখ টাকা লাভ করবে। সুদে আসলে টাকাটা ফেরত পেতে ব্যাংকের ২০ বছর সময় লাগবে। ব্যাংক দেখলো এই ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ২০ বছরে ফেরত না নিয়ে যদি কোনোভাবে এক বছরের মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা ফেরত নিয়ে নিতে পারে, তাহলে লাভের অংশটা রেখে ১ কোটি টাকা এই মুহূর্তে আবার ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করা সম্ভব। ২০ বছরে ব্যাংক মোট ২ কোটি টাকা (২০ বছর × ১০ লাখ) লাভ করতে পারে, যেখানে আগের হিসেবে ব্যাংকের ৫০ লাখ টাকা লাভ থাকতো! অ্যাসেট সিকিউরিটাইজেশনের মাধ্যমে ব্যাংক এই ঋণকে অনেকগুলো শেয়ারে ভাগ করে বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করবে। ধরা যাক শেয়ারের সংখ্যা সব মিলিয়ে ১০১টি, যেগুলোর প্রতিটির মূল্য ১ লাখ টাকা। যারা শেয়ারগুলো কিনবে তারা প্রতিটি শেয়ারের বিনিময়ে ১ লাখ টাকা করে মোট ১ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যাংককে পরিশোধ করবে। ব্যাংক শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে বাড়ি কেনার জন্য যে ১ কোটি টাকা লোন দিয়েছিলো, সেটা ১০ লাখ টাকা লাভসহ তৎক্ষণাৎ বাজার থেকে তুলে নিলো। অন্যদিকে ঐ ব্যক্তি ঋণগ্রহীতা হিসেবে যে ঋণের কিস্তি প্রতিনিয়ত পরিশোধ করে যাচ্ছে, সেটা এখন ব্যাংক পাবে না, পাবে শেয়ার কেনার মাধ্যমে ঋণের মালিক বনে যাওয়া বিনিয়োগকারীরা। তারা ২০ বছর ধরে পরিশোধিত ঋণের কিস্তি থেকে সুদ এবং আসল পেতে থাকবে। সব মিলিয়ে তারা পাবে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যেটা ঐ ব্যক্তি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকে পরিশোধ করবে বলে দায়বদ্ধ হয়েছিলো। ঋণের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করার মাধ্যমে ব্যাংক অ-তরল সম্পদকে তরল সম্পদে রুপান্তর করে ফেললো। বিনিয়োগকারীদের লাভ হচ্ছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার সম্পদ ১ কোটি ১০ লাখ টাকায় কিনেছে, যেটা থেকে পরবর্তী ২০ বছরে ৪০ লাখ টাকা লভ্যাংশ আসবে। ব্যাংকের লাভ হচ্ছে ২০ বছর ধরে অপেক্ষা করার দরকার নেই, ১ বছরের মধ্যে ১০ লাখ টাকা লাভ নিয়ে নতুন আরেকটি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারছে এবং ৫০ লাখ টাকার স্থলে ২ কোটি টাকা লাভ করছে! যেই শেয়ারগুলো বিক্রি করা হয়েছে সেগুলো মর্টগেজ ব্যাকড সিকিউরিটিস। যেহেতু ঋণ দেয়ার সময় ব্যাংক বাড়িটিকে বন্ধক রেখে সেটার বিপরীতে ঋণ দিয়েছিলো, সেহেতু যখন ব্যাংক ঋণের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করার মাধ্যমে ঋণটি বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে দেবে তখন বাড়িটি বন্ধকী সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে। যখন বন্ধকী স্থাবর সম্পত্তির বিপরীতে সিকিউরিটি ইস্যু করা হয়, তখন সেই সিকিউরিটিকে বলা হয় মর্টগেজ ব্যাকড সিকিউরিটি। বন্ধকী সম্পদ আবার দুই ধরনের- প্রাইম এবং সাবপ্রাইম মর্টগেজ। প্রাইম মর্টগেজ হচ্ছে সেই ধরনের সম্পদ যেগুলো নিয়মিত বন্ধকী দেনা পরিশোধ করছে। যদি ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকা যথাসময়ে পরিশোধ করে দিতে পারে, তাহলে সেটা ব্যাংকের জন্য প্রাইম মর্টগেজ সম্পদ। কোনো কারণে ঋণ ঠিক সময়ের মধ্যে পরিশোধিত না হলে সেটা ব্যাংকের জন্য সাবপ্রাইম মর্টগেজ সম্পদ।ডাচ ডিজিজ
কোনো দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের আবিষ্কারের পর কোনো সীমিত পরিমাণের বস্তুর উপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে উঠলে ঐ দেশের অর্থনীতিতে ডাচ ডিজিজ দেখা দেয়। প্রাকৃতিক সম্পদের ভবিষ্যতের কোনো না কোনো সময় সমাপ্তি ঘটবে। একটি দেশের অর্থনীতি মূল যে ক্ষেত্রের উপর নির্ভর করে চলছে, সেই ক্ষেত্রের কাঁচামাল না থাকলে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থায় ধ্বস নামবে। প্রাকৃতিক সম্পদভিত্তিক ক্ষেত্র নয় যেগুলো, সেসব ক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট দ্রব্যগুলোর চাহিদা বিশ্ব বাজারে কমে যাওয়ার কারণে রপ্তানি কমে যাবে। তখন নির্দিষ্ট একটি ক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত দ্রব্য বাদে বাকি দ্রব্যগুলোর জন্য আমদানির উপর নির্ভরশীল হতে হয়। ফলে ঐ ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ এবং চাকরির সুযোগ এর অভাব দেখা যায়। ম্যানুফ্যাকচারিং এবং এই ধরনের শিল্প সংক্রান্ত কাজ চলে যায় নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। মূদ্রাস্ফীতি, আয়ের দিক থেকে বৈষম্য এবং আমদানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ডাচ ডিজিজের পূর্বাভাস। ১৯৭৭ সালে ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ ম্যাগাজিনে ‘ডাচ ডিজিজ’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়। ম্যাগাজিনটি ১৯৫৯ সালে নেদারল্যান্ডসে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল এলাকা আবিষ্কৃত হওয়ার পর সেখানে কীরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তা ব্যাখা করার জন্য শব্দটি ব্যবহার করে। সেসময় প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেলের অতিরিক্ত রপ্তানি শুরু হওয়ায় নেদারল্যান্ডসের আয় অতিরিক্ত বেড়ে যায়। অধিক রপ্তানির ফলে ডাচ মুদ্রার মূল্য বেড়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতির ফলে যেসব দ্রব্য প্রাকৃতিক গ্যাস কিংবা তেলের সাথে সংযুক্ত নয়, সেগুলো বিশ্ব বাজারে কম প্রতিযোগিতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। ঐ একটি ক্ষেত্র বাদে বাকি ক্ষেত্রগুলো অকেজো হতে শুরু করে। একটি নির্দিষ্ট সেক্টরের সাথে সম্পর্কিত সম্পদের রপ্তানিতে ব্যস্ত অর্থনীতির অন্যান্য সেক্টর উন্নত করার ক্ষেত্রে কারো মাথাব্যথা থাকে না৷ ডাচ ডিজিজের সময় হাতে প্রচুর টাকাকড়ি থাকলেও তা ঠিকমতো ব্যয় করা সম্ভব হয়না অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতির কারণে। ডাচ ডিজিজের প্রভাবে সম্পদ কিছু মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত থাকে। এতে বিলাস দ্রব্য ও সেবার উপর খরচ বেড়ে যায়। টাকার অভাবে বাকিরা কিছু ক্রয় করতে পারেনা দেখে অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে বিভিন্ন সামুদ্রিক পাখির অভরায়ণ্য ছিলো নাউরু। তাদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে জমতে জমতে উৎকৃষ্ট মানের ফসফেটের টিলায় পরিণত হয়। ফসফেট কৃষি কাজের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান এবং নাউরুতে যে ফসফেট পাওয়া যেতো, সেগুলো ছিলো পুরো পৃথিবীতে সর্বোৎকৃষ্ট মানের। ১৯০৬ সালে জার্মানরা প্রথম নাউরুর ফসফেট খনির সন্ধান পায়। প্যাসিফিক ফসফেট কোম্পানির নামে এখান থেকে তারা ফসফেট উত্তোলন শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা পরাজিত হলে ব্রিটিশ ফসফেট কমিশনের নামে নাউরু থেকে ফসফেট উত্তোলন চলতে থাকে। এর সুবিধা নেয় ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। ১৯৬৮ সালে নাউরু স্বাধীনতা লাভের পর সরকার ‘ব্রিটিশ ফসফেট কমিশন’ কিনে নিয়ে ‘নাউরু ফসফেট কর্পোরেশন’ নাম দিয়ে ফসফেট উত্তোলন করে বিক্রি করতে থাকে পশ্চিমাদের কাছে। জাহাজে পণ্য তোলার জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে গড়ে তোলা হয় বিশাল ক্রেন। নাউরু সরকারের হাতে আসতে থাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ। ১৯৭৫ সালে নাউরুর সরকারি ব্যাংকে জমা হয় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! নাউরুকে তখন বলা হতো প্যাসিফিকের কুয়েত। উন্নত চিকিৎসা, উচ্চ শিক্ষা, মানসম্মত বাসস্থান- এসব কাজে খরচ করার জন্য এই অর্থ ছিলো যথেষ্ট। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এর পরিবর্তে দামি বাড়ি, বিলাসবহুল হোটেল এবং গলফ কোর্ট বানায়। তারা একটি বিমানবন্দর তৈরী করে পশ্চিমাদের থেকে খাদ্য আমদানি করার উদ্দেশ্যে। নিজেদের দেশে খাদ্য উৎপাদন করার চেয়ে তারা বহির্দেশ থেকে খাবার আনার দিকে বেশি মনোযোগ দিতে থাকে। সেজন্য তারা ৭টি বোয়িং বিমান কেনে, যেগুলো সম্মিলিতভাবে নাউরুর ১০% জনগণ বহন করতে সক্ষম। সবকিছু দেখভাল করার জন্য তারা ট্রাস্ট গঠন করে। অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অবাস্তব পরিকল্পনা- সবকিছু নাউরুকে নিঃস্ব করে দিতে শুরু করে। সরকারি লোকজন রাষ্ট্রের টাকায় বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে শুরু করে। এরা অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, লন্ডন এবং ফিজির মতো দেশগুলোতে তৈরি করে নিজেদের বিলাসবহুল হোটেল। তারা প্রচুর পরিমাণ অর্থ পাচার করতে থাকে। ফসফেটের সম্পদ একসময় ফুরিয়ে আসলো। ফসফেট রপ্তানি ছাড়া নাউরুর আর কোনো রাষ্ট্রীয় উপার্জন নেই এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারও ফাঁকা হয়ে পড়ে, নাউরু সরকার অন্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে অর্থ ধার নিয়ে রাষ্ট্র চালাতে থাকে। নাউরুর এক অর্থ বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিলেন, লন্ডনভিত্তিক ব্যান্ড ‘ইউনিট ফোর প্লাস টু’ কে দিয়ে সঙ্গীতানুষ্ঠান আয়োজন করতে। লন্ডনে তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে উঠে আসবে নাউরুর রাষ্ট্র চালানোর অর্থ! দুই সপ্তাহ চলার পর 'ইউনিট ফোর প্লাস টু' এর অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। সেইসাথে নাউরুর উপর চাপিয়ে দেয় ৭ মিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা! অনুষ্ঠানের পেছনে যেসকল প্রতিষ্ঠান অর্থ খরচ করেছিলো, তারা নাউরুর সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। নাউরুর কাছে এখন আছে শুধু ২১ বর্গ কিলোমিটারের জমি, যার কোথাও ফসল আবাদ করা সম্ভব না। মাত্রাতিরিক্ত খোঁড়াখুড়ির ফলে আশেপাশের সকল পানি দূষিত হয়ে পড়ে। আছে ৭,০০০ লোকজন, যারা সবাই মিলে একটি জেলখানায় আটকা পড়ে। নাউরু সরকার ঘোষণা দিলো, ২০ হাজার ডলার দিয়ে যেকেউ চাইলে নাউরুতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। নাউরুর সাদাসিধে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনাকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়ান মাফিয়া গোষ্ঠী ৭০ বিলিয়ন ডলারের অর্থ পাচার করে। ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ান সরকার নাউরুতে উদ্বাস্তু শিবির কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। যারা অস্ট্রেলিয়া থেকে পালিয়ে আসতো কিংবা কঠিন অপরাধে অস্ট্রেলিয়া সরকার যাদের দেশ থেকে বিতারিত করার নির্দেশ দিতো, তাদের ঠিকানা হতো নাউরু। এজন্য নাউরুকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ভাড়া দিতো অস্ট্রেলিয়া। আন্দোলনের মুখে ২০০৮ সালে বন্ধ করে দেয়া হয় উদ্বাস্তু কেন্দ্র। ২০১৪ সালে কিছুটা উন্নতি করে আবার এই কেন্দ্র চালু করা হলেও অবস্থা আগের মতোই। ২০১৬ সালে এক ইরানি যখন জানতে পারে তাকে নাউরুর উদ্বাস্তু কেন্দ্রে ১০ বছর কাটাতে হবে, তখন সে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে। বর্তমানে নাউরুর ৭০% জমিতে কোনোপ্রকার চাষাবাদ সম্ভব না, নিম্নমানের খাবার খেয়ে নানা রোগে ভুগতে থাকা জনগণের অবস্থা শোচনীয়। নাউরুর ৯০% নাগরিক বর্তমানে বেকার।
মুদ্রাস্ফীতি
ধরুন, আপনি দশ টাকা পকেটে নিয়ে সিঙ্গারা বিক্রেতার কাছে দাম জিজ্ঞেস করলে উত্তর এলো একটার দাম পাঁচ টাকা। আপনি দশ টাকা দিয়ে দু'টি সিঙ্গারা নিলেন। যদি একটার দাম দশ টাকা হয়, সেক্ষেত্রে আপনি দু'টি সিঙ্গারা কিনতে পারবেন না। মূল্য বৃদ্ধি পেলে একই পণ্য ক্রয় করার জন্য আমাদের আরও বেশি টাকা প্রয়োজন হয়। পণ্যটি কেনার সক্ষমতা আমাদের কমে যায়। এই অবস্থাকে বলা হয় মুদ্রাস্ফীতি। পহেলা বৈশাখের আগে ইলিশ মাছের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা জানে যে আপনি না কিনলেও অন্য কেউ বেশি টাকা দিয়ে মাছ কিনবে। যে মাছটা কয়েকদিন আগে আপনি পাঁচশো টাকায় কিনেছেন, সেই মাছটা দুই হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে যাবে। দোকানদার একবার যখন দুই হাজার টাকায় একটা ইলিশ বিক্রি করবে, তখন সে বাকিগুলোর দামও এমন হাঁকাবে। অন্য বিক্রেতারাও পিছিয়ে থাকবে না। ইলিশ মাছের দাম বেড়ে যাবে তিনগুণ, চারগুণ! কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি বেশি টাকা ছাপিয়ে ফেলে, সেক্ষেত্রে মানুষের কাছে অতিরিক্ত টাকা চলে আসবে। মানুষের কাছে যখন বেশি টাকা থাকবে, তখন তারা কাঙ্ক্ষিত পণ্যটি নিজের করে নেয়ার জন্য বেশি টাকা পরিশোধ করতে বিচলিত হবেনা। ইলিশ মাছের মতো সব পণ্যের দাম বেড়ে মুদ্রাস্ফীতি হবে। ইচ্ছা করলেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক যতো খুশি টাকা ছাপাতে পারে না। আপনি একটা সিঙ্গারা শেষ করে খেয়াল করলেন পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় সিঙ্গারার সাথে পেঁয়াজ দেয়া হয়নি। পেঁয়াজের দাম না বেড়ে যদি আলুর দাম বাড়তো, তখন সিঙ্গারার দাম বাড়িয়ে দিতে হতো। একই কারণে মাংস বা চালের দাম বাড়লে বিরিয়ানির দাম বেড়ে যায়। চামড়ার দাম বাড়লে জুতার দাম বেড়ে যায়। শ্রমিকদের মজুরি এবং আনুষঙ্গিক নানা খরচের পরিমাণ বৃদ্ধিও পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি ঘটানোর জন্য দায়ী। কোনো পণ্যের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত যোগান না থাকলে দেশের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ যাবতীয় পণ্য বা সেবার মূল্যবৃদ্ধি হয় মুদ্রাস্ফীতির কারণে। মুদ্রাস্ফীতি যখন হয় তখন সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ আশঙ্কা করে ভবিষ্যতে মূল্য আরো বৃদ্ধি পাবে। তারা বেশি করে তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে রাখতে চায়। লবণের দাম বেড়ে যাওয়ার গুজবে সবাই দশ কেজি, পনের কেজি করে লবণ কিনতে শুরু করে! মুদ্রাস্ফীতির কারণে বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পায়। চাহিদা বেড়ে গেলে ভোগ বেড়ে যায় এবং বাড়তি চাহিদা মেটাতে বাড়তি যোগানের ব্যবস্থা করতে হয়। জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে দ্রব্য বা সেবার জন্য মূল্য পরিশোধের অক্ষমতা সৃষ্টি হয়। দশ বছর আগে যেই দূরত্বের রিকশা ভাড়া ছিলো বিশ টাকা, এখন সেটা পঞ্চাশ টাকা হয়ে গেছে। আবার চালের দাম ছিলো চল্লিশ টাকা কেজি, এখন সেটা দাঁড়িয়েছে ষাট টাকা কেজিতে। এভাবে প্রত্যেকটা পণ্যের দাম বেড়ে গেলেও কারো বেতন সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। মুদ্রাস্ফীতির জন্য অবসরপ্রাপ্ত কিংবা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষদের দুর্ভোগ হয় অন্য সবার চেয়ে বেশি। ধরুন, আপনার কাছে এক লাখ টাকা আছে। আপনি ঠিক করলেন এই টাকা দিয়ে একটি আইফোন এবং একটি ল্যাপটপ কিনবেন। মুদ্রাস্ফীতির জন্য আইফোন এবং ল্যাপটপ দু'টোর দাম বেড়ে যদি এক লাখ টাকা হয়ে যায় সেক্ষেত্রে আপনাকে ল্যাপটপ অথবা আইফোন এর মধ্যে যেকোনো একটি কিনতে হবে। এরকম একটি সুযোগ গ্রহণ করে আরেকটি হাতছাড়া করাকে বলে "সুযোগ ব্যয়"। মুদ্রাস্ফীতির জন্য সুযোগ ব্যয় বেড়ে যায়। তখন আপনার অনেকগুলো চাহিদা থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু সুযোগ গ্রহণ করতে হবে।
পঞ্জি স্কিম
পঞ্জি স্কিমগুলো পিরামিড আকৃতির কাঠামো, যার একেবারে চূড়ায় থাকে মূল পরিকল্পনাকারীরা। এরপর থাকে প্রাথমিক সদস্যরা। প্রাথমিক সদস্যরা নতুন সদস্য সংগ্রহ করে, যারা তাদের নিচের ধাপে থাকে এবং এভাবে সদস্য দ্বারা সদস্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার মাধ্যমে উপর থেকে নিচের দিকে ছড়ানো পিরামিড আকারের গ্রাহক অবস্থান তৈরি হয়। পিরামিডের যতো নিচের দিকে যাওয়া যাবে, ততো এর সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকবে। পুরো পরিকল্পনা থেকে মূল পরিকল্পনাকারী ও প্রাথমিক সদস্যরা কেবল লাভবান হতে পারে। স্বল্পমেয়াদে মুনাফাসহ বিনিয়োগ ফেরৎ পাওয়ার টোপ দেখিয়ে নতুন গ্রাহক তৈরি করা হয়। নতুন গ্রাহকরা মনে করে তারা যদি আরও কিছু গ্রাহককে ঘোষিত স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে তবে তার মুনাফা আরো বাড়বে। "পঞ্জি স্কিম" নামটি চার্লস পঞ্জি নামে এক প্রতারকের নামানুসারে প্রদান করা হয়েছে। চার্লস পঞ্জি এ ধরনের প্রতারণামূলক স্কিমের মাধ্যমে ১৯২০ সালের দিকে বোস্টনে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। তার স্কিমটি ছিলো তৎকালীন ডাক ব্যবস্থাকে ঘিরে। সেসময় বিভিন্ন দেশের ডাক বিভাগ নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক কুপন ব্যবহার করতো চিঠিপত্র বিনিময়ের জন্য। কুপনগুলোর স্থানীয় মুদ্রামান একই থাকলেও দেশ ভেদে মুদ্রার বিনিময় মূল্যের উঠানামার কারণে অন্য কোনো দেশে এই মান বেড়ে যেতো বা কমে যেতো। চার্লস পঞ্জি সুযোগটাই গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে আরো সুযোগ ছিলো এসব কুপনকে ডাকটিকিটের সাথে পরিবর্তন করার। পরবর্তীতে এসব ডাকটিকিটের দাম দেশ ভেদে উঠানামা করতে শুরু করে। চার্লস পঞ্জি ইউরোপে কিছু এজেন্ট নিয়োগ করলো যাতে আন্তর্জাতিকভাবে এসব কুপন কম মূল্যমানের মুদ্রায় কিনতে পারে। পঞ্জি এসব সস্তায় ক্রয় করা কুপন ব্যয়বহুল ডাক টিকেটের সাথে বিনিময় করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই দুই মূল্যের ব্যবধানে মোটা মুনাফা সে পকেটস্থ করে। এরপর সে চার্লস পঞ্জি ‘সিকিউরিটি একচেঞ্জ কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করে। কোম্পানির কার্যক্রম এমনভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করা হলো যাতে দেখানো হলো কোম্পানিটি স্বল্প সময়ের মধ্যে বিস্ময়কর মুনাফা প্রদান করতে সক্ষম। সে অবিশ্বাস্য রকমের মুনাফার প্রস্তাব দিলো। যেমন- ৪৫ দিনে ৫০% অথবা ৯০ দিনে ১০০% মুনাফা। পঞ্জি ষ্ট্যাম্প বিক্রির মাধ্যমে যথেষ্ট মুনাফা অর্জন করায় বাজারে তার বিশ্বাসযোগ্যতা ছিলো এবং বিনিয়োগকারীরা তার উপর আস্থা রাখলো। নিজের কোম্পানিতে পঞ্জির খুব কম বিনিয়োগ ছিলো। পঞ্জি বিনিয়োগকারীদের তাদের জমা দেয়া অর্থ এমনভাবে পুনর্বণ্টন করে দিতে শুরু করলো যে, তারা বিশ্বাস করতে শুরু করলো স্কিমটি ভালো মুনাফা করতে সক্ষম। স্কিমটি প্রায় এক বছর চলার পর মার্কিন এস ই সি স্কিমটি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। ১৮৪০-১৮৬০ সালের চার্লস ডিকেন্সের কয়েকটি উপন্যাসে এরকম স্কিমের উল্লেখ আছে। এটা হচ্ছে একধরনের প্রতারণামূলক কার্যক্রম, যেখানে বিনিয়োগকারীদের সামান্য বিনিয়োগের বিপরীতে বিশাল অংকের লভ্যাংশ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। বাস্তবে নতুন বিনিয়োগকারীদের থেকে জমাকৃত টাকা দ্বারা পুরনো বিনিয়োগকারীদের টাকা প্রদান করা হয়। স্কিমের আকার যত বড় হতে থাকে, নতুন বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা তত বাড়তে থাকে এবং স্কিমে বিনিয়োগকৃত টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এখানে তারা টাকা উপার্জন করতে পারে যারা পিরামিডটির একদম উপরের দিকে অবস্থান করে। প্রতিটি সদস্য আরো নতুন সদস্য যোগ করার মাধ্যমে পঞ্জির পিরামিডকে বড় করে তোলে। ব্যবসার স্থায়িত্ব নির্ভর করে নতুন সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির উপর। একটা সময় সদস্য বৃদ্ধির হার কমে যায় এবং নতুন সদস্য আর পাওয়া যায়না। পঞ্জি স্কিম ভেঙে পড়তে শুরু করে এবং উদ্যোক্তারা পালিয়ে যায়। স্কিমের প্রতিষ্ঠাতা পালিয়ে গেলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার সুযোগ থাকেনা। বেশিরভাগ সময় নিম্ন আয়ের মানুষ পঞ্জি স্কিমের প্রধান লক্ষ্য হয়ে থাকে। পঞ্জি স্কিমের সফলতার পেছনে দু'টি বিষয় কাজ করে। প্রথমত, মানুষের লোভ এবং দ্বিতীয়ত, সহজে অর্থ উপার্জনের তীব্র আকাঙ্খা। পঞ্জি স্কিম দ্রুত বিশাল অর্থ উপার্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, যেখানে টাকা উপার্জন করতে বিনিয়োগকারীদের কিছু করতে হয়না। তারা কেবল বিনিয়োগ করবে আর মুনাফা গুনবে। পঞ্জি স্কিমের তথ্যগুলো অস্পষ্ট থাকে। বিনিয়োগকারীরা কম সময়ে অপ্রত্যাশিত মুনাফার লোভে কখনো তলিয়ে দেখে না কীভাবে স্কিমটি উপার্জনের মাধ্যমে তাদের মুনাফা প্রদান করবে। বার্নাড ম্যাডফ শেয়ার বাজারের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত ছিল। ২০০৮ সালে ম্যাডফের পুত্র বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পর এই কেলেঙ্কারির পর্দা ফাঁস হয়। ম্যাডফ নাসদাকের একজন চেয়ারম্যান ছিল, যে পঞ্জি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬০ সালে চালু হয় এবং ৪০ বছর ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করে। সে জনগণকে এমন অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিল, যেগুলোর কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। পঞ্জি কেলেঙ্কারির বিষয়টি উন্মোচিত হলে তাকে ১১টি ফেডারেল অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিচারে তাকে ১৫০ বছর কারাবাসের সাজা দেয়া হয়। তার প্রতিষ্ঠানের দেনার পরিমাণ ছিলো ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং তার জালিয়াতির পরিমাণ ছিলো প্রায় ৬৪.৮ বিলিয়ন ডলার। ২০০৮ এর শেষভাগে যখন এই কেলেঙ্কারির পর্দা উন্মোচন হয় তখন তার গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৪,৮০০।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Madoff_investment_scandal
বেশিরভাগ সময় কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ভেতরের কোনো লোক স্কিম সর্ম্পকে অবহিত করার পর পঞ্জি স্কিমগুলোর পর্দা ফাঁস হয়। গোপনীয়তা সত্ত্বেও পঞ্জি স্কিম একসময় মুখ থুবড়ে পড়ে। পিরামিড একটি প্রান্তিক পর্যায়ে এসে থামতে বাধ্য হয়। তখন কোনো নতুন বিনিয়োগকারী এতে অর্থ বিনিয়োগ করে না। অর্থের উৎস বা তারল্য কমে যাওয়ায় স্কিমটি সমাপ্তিতে পৌঁছাতে বাধ্য হয়। এসময় যখন অনেক লোক একসাথে তাদের মূল অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য তাগাদা দিতে শুরু করে, তখন পঞ্জি স্কিমের গোমড় ফাঁস হয়ে যায়। বিশ্ব অর্থনীতি এবং বাজার পরিস্থিতির ওঠা-নামাও পঞ্জি স্কিম এর অবসান ঘটাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
মিসিসিপি বাবল
অষ্টাদশ শতকে জন ল ফরাসি সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পদে বহাল হন এবং ‘জেনারেল ব্যাংক’ নামক রাষ্ট্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্যাংকের আওতায় জন ক্রয় করেন ‘মিসিসিপি কোম্পানি’, যা উত্তর আমেরিকায় ফরাসি কলোনির উন্নয়নের দায়িত্ব পায়। মিসিসিপি কোম্পানি শেয়ারের দাম উর্ধ্বাকাশে চড়িয়ে বলে যে, মিসিসিপিতে দু'হাত ভরে আয় করা যাবে! ১৭১৫ সালে ফরাসি সরকার দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। তারা সরকারি সুদের হার কমিয়ে জনগণের উপর ব্যাপক হারে কর চাপিয়ে দিলো। ফ্রান্সে শুরু হলো অর্থনৈতিক মন্দা। ফরাসি সরকার পরিচালিত হতো কয়েকজন রাজপ্রতিনিধির দ্বারা, যারা ‘রিজেন্ট’ নামে পরিচিত। পঞ্চদশ লুইয়ের বয়স তখন ৫ হওয়ার কারণে রিজেন্টরা দেশ পরিচালনা করতেন। স্কটল্যান্ডের এক ধনী ব্যাংকারের ঘরে জন্ম নেয়া জন ল ১৪ বছর বয়স থেকে বাবার সাথে ব্যাংকের কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন এবং অর্থনীতি অধ্যয়ন করতেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি অর্থনীতি নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে লন্ডন পাড়ি জমান। সেখানে গিয়ে জুয়ার নেশায় আসক্ত হন। একবার এক স্থানীয় ব্যক্তির সাথে জুয়ার আসরে মারামারি করে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এ যুদ্ধে তিনি প্রতিপক্ষকে গুলি করে হত্যা করেন। লন্ডনের আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। জন কিছুকাল জেলে কাটিয়ে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে পুনরায় অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। আমস্টারডাম, ভেনিস আর জেনোয়া শহরে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করে ১৭০৫ সালে দেশে ফেরেন। সেই বছর তিনি মুদ্রার প্রকৃতি নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি মূল্যবান ধাতব মুদ্রার পরিবর্তে কাগুজে মুদ্রা ব্যবহারের উপকারিতা বর্ণনা করেন। ব্যাংক ব্যবস্থা এবং মুদ্রা ব্যবস্থার উপর তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছিলো প্রচুর। দেশের সংকট কাটাতে তাকে স্মরণ করেন ডিউক অব অরলিন্স। জন জেনারেল ব্যাংকের মাধ্যমে কাগুজে মুদ্রা ছাপাতে শুরু করেন। সাধারণ মানুষের সংগ্রহে থাকা স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা গচ্ছিত রাখার বিনিময়ে কাগুজে মুদ্রা সরবরাহ শুরু করে জেনারেল ব্যাংক। ব্যাংকের রিজার্ভ গঠিত হয় প্রচুর পরিমাণ শেয়ার বিক্রয়ের মাধ্যমে। এটি ছিলো ফ্রান্সে প্রথম কাগুজে মুদ্রার প্রচলন। তিনি ‘মিসিসিপি কোম্পানি’ কব্জা করেন এবং এর নাম দেন কম্পানি দো’ক্সিদো। এই কোম্পানিকে ফরাসি সরকার মিসিসিপি রাজ্যে উন্নয়নের জন্য একচেটিয়া দায়িত্ব প্রদান করে। মিসিসিপি কোম্পানি সাধারণ মানুষকে বোঝায় যে মিসিসিপি রাজ্যে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ; যেমন- কয়লা, মূল্যবান ধাতু আর মূল্যবান পশুপাখির চামড়া পাওয়া সম্ভব। কয়েক মাসের মাথায় কোম্পানিটি ইউরোপের বাইরে ফ্রান্স সরকারের যাবতীয় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করলো। সরকারি রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব এই কোম্পানির হাতে গেলো। জন ল ফরাসি সরকারের ঋণ পরিশোধ পরিকল্পনাকে নিজের মতো করে ঢেলে সাজান এবং সরকারি ঋণ কোম্পানির শেয়ারের বিনিময়ে ঋণ পরিশোধ করার পদ্ধতি চালু করেন। ১৭১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মিসিসিপি কোম্পানি তাদের ৫০০ লিভার মূল্যের শেয়ার বাজারে ছাড়া শুরু করে। এই শেয়ার দ্বারা ব্যাংক নোট কেনা কিংবা সরকারি ঋণ পরিশোধ করা যেতো। জন ল প্রচার করলেন এই শেয়ার ক্রয় করে মিসিসিপি রাজ্যে বিনিয়োগ করে দ্রুত বিত্তশালী হওয়া সম্ভব। জানুয়ারিতে যে শেয়ারের মূল্য ছিলো ৫০০ লিভার, সেই শেয়ারের মূল্য ডিসেম্বর নাগাদ ১০ হাজার লিভারে দাঁড়ায়! ৩৬৫ দিনের ব্যবধানে মিসিসিপি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য আকাশ ছুঁয়ে ফেললে সর্বস্তরের মানুষ এই শেয়ার ক্রয় করে অধিক মুনাফার আশায়। জন ল ইউরোপের সবচেয়ে বিত্তশালী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন। জেনারেল ব্যাংক মানুষের অসীম চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক নোট বাজারে ছেড়ে যাচ্ছিলো দেখে এক বছরের মধ্যে বাজারে তরল অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ১৮৬%! মুদ্রাস্ফীতির ভয়াবহতায় ১৭১৯ সালের শেষ নাগাদ ফ্রান্সের বাজারে পণ্যমূল্য দ্বিগুণ হয়ে যায়, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি পায় ২০ গুণ! বাড়ি ভাড়া দেয়ার জন্য বাড়িওয়ালারা তাদের সকল জমির উপর বাড়ি নির্মাণ করতে শুরু করেন। দ্রুত শেয়ারের দাম বৃদ্ধি ও এর সার্বিক পরিণতির কিছুটা আঁচ পাচ্ছিলেন জন। জেনারেল ব্যাংক তাদের কাছে গচ্ছিত সোনা, রূপার তুলনায় ৩-৪ গুণ বেশি কাগুজে নোট বাজারে ছেড়ে দিয়েছে ততদিনে। গচ্ছিত সম্পদ ও তরল অর্থের মধ্যকার বিপুল ব্যবধান কমাতে তিনি মিসিসিপি উপনিবেশ থেকে সোনা-রূপার স্বদেশমুখী প্রবাহের আশায় ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, মিসিসিপির উপর বিনিয়োগের অর্থ দিয়ে তিনি ঘাটতি মেটাবেন। ১৯২০ সালের শুরুর দিকে মিসিসিপি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য পড়তে শুরু করে। অনেক বিনিয়োগকারী মূল্য চূড়ায় থাকতে লাভ তুলে নিতে চাইছিল, তারা তাদের শেয়ার বিক্রয় করে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ফেরত নিতে গেলে জন আইন করে শেয়ার বিক্রয়ের সর্বোচ্চ সীমা ১০০ লিভার নির্ধারণ করেন। কিছুকালের মধ্যে কোম্পানির শেয়ার মূল্য অতিরিক্ত নির্ধারিত হয়েছে, এমন ঘোষণা দিয়ে মূল্য কমিয়ে দেন জন। শেয়ারের মূল্য কমে যাওয়ায় ব্যাংক নোটের মূল্য ৫০% পড়ে গেলে শুরু হয় জনরোষ। গণ আন্দোলন শুরু হয়ে যেতে পারে, এই ভয়ে ব্যাংক নোটের মান আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিলেও ব্যাংকে গচ্ছিত মূল্যবান ধাতব মুদ্রার অভাবে কাগুজে মুদ্রার সাথে ধাতব মুদ্রার বিনিময় সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অনেক বিনিয়োগকারী একযোগে শেয়ার বিক্রি করায় শেয়ারের দাম ১,০০০ লিভারে নেমে আসে। একসময়ের মিলিয়নিয়াররা নিঃস্ব হয়ে রাস্তায় নেমে আসে, শ্লোগান দেয় জনের বিরুদ্ধে। ততদিনে কোম্পানির দুই-তৃতীয়াংশ শেয়ার তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে চলে গেছে। একই সময়ে ব্রিটেনেও ‘সাউথ সি বাবল’ নামক অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকেন্দ্রিক ত্রুটির ঘটনা ঘটেছিল। কয়েক দশক ধরে ফ্রান্সে চলতে থাকে মন্দা। এই মন্দার রেশ ধরে ফরাসি বিপ্লবের জ্বালানী পুঞ্জীভূত হয়েছিল। আর নারীর ছদ্মবেশে দেশ থেকে পালিয়েছিলেন জন!
অষ্টাদশ শতকে জন ল ফরাসি সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পদে বহাল হন এবং ‘জেনারেল ব্যাংক’ নামক রাষ্ট্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্যাংকের আওতায় জন ক্রয় করেন ‘মিসিসিপি কোম্পানি’, যা উত্তর আমেরিকায় ফরাসি কলোনির উন্নয়নের দায়িত্ব পায়। মিসিসিপি কোম্পানি শেয়ারের দাম উর্ধ্বাকাশে চড়িয়ে বলে যে, মিসিসিপিতে দু'হাত ভরে আয় করা যাবে! ১৭১৫ সালে ফরাসি সরকার দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। তারা সরকারি সুদের হার কমিয়ে জনগণের উপর ব্যাপক হারে কর চাপিয়ে দিলো। ফ্রান্সে শুরু হলো অর্থনৈতিক মন্দা। ফরাসি সরকার পরিচালিত হতো কয়েকজন রাজপ্রতিনিধির দ্বারা, যারা ‘রিজেন্ট’ নামে পরিচিত। পঞ্চদশ লুইয়ের বয়স তখন ৫ হওয়ার কারণে রিজেন্টরা দেশ পরিচালনা করতেন। স্কটল্যান্ডের এক ধনী ব্যাংকারের ঘরে জন্ম নেয়া জন ল ১৪ বছর বয়স থেকে বাবার সাথে ব্যাংকের কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন এবং অর্থনীতি অধ্যয়ন করতেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি অর্থনীতি নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে লন্ডন পাড়ি জমান। সেখানে গিয়ে জুয়ার নেশায় আসক্ত হন। একবার এক স্থানীয় ব্যক্তির সাথে জুয়ার আসরে মারামারি করে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এ যুদ্ধে তিনি প্রতিপক্ষকে গুলি করে হত্যা করেন। লন্ডনের আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। জন কিছুকাল জেলে কাটিয়ে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে পুনরায় অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। আমস্টারডাম, ভেনিস আর জেনোয়া শহরে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করে ১৭০৫ সালে দেশে ফেরেন। সেই বছর তিনি মুদ্রার প্রকৃতি নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি মূল্যবান ধাতব মুদ্রার পরিবর্তে কাগুজে মুদ্রা ব্যবহারের উপকারিতা বর্ণনা করেন। ব্যাংক ব্যবস্থা এবং মুদ্রা ব্যবস্থার উপর তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছিলো প্রচুর। দেশের সংকট কাটাতে তাকে স্মরণ করেন ডিউক অব অরলিন্স। জন জেনারেল ব্যাংকের মাধ্যমে কাগুজে মুদ্রা ছাপাতে শুরু করেন। সাধারণ মানুষের সংগ্রহে থাকা স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা গচ্ছিত রাখার বিনিময়ে কাগুজে মুদ্রা সরবরাহ শুরু করে জেনারেল ব্যাংক। ব্যাংকের রিজার্ভ গঠিত হয় প্রচুর পরিমাণ শেয়ার বিক্রয়ের মাধ্যমে। এটি ছিলো ফ্রান্সে প্রথম কাগুজে মুদ্রার প্রচলন। তিনি ‘মিসিসিপি কোম্পানি’ কব্জা করেন এবং এর নাম দেন কম্পানি দো’ক্সিদো। এই কোম্পানিকে ফরাসি সরকার মিসিসিপি রাজ্যে উন্নয়নের জন্য একচেটিয়া দায়িত্ব প্রদান করে। মিসিসিপি কোম্পানি সাধারণ মানুষকে বোঝায় যে মিসিসিপি রাজ্যে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ; যেমন- কয়লা, মূল্যবান ধাতু আর মূল্যবান পশুপাখির চামড়া পাওয়া সম্ভব। কয়েক মাসের মাথায় কোম্পানিটি ইউরোপের বাইরে ফ্রান্স সরকারের যাবতীয় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করলো। সরকারি রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব এই কোম্পানির হাতে গেলো। জন ল ফরাসি সরকারের ঋণ পরিশোধ পরিকল্পনাকে নিজের মতো করে ঢেলে সাজান এবং সরকারি ঋণ কোম্পানির শেয়ারের বিনিময়ে ঋণ পরিশোধ করার পদ্ধতি চালু করেন। ১৭১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মিসিসিপি কোম্পানি তাদের ৫০০ লিভার মূল্যের শেয়ার বাজারে ছাড়া শুরু করে। এই শেয়ার দ্বারা ব্যাংক নোট কেনা কিংবা সরকারি ঋণ পরিশোধ করা যেতো। জন ল প্রচার করলেন এই শেয়ার ক্রয় করে মিসিসিপি রাজ্যে বিনিয়োগ করে দ্রুত বিত্তশালী হওয়া সম্ভব। জানুয়ারিতে যে শেয়ারের মূল্য ছিলো ৫০০ লিভার, সেই শেয়ারের মূল্য ডিসেম্বর নাগাদ ১০ হাজার লিভারে দাঁড়ায়! ৩৬৫ দিনের ব্যবধানে মিসিসিপি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য আকাশ ছুঁয়ে ফেললে সর্বস্তরের মানুষ এই শেয়ার ক্রয় করে অধিক মুনাফার আশায়। জন ল ইউরোপের সবচেয়ে বিত্তশালী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন। জেনারেল ব্যাংক মানুষের অসীম চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক নোট বাজারে ছেড়ে যাচ্ছিলো দেখে এক বছরের মধ্যে বাজারে তরল অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ১৮৬%! মুদ্রাস্ফীতির ভয়াবহতায় ১৭১৯ সালের শেষ নাগাদ ফ্রান্সের বাজারে পণ্যমূল্য দ্বিগুণ হয়ে যায়, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি পায় ২০ গুণ! বাড়ি ভাড়া দেয়ার জন্য বাড়িওয়ালারা তাদের সকল জমির উপর বাড়ি নির্মাণ করতে শুরু করেন। দ্রুত শেয়ারের দাম বৃদ্ধি ও এর সার্বিক পরিণতির কিছুটা আঁচ পাচ্ছিলেন জন। জেনারেল ব্যাংক তাদের কাছে গচ্ছিত সোনা, রূপার তুলনায় ৩-৪ গুণ বেশি কাগুজে নোট বাজারে ছেড়ে দিয়েছে ততদিনে। গচ্ছিত সম্পদ ও তরল অর্থের মধ্যকার বিপুল ব্যবধান কমাতে তিনি মিসিসিপি উপনিবেশ থেকে সোনা-রূপার স্বদেশমুখী প্রবাহের আশায় ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, মিসিসিপির উপর বিনিয়োগের অর্থ দিয়ে তিনি ঘাটতি মেটাবেন। ১৯২০ সালের শুরুর দিকে মিসিসিপি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য পড়তে শুরু করে। অনেক বিনিয়োগকারী মূল্য চূড়ায় থাকতে লাভ তুলে নিতে চাইছিল, তারা তাদের শেয়ার বিক্রয় করে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ফেরত নিতে গেলে জন আইন করে শেয়ার বিক্রয়ের সর্বোচ্চ সীমা ১০০ লিভার নির্ধারণ করেন। কিছুকালের মধ্যে কোম্পানির শেয়ার মূল্য অতিরিক্ত নির্ধারিত হয়েছে, এমন ঘোষণা দিয়ে মূল্য কমিয়ে দেন জন। শেয়ারের মূল্য কমে যাওয়ায় ব্যাংক নোটের মূল্য ৫০% পড়ে গেলে শুরু হয় জনরোষ। গণ আন্দোলন শুরু হয়ে যেতে পারে, এই ভয়ে ব্যাংক নোটের মান আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিলেও ব্যাংকে গচ্ছিত মূল্যবান ধাতব মুদ্রার অভাবে কাগুজে মুদ্রার সাথে ধাতব মুদ্রার বিনিময় সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অনেক বিনিয়োগকারী একযোগে শেয়ার বিক্রি করায় শেয়ারের দাম ১,০০০ লিভারে নেমে আসে। একসময়ের মিলিয়নিয়াররা নিঃস্ব হয়ে রাস্তায় নেমে আসে, শ্লোগান দেয় জনের বিরুদ্ধে। ততদিনে কোম্পানির দুই-তৃতীয়াংশ শেয়ার তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে চলে গেছে। একই সময়ে ব্রিটেনেও ‘সাউথ সি বাবল’ নামক অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকেন্দ্রিক ত্রুটির ঘটনা ঘটেছিল। কয়েক দশক ধরে ফ্রান্সে চলতে থাকে মন্দা। এই মন্দার রেশ ধরে ফরাসি বিপ্লবের জ্বালানী পুঞ্জীভূত হয়েছিল। আর নারীর ছদ্মবেশে দেশ থেকে পালিয়েছিলেন জন!
Comments