মূর্খদের হাতে চাঁদের অবস্থা
১১৭৮ সালের ১৮ই জুনের ভ্যাপসা গরমের এক সন্ধ্যায় উত্তর ইংল্যান্ডের কেন্ট শহরের ক্যান্টারবেরি ক্যাথিড্রালের সন্ন্যাসীরা তাদের সন্ধ্যার প্রার্থনা শেষ করে বাইরে খোলা মাঠে একটু বাতাস খেতে বেরিয়েছিলেন। হঠাৎ তারা খেয়াল করলেন নতুন চাঁদের মতো ছোট এক চিলতে অংশ প্রায় খাড়াভাবে আকাশে ঝুলে ছিল। উপরে এবং নিচে গরুর শিংয়ের মতো দু’টো অংশ দেখা যাচ্ছিলো। সন্ন্যাসীরা দেখলেন, চাঁদের উপরের ফালির অংশটা দুই ভাগ হয়ে গেলো আর সে দুই ভাগের মাঝখান থেকে একটি জ্বলন্ত মশাল বেরিয়ে আসলো। স্ফুলিঙ্গ এবং ধোয়া ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো চাঁদ জুড়ে। চাঁদটা বেশ কিছুক্ষণ সাপের মতো পাক খেলো। চাঁদের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত পুরো অংশ ছাই রঙের হয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ এই অবস্থায় থাকার পর চাঁদ আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেলো। চার্চে ’ক্রনিকলার’ নামে একটা পোস্ট ছিল যা উল্লেখযোগ্য সকল ঘটনার সাল তারিখসহ রেকর্ড রাখতো। ১১৭৮ সালে ক্যান্টারবেরি চার্চের ক্রনিকলার ছিলেন Gervasus Cantuariensis। তিনি এই ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন তার ক্রনিকলে।
১৯৫০ এর পরে যখন একের পর এক রকেট চাঁদে যাওয়া শুরু করলো, তখন চাঁদের পৃষ্ঠের প্রচুর ছবি বিজ্ঞানীদের হাতে আসে। দেখা গেলো সেখানকার মাটিতে প্রচুর খাদ বা গর্ত রয়েছে। লাখ লাখ বছর ধরে অনেক গ্রহাণু কিংবা ধূমকেতু চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়ে এই গর্ত করেছে বলে ধারণা করা হয়। গ্রহাণুরা হলো বিভিন্ন ধূমকেতু বা অন্যান্য গ্রহের অবশিষ্ট অংশ। বৃহস্পতি আর মঙ্গল গ্রহের মাঝে এই গ্রহাণুর সংখ্যা অনেক বেশি। এই অঞ্চলকে এ্যস্টেরয়েড বেল্ট বলে। এরা সূর্যের চারদিকে নিজের কক্ষপথে ঘোরে। তবে মাঝে মাঝে তাদের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে অন্যদিকে চলে আসে। পৃথিবীর আশেপাশেও মাঝে মাঝে গ্রহাণু চলে আসে। এগুলো কয়েক সেন্টিমিটার থেকে শুরু করে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এই গ্রহাণুরা ঢুকে পড়লে বাতাসের সাথে ঘষা খেয়ে আগুন জ্বলে ওঠে। তখন গ্রহাণুগুলো পুড়ে পৃথিবীর মাটিতে ছাই হয়ে পড়ে যায়। আকাশে মাঝেই মাঝেই কিছু সময়ের জন্য আগুন জ্বলতে দেখা যায়। এদেরকেই ’তারা খসা’ বলে। মহাশূন্যে বাতাস নেই দেখে সেখানে প্রচণ্ড গতিতে গ্রহাণুগুলো চললেও আগুন ধরে না। পৃথিবীর পৃষ্ঠের কয়েক কিলোমিটার উপর পর্যন্ত বায়ুমণ্ডল আছে। এর মধ্যে প্রচণ্ড গতি নিয়ে কোনো বস্তু ঢুকে পড়লে বাতাসের সাথে ঘর্ষণে অনেক তাপ উৎপন্ন হয়। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন আছে প্রচুর। প্রচুর তাপ আর অক্সিজেন মিলিয়ে গ্রহাণুতে আগুন জ্বলে ওঠে। মাঝে মাঝে কিছু বড় আকারের গ্রহাণুও ঢুকে পড়ে। তারা এতই বড় হয় যে আগুন ধরে গিয়ে পুড়তে পুড়তে শেষ হয়ে যায়না, কিছু অংশ মাটি পর্যন্ত চলে আসে। মাটিতে আছড়ে পড়ে তার মধ্যে ক্র্যাটার তৈরি করে। গত কয়েক কোটি বছরে পৃথিবীতে প্রচুর গ্রহাণু এসে অনেক গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সেসব গর্তের অধিকাংশই পূরণ হয়ে গেছে প্লেট টেকটোনিক্স সক্রিয়তার কারণে কিংবা বায়ুপ্রবাহ বা জলীয় স্রোতের কারণে। তবে এখনো অনেক গর্তের আলামত আছে। মেক্সিকোর Chicxulub crater এরকম একটা বড় গর্ত, যেখানে ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে একটা বড় গ্রহাণু এসে আছড়ে পড়েছিল। ফলে ডাইনোসরসহ পৃথিবীর অধিকাংশ জীব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। চাঁদে যেহেতু কোনো বায়ুমণ্ডল বা অক্সিজেন নেই, তাই চাঁদে উল্কা বা গ্রহাণু ঢুকে পড়লে আগুন জ্বলে আর সরাসরি পৃষ্ঠে পড়ে গর্ত তৈরি করবে। আর চাঁদে যেহেতু কোনো বায়ুমণ্ডল, পানি, নদীর স্রোত আর প্লেট টেকটোনিক্স নেই তাই এর ক্রেটারগুলো বছরের পর বছর প্রায় অবিকৃত অবস্থায় থাকে।
চাঁদের উত্তর-পূর্ব অংশে ২২ কিলোমিটারের একটা ক্র্যাটার পাওয়া যায়। জ্যোতির্বিদ জিওর্দানো ব্রূনোর নামানুসারে এর নাম রাখা হয় জিওর্দানো ব্রূনো ক্র্যাটার। ১৯৭৬ সালে জিওলজিস্ট Jack B. Hartung খেয়াল করলেন, এই ক্র্যাটারের অবস্থানের সাথে ক্যান্টারবেরির সন্ন্যাসীদের পর্যবেক্ষণ মিলে যায়।
একটা ধূমকেতু বা গ্রহাণু চাঁদের খুব কাছে এসেছিল দেখেই সন্ন্যাসীরা চাঁদ দুই ভাগ হয়ে গেছে ভেবেও ভুল করেছিলেন। গ্রহাণুটা চাঁদের বুকে আছড়ে পড়ার পর প্রচুর পাথর খণ্ড ও ধুলোবালি বাতাসে উড়ে। সন্ন্যাসীদের পরবর্তী বিবরণের (পুরো চাঁদ ধুলোয় ঢেকে গিয়ে ছাই বর্ণ হয়ে গিয়েছিল) সাথেও সেটা মিলে যাচ্ছে। যথেষ্ট বড় আকারের ধূমকেতু যদি চাঁদকে আঘাত করে, তাহলে সেটা তার নিজের কক্ষপথ থেকে একটু সরে যাবে। চাঁদের সাপের মতো পাক খাওয়ার ব্যাখ্যাও এটাই।
তবে কেউ কেউ এই হাইপোথিসিসের কিছু ত্রূটি বের করেছেন। যেমন-
১১৭৮ সালের ১৮ই জুন চাঁদে যদি ধূমকেতু বা উল্কাপাত ঘটে, তবে প্রচুর পরিমাণে পাথরখণ্ড চাঁদ থেকে ছিটকে মহাশূন্যে যাওয়ার কথা। এদের মধ্যে অনেক পাথরখণ্ড পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেও পড়ার কথা। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকলে বাতাসের প্রচণ্ড ঘর্ষণের কারণে আগুন জ্বলে উঠার কথা, যেটাকে প্রচলিত ভাষায় ’তারা খসা’ বলে। ১১৭৮ সালে এই ঘটনা চাঁদের বুকে ঘটলে পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পৃথিবীতে অনেক বেশি উল্কাপাত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি। বাগদাদ, ভারত কিংবা চীনের কোনো লিখিত ইতিহাসেও সেসময়ে এমন কোনো উল্কা বৃষ্টির কথা পাওয়া যায়নি। আর মহাজাগতিক বড় কোনো ঘটনা বিশ্বের সব জায়গা থেকে কম বেশি দেখা যায় এবং একাধিক জাতির পুরনো ইতিহাস বা ছবিতে সে সকল ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু ক্যান্টারবেরির সন্ন্যাসীদের চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হতে দেখার ঘটনার বিবরণ আর কোথাও পাওয়া যায়না।
এসব দিক বিবেচনা করে ক্যান্টারবেরি সন্ন্যাসীদের ঘটনার আরেকটি নতুন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তৈরি করা হয়েছে-
সেসময়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে একটা উল্কাপাত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের কেন্টের আকাশ থেকে দেখে মনে হয়েছিল, উল্কাটা ঠিক চাঁদ বরাবর ঘটেছে। একারণে ক্যান্টারবেরির সন্ন্যাসীরা লিখেছিলেন যে চাঁদে ভয়ানক একটা ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বিশ্বের অন্য এলাকার মানুষ দেখেছিলো চাঁদ থেকে বহুদূরে আকাশের অন্য জায়গায় একটা উল্কাপাত ঘটেছে। একারণে গুরুত্বহীন ঘটনাটা কেউ আর লিখে রাখেনি।
২০১৩ সালের ১৫ই ফেব্রূয়ারি সকাল ৯ টায় রাশিয়ার সেলিয়াবিনস্ক শহরের আকাশে ৬৬ ফুট ব্যাসার্ধের একটা গ্রহাণু আছড়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিল, হঠাৎ কোথা থেকে আকাশে একটা আগুনের গোলা আসছে এবং সেটা ক্রমাগত বড় হচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সূর্যের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি দেখতে পায় শহরবাসী। মাটিতে না পড়ে আকাশেই আগুন ধরে বিস্ফোরিত হয় সেটি (২৭ কিলোমিটার উপরে)। শব্দের শক ওয়েভে বাসার জানালার কাচ ও দুর্বল কাঠামো ভেঙে যায়। গ্রহাণুটা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পর আকাশের কিছু অংশ ধোয়ায় ঢেকে গিয়েছিল। ১১৭৮ সালের ১৮ই জুন এ রকম ছোট কোনো গ্রহাণু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়েছিল এবং ক্যান্টারবেরির সন্ন্যাসীরা সেটা দেখেই ভয় পেয়েছিলেন বলে অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের অভিমত।
https://www.youtube.com/watch?v=dpmXyJrs7iU
Comments