পশতুনদের জাতিগত আধিপত্যবাদ ও আফগানিস্তানের সর্বনাশ

 

ফগান যুদ্ধ নিয়ে ছড়ানো পুঁজিবাদীদের প্রচুর প্রোপাগান্ডাঅন্যতম ছিলআফগানিস্তানে সোভিয়েত নাস্তিক/খ্রিস্টান সৈন্যরা আফগান মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।” সেসময় পশ্চিমা অন্যান্য সোভিয়েতবিরোধী গণমাধ্যমে ধারণাটি ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছিল, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব মুসলিম জনমতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধী করে তোলা। অথচ আফগান যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে আফগানিস্তানে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন্যদের ৮০% থেকে ৯০ছিল মুসলিম! আফগানিস্তানে প্রাথমিকভাবে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন্যদের সিংহভাগ ছিল উজবেক, তাজিক, তুর্কমেন, কাজাখ কিরগিজ। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানের জনসংখ্যার ৩৫% ছিল তাজিক, উজবেক তুর্কমেন। এসময় আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় কোটি ৭০ লক্ষ এবং এদের মধ্যে ৪০ লক্ষ ছিল তাজিক, ১৫ লক্ষ উজবেক আর ১১ লক্ষ তুর্কমেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ পশতুন ছিল প্রায় ৯০ লক্ষ। আফগান তাজিক, উজবেক তুর্কমেন জনসাধারণের একাংশ সোভিয়েত সৈন্যদের স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু আফগান পশতুনদের বৃহদাংশ আফগানিস্তানে আগত সোভিয়েত সৈন্যদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক তাজিক উজবেকদের দেখে ক্ষিপ্ত হয়েছিল।পশতুনরা মনে করেছিল মস্কো আফগানিস্তানে পশতুনদের এতদিন ধরে চলে আসা রাজনৈতিক আধিপত্যকে শেষ করে তাজিক উজবেকদের ক্ষমতায়ন করবে। ফলে আফগান যুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়ে মস্কো আফগানিস্তানে মধ্য এশিয়ান সোভিয়েত সৈন্যদের পরিবর্তে স্লাভিক, বাল্টিক ককেশীয়ান সৈন্যদের প্রেরণ করতে শুরু করে। আফগান যুদ্ধের প্রথমদিকে মস্কো আফগানিস্তানে যেসব মুসলিম সৈন্যকে মোতায়েন করেছিল, তাদের সিংহভাগ ছিল সাধারণ সৈন্য। এদের ছাড়াও মস্কো আফগানিস্তানে দুই ব্যাটালিয়ন মুসলিম সৈন্য মোতায়েন করেছিল, যারা ছিল স্পেৎসনাজ

https://ru.wikipedia.org/wiki/%D0%A4%D0%BE%D1%80%D0%BC%D0%B8%D1%80%D0%BE%D0%B2%D0%B0%D0%BD%D0%B8%D1%8F_%D1%81%D0%BF%D0%B5%D1%86%D0%B8%D0%B0%D0%BB%D1%8C%D0%BD%D0%BE%D0%B3%D0%BE_%D0%BD%D0%B0%D0%B7%D0%BD%D0%B0%D1%87%D0%B5%D0%BD%D0%B8%D1%8F

(সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং বর্তমান রাশিয়ায় যেকোনো বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্যদলকে 'স্পেৎসনাজ' বলা হয়)। আফগানিস্তানে মস্কো যে দু’টি মুসলিম স্পেৎসনাজ সৈন্যদল প্রেরণ করেছিল তারা পরিচিতি পায় 'মুসলিম ব্যাটালিয়ননামে।

https://ru.wikipedia.org/wiki/%D0%9C%D1%83%D1%81%D1%83%D0%BB%D1%8C%D0%BC%D0%B0%D0%BD%D1%81%D0%BA%D0%B8%D0%B5_%D0%B1%D0%B0%D1%82%D0%B0%D0%BB%D1%8C%D0%BE%D0%BD%D1%8B

১৯৭৮ সালের ২৮ এপ্রিল আফগান সেনাবাহিনীর একদল মার্ক্সবাদী কর্মকর্তা এবং আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট দল People's Democratic Party of Afghanistan মুহাম্মদ দাউদ খানকে হত্যা করে ক্ষমতায় আসে

https://en.wikipedia.org/wiki/Mohammed_Daoud_Khan

https://en.wikipedia.org/wiki/People%27s_Democratic_Party_of_Afghanistan

https://en.wikipedia.org/wiki/Nur_Muhammad_Taraki

পিডিপিএ এর মহাসচিব নূর মুহাম্মদ তারাকী আফগানিস্তানের নতুন রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন এবং তার নেতৃত্বাধীন আফগান সরকার দেশটিতে বৈপ্লবিক সামাজিক অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। পাকিস্তান, ইরান, চীন, পশ্চিমা বিশ্ব উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর সক্রিয় সহযোগিতায় আফগান ইসলামপন্থী জঙ্গিরা দেশজুড়ে বিদ্রোহ করে। ১৯৭৯ সালের মার্চে হেরাত শহরের জনসাধারণ শহরটিতে মোতায়েনকৃত আফগান সৈন্যদল সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং শহরটিতে সরকারি দলের সদস্য সমর্থকদের ওপর গণহত্যা চালায়। আফগান গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, এই বিদ্রোহে ইরানের ইন্ধন ছিল এবং Islamic Revolutionary Guards Corps এর সদস্যরা ছদ্মবেশে বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল।

https://en.wikipedia.org/wiki/Islamic_Revolutionary_Guard_Corps

এমতাবস্থায় আফগান নেতৃবৃন্দের মনে আফগান সশস্ত্রবাহিনীর বিশ্বস্ততা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দেয় এবং ১৯৭৯ সালের ১৮ মার্চ তারাকী সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিনকে সোভিয়েত তাজিক, উজবেক তুর্কমেন সৈন্যদের আফগান সশস্ত্রবাহিনীর উর্দি পরিয়ে আফগান সৈন্যদের ছদ্মবেশে দেশটিতে প্রেরণের জন্য অনুরোধ জানান।

https://en.wikipedia.org/wiki/Alexei_Kosygin

মস্কো কাবুলের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেও আফগান রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য সোভিয়েত মুসলিম সৈন্যদের একটি ব্যাটালিয়ন গঠনের উদ্যোগ নেয়। ১৯৭৯ সালের ২৬ এপ্রিল সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর জেনারেল স্টাফ ডিরেক্টিভ নম্বর ৩১৪//০০৬১ জারি করে সোভিয়েত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দেয় সোভিয়েত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা 'গ্ রুএর কর্মকর্তা মেজর সের্গেই কজলভ (ছদ্মনাম 'কোলেসনিক') এই বাহিনীটি গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।

https://en.wikipedia.org/wiki/GRU_(G.U.)

তিনি ছিলেন কাবুলে 'গ্ রু' এর সিনিয়র প্রতিনিধি। প্রথম যেই মুসলিম ব্যাটালিয়নটি গঠন করা হয় সেটির আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ১৫৪ তম পৃথক স্পেশাল-পার্পাস ডিটাচমেন্ট

https://ru.wikipedia.org/wiki/15-%D1%8F_%D0%BE%D1%82%D0%B4%D0%B5%D0%BB%D1%8C%D0%BD%D0%B0%D1%8F_%D0%B1%D1%80%D0%B8%D0%B3%D0%B0%D0%B4%D0%B0_%D1%81%D0%BF%D0%B5%D1%86%D0%B8%D0%B0%D0%BB%D1%8C%D0%BD%D0%BE%D0%B3%D0%BE_%D0%BD%D0%B0%D0%B7%D0%BD%D0%B0%D1%87%D0%B5%D0%BD%D0%B8%D1%8F

এটি '১ম মুসলিম ব্যাটালিয়ন' নামে সমধিক পরিচিত। বাহিনীটি গঠনের জন্য সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর 'তুর্কিস্তান সামরিক জেলার ,০০০ সেরা সৈন্যকে বাছাই করা হয়, যাদের সকলে ছিল তাজিক, উজবেক কিংবা তুর্কমেন।

https://ru.wikipedia.org/wiki/%D0%A2%D1%83%D1%80%D0%BA%D0%B5%D1%81%D1%82%D0%B0%D0%BD%D1%81%D0%BA%D0%B8%D0%B9_%D0%B2%D0%BE%D0%B5%D0%BD%D0%BD%D1%8B%D0%B9_%D0%BE%D0%BA%D1%80%D1%83%D0%B3

এদের মধ্য থেকে সেরা ৫৩৮ জন সৈন্যকে মুসলিম স্পেৎসনাজ গঠনের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত করা হয়। এই সৈন্যদের মধ্যে ট্যাঙ্কম্যান, মোটরবাহী রাইফেল ইউনিটের সৈন্য, সীমান্তরক্ষী, প্যারাট্রুপার থেকে শুরু করে সব ধরনের সৈন্য ছিল। ৫৩৮ জন বাছাইকৃত সৈন্যদের মধ্যে মাত্র জন ছিল রুশ, যাকে একটি বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র চালানোর জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল। ব্যাটালিয়নের কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর হাবিব খালবায়েভ, যিনি ছিলেন উজবেক। ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়ন ৪টি কোম্পানি এবং ৩টি অতিরিক্ত প্লাটুনে বিভক্ত ছিল। ১ম কোম্পানির সৈন্যরা ট্র্যাকযুক্ত 'বিএমপি-' সাঁজোয়া যান এবং ২য় ৩য় কোম্পানির সৈন্যরা চাকাযুক্ত 'বিটিআর-৬০পিবি' সাঁজোয়া যান ব্যবহার করতো।

https://en.wikipedia.org/wiki/BMP-1

https://en.wikipedia.org/wiki/BTR-60

৪র্থ কোম্পানি ছিল ওয়েপন্স ইউনিট; এটির অংশ ছিল এক প্লাটুন 'এজিএস-১৭' স্বয়ংক্রিয় গ্রেনেড লঞ্চারধারী সৈন্য, এক প্লাটুন 'লিঙ্কস আরপিও' ফ্লেমথ্রোয়ারধারী সৈন্য এবং এক প্লাটুন স্যাপার।

https://en.wikipedia.org/wiki/AGS-17

https://en.wikipedia.org/wiki/RPO-A_Shmel

https://en.wikipedia.org/wiki/Sapper

ব্যাটালিয়নটিতে যে অতিরিক্ত তিনটি প্লাটুন ছিল তার একটি ছিল সিগন্যাল প্লাটুন, একটি ছিল 'জেডএসইউ ২৩- শিল্কা' বিমান বিধ্বংসী প্লাটুন এবং একটি ছিল যানবাহন বস্তুগত সহায়তা প্লাটুন। ব্যাটালিয়নটিতে একটি চলমান ফিল্ড ড্রেসিং স্টেশন ছিল, যেটিতে একজন অ্যানাস্থিসিয়া বিষয়ক ডাক্তার একজন সার্জন ছিলেন।

https://en.wikipedia.org/wiki/ZSU-23-4_Shilka

প্রতিটি কোম্পানিতে একজন করে সামরিক দোভাষী নিযুক্ত করা হয়েছিল, যদিও ব্যাটালিয়নটির তাজিক সৈন্যদের সকলেই, উজবেক সৈন্যদের প্রায় অর্ধাংশ এবং তুর্কমেন সৈন্যদের একাংশ ফার্সি ভাষায় সুদক্ষ ছিল। ব্যাটালিয়নটি সৃষ্টির পর সৈন্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাদের প্যারাট্রুপার হিসেবে প্রশিক্ষিত করা হয় এবং দালান, বিমানঘাঁটি পার্বত্য গিরিপথ দখল করা শহরাঞ্চলে যুদ্ধ চালানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়। প্রতিটি সৈন্যকে সাম্বোতে বিশেষভাবে দক্ষ করে তোলা হয় এবং দৌড়ানো অবস্থায় গুলি চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

https://en.wikipedia.org/wiki/Sambo_(martial_art)

https://en.wikipedia.org/wiki/Paratrooper

যেসব সৈন্য গ্রেনেড লঞ্চার চালাতো, তাদের ধোঁয়ার মধ্যে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার জন্য আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

https://en.wikipedia.org/wiki/Grenade_launcher

প্রশিক্ষণ শেষে ব্যাটালিয়নটির সৈন্যদের আফগান সেনাবাহিনীর উর্দি পরানো হয় এবং তাদের জন্য জাল আফগান পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়। পরিচয়পত্রে তাদের আসল নাম দেয়া ছিল, কারণ তাদের নামগুলো ছিল আফগানিস্তানে প্রচলিত। পরবর্তীতে মস্কো ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নসহ আরো ৭টি স্পেৎসনাজ সৈন্যদল আফগানিস্তানে প্রেরণের জন্য গঠন করে এবং ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়ন ছিল এই সৈন্যদলগুলোর প্রোটোটাইপ। ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয়েছিল তারাকীর ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য। কিন্তু বাহিনীটিকে আফগানিস্তানে মোতায়েন করার আগেই ১৯৭৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আফগান প্রধানমন্ত্রী প্রতিরক্ষামন্ত্রী হাফিজুল্লাহ আমিন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারাকীকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং লিওনিদ ব্রেজনেভের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও তারাকীকে হত্যা করা হয়।

https://en.wikipedia.org/wiki/Hafizullah_Amin

https://en.wikipedia.org/wiki/Leonid_Brezhnev

আমিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছিলেন এবং সেসময় সিআইএ তাকে অর্থসাহায্য করেছিলআমিন কর্তৃক মস্কোপন্থী তারাকীকে ক্ষমতাচ্যুত করা পরবর্তীতে মস্কোর অনুরোধ উপেক্ষা করে তাকে হত্যা করা, মস্কোর পরামর্শ উপেক্ষা করে আফগান ইসলামপন্থীদের ওপর নির্যাতন চালানো এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা- এসব বিবেচনা করে কেজিবি প্রধান ইউরি আন্দ্রোপভ সিদ্ধান্ত নেন আমিন সিআইএ এজেন্ট।

https://en.wikipedia.org/wiki/Yuri_Andropov

https://en.wikipedia.org/wiki/KGB

সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন আমিনকে সরিয়ে তার জায়গায় সমঝোতায় আগ্রহী কাউকে কাবুলের ক্ষমতায় বসাতে হবে। আমিন বারবার মস্কোকে অনুরোধ জানাচ্ছিলেন দেশটিতে সোভিয়েত সৈন্য মোতায়েন করার জন্য। ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নকে আফগান রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা বিমানযোগে আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটিতে পৌঁছে। সেখান থেকে তাদের কাবুলে প্রেরণ করা হয়। ২৪ ডিসেম্বর ৮০,০০০ সোভিয়েত সৈন্য আমুদরিয়া নদী পেরিয়ে আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। ২৭ ডিসেম্বর কেজিবি 'স্টর্ম-৩৩৩' অভিযানটি পরিচালনা করে 

https://en.wikipedia.org/wiki/Operation_Storm-333

আমিন তৎকালীন আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি নিবাস তাজবেগ প্রাসাদে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থাকতেন। আমিনের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী বাহিনী, আফগান জাতীয় রক্ষীবাহিনী আফগান সেনাবাহিনীর প্রায় ,২০০ সৈন্য প্রাসাদটি পাহারা দিতো। ২৭ ডিসেম্বর রাতে কেজিবির স্পেৎসনাজের ৫৫ জন সৈন্য, ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নের ৫২০ জন সৈন্য এবং ৮৭ জন সোভিয়েত প্যারাট্রুপার- মোট ৬৬২ জন সোভিয়েত সৈন্য তাজবেগ প্রাসাদ আক্রমণ করে। ৪০ মিনিটের মধ্যে সোভিয়েত সৈন্যরা তিনগুণ বেশি সংখ্যক আফগান সৈন্যকে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি আমিনকে খুন করে। ২০০ জনের বেশি আফগান সৈন্য নিহত এবং প্রায় ,৭০০ আফগান সৈন্য সোভিয়েত সৈন্যদের হাতে বন্দি হয়। মাত্র ১৪ জন সোভিয়েত সৈন্য নিহত হয়, যাদের মধ্যে জন ছিল ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নের সদস্য। আফগান প্রচারমাধ্যমে ঘোষণা করা হয়, একটি আফগান বিপ্লবী আদালতে আমিনকে তার অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। ১৯৮০ সালের ১০ জানুয়ারি ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রত্যাবর্তন করে। সৈন্যদের অভিযান সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চুপ থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। আমিনকে সরিয়ে মস্কো আফগানিস্তানের প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপ্রধান বাবরাক কারমালকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে।

https://en.wikipedia.org/wiki/Babrak_Karmal

মস্কোর পরিকল্পনা ছিল সোভিয়েত সৈন্যরা বছরখানেক আফগানিস্তানে থেকে ইসলামপন্থী জঙ্গীদের পরাজিত করতে আফগান সরকারি বাহিনীকে সহায়তা করবে এবং এরপর সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু মার্কিন, পাকিস্তানি, ইরানি চীনা সহায়তায় আফগান জঙ্গীরা আরো সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৮১ সালের অক্টোবরে ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নকে আবার আফগানিস্তানে প্রেরণ করা হয়। সৈন্যদলটি আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে আফগান জঙ্গীদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ অ্যামবুশ, বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তিরক্ষা অভিযান এবং আফগানিস্তান পুনর্গঠনের কাজে অংশগ্রহণ করে। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে এই বাহিনীর সৈন্যরা আফগানিস্তানের জৌজ্জান প্রদেশের জার কুদুক অঞ্চলে অবস্থিত জঙ্গীদের ঘাঁটিগুলো দখল করে নেয়। ১৯৮২ সালের এপ্রিলে তারা জৌজ্জান প্রদেশের সানচারাকা অঞ্চলে জঙ্গীদের দ্বারা অবরুদ্ধ আফগান সরকারি সৈন্যদলকে উদ্ধার করে। ১৯৮২ সালের অক্টোবরে তারা সামানগান প্রদেশের কুলি ইশান অঞ্চলে ২টি জঙ্গি গ্রূপকে ধ্বংস করে দেয়। ১৯৮৩ সালের মার্চে ব্যাটালিয়নটি মার্মোল উপত্যকায় তাদের সর্বশেষ অভিযানে অংশ নেয় এবং সেখানকার জঙ্গি ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দেয়। একই মাসে ব্যাটালিয়নটিকে চূড়ান্তভাবে আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। আফগান যুদ্ধে ব্যাটালিয়নটির সর্বমোট ৩৪ জন সৈন্য নিহত জন সৈন্য নিখোঁজ হয়। 'স্টর্ম-৩৩৩' অভিযানে ১ম মুসলিম ব্যাটালিয়নের কৃতিত্ব দেখে মস্কোর নীতিনির্ধারকরা অনুরূপ আরেকটি বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৮১ সালের ফেব্রূয়ারিতে সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর 'তুর্কিস্তান সামরিক জেলা' এবং 'লাল ব্যানার মধ্য এশিয়ান সামরিক জেলা' মুসলিম সৈন্যদের মধ্য থেকে সেরাদের বাছাই করে গঠন করা হয় '২য় মুসলিম ব্যাটালিয়ন', আনুষ্ঠানিকভাবে যেটির নাম ছিল ১৭৭তম পৃথক স্পেশাল-পার্পাস ডিটাচমেন্ট

https://en.wikipedia.org/wiki/Central_Asian_Military_District

ব্যাটালিয়নটির সদস্যদের মধ্যে প্রায় ৩০০ জন ছিল উইঘুর; অন্যরা ছিল তাজিক, উজবেক, কাজাখ কিরগিজ জাতিভুক্ত। ব্যাটালিয়নটির কমান্ডার মেজর বোরিস কেরিমবায়েভ ছিলেন কাজাখ এবং ডেপুটি কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেলস বেকবোয়েভ ছিলেন কিরগিজ। ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে বাহিনীটিকে উত্তর আফগানিস্তানের ফারিয়াব প্রদেশের দারঝোব জেলায় মোতায়েন করা হয়। সেখানে তাদের আফগানিস্তান পুনর্গঠনের কাজে নিযুক্ত করা হয়। অঞ্চলটির অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল তাজিক উজবেক। ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়ন তাদের সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ধর্মগত সামঞ্জস্যের কারণে অঞ্চলের অধিবাসীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। অঞ্চলের জঙ্গীদের দমন করার জন্য তারা স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে বড় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। তাদের প্রচেষ্টায় এতদঞ্চলের জঙ্গী কমান্ডার মৌলভি পাহলোয়ান তার দলের প্রায় ১৫০ যোদ্ধাসহ আফগান সরকারি বাহিনীতে যোগদান করেন। ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়ন অঞ্চলটিতে এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, যখন বাহিনীটিকে ১৯৮২ সালের মাঝামাঝি সময়ে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয় তখন অঞ্চলটির স্থানীয় নেতারা আফগান রাষ্ট্রপ্রধান কারমালকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন যেন বাহিনীটিকে সেখান থেকে প্রত্যাহার না করা হয়। এমনকি তারা দারঝোব জেলায় জনগণের নিজেদের অর্থে ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নকে অঞ্চলে রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ১৯৮২ সালের মাঝামাঝিতে ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নকে মোতায়েন করা হয় পাঞ্জশির উপত্যকায়। এই অঞ্চলে সক্রিয় ছিল কুখ্যাত আফগান জঙ্গী কমান্ডার আহমদ শাহ মাসুদ। ১৯৮২ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সোভিয়েত আফগান সৈন্যরা পরপর বার পাঞ্জশির আক্রমণ করে মাসুদের নেতৃত্বাধীন জঙ্গীদের তারা পিছু হটতে বাধ্য করলেও পুরোপুরি পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়। প্রায় ,০০০ আফগান সৈন্য প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ৯টি ট্যাঙ্কসহ জঙ্গীদের সঙ্গে যোগ দেয়। সোভিয়েত সৈন্যরা মাসুদকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে না পারার মূল কারণ ছিল মূলত জঙ্গীদের কাছ থেকে অঞ্চলটি দখল করে নেয়ার পর সোভিয়েতরা আফগান সরকারি সৈন্যদের হাতে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে তাদের সৈন্য সরিয়ে নিতো, এরপর মাসুদের বাহিনী আফগান সরকারি সৈন্যদের হারিয়ে দিয়ে অঞ্চলটি পুনর্দখল করে নিতো।

https://en.wikipedia.org/wiki/Ahmad_Shah_Massoud

মাসুদ দম্ভের সঙ্গে ঘোষণা করেছিল, একজন সোভিয়েত সৈন্যও পাঞ্জশিরে থাকতে পারবে না! সোভিয়েতরা ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নকে পাঞ্জশিরে মোতায়েন করে। ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নের সৈন্যদের পাঞ্জশিরের সঙ্গে কাবুলকে সংযোগকারী সড়কগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। এই পথে অবস্থিত সালাং টানেলের মাধ্যমে মধ্য পূর্ব আফগানিস্তানে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন্যদের রসদপত্র সরবরাহ করা হতো। মাসুদের জঙ্গীরা বহুবার ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নের ওপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু সোভিয়েত সৈন্যরা প্রতিটি আক্রমণ প্রতিহত করে এবং জঙ্গীদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে মাসুদ সোভিয়েতদের সঙ্গে মাসের জন্য যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং তার বাহিনী সালাং টানেলে সোভিয়েত কনভয়গুলোকে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকতে সম্মত হয়। ১৯৮৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়ন অঞ্চলটিতে মোতায়েন ছিল। এরপর বাহিনীটিকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরিয়ে নেয়া হয়। আফগান যুদ্ধে ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নের মোট ৫০ জন সৈন্য নিহত এবং জন সৈন্য নিখোঁজ হয়। ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নের কমান্ডার মেজর বোরিস কেরিমবায়েভ আফগান জঙ্গিদের নিকট পরিচিত ছিলেন 'কালো মেজর' নামে। তাকে জঙ্গীরা সমীহ ভয় করতো। ১৯৯২ সালে কাজাখস্তানের সেনাবাহিনীর কর্নেল হিসেবে তিনি অবসর নেন এবং ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রূয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। ২য় মুসলিম ব্যাটালিয়নের ডেপুটি কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেলস বেকবোয়েভ কিরগিজস্তানের সেনাবাহিনীতে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। তিনি কিরগিজস্তানের প্রথম উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং ২০০৪-২০০৬ সাল পর্যন্ত কিরগিজস্তানের সেনাবাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।  

 


 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]