পরবর্তী টার্গেট সোভিয়েত তাজিকিস্তান ও সোভিয়েত উজবেকিস্তান

 

আফগান যুদ্ধ চলাকালে আফগান জঙ্গীরা সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরেও আক্রমণ চালিয়েছিল এবং এই আক্রমণে সহায়তা করেছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, যাদের পর্দার অন্তরাল থেকে সমর্থন দিচ্ছিল সিআইএ। ১৯৭৯ সালে ইরানে সংঘটিত ইসলামি বিপ্লবের ফলে ইরানের শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন এবং আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামপন্থী সরকার ইরানের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ইরানের নতুন সরকার ইরানি কমিউনিস্টদের ওপর নির্যাতন শুরু করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি শত্রুতামূলক আচরণ শুরু করে।১৯৭৮ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আফগান কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করে।

https://en.wikipedia.org/wiki/Saur_Revolution

তাদের বৈপ্লবিক, সামাজিক অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে ভীত হয়ে পাকিস্তান ইরানের প্রত্যক্ষ সহায়তায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদে বিভিন্ন জঙ্গী গ্রূ আফগান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হয়। ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরের অভ্যুত্থানে আফগান রাষ্ট্রপতি নূর মুহম্মদ তারাকীকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রধানমন্ত্রী হাফিজুল্লাহ আমিন ক্ষমতা দখল করেন যে ছিল মূলত মার্কিনিদের গুপ্তচর। সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রের মধ্যে ৬টি ছিল মুসলিম অধ্যুষিত। এগুলোর মধ্যে ৫টি (কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান তুর্কমেনিস্তান) ছিল মধ্য এশিয়ায় এবং ১টি (আজারবাইজান) ছিল দক্ষিণ ককেশাসে অবস্থিত। ১৯৩০ এর দশকের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সবগুলো প্রজাতন্ত্রের মধ্যে এই প্রজাতন্ত্রগুলো ছিল মস্কোর প্রতি সবচেয়ে অনুগত। প্রজাতন্ত্রগুলো ছিল খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস অন্যান্য খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রচুর অর্থ ব্যয় করে প্রজাতন্ত্রগুলোতে শিল্পায়ন ঘটিয়েছিল এবং জল, স্থল আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছিল। সেসময় সমগ্র মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সোভিয়েত মুসলিম প্রজাতন্ত্রগুলোর জীবনযাত্রার মান ছিল সবচেয়ে উন্নত এবং সাক্ষরতার হার ছিল সবচেয়ে বেশি। সিআইএর পরিচালক (১৯৮১-১৯৮৭) উইলিয়াম কেসি মধ্য এশিয়াকে সোভিয়েত 'ভাল্লুকের নরম তলপেট' হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা আফগান জঙ্গীদের পাকিস্তানের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে। একজন সোভিয়েত জেনারেলের মতে, আফগানিস্তানকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং পাকিস্তানি-আফগান সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করার মাধ্যমে জঙ্গীদের দমন করতে কমপক্ষে ৩৬ ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কৌশলগত কারণে মস্কো আফগানিস্তানে  ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করেছিল এবং বছরব্যাপী আফগান যুদ্ধে দেশটিতে নিয়োজিত সোভিয়েত সৈন্য সংখ্যা কখনো ,১৫,০০০ এর বেশি ছিল না। সোভিয়েত সৈন্যবাহিনীকে সামরিকভাবে পরাজিত করা জঙ্গীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সোভিয়েতদের ভয়ে আফগান জঙ্গীদের অস্ত্র অর্থ সরবরাহের ক্ষেত্রে মার্কিন বা অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থা সরাসরি সংযুক্ত ছিল না, পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা 'ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স' এক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতো। ১৯৮৪ সালে সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম কেসি আফগান যুদ্ধের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য পাকিস্তানে আসেন। কেসি ছিলেন রিপাবলিকান দলের সমর্থক এবং তীব্র সোভিয়েতবিরোধী। বলা হয়ে থাকে, কেসি সিআইএ-তে এসেছিলেন সংগঠনটির সংস্কার বা কার্যপদ্ধতির উন্নয়নের জন্য নয়, বরং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। কেসির মতামত ছিল, 'নাস্তিক' কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান মুসলিমদের একত্রিত হয়ে যথাক্রমে 'ক্রুসেড' 'জিহাদ' পরিচালনা করা উচিত! স্নায়ুযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের -রুশ অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদ ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট ছিল। ইউক্রেনীয় বাল্টিক জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে সিআইএ-র ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, কিন্তু মধ্য এশিয়ায় তাদের তেমন কোনো কার্যক্রম ছিল না। কেসি তার পাকিস্তান সফরকালে আইএসআই কর্মকর্তাদের পরামর্শ দেন, তাদের উচিত সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে ধর্মীয় মৌলবাদ ছড়িয়ে দেয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালানোর জন্য আফগান গেরিলাদের উৎসাহিত করা! এই উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে সোভিয়েতবিরোধী প্রচারণা চালানো এবং অস্ত্র সরবরাহের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তিনি তাদের উৎসাহ দেন। আফগান যুদ্ধের ফলে প্রায় ৩০ লক্ষ শরণার্থী পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল পাকিস্তানি নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা পার্শ্ববর্তী আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্যদের উপস্থিতিকে ভীতির চোখে দেখতেন, তাদের আশঙ্কা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত মহাসাগরের উষ্ণ জলীয় বন্দরে প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য পাকিস্তান আক্রমণ করতে পারে। আফগানিস্তানে পাকিস্তানপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা করে জাতীয়তাবাদী আফগানদের 'বৃহত্তর পশতুনিস্তান' দাবির অবসান ঘটানো এবং পাকিস্তানের 'কৌশলগত গভীরতা' বৃদ্ধি করাও তাদের লক্ষ্য ছিল। সিআইএ-র তথ্যমতে, পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল মুহাম্মদ জিয়াউল হক পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রগুলোর সমন্বয়ে একটি মুসলিম 'ফেডারেশন' বা 'কনফেডারেশন' সৃষ্টির ইচ্ছা পোষণ করতেন। আইএসআই সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে আফগান জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। আইএসআই এর কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ ইউসুফ এই প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলোতে আফগান জঙ্গীদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ব্যাপক হারে প্রচারণা চালানো হবে। এরপর আফগানিস্তানের ভূমি থেকে সোভিয়েত ভূমিতে নিয়মিত গোলাবর্ষণ করা হবে এবং সোভিয়েত-আফগান সীমান্তবর্তী আমুদরিয়া নদীতে চলমান নৌকা স্টিমারগুলো ডুবিয়ে দেয়া হবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে সশস্ত্র আফগান যোদ্ধারা সোভিয়েত মধ্য এশিয়ায় অনুপ্রবেশ করে বিভিন্ন সোভিয়েত স্থাপনার ওপর রকেট হামলা চালাবে, মাইন পুঁতে রাখবে, ট্রেনের লাইন উপড়ে ফেলবে এবং সোভিয়েত সৈন্যদের ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালাবে। সিআইএ এবং আইএসআই এর আশা ছিল, এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলিমরা মস্কোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবেউজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান তুর্কমেনিস্তান এর সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্ত ছিল এবং আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে বহু তাজিক, উজবেক তুর্কমেন জাতিভুক্ত মানুষ বসবাস করতো। আফগান তাজিক, উজবেক তুর্কমেনদের সঙ্গে সোভিয়েত উজবেক, তাজিক তুর্কমেনদের জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং গোত্রগত সামঞ্জস্য ছিল এবং সিআইএ এবং আইএসআই এই সামঞ্জস্যকে কাজে লাগিয়ে সোভিয়েত মুসলিমদের মধ্যে অসন্তোষ বিদ্রোহ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। ১৯৮৪ সালে পাকিস্তানের বিশেষ প্রশিক্ষণকেন্দ্রে আইএসআই এর তত্ত্বাবধানে সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুপ্রবেশ করানোর উদ্দেশ্যে বাছাইকৃত আফগান জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আইএসআই তাদের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ শুরু করে। প্রাথমিকভাবে মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলোতে কুরআনের কপি প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিআইএ-তে কর্মরত এক উজবেক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী উজবেক ভাষায় লিখিত কিছু উপন্যাস প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই উপন্যাসগুলোতে উজবেকদের ওপর সোভিয়েতদের তথাকথিত নৃশংসতার বিবরণ ছিল! কুরআন প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত মুসলিমদের ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা, আর উপন্যাসগুলো প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল তাদের মধ্যে সোভিয়েতবিরোধী মনোভাব গঠন করা। মার্কিনি পাকিস্তানিরা আশা করেছিল, এর ফলে সোভিয়েত মুসলিমরা আফগান জঙ্গীদের সঙ্গে যোগ দেবে কিংবা নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করবে। পরিকল্পনা মোতাবেক সিআইএ-র উদ্যোগে কুরআনকে আরবি ভাষা থেকে সিরিলিক লিপিতে লিখিত উজবেক ভাষায় অনুবাদ করা হয় এবং এর ১০,০০০ কপি তৈরি করা হয়। একই সঙ্গে উজবেক ভাষায় লিখিত সোভিয়েতবিরোধী উপন্যাসগুলোর কিছু কপি তৈরি করা হয়। ১৯৮৫ সালে আফগান জঙ্গীরা সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুপ্রবেশ করে সোভিয়েত উজবেকদের মধ্যে প্রায় ,০০০ কুরআনের কপি বিলি করে। সোভিয়েত উজবেকরা কুরআনের কপিগুলো গ্রহণ করলেও সোভিয়েতবিরোধী উপন্যাসগুলো ফিরিয়ে দেয়। খুব কম সংখ্যক সোভিয়েত মুসলিম আফগান জঙ্গীদের সঙ্গে যোগ দিতে বা সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহী ছিল। আইএসআই এর পরিকল্পনার প্রথম ধাপ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মার্কিন সরকারের চাপে সিআইএ আইএসআই-কে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে অভিযান চালানো বন্ধ করার নির্দেশ দেয়, কিন্তু আইএসআই তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করতে থাকে। সিআইএ কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে আইএসআইকে তাদের পরিকল্পনা চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করেন, কিন্তু পাকিস্তানিদের সরাসরি কোনো সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানান। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা সিআইএ'র কাছে সোভিয়েত-আফগান সীমান্তবর্তী সোভিয়েত অঞ্চলগুলোর বিস্তারিত মানচিত্র চেয়েছিলেন, কিন্তু সিআইএ এতে অস্বীকৃতি জানায়। সিআইএ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য ছিল, আইএসআই নিজ উদ্যোগে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে আক্রমণ পরিচালনা করলেও তাতে যেন মার্কিন সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ না পাওয়া যায়। ১৯৮৬ সালের প্রথমদিকে আফগান জঙ্গীরা আফগানিস্তানের ভূমি থেকে সোভিয়েত-আফগান সীমান্তবর্তী আমুদরিয়া নদীতে চলমান মালবাহী সোভিয়েত নৌকা স্টিমারগুলোর ওপর আক্রমণ চালায় এবং ব্রিটিশদের সরবরাহকৃত লিম্পেট মাইন ব্যবহার করে বেশ কয়েকটি সোভিয়েত নৌযান ডুবিয়ে দেয়। আফগান ভূমি থেকে তারা সীমান্তের অপর পাশে অবস্থিত সোভিয়েত গ্রাম শহরগুলোর ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে দেয়।

https://en.wikipedia.org/wiki/Limpet_mine

আমুদরিয়া নদীর ওপর অবস্থিত সোভিয়েত-আফগান মৈত্রী সেতুটি বিস্ফোরকের মাধ্যমে উড়িয়ে দেয়ার জন্য আইএসআই পরিকল্পনা করে। এই সেতু দিয়ে সোভিয়েত সৈন্যরা আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিল এবং এটির মাধ্যমে আফগানিস্তানে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন্যদের রসদপত্র সরবরাহ করা হতো। পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হক এই পরিকল্পনার কথা জানতে পারার সাথে সাথে এটি বাতিল করে দেন। তার আশঙ্কা ছিল, এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সোভিয়েতরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বড় বড় স্থাপনায় আক্রমণ চালাতে পারে। সোভিয়েত উজবেকিস্তানের সমরখন্দ থেকে আফগান সীমান্তের নিকটবর্তী তেরমেজ শহর পর্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ ছিল। এটির মাধ্যমে সোভিয়েত সৈন্যরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র রসদপত্র সরবরাহ করতো। ১৯৮৬ সালে আইএসআই রেলপথটি উপড়ে ফেলার উদ্দেশ্যে দু’টি প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রে আফগান জঙ্গীরা কেজিবি' হাতে ধরা পড়ে নিহত হয়। ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরে আফগান জঙ্গীরা সোভিয়েত তাজিকিস্তানে অনুপ্রবেশ করে এবং সেখানকার দু’টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে আক্রমণ চালায়। ১৯৮৭ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি আফগান জঙ্গীদের একটি দল সোভিয়েত তাজিকিস্তানে অনুপ্রবেশ করে এবং সোভিয়েত ভূমিতে প্রায় ২০ কি.মি. অগ্রসর হয়ে ভরোশিলোভাবাদ শহরের একটি শিল্প কারখানায় রকেট হামলা চালায়। কারখানাটির বেশ কয়েকজন কারখানা কর্মী নিহত হয়। নিহত ব্যক্তিদের সবাই ছিল সোভিয়েত মুসলিম, যাদের জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করানোর জন্য আইএসআই ধরনের আক্রমণ পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছিল! পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইউসুফের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, আক্রমণটিতে অংশগ্রহণকারী আফগান দলটি নিরাপদে আফগানিস্তানে ফিরে আসে, কিন্তু পথিমধ্যে দলটির অধিনায়ক সোভিয়েতদের পুঁতে রাখা anti-personnel mine এর আঘাতে পঙ্গু হয়ে যায়। ইউসুফ এই ব্যক্তিকে 'ওয়ালী বেগ' ছদ্মনামে আখ্যায়িত করেন। ভরোশিলোভাবাদের আক্রমণের ফলে পাকিস্তানে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত আব্দুর রহমান ওয়াজিরভ পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করে পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের হুমকি দেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ বন্ধ না হলে পাকিস্তানকে চরম মূল্য দিতে হবে! পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ জিয়াউল হক এবং প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ খান জুনেজো সোভিয়েত হুমকিতে আতঙ্কিত হয়ে আইএসআই মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ গুলকে ডেকে নির্দেশ দেন, কোনো অবস্থাতেই যেন আর সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালানো না হয়। এই পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার আরম্ভ করেছিল এবং এজন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে শত্রুতা বৃদ্ধির কোনো ইচ্ছে পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের ছিল না। বহু প্রচেষ্টা, মধ্যস্থতা ভয়ভীতি প্রদর্শনের পর পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে আর আক্রমণ না করার জন্য আফগান জঙ্গী নেতাদের রাজি করাতে সক্ষম হন।

 

 

 

 

 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]