তেলেঙ্গানার কৃষক বিদ্রোহ
স্বাধীনতার পূর্ব থেকে ভারতের হায়দারাবাদ অঙ্গরাজ্যে তিনটি ভাষাগত অঞ্চল বিভাজন ছিল। তেলেগু, মারাঠি ও কন্নড়ি ভাষাভাষী মানুষের এই তিন অঞ্চলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল সংখ্যাগুরু; আর শাসন ক্ষমতা ছিল মুসলিমদের হাতে। হায়দারাবাদের অর্ধেকের বেশি অঞ্চলে তখন তেলেগুদের বসবাস ছিল। এই অঞ্চলের ৪০% এর বেশি জমির মালিকানা ছিল হয় নিজামের, নাহয় নিজাম কর্তৃক জায়গির হিসেবে প্রদত্ত কোনো অভিজাত বংশের হাতে। অবশিষ্ট জমি ছিল সরকারি কর ব্যবস্থার অন্তর্গত। স্থানীয় প্রভাবশালী জমিদারদের কারণে সরকারি এসব জমিতে কোনোরুপ অধিকার বা নিরাপত্তা ছিল না দরিদ্র চাষীদের। কোনো কারণ ছাড়াই উচ্ছেদ করা যেতো যেকোনো মুহূর্তে। তেলেঙ্গানার কৃষক আন্দোলনের নেতা এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য পুচালাপালি সুন্দরাইয়া ১৯৭২ সালে একটি গবেষণামূলক রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে তেলেঙ্গানায় তৎকালীন ভূমি বন্টন বিষয়ক বৈষম্যের চিত্র উঠে এসেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী ’৪৭ পূর্ব সময়ে অন্তত ৫৫০ জন জমিদার ৫০০ একরের অধিক জমির মালিক ছিল। কয়েকজন জমিদারের মালিকানায় ৩০ হাজার থেকে ১ লক্ষ একর জমি পর্যন্ত ছিল! দলিত সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে শোষণ ছিল আরো ভয়াবহ। ‘ভেতি’ আইনের আওতায় প্রত্যেক দলিত পরিবার থেকে একজন পুরুষকে প্রতিদিন বাধ্যতামূলকভাবে বিনা পারিশ্রমিকে জমিদারদের জন্য কাজ করতে হতো। কোথাও কোথাও নারীদের যেতে হতো জমিদারদের গৃহস্থালী কাজের জন্য। এসব নারীরা প্রায়ই যৌন নির্যাতনের শিকার হতেন। ভাষা ও সংস্কৃতিগতভাবে তেলেগুদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা সবসময় ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনে তেলেগু ভাষাভাষী মানুষের প্রাধান্য ছিল নীচের দিকে। অবহেলিত তেলেগুরা ১৯২২ সালে একাট্টা হয় নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য। সেই বছর ‘হিন্দু রিফর্ম কনফারেন্স’ নামক সভায় তেলেগু বক্তাদের ভাষণের সময় তীব্র ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করা হলে নেতারা সভা ত্যাগ করে হায়দারাবাদে তেলেগু ভাষার মানুষের অধিকার স্থাপনের শপথ নিয়ে ‘অন্ধ্র জন সংঘ’ গঠন করেন। ১৯২৮ সালে এটি ‘অন্ধ্র মহাসভা’ নাম ধারণ করে আরো বড় পরিসরে আত্মপ্রকাশ করে এবং ভাষা কেন্দ্রিক আন্দোলনে সীমাবদ্ধ না থেকে তেলেঙ্গানা অঞ্চলের মানুষের বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থে আন্দোলন শুরু করে। ’৩০ এর দশকের শুরুতে অন্ধ্র মহাসভাতে যোগ দেয় বামপন্থী নেতা রবি নারায়ণ রেড্ডি। ভূমিকর কমানো, অলিখিত ভেতি আইন বিলোপ, স্থানীয় আদালতগুলোতে তেলেগু ভাষার প্রচলনসহ একাধিক দাবি উত্থাপন করেন এই নেতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির উপর নিষেধাজ্ঞা রদ করা হয়। সাথে সাথে তেলেঙ্গানার দুস্থ ও দলিত কৃষকদের নিয়ে কাজ শুরু করে কমিউনিস্টরা। অন্ধ্র মহাসভাও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয় কমিউনিস্ট মনোভাব দ্বারা, প্রভাবিত হন রেড্ডি নিজেও। তারা গ্রামে গ্রামে জমিদার আর ভূস্বামীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র কৃষক সংঘ গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। গ্রামে গড়ে তোলা সংঘগুলো থেকে মূলত তেলেঙ্গানায় কৃষক আন্দোলনের সূচনা। ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে এক স্থানীয় জমিদারের একজন কর কর্মকর্তা তেলেঙ্গানার এক গ্রামে শতাধিক গুন্ডা নিয়ে এক ব্যক্তির ফসলি জমি দখলে যায়। ঐ ব্যক্তি গ্রামের কৃষক সংঘের সহায়তায় কর সংগ্রাহকসহ তার দলকে ধাওয়া দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। পরদিন ঐ সংঘের ৬ জন নেতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রামবাসী পরদিন মিছিল নিয়ে স্থানীয় ঐ জমিদারের বাড়ির দিকে যাত্রা করে। বাড়িতে পৌঁছার পূর্বে জমিদার পক্ষের লোকজনের গুলিতে নিহত হয় সংঘের নেতা ডোডি কোমারাইয়া। এই খুনের দায়ে থানায় মামলা হয় সংঘেরই সদস্যদের নামে! গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে এই মৃত্যু, কৃষকদের প্রতিবাদ আর জমিদারদের পক্ষ নিয়ে পুলিশের মিথ্যা মামলার খবর। প্রায় ৪০০ গ্রামের হাজার হাজার কৃষক রাস্তায় নেমে আসে, জমিদারদের বাড়ির সামনে ভেতি আইন, নির্বিচার উচ্ছেদসহ অন্যান্য বঞ্চনার বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে থাকে। কৃষক সংঘের গঠিত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর ভয়ে অনেক গ্রামের জমিদার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। অনেক গ্রামে কৃষকরা ভেতি আইন বন্ধ করতে সক্ষম হয়। দ্রুত তাদের উপর রাষ্ট্রযন্ত্রের খড়গ নেমে আসে। পুলিশ আর সেনাবাহিনী সম্মিলিতভাবে সার্চ অপারেশন চালিয়ে বহু নিরপরাধ এবং আন্দোলনে সংযুক্ত নয় এমন কৃষককে গ্রেফতার করে অত্যাচার চালায়। স্বাধীনতার পরও হায়দারাবাদের নিজাম এবং অভিজাত শ্রেণী হায়দারাবাদকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভারত থেকে আলাদা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় জনমানুষের জন্য কাজ করা অন্ধ্র মহাসভাকে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এই সংগঠন কংগ্রেসের সাথে জোট বেঁধেছিল হায়দারাবাদকে ভারতের অংশ করতে, যদিও নীতিগত বিরোধে দ্রুত জোটের পতন ঘটে। নিজামের সহযোগী উগ্র সংগঠন ‘মজলিস-ই-ইত্তেহাদ’ নিজামকে সহায়তার জন্য নিজস্ব প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে, যার নাম দেয়া হয় রাজাকার বাহিনী। এই বাহিনী গ্রামে গ্রামে কৃষকদের উপর নির্যাতন, অপহরণ, গুম, খুন আর লুটপাট চালায়। আন্দোলন ততদিনে হাজার চারেক গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। সিপিআই আর অন্ধ্র মহাসভার মিলিত উদ্যোগে গ্রামে গ্রামে ২৫ সদস্যের এলাকা বাহিনী আর ৫০ সদস্যের সশস্ত্র গ্রাম বাহিনী গড়ে তোলা হয়। বাহিনীগুলো রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৯৪৮ এর শেষ নাগাদ প্রায় ২ হাজার সদস্যের গেরিলা বাহিনী তৈরি হয়ে যায়। রাজাকার আর কৃষকদের দ্বিমুখী সংঘর্ষের মাঝে সেনাবাহিনী নামিয়ে হায়দারাবাদকে ভারতের সাথে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় কংগ্রেস সরকার। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গ্রামে গ্রামে শুরু হয় সেনাবাহিনীর চিরুনি অভিযান। সেনাবাহিনী প্রথমে আক্রমণ করে নিজাম, নিজামের অনুগত পুলিশ আর রাজাকার বাহিনীর উপর। অল্প সময়ের মধ্যে এরা সবাই বশ্যতা স্বীকার করে নিলে সেনাবাহিনী কৃষক আন্দোলন ঠেকাতে উদ্যত হয়। সেনাবাহিনীর এই অভিযান চলে পরবর্তী তিন বছর। এসময় ৩ লক্ষাধিক সাধারণ মানুষ নির্যাতিত হয়, ৫০ হাজারের অধিককে টর্চার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়, বিভিন্ন মেয়াদে কারাগারে পাঠানো হয় ৫ হাজার মানুষকে। মৃতের সঠিক সংখ্যা কারো জানা নেই। সেনাবাহিনীর আগমনের পূর্বে যে আন্দোলন ছিল অন্যায় অবিচার আর শোষণমূলক আইনের বিরুদ্ধে, সেনাবাহিনী আসার পর সেই আন্দোলন হয়ে যায় নবগঠিত রাষ্ট্রের অত্যাচারী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার লড়াই। সেনাবাহিনী ভেতি আইন ও জায়গির প্রথা রদ করলেও শীঘ্রই জমিদাররা পুনরায় এসে নিজেদের জমির দখল শুরু করে। সিপিআইকে এক সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে দেখামাত্র গুলির হুমকি দেয়া হলেও আন্দোলন চলতে থাকে। গেরিলা সদস্যরা জঙ্গলে বসবাসকারী পাহাড়িদের বাড়িতে আশ্রয় নিলে সেনাবাহিনী জরুরি ভিত্তিতে সাধারণ মানুষ সরিয়ে নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম, বন-জঙ্গল জ্বালিয়ে দেয়, কিছু স্থানে গণহত্যা চালায়। ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে কংগ্রেসের সাথে একাধিক বৈঠক ও সমঝোতার পর আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করে সিপিআই।

Comments