সিকিম দখল
উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে প্রতিনিয়ত নেপালের গোর্খা রাজ্যের হামলায় উৎকণ্ঠিত ছিল সিকিম।
http://archive.nepalitimes.com/news.php?id=9621#.YAGqG09DYzS
গোর্খা রাজ্য হামলা চালাতো ব্রিটিশ ভারতের রাজ্যগুলোতেও। তাই সিকিম ও ব্রিটিশ রাজ গোর্খাদের বিরুদ্ধে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যায়। ১৮১৪ সালে শুরু হওয়া ব্রিটিশ-নেপাল যুদ্ধে নেপাল পরাজিত হয়। এক চুক্তি অনুসারে সিকিম ফিরে পায় নেপাল অধিকৃত তাদের অংশগুলো।
https://www.indiatoday.in/magazine/cover-story/story/19780430-did-india-have-a-right-to-annex-sikkim-in-1975-818651-2015-02-18
বৃটিশরা সিকিমের উপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। তারা সিকিমের রাজাকে চাপ প্রয়োগ করে দার্জিলিং করায়ত্ত করে। এলাকাটি তিব্বতের সাথে তাদের বাণিজ্যিক পথ স্থাপনের সুবিধা করে দেয়। ব্রিটিশদের সাথে চুক্তি হয়েছিল দার্জিলিংয়ের জন্য তারা সিকিমকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর প্রদান করবে। কর নিয়ে ব্রিটিশ ভারত ও সিকিমের সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করে। সিকিমের শ্রমিক শ্রেণীর অনেকে উন্নত জীবনব্যবস্থার জন্য ব্রিটিশ অধিকৃত অংশে জীবনযাপন শুরু করে। সিকিমের রাজা জোরপূর্বক তাদের ফেরত আনার চেষ্টা করলে ব্রিটিশরা অসন্তুষ্ট হয়ে উঠে। ১৮৪৯ সালে দুই ব্রিটিশ কর্মকর্তা সিকিমে এলে সিকিম প্রশাসন তাদের বন্দী করে রাখে। এসবের জের ধরে সিকিমে ব্রিটিশ সৈন্যদের আগমন শুরু হয়। ১৮৬১ সালে ব্রিটিশরা দার্জিলিং সহ সিকিমের অনেকটা দখল করে। আবার নতুন চুক্তি হয়। সিকিম ব্রিটিশ ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়, সিকিমে ব্রিটিশ প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হয়। সিকিম অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকলেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রিটিশদের হাতে। ব্রিটিশরা এ অঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে স্বাধীন রাজতন্ত্র হিসেবে সিকিমের স্বীকৃতি দিয়ে গিয়েছিল। ভারতের সাথে যোগ দেয়ার প্রশ্নে সিকিমে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সিকিমের সাধারণ জনতা ইন্ডিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু ‘সিকিম স্টেট কংগ্রেস’ রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। তাদের চাপে ১৯৫০ সালে সিকিমের ১১তম 'চোগিয়াল' থাসি নামগয়াল ভারতের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হন। চুক্তি অনুসারে নেহেরু সিকিমকে ভারতের আশ্রিত রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। ভারতের হাতে সিকিমের নিরাপত্তা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ সম্পর্কিত বিষয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে আসলেও অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে সিকিম ছিল স্বাধীন। ভারত কর্তৃক একজন রাজনৈতিক প্রতিনিধি নিয়োগপ্রাপ্ত গ্যাংটকে। কাজী লেন্দুপ দর্জি ১৯৪৫ সালে সিকিম প্রজামন্ডল নামক দল গঠন করে এটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৩-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি সিকিম স্টেট কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে সিকিমের আরো কয়েকটি দলকে একীভূত করে গঠন করেন ‘সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস’। ১৯৬৩ সালে তৎকালীন চোগিয়াল থাশি নামগয়াল এবং ১৯৬৪ সালে নেহেরু মারা গেলে ভারতের ক্ষমতায় আসেন ইন্ধিরা গান্ধী। ১৯৬০ সালে এক সাক্ষাৎকারে নেহেরু বলেছিলেন-
“জোরপূর্বক সিকিম দখল করা হবে মশা মারতে কামান দাগানোর মতো ঘটনা।”
১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর ভারতের কাছে সিকিম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভৌগলিক দিক থেকে সিকিমের পশ্চিমে নেপাল, উত্তর-পূর্বে তিব্বত, পূর্বে ভুটান এবং দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গ অবস্থিত। ভারতের ভয় ছিল সিকিম স্বাধীনতার জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদন করতে পারে কিংবা চীনের সাহায্য চাইতে পারে। রাজা পানডেলকে সন্দেহের চোখে দেখতো ভারত। তার আমেরিকান স্ত্রী সম্পর্কে সিআইএ এজেন্ট হওয়ার গুজব প্রচলিত ছিল। তারা লেন্দুপ দর্জিকে সহায়তা করতে শুরু করে। পরবর্তীতে লেন্দুপ দর্জি স্বীকার করেন ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স থেকে তাকে অর্থ এবং করণীয় বলে দেয়া হতো। ভারতকে পেছনে পেয়ে লেন্দুপ দর্জি একের পর এক ক্ষমতার সিঁড়ি টপকাতে শুরু করে। ‘র’ এর তৎকালীন পরিচালক অশোক রায়নার বই ‘ইনসাইড র‘ থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালে ভারতের সিকিমকে দখল করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। পরের দুই বছর ‘র’ উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির কাজ করে যায়। সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেসের মাধ্যমে তারা সেখানকার নেপালী হিন্দুদের বৌদ্ধ চোগিয়ালদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে এবং দাবি তোলে রাজতন্ত্রের অবসানের। আন্দোলন, খুন-জখম ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মাধ্যমে পরিস্থিতিকে এতটাই ঘোলাটে করে ফেলা হয় যে, সিকিমের অভিজাত হিন্দু সমাজ ভাবতে শুরু করে বৌদ্ধ রাজাদের অধীনে থাকার চেয়ে ভারতীয় হয়ে যাওয়াটা ভালো হবে। সবকিছু যে ভারতের ইন্ধনে হচ্ছে তৎকালীন চোগিয়াল পালডেন তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি। তিনি গান্ধী ও নেহেরুর ভীষণ ভক্ত ছিলেন। ভারত একদিকে পালডেনকে আশ্বস্ত করেছে, অন্যদিকে লেন্দুপ দর্জিকে কাজে লাগিয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে তাকে ভারতের বিষয়ে সতর্ক করা হলেও তিনি তা কানে তোলেননি। ১৯৭০ সালের দিকে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস দেশব্যাপী নতুন করে সুষ্ঠু নির্বাচন ও নেপালী জনগোষ্ঠীর অধিক অংশগ্রহণ দাবি করে। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলে অসন্তুষ্ট হয়ে তারা ভোট কারচুপির অভিযোগ আনে। আন্দোলনে সিকিমের আরো কয়েকটি দল যোগ দিলে পরিস্থিতির অবনতি হয়। পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে চোগিয়াল ভারতের সাহায্য কামনা করেন। ভারত প্রশাসন তাকে চাপে ফেলে চোগিয়ালের ক্ষমতা খর্ব করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে। সংবিধান অনুসারে প্রায় সব ক্ষমতা চলে যায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে। ১৯৭৪ সালের নির্বাচনে লেন্দুপ দর্জি অস্বাভাবিক ব্যবধানে বিজয় লাভ করে। ৩২টি আসনের মধ্যে ৩১টি আসন তার দল লাভ করেছিল। লেন্দুপ দর্জি সিকিমের প্রধানমন্ত্রী হলেও চোগিয়াল সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে রয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৭ মার্চ লেন্দুপ দর্জি কেবিনেট মিটিংয়ে রাজতন্ত্র বিলোপের প্রশ্নে গণভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। অচিরেই চারদিক থেকে গণভোটের ফলাফল আসতে শুরু করে যে, “জনগণ রাজতন্ত্র চায় না“। পুরো বিষয়টি ছিল সাজানো। ভারতীয় সেনাবাহিনী জনগণকে বাধ্য করেছিল রাজতন্ত্রের বিপক্ষে ভোট দিতে। ১৯৭৫ সালের ৬ এপ্রিল সকালে চোগিয়াল পানডেল দেখতে পান ভারতীয় সেনাবাহিনী ঘিরে ফেলেছে প্রাসাদ। প্রাসাদের ২৪৩ জন পাহারাদারকে কব্জা করতে ৫০০০ ভারতীয় সেনাবাহিনীর আধা ঘন্টার বেশী লাগেনি। পানডেল বন্দী হন আর সিকিমের পতাকাকে হটিয়ে আকাশ দখল করে ভারতের তেরঙ্গা। এরপর ভারতের কেনা গোলাম লেন্দুপ দর্জি সিকিমকে প্রদেশ করার জন্য ভারতীয় পার্লামেন্টের কাছে আবেদন জানান। ১৪ এপ্রিল এক গণভোটে সিকিমের জনগণ এ আবেদনে সম্মতি জানায়! ২৬ এপ্রিল ১৯৭৫ সিকিম অফিশিয়ালী ভারতের ২২তম প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। জাতিসংঘে চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশ এই দখলদারি নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি!
Comments