সোভিয়েত তাতারস্তান
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার প্রাক্কালে ১৯৯০ সালে তাতারস্তান 'সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র' হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করে এবং ১৯৯২ সালের ২১ মার্চ তাতারস্তানে স্বাধীনতার ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হলে ৬০% এর বেশি মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়।
https://m.business-gazeta.ru/blog/351643
একই সময়ে রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে তাতারস্তানের নেতৃবৃন্দের আলোচনা চলছিল এবং ১৯৯৪ সালে তাতারস্তান ও রাশিয়ার মধ্যে 'ফেডারেশন চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্য দিয়ে তাতারস্তান রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। তাতারস্তানের মোট দেশজ উৎপাদনে শিল্পখাতের অবদান ৪৫%। পেট্রোকেমিক্যাল, যন্ত্রাংশ নির্মাণ, ভারী যানবাহন নির্মাণ, পোশাক এবং খাদ্যদ্রব্য ও কাঠ বাজারজাতকরণ তাতারস্তানের শিল্পগুলোর মধ্যে প্রধান। রাশিয়ার বিখ্যাত ট্রাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান 'কামাজ' তাতারস্তানে অবস্থিত।
https://tatarstan.ru/eng/about/welcome.htm
রাশিয়ার অন্যতম প্রধান রাসায়নিক দ্রব্য নির্মাতা কোম্পানি 'কাজানোর্গসিন্তেজ' তাতারস্তানে অবস্থিত। তাতারস্তানে 'টিইউ-২১৪' যাত্রীবাহী বিমান ও হেলিকপ্টার নির্মিত হয় এবং 'কাজান হেলিকপ্টার প্ল্যান্ট' বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম হেলিকপ্টার নির্মাণ কেন্দ্র। প্রতি বছর প্রজাতন্ত্রটিতে ৩ কোটি ২০ লক্ষ টন তেল উৎপাদিত হয় এবং সেখানে মোট ১০০ কোটি টন তেল মজুদ আছে।
https://www.nytimes.com/2008/09/10/world/europe/10separatists.html
১৯৯৯ সালে প্রজাতন্ত্রটির সরকার তাতার ভাষা লেখার জন্য সিরিলিক লিপির পরিবর্তে ল্যাটিন লিপি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়।
https://www.aljazeera.com/opinions/2014/4/20/remembering-referendums-tatarstan-and-crimea
https://warontherocks.com/2018/01/moscows-fight-against-federalism-fear-and-loathing-in-russias-catalonia/
২০০২ সালে রুশ কেন্দ্রীয় সরকার তাতারস্তানের সংবিধান থেকে 'সার্বভৌমত্ব' শব্দটি অপসারণ করে এবং সিরিলিক লিপিতে তাতার ভাষা লেখা বাধ্যতামূলক করে। কিছু তাতার জাতীয়তাবাদী এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেও সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদ জনসাধারণের মধ্যে বিস্তার লাভ করতে পারেনি।
https://warontherocks.com/2018/01/moscows-fight-against-federalism-fear-and-loathing-in-russias-catalonia/
২০০৮ সালে রুশ-জর্জীয় যুদ্ধের পর রাশিয়া জর্জিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রজাতন্ত্র দক্ষিণ ওসেতিয়া ও আবখাজিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
https://www.nytimes.com/1973/07/20/archives/volga-tatars-care-little-for-genghis-khan-but-a-lot-for-russia.html
এসময় তাতার জাতীয়তাবাদীরা তাতারস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবী করে। ২০০৮ সালের ২০ ডিসেম্বর 'মিল্লি মজলিস' তাতারস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং জাতিসংঘের কাছে স্বীকৃতির আবেদন জানায়।
https://minorityrights.org/minorities/russians-ukrainians-belarusians/
রুশ কেন্দ্রীয় সরকার, জাতিসংঘ কিংবা তাতারস্তানের বাসিন্দারা এই ঘোষণাকে গুরুত্ব সহকারে নেয়নি। ২০১৩-২০১৪ সালে ইউক্রেনে পশ্চিমা সমর্থিত তথাকথিত ইউরোমাইদান বিপ্লবের ফলে রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হলে কট্টর রুশবিরোধী সরকার তদস্থলে অধিষ্ঠিত হয়।
https://geohistory.today/elvira-nabiullina/
রুশ অধ্যুষিত ক্রিমিয়া প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং পরবর্তীতে গণভোটের মাধ্যমে রুশ ফেডারেশনে যোগদান করে। এসময় তাতার বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত তাতারস্তানের স্বাধীনতা সংক্রান্ত গণভোটের প্রসঙ্গ টেনে আনে। ২০১৭ সালে রাশিয়া ও তাতারস্তানের মধ্যে ১৯৯৪ সালে স্বাক্ষরিত ফেডারেশন চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। মস্কো চুক্তিটি নবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং তাতারস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাতার ভাষার ওপর শিক্ষা প্রদানের বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত যে আইন ছিল সেটি বাতিল করে। তাতারস্তানের সরকার এই নির্দেশনা উপেক্ষা করলে মস্কো তাতারস্তানে তদন্তকারী দল প্রেরণ করে। তাতারস্তানের প্রধান মুফতি প্রজাতন্ত্রটির মসজিদগুলোতে তাতার ভাষায় প্রার্থনা পরিচালনার মাধ্যমে তাতার ভাষাকে রক্ষা করার আহ্বান জানান। কিন্তু এই অসন্তোষ বড় ধরনের আন্দোলনে রূপ নিতে ব্যর্থ হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পুগাচেভের বিদ্রোহের পর থেকে তাতাররা রুশ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি এবং তাতারস্তানের জনসাধারণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব তীব্র নয়। মিল্লি মজলিস এবং অল-তাতার সিভিক সেন্টারের মতো কিছু জাতীয়তাবাদী সংগঠন তাতারস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী, কিন্তু তাদের জনসমর্থন এখন পর্যন্ত সীমিত। এপর্যন্ত তাতার জাতীয়তাবাদীরা তাতারস্তানে কোনো বড় ধরনের জনবিক্ষোভের আয়োজন করতে পারেনি এবং এমনকি বাধ্যতামূলক তাতার ভাষা শিক্ষা তুলে দেয়ার পরও তাতারস্তানের বাসিন্দারা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। প্রজাতন্ত্রটি তাতারদের জন্য নির্ধারিত হলেও রাশিয়ায় বসবাসকারী অধিকাংশ তাতার তাতারস্তানের বাইরে বসবাস করে। রাশিয়ায় বসবাসকারী প্রায় ৫৩ লক্ষ তাতারের মধ্যে মাত্র ২০ লক্ষ তাতার তাতারস্তানের অধিবাসী। সোভিয়েত শাসনে মুসলিম তাতারদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপক বিস্তার ঘটে। এখনো অধিকাংশ তাতার নিজেদের ভাষার পরিবর্তে রুশ ভাষায় কথা বলে। বর্তমানে তাতার জাতীয়তাবাদীরা ক্রমশ ধর্মকে বেছে নিচ্ছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। ধর্মনিরপেক্ষ তাতাররা এবং তাতারস্তানের অ-তাতার জাতিগুলো এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হচ্ছে না। তাতারস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অভিজাতরা মস্কোর প্রতি অনুগত। তাতারস্তানের বর্তমান রাষ্ট্রপতি রুস্তাম মিন্নিখানভ, প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই পেসোশিন এবং ১০০ সদস্যবিশিষ্ট আইনসভা দেভলেত সোভিয়েতি'র স্পিকার ফারিদ মুখামেতশিন তিনজনই রাশিয়ার ক্ষমতাসীন দল সংযুক্ত রাশিয়া'র সদস্য। রাশিয়ার বর্তমান নির্মাণ ও আঞ্চলিক উন্নয়ন বিষয়ক উপপ্রধানমন্ত্রী মারাত খুনসুল্লিন; ডিজিটাল উন্নয়ন, যোগাযোগ ও গণমাধ্যম বিষয়ক মন্ত্রী মাকসুত শাদায়েভ এবং রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট এলভিরা নাবিউল্লিনা- এরা সকলেই তাতার। রুশ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান মুফতি রাভিল গাইনুৎদিন একজন তাতার। রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার ৪% তাতার এবং সেই অনুপাতে রুশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অভিজাতদের মধ্যে তাতারদের সংখ্যা অনেক বেশি। পশ্চিমা ও পশ্চিমাপন্থী রাষ্ট্রগুলো রাষ্ট্রগুলোর গণমাধ্যম তাতারস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন জানিয়েছে এবং রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো রাশিয়ার বিভাজনে আগ্রহী। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের প্রাক্কালেও সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর অ-রুশ সৈন্যরা মস্কোর প্রতি অনুগত ছিল। তাতার অভিজাত সম্প্রদায় ও জনসাধারণের সিংহভাগ এখনো মস্কোর প্রতি অনুগত।
রাশিয়া প্রশাসনিকভাবে ৮৫টি অঞ্চলে বিভক্ত। এই অঞ্চলগুলো সামগ্রিকভাবে 'সুবইয়েক্তি ফেদেরাৎসি' নামে পরিচিত এবং এই কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলো 'রেসপুবলিকা' (প্রজাতন্ত্র), 'ক্রাই' (সীমান্ত প্রদেশ), 'ওব্লাস্ত' (প্রদেশ), 'আভতোনোমনায়া ওব্লাস্ত' (স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ), 'আভতোনোমনি ওক্রুগ' (স্বায়ত্তশাসিত জেলা) ও 'গরোদ ফেদেরালনোগো জনাচেনিয়া' (কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর)- এভাবে বিভক্ত। এদের মধ্যে প্রজাতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ এবং স্বায়ত্তশাসিত জেলাগুলো রাশিয়ার জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য নির্ধারিত।
https://www.britannica.com/place/Tatarstan
সোভিয়েত শাসনামলে সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের উদ্দেশ্যে প্রশাসনিক অঞ্চলগুলো গঠন করা হয়েছিল। বর্তমানে রাশিয়ায় ২২টি প্রজাতন্ত্র, ১টি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ এবং ৪টি স্বায়ত্তশাসিত জেলা রয়েছে। রাষ্ট্রটিতে কমপক্ষে ১৮৫টি অ-রুশ জাতি বসবাস করে। রাশিয়ায় মোট ৩৫টি আঞ্চলিক রাষ্ট্রভাষা প্রচলিত রয়েছে। এরকমই একটি অ-রুশ কেন্দ্রীয় অঞ্চল 'তাতারস্তান' বা 'তাতারিয়া'। এর রাজধানী কাজান রাশিয়ার 'তৃতীয় রাজধানী' এবং 'ক্রীড়া রাজধানী' হিসেবে পরিচিত। তাতারস্তানের বর্তমান জনসংখ্যার মধ্যে ৫৩% তাতার, ৩৯.৭% রুশ, ৩% চুভাশ ও বাকিরা অন্যান্য জাতিভুক্ত। সপ্তম শতাব্দীতে অঞ্চলটিতে প্রথম সংগঠিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি 'ভোলগা বুলগেরিয়া' নামে পরিচিতি অর্জন করে। এটির আয়তন ছিল বর্তমান তাতারস্তানের তুলনায় অনেক বেশি এবং এটির অধিবাসীরা 'বুলগার' নামে পরিচিত ছিল। রাষ্ট্রটিতে বৃহত্তর তুর্কি জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত বুলগারদের পাশাপাশি ফিনিক, উগ্রিক ও পূর্ব স্লাভ জনগোষ্ঠীর মানুষরা বসবাস করতো এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে রাষ্ট্রটি পরিচিতি লাভ করে। দশম শতাব্দীতে বুলগাররা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। দ্বাদশ শতাব্দীতে রুশ অধ্যুষিত নভগরোদ ও ভ্লাদিমির রাষ্ট্রদ্বয়ের সঙ্গে ভোলগা বুলগেরিয়ার কয়েকবার যুদ্ধ হয়। ১২২৩-১২২৪ এবং ১২২৯-১২৩৪ সালে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের সঙ্গে বুলগাররা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ১২৩৬ সালে মোঙ্গল নেতা বাতু খান রুশভূমি আক্রমণ করেন এবং এর অংশ হিসেবে মোঙ্গলরা ভোলগা বুলগেরিয়া আক্রমণ করে। বুলগারদের তীব্র প্রতিরোধ সত্ত্বেও মোঙ্গলরা তাদের পরাজিত করে অঞ্চলটি দখল করে নেয়। মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এবং যুদ্ধপরবর্তী গণহত্যায় ভোলগা বুলগেরিয়ার প্রায় ৮০% অধিবাসী নিহত হয়। অঞ্চলটি 'গোল্ডেন হোর্ড' সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং প্রায় ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে অঞ্চলটি মোঙ্গল শাসনাধীনে ছিল। এসময় মোঙ্গলদের সঙ্গে বুলগারদের বৈবাহিক সম্পর্কের ফলে উভয় জাতির মধ্যে মিশ্রণ ঘটে এবং গোল্ডেন হোর্ডের শাসকশ্রেণি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় এই প্রক্রিয়া আরো জোরদার হয়। এসময় থেকে বুলগাররা 'তাতার' নামে পরিচিতি অর্জন করে। প্রকৃতপক্ষে রুশরা 'তাতার' বলতে মোঙ্গলদের বুঝাতো। রাশিয়ায় গোল্ডেন হোর্ডের শাসনামল 'মোঙ্গল-তাতার জোয়াল' হিসেবে পরিচিত। পঞ্চদশ শতাব্দীতে অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে গোল্ডেন হোর্ড সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। ১৪৩৮ সালে উলুঘ মুহাম্মদ নামক চেঙ্গিস খানের এক বংশধরের নেতৃত্বে কাজান শহরকে কেন্দ্র করে তাতাররা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, যেটি 'কাজান খানাত' নামে পরিচিত ছিল। বর্তমান তাতারস্তান, মারি এল, চুভাশিয়া ও মর্দোভিয়ার সম্পূর্ণ অংশ এবং উদমুর্তিয়া ও বাশকোরতোস্তানের অংশবিশেষ কাজান খানাতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তী ১০০ বছর ধরে মস্কোকেন্দ্রিক রুশ রাষ্ট্র মাস্কোভির সঙ্গে কাজান নিরবচ্ছিন্ন দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। দ্বন্দ্বের প্রাথমিক পর্যায়ে কাজানের আধিপত্য থাকলেও পরবর্তীতে মাস্কোভি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে এবং ১৫৫২ সালে জার চতুর্থ ইভান কাজান দখল করে নেন। একই সময় কাজান খানাতের ভূমিতে রুশদের বসতি স্থাপন শুরু হয় এবং তাতাররা রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৭০৮ সালে জার প্রথম পিওতর কাজান খানাত'কে উচ্ছেদ করে এটিকে কাজান গুবের্নিয়া'তে পরিণত করেন এবং তখন থেকে একজন রুশ গভর্নর জেনারেল কাজান শাসন করতেন। কাজান রাশিয়ার অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হতে থাকে। রুশ শাসনামলের প্রথম দিকে খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা এবং অর্থনৈতিক শোষণ প্রভৃতি কারণে তাতাররা বেশ কয়েকবার রুশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ১৫৫২-১৫৫৬, ১৬১৬ এবং ১৭৫৫-১৭৫৬ সালে তাতাররা রুশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং ১৬০৬-১৬০৭ সালের ইভান বোলোতনিকভের বিদ্রোহ ও ১৭৭৩-১৭৭৫ সালের ইয়েমেলিয়ান পুগাচেভের বিদ্রোহে তাতারদের একাংশ যোগদান করে। তাদের প্রতিটি বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৭৭৩ সালে সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় একাতেরিনা তাতারসহ রুশ মুসলিমদের বিস্তৃত অধিকার প্রদান করেন এবং তাতার অভিজাতদের রুশ অভিজাত সম্প্রদায়ের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে নেন। এসময় তাতারদের রুশ সেনাবাহিনীতে নেয়া শুরু হয় এবং ১৮০৩-১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রুশ সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে তাতাররা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কাজানে কিছু কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে এবং রাশিয়া জুড়ে তাতারদের বণিক শ্রেণি গড়ে ওঠে। ১৮৬০ এর দশকে সম্রাট দ্বিতীয় আলেক্সান্দরের গৃহীত অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার এবং ১৯০৬-১৯১১ সালে রুশ প্রধানমন্ত্রী পিওতর স্তোলিপিনের গৃহীত অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে কাজানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়। একই সঙ্গে তাতারদের মধ্যে 'জাদিদ' নামক একটি সংস্কার কর্মসূচি আরম্ভ হয় এবং তাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতার সৃষ্টি হয়। ১৯০৫ সালের ব্যর্থ রুশ বিপ্লবের পর যে রুশ আইনসভার সৃষ্টি করা হয়, সেটিতে তাতারদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। একই সময়ে তাতারদের একটি অংশের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা বিস্তার লাভ করে। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর রাশিয়া জুড়ে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ তাতার অধ্যুষিত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১৮ সালের ১লা মার্চ তাতার জাতীয়তাবাদীরা বর্তমান তাতারস্তানে 'ইদেল-উরাল রাষ্ট্র' নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে, ২৮ মার্চ তাতার বলশেভিকরা রাষ্ট্রটিকে উচ্ছেদ করে সেখানে বলশেভিক শাসন প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯১৮ সালের আগস্টে বলশেভিক বিরোধী শ্বেত ফৌজ চেকোস্লোভাক সৈন্যদের সহযোগিতায় কাজান দখল করে, কিন্তু শ্বেত ফৌজের নেতারা রুশ মুসলিমদের স্বায়ত্তশাসন প্রদানে রাজি ছিল না বিধায় তাতাররা তাদের বিরোধিতা করে। তাতারদের সহযোগিতায় বলশেভিক লাল ফৌজ কাজান পুনর্দখল করে এবং ১৯২০ সালের ২৭ মে 'তাতার স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২০ এর দশকে তাতাররা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন লাভ করে এবং তাতার ভাষা, সংস্কৃতি ও শিল্প-সাহিত্যের বিশেষ উন্নতি ঘটে। ১৯৩০ এর দশকে সোভিয়েত সরকারের অধীনে অঞ্চলটি শিল্পায়ন, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি অর্জন করে। খনিজ তেলের আবিষ্কার অঞ্চলটির অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অক্ষশক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চিমাঞ্চল থেকে বহু শিল্পকারখানা তাতার প্রজাতন্ত্রে স্থানান্তর করা হয়। ৫,৬০,০০০ তাতার সৈন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে যুদ্ধ করে। যুদ্ধোত্তর কালে প্রজাতন্ত্রটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকে এবং এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান শিল্পকেন্দ্রে পরিণত হয়।

Comments