তামিলনাড়ুর কৃষক বিদ্রোহ
১৯৬০ এর দশকে তামিলনাড়ুর কিলভেনমনি গ্রামে কৃষি শ্রমিক আর জমির মালিকদের মধ্যে মতবিরোধ তীব্র আকার ধারণ করেছিল। ধানক্ষেতে কাজ করা মজুররা আগের চেয়ে ভালো থাকার আশায় কিছুটা বেশি মজুরি দাবি করেছিল।
https://www.news18.com/news/india/justice-still-eludes-44-dalits-in-tamil-nadu-who-were-charred-to-death-50-years-ago-on-this-day-1983011.html
ভারতে সরকারের নেয়া ‘কৃষি বিপ্লব’ কর্মসূচীর কারণে কৃষি যন্ত্রপাতির মূল্য বেড়ে গিয়েছিল। ১৯৫৫ সালে প্রদেশে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলেও কৃষি মজুরদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। জমিদারি আমলে তারা বাধ্যতামূলক মজুরি করতো, আর তা উচ্ছেদ হওয়ার পর তারা হয়ে গেলো দিনমজুর। কৃষিজমির একটা বড় অংশ গ্রামাঞ্চলের মন্দির কর্তৃপক্ষ দেখাশোনা করতো। গরিব কৃষি শ্রমিকরা আর্থিক বৈষম্যের পাশাপাশি সামাজিক অমর্যাদার শিকার হতো। ১৯৬৬ সালে তামিলনাড়ুর বিভিন্ন অঞ্চলে ধানের ফলন কিছুটা কম হয়। ধানের বর্ধিত মূল্যের কারণে মজুররা আগের চেয়ে কিছুটা বেশি মজুরি দাবি করলে মালিকপক্ষ তা অস্বীকার করে। এতে দলিত কৃষি মজুররা ক্ষুব্ধ হয়। অধিকার আদায়ের জন্য তারা সংগঠিত হতে থাকে। জমির মালিকগোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একত্রিত হলো। ‘Paddy Producers Association’ নামের সংগঠন সামনে রেখে তারা দলিত মজুরদের বিরুদ্ধে একত্রিত হলো। কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক শাখার সাথে সেখানকার কৃষি মজুরদের অনেকে জড়িত ছিল।
https://www.newindianexpress.com/states/tamil-nadu/2018/dec/25/things-changed-but-a-lot-more-yet-to-be-done-say-experts-1916077.html
মালিকগোষ্ঠী বামপন্থী মজুরদের কাজ থেকে বের করে দেয়ার নীতি গ্রহণ করলেও দলিত মজুররা তাদের পাওনার দাবিতে অটল রইলো। মালিকগোষ্ঠী অন্য অঞ্চল থেকে মজুর এনে ধান কাটার ব্যবস্থা করলো। গ্রামের মজুরদের আগের পাওনার সুরাহা না হওয়ায় তারা এই পদক্ষেপ মেনে না নিয়ে প্রতিরোধের পথে গেলো। গ্রামের কৃষকদের সাথে সংঘর্ষে বহিরাগত মজুরদের মধ্যে পাক্কিরিস্বামী পিল্লাই নামে একজন নিহত হলো। বামপন্থী সংগঠনের সাথে জড়িত আরো কয়েকজন কৃষি মজুর এই ঘটনায় প্রাণ হারালো। জমির মালিকদের সংগঠন কৃষকদের প্রকাশ্যে হুমকি দিতে লাগলো। ১৯৬৮ সালের ১৫ নভেম্বর গ্রামের দলিত মজুরদের পক্ষ থেকে তামিলনাড়ু প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আন্নাদুরাইয়ের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে চিঠি পাঠানো হলেও তা যথাসময়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছায়নি মালিকপক্ষের কারসাজিতে। ১৯৬৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাত ১০টার দিকে পুলিশের গাড়িতে করে কিলভেনমনি গ্রামে একদল ঘাতক প্রবেশ করলো। তারা গ্রামে দলিত মজুরদের বসবাসের এলাকাগুলো ঘিরে ফেললো।
https://www.thehindu.com/todays-paper/tp-national/tp-tamilnadu/Anniversary-of-Keezhvenmani-carnage-observed/article16464029.ece
অসহায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের পালানোর সব পথ বন্ধ করা হলো। নির্বিচারে গুলি চালানো ছাড়াও কুঁড়েঘরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো। আগুনে পুড়ে কয়েকটি পরিবার নিহত হলো। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছিল, কুঁড়েঘর আগুনে জ্বলতে থাকার সময় হতভাগ্য পরিবারের লোকেরা জানালার মাধ্যমে একটি নিরীহ শিশুকে বাইরে নিক্ষেপ করে। কিন্তু শিশুটি কুঁড়েঘরের বাইরে পড়া মাত্র আক্রমণকারীরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অন্য আরেকটি কুঁড়েঘর থেকে এক মজুর পরিবারের ৬ জন কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করছিল। ঘাতকদের চোখে পড়তে তারা গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারায়।
১৯৬৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম হয়েছিল-
“থানজাভুরের গ্রামে কৃষকদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষে ৪২ জনের মৃত্যু।”
দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় সংবাদ হয়েছিল-
“কৃষক সংঘর্ষ রক্তাক্ত: আগুনে পুড়ে ৪২ কৃষকের মৃত্যু।”
তামিল সংবাদপত্র দিনমণিতে ছাপা হলো-
“কৃষকদের মধ্যে সংঘর্ষে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৪২ জনের প্রাণহানি।”
এসব সংবাদে কৃষক সংঘর্ষের কথা বলা হয়েছে, এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে জমির মালিকপক্ষের কথা। সবচেয়ে বেশি উপেক্ষা করা হয়েছে নিহত মজুরদের সামাজিক ও ধর্মীয় পরিচয়ের কথা। তাদের দলিত পরিচয় চেপে যাওয়া হয়েছে।
https://www.freepressjournal.in/analysis/unable-to-crack-the-caste-calculus-sunanda-k-datta-ray
পুরো ঘটনাটিকে নিছক গ্রামীণ সংঘর্ষ আকারে প্রচার করা হয়েছে। মাদ্রাজ হাইকোর্ট পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে। ১৯৭৩ সালে ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাইকোর্টের বিচারক মামলা চলাকালে নিহতদের সামাজিক ও ধর্মীয় পরিচয় গোপন করার জন্য প্রচার মাধ্যমকে তিরষ্কার করেন।
Comments