নক্সালদের ইতিবৃত্ত

 

https://indianexpress.com/article/research/51-years-of-naxalbari-how-a-peasant-uprising-triggered-a-pan-india-political-movement-5191046/

নকশালবাড়ির কৃষকরা মূলত চা বাগান এবং বড় বড় এস্টেটে কাজ করতো। বহু শতাব্দী ধরে তারা ভূমি মালিকশ্রেণী এবং মহাজন দ্বারা শোষিত হয়ে আসছিল। ১৯৬৭ সালের ২৪ মার্চে গ্রামের এক অংশীদারি কৃষক যাকে অবৈধভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, সে তার জমি চাষ করার চেষ্টা করে। এ কারণে ভূমি মালিকশ্রেণী তার জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে নির্মমভাবে মারধর করলে সে মারা যায়। জমিদারদের শোষণে ক্ষুব্ধ হয়ে কৃষকরা একত্রিত হয়ে বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ে। পরদিন একদল সাঁওতাল আদিবাসীকে সঙ্গে নিয়ে তারা একটি পুলিশ দলকে আক্রমণ করে যারা কৃষক হত্যার তদন্ত করতে এসেছিল। পুলিশ কনভয়ের উপর ধনুক ও তীর নিয়ে হামলায় এক সাব-ইন্সপেক্টর নিহত হয়। ১৯৬৭ এর দু'বছর পূর্ব থেকে নকশালবাড়িতে বিদ্রোহের বীজ রোপন করছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি-মার্কসবাদী (সিপিআই-এম) এর কর্মীরা। সিপিআই-এম এর অনুগতরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিল যখন শ্রমিক এবং কৃষকরা বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করবে তখন প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব হবে। ২৫ মার্চ নকশালবাড়ির ঘটনার পর তারা ভেবেছিল সেই মুহুর্তটি এসে গেছে। চারু মজুমদার ঐ বছর অন্যতম দুই প্রধান কমরেড কানু সান্যাল ও জঙ্গল সাঁওতালের সাথে নকশালবাড়িতে কৃষক বিদ্রোহ শুরু করেন। চারু মজুমদার মাও সে তুংয়ের সাফল্য ও কর্মকৌশল দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। মাও ক্ষমতাসীন অভিজাতদের উৎখাত করে চীনে সাধারণ ও শোষিত জনগণকে সংগঠিত এবং নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে চমৎকার দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। চারু মজুমদার পশ্চিম বাংলার প্রেক্ষাপটে মাও এর মতবাদ প্রচার করেন। তিনি ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার সাথে মানানসই কৌশল প্রণয়ন করেন। তার ঐতিহাসিক 'আট নথি' বিদ্রোহীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়।

https://theprint.in/opinion/from-bihar-to-andhra-how-india-fought-and-won-its-50-yr-war-with-left-wing-extremism/254462/

তাদের উদ্দেশ্য ছিল বড় বড় জমিদারদের কাছ থেকে জমি ছিনিয়ে নিয়ে কৃষক ও ভূমিহীন শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করা। এর প্রেক্ষিতে নক্সালবাদের জন্ম হয়। অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীকাকুলামে একই ধরনের বিদ্রোহ হয়। ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে শ্রীকাকুলামের বিদ্রোহ নকশালবাড়ী থেকে অনুপ্রাণিত বলে জানা যায়। কমিউনিস্টদের সাথে যুক্ত কোরান্না ও মঙ্গান্নাকে স্থানীয় জমিদাররা হত্যা করে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য গ্রামের আদিবাসী জনগণ অস্ত্র নিয়ে জমিদারদের শস্য ও জমি লুট করে নিয়ে যায়। ১৯৬৮ সালে এই আন্দোলন আরও বেড়ে যায় যখন একদল কৃষক পুলিশ অফিসারদের আক্রমণ করার জন্য গেরিলা স্কোয়াডে নিজেদের সংগঠিত করে। নকশাল আন্দোলনের শিকড় জড়িয়ে ছিল তেলেঙ্গানা সংগ্রাম এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) সাথে। ১৯৪৮ সালের জুলাইয়ের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের ২,৫০০টি গ্রাম মিলে কৃষক আন্দোলনের অংশ হিসাবে 'কম্যুন' গঠন করা হয়, যা তেলেঙ্গানা সংগ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করে। "অন্ধ্র থিসিস" এটির একটি অংশ।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Andhra_Pradesh_Coordination_Committee_of_Communist_Revolutionaries

চারু মজুমদারের নেতৃত্বে বিদ্রোহী ক্যাডাররা নকশালবাড়িতে কৃষক বিদ্রোহ এগিয়ে নিয়ে যান। তারা আদিবাসীদের সাহায্য করেন ভূ-মালিকদের জমি দখল করতে। সিপিআই (এম) নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকার গণজাগরণের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় এবং কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার অভিযানকে সমর্থন করে। এই ঘটনা সারা ভারতজুড়ে প্রতিধ্বনিত হয় এবং নকশালবাদের উত্থান ঘটে। এটি বেশ কিছু কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে যা প্রাথমিকভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতে এবং পরবর্তীতে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলন দ্রুত রাজ্য সরকারের ক্ষোভের মুখোমুখি হয় এবং পুলিশ নির্মমভাবে বিদ্রোহীদের দমন করতে শুরু করে। আগামী দশকগুলোতে নকশালবাড়ি বিদ্রোহ ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়। ভারতের জাতীয় ও রাজ্য সরকারগুলোনকশাল গোষ্ঠীগুলোকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করে এবং এদের অবৈধ বলে ঘোষণা করে। পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী গেরিলা আক্রমণ মোকাবেলা এবং বিদ্রোহীদের তাদের অভয়ারণ্য থেকে বের করে দেয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। পাঁচ দশক পরও এই আন্দোলন ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা এবং অন্ধ্র প্রদেশের কিছু অংশে চলমান রয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে জরুরি অবস্থার সময়ে এটি কঠোরভাবে মোকাবেলা করা হয়। পরবর্তী দশকগুলোতে ভারতীয় পুলিশের কড়া নজরদারি সত্ত্বেও আন্দোলন টিকে থাকতে সক্ষম হয় পরিবর্তিত আকারে। ভারত সরকার নকশালবাদ ও মাওবাদকে বামপন্থী চরমপন্থা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পৃথক বিভাগ দ্বারা এটি মোকাবেলা করা হয়। নকশালবাদী দলগুলো ভারতীয় সমাজের দরিদ্রতম এবং সামাজিকভাবে প্রান্তিক সদস্যদের, বিশেষ করে উপজাতি জনগোষ্ঠী এবং দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। কয়েক দশক ধরে তারা ভূ-স্বামী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মতো লক্ষ্যবস্তুদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। নকশালবাদী গোষ্ঠীগুলো পূর্ব ভারতের বেশিরভাগ রাজ্যে; বিশেষ করে অন্ধ্র প্রদেশ, বিহার, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা এবং পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল এবং তাদের প্রভাব এই অঞ্চল ছাড়িয়ে পুরো ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। নকশাল বিদ্রোহের পর ভারতের শহুরে তরুণরা, যাদের অনেকেই সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর অংশ, বিপ্লবে উল্লেখযোগ্যভাবে অনুপ্রাণিত হয়। চারু মজুমদার ঘোষণা করেছিলেন এই বিপ্লব শুধুমাত্র গ্রামীণ জনগণের জন্য নয়, বরং যারা শ্রেণী শত্রু তাদের বিরুদ্ধে লড়াই। এই শ্রেণী শত্রুর তালিকায় পড়বে সরকার থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, পুলিশ এবং আরো অনেকে। নকশালপন্থীরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নেয়। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স নকশাল কার্যকলাপের জন্য অন্যতম ঘাঁটি হয়ে ওঠে। চরম দারিদ্র্য, ভূমিহীন চাষীদের শোষণ (যাদের অধিকাংশই দলিত ও উপজাতি সম্প্রদায়ের অংশ) এবং প্রশাসনের কর্তৃক সামাজিক ন্যায়বিচারের বঞ্চনা জনসাধারণ এবং বামপন্থী নেতাদের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দেয়। স্বাধীনতার পর সরকার কৃষি সংস্কারের অংশ হিসেবে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে। তবে কিছু দলের প্রতিবাদের কারণে জমি পুন:বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি এবং কৃষিতে উন্নততর পদ্ধতির সম্মিলিত প্রভাবের ফলে অনেক নব্য ধনী কৃষক শ্রেণীর জন্ম হয়। তারা ভূমিহীন কৃষক ও মজুরদের সাথে তাদের লাভ ভাগ করে নিতে প্রস্তুত ছিল না। জমির মালিকরা দ্রুত সাফল্য লাভ করলেও ভূমিহীনদের খাদ্যের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হলো। বেশ কিছু কৃষিনির্ভর এলাকায় দারিদ্রের মাত্রা ৯৫% এর বেশি ছিল বলে জানা গেছে। এতো বছর পরও সেই আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা বিন্দুমাত্র হারিয়ে যায়নি।


Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]