মিজোদের প্রতি বর্বরতা

 

কয়েকশ বছর আগে পূর্ব এশিয়া থেকে অসংখ্য গোষ্ঠী এসে মিজোরামে বসতি স্থাপন করে। কুকি, চিন, লুসাই সহ নানা গোত্র-উপগোত্রে বিভক্ত জাতিসমষ্টিকে একত্রে 'মিজো' বলে সম্বোধন করা হয়। মিজো শব্দের অর্থ 'পাহাড়ী মানুষ'। আর 'মিজোরাম' অর্থ 'পাহাড়ী মানুষের অঞ্চল'। মিজোরামের সিংহভাগ মানুষ কৃষিজীবি। বনাঞ্চলে ছাওয়া প্রদেশটিতে তারা জুম চাষ করে। ব্রিটিশ ভারতে মিজোরামের অধিকাংশ জনগণ অসংখ্য স্বায়ত্বশাসিত সর্দারের অধীনে বাস করতো। প্রথাগত সর্দারতন্ত্রের বিরুদ্ধে শহরের শিক্ষিত মিজোদের ক্ষোভ ছিল। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর আসাম সরকার আর মিজোরামের শিক্ষিত অংশটি সর্দার প্রথা বিলোপ করে। ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, আসাম আর মিজোরামে প্রচুর বাঁশ জন্মে। এদের মধ্যে অন্যতম প্রজাতিটি হচ্ছে 'চিটাগং ফরেস্ট ব্যাম্বু'। মিজোরাম প্রদেশের প্রায় ৩০% বাঁশবনে আবৃত। এর ৯৫% হচ্ছে চিটাগাং ফরেস্ট ব্যাম্বু। সেখানে বাড়ি বানানো থেকে শুরু করে খাদ্য হিসেবেও বাঁশের ব্যবহার ব্যাপক। বাঁশ প্রতি দিন গড়ে দশ সেন্টিমিটার করে বৃদ্ধি পায়। প্রজাতিভেদে ৪০, ৫০, ৬০ বা ১০০ বছরের বেশি সময় বিরতি দিয়ে বাঁশগাছে ফুল আসে। একটি প্রজাতির সব বাঁশগাছে ফুল আসে প্রায় একই সময়ে।

http://tropical.theferns.info/viewtropical.php?id=Melocanna+baccifera

ফুল ফোটার সময় বাঁশবনে অসংখ্য ফুল ও বাঁশ ফল উৎপন্ন হয়। চিটাগং ফরেস্ট ব্যাম্বুতে ফুল আসে ৪৮-৫০ বছর পর পর। প্রতি ৪৮-৫০ বছর পর পর মিজোরামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বাঁশবনগুলো বিপুল ফুল ও ফলের যোগান দিয়ে দ্রুত মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

https://www.guaduabamboo.com/blog/bamboo-flowering-habits

জঙ্গলের তীক্ষ্ণদন্তী প্রাণীদের কাছে বাঁশফল এবং ফুল উপাদেয় খাবার। কালো ইঁদুর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জঙ্গলগুলোতে প্রচুর পরিমাণে বাস করে। মিজোরামেও তারা যথেষ্ঠ পরিমাণে আছে। বাঁশফল এই প্রজাতির ইঁদুরের প্রিয় খাদ্য। বাঁশগাছে ফল ধরলে মিজোরামের বাঁশবনগুলো এসব ক্ষুদ্র প্রাণীতে ছেয়ে যায় আর এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে অস্বাভাবিকভাবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ইঁদুরের প্রজনন ক্ষমতার সাথে বাঁশের ফুলের সংযোগ আছে। বাঁশ ফুল খেলে ইঁদুরের বাচ্চা জন্ম দেয়ার ক্ষমতা অসম্ভব বৃদ্ধি পায়।

https://www.amusingplanet.com/2015/09/the-mysterious-phenomenon-of-bamboo.html?m=1

এজন্য পঞ্চাশ বছর পর পর এই অঞ্চলে কালো ইঁদুরের মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যাবৃদ্ধি দেখা দেয়। বনের শিকারীরা আর তাদের সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। বাঁশফলের মৌসুমে এদের রীতিমতো জনবিস্ফোরণ ঘটে।

https://www.projectmaje.org/mautam.htm

বাঁশফল শেষ হয়ে গেলে ইঁদুরের পালের আর খাওয়ার কিছু থাকে না। না খেতে পেয়ে অসংখ্য ইঁদুর মারা পড়ে এবং ইঁদুরের সংখ্যা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে। মিজোরামের বাঁশফল খেয়ে শেষ করে তখন এই ইঁদুররা হানা দেয় গ্রামেগঞ্জে, ক্ষেতে-খামারে, গোলা ঘরে আর শস্য গুদামে। টনের পর টন খাদ্যশস্য আর কৃষিজমি নষ্ট হয়ে গোটা অঞ্চলে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ।

https://m.timesofindia.com/india/Mautam-famine-hits-eastern-Mizoram/articleshow/293387.cms

মিজোরামের মাটি চাষাবাদের উপযোগী নয়। ইঁদুরের আক্রমণে গোটা প্রদেশ মারাত্মক খাদ্যসংকটের মুখে পড়ে। এই দুর্ভিক্ষকে মিজোরা বলে 'মাওতাম'। যেহেতু বাঁশগাছে ফুল একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর আসে, তাই ইঁদুরের বন্যাও নিয়ম মেনে চলে। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া হিসাবমতে, ১৮৬২ আর ১৯১১ সালে গোটা প্রদেশ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছিল। ১৯৫৮-১৯৫৯ এবং ২০০৬-২০০৮ সালে পাহাড় ছেয়ে যায় কালো ইঁদুরে, দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় গোটা প্রদেশে। ১৯৫৮-১৯৫৯ এর সময় আসাম সরকার প্রতিটি ইঁদুর মারার বিনিময়ে সত্তর পয়সা করে দিতো। অন্তত বিশ লক্ষ ইঁদুর মারা হলেও মিজোরামে দুর্ভিক্ষ ঠেকানো যায়নি। পঞ্চাশের দশকের মাওতামে প্রায় শতাধিক লোক খাদ্যাভাবে মারা পড়ে। ইঁদুরের কারণে ছড়িয়ে পড়ে রোগজীবাণু আর অসুখ। মিজোরা তাদের ওপর আসামের নিয়ন্ত্রণ ভাল চোখে দেখতো না। মিজো বর্ষীয়ানরা আসন্ন ইদুঁরের আক্রমণের ব্যাপারে আসাম সরকারকে পঞ্চাশের দশকে বারবার সাবধান করেছিল। সরকার গোটা ব্যাপারকে লোকগাঁথা হিসেবে উড়িয়ে দেয়। যখন ইঁদুরের কারণে দুর্ভিক্ষ হানা দিলো, তখন মিজোরা গেলো ক্ষেপে। প্রায় শতাধিক মানুষ খাদ্যাভাবে মারা পড়ে। ১৯৬১ সালে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ) গঠিত হয়। এরা দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে সাহায্য করে। এমএনএফ বামপন্থী ঘরানার ছিল। এমএনএফ নেতা পু লালডেঙ্গা স্বাধীনতার ছক কষতে শুরু করলেন। আটটি ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয় মিজো বীরদের নামকরণে। প্রায় ২,০০০ যোদ্ধার পাশাপাশি ২,০০০ স্বেচ্ছাসেবক যোগ দেয় এমএনএফ-এ। অসমীয়া ভাষাকে মিজো অঞ্চলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলে মিজো জনতা আরো ক্ষুব্ধ হয়। ১৯৬৬ সালের মার্চে এমএনএফ এর সদস্যরা আসাম রাইফেলস এর ঘাঁটিগুলো আক্রমণ করতে থাকে। আইজল বাদে বাদবাকি অঞ্চলে মিজো যোদ্ধারা নিয়ন্ত্রণ নেয়।

https://m.economictimes.com/opinion/et-commentary/air-attacks-in-mizoram-1966-our-dirty-little-secret/articleshow/18565883.cms

পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান স্যাম মানেকশের আদেশে ভারতীয় বিমানবাহিনী আইজলে আক্রমণ চালায়। এরপর সেনাবাহিনী মিজোদের হটিয়ে আইজল পুনরুদ্ধার করে। মিজো যোদ্ধারা বিদ্রোহ অব্যাহত থাকে। ১৯৭২ সালে মিজোরামকে ইউনিয়ন টেরিটরি এবং ১৯৮৬ সালে প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এমএনএফ রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। লালডেঙ্গা মিজোরামের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]