সোভিয়েত ইঙ্গুশেতিয়া
নবম শতাব্দীতে বর্তমান ইঙ্গুশেতিয়াসহ উত্তর ককেশাসের একটি বড় অংশ জুড়ে 'আলানিয়া' রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১২৩৮-১২৩৯ সালে মোঙ্গল নেতা বাতু খানের নেতৃত্বে মোঙ্গল বাহিনী আলানিয়া আক্রমণ করে রাজ্যটিকে ধ্বংস করে দেয় এবং বর্তমান ইঙ্গুশেতিয়ার ভূখণ্ড 'গোল্ডেন হোর্ড' সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৩৯৫ সালে সমরকন্দের সুলতান তৈমুর অঞ্চলটি আক্রমণ করে বিধ্বস্ত করে দেন। এসময় ইঙ্গুশরা বিভিন্ন দেবতার উপাসনা করতো।
https://www.britannica.com/place/Ingushetiya
পরবর্তীতে তাদের মধ্যে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটে। ইঙ্গুশরা যুদ্ধবাজ ও সাহসী জাতি হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে এবং তারা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইঙ্গুশদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রতিবেশী কাবার্দীয়রা রাশিয়ার জার চতুর্থ ইভানের সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং এসময় প্রথমবারের মতো রুশদের সঙ্গে ইঙ্গুশদের সংঘর্ষ হয়। ১৭৭০ সালে ২৪ জন ইঙ্গুশ গোত্রীয় নেতা সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় একাতেরিনার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ১৮১০ সালে ৬টি ইঙ্গুশ গোত্র সম্রাট প্রথম আলেক্সান্দরের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দিলে অঞ্চলটি রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮২০ এর দশক থেকে ১৮৫০ এর দশক পর্যন্ত উত্তর ককেশাসে রুশ সাম্রাজ্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও ককেশাস আমিরাতের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়, তাতে ইঙ্গুশদের একাংশ রুশদের পক্ষে এবং আরেক অংশ ককেশাস আমিরাতের পক্ষে যুদ্ধ করে। ১৮৫৮ সালে ইঙ্গুশদের ভূমিতে রুশ সরকার কসাকদের বসতি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিলে ইঙ্গুশদের একাংশ বিদ্রোহ করে। ইঙ্গুশ জনসাধারণের একাংশকে রাশিয়া থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং এরা ওসমানীয় সাম্রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৮৭৭-১৮৭৮ সালের রুশ-ওসমানীয় যুদ্ধে এবং ১৯০৪-১৯০৫ সালের রুশ-জাপানি যুদ্ধে প্রচুর ইঙ্গুশ রুশ সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে ওসমানীয় সাম্রাজ্য ও জাপানের বিরুদ্ধে কৃতিত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইঙ্গুশ সৈন্যরা সাহসিকতার সঙ্গে জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। রুশ বিপ্লবের পর ১৯১৭ সালের নভেম্বরে উত্তর ককেশাসের বিভিন্ন জাতির প্রতিনিধিরা মিলে 'পার্বত্য প্রজাতন্ত্র' নামক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে এবং ইঙ্গুশরা এই রাষ্ট্রে যোগদান করে। রাষ্ট্রটি জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, ওসমানীয় সাম্রাজ্য, ব্রিটেন ও আরো কয়েকটি রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ করে এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। বলশেভিকরা প্রত্যুত্তরে 'তেরেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র' ও 'উত্তর ককেশীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র' গঠন করে। ১৯১৯ সালের মার্চে পার্বত্য প্রজাতন্ত্রের একটি প্রতিনিধিদল ভার্সাই শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে এবং রুশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তা জাউরবেক আখুশকভ সম্মেলনে ইঙ্গুশদের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেনারেল আন্তন দেনিকিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক বিরোধী দক্ষিণ রাশিয়ার সশস্ত্রবাহিনী পার্বত্য প্রজাতন্ত্র আক্রমণ করে রাষ্ট্রটির অধিকাংশ স্থান দখল করলে রাষ্ট্রটির বিলুপ্তি ঘটে।
http://countrystudies.us/russia/34.htm
ইঙ্গুশরা চলমান রুশ গৃহযুদ্ধে বলশেভিকদের পক্ষাবলম্বন করে এবং লাল ফৌজের অংশ হিসেবে শ্বেত ফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ১৯২০ সালের মার্চে লাল ফৌজ ইঙ্গুশেতিয়ার ভূমি থেকে দেনিকিনের সৈন্যদের বিতাড়িত করে। বলশেভিকরা উত্তর ককেশাসের জাতিগুলোকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯২০ সালের ১৭ নভেম্বর 'পার্বত্য সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' গঠন করে, ইঙ্গুশেতিয়া যার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯২১ সালের ২০ জানুয়ারি এটিকে 'পার্বত্য স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে' রূপান্তরিত করা হয়। পরবর্তীতে উত্তর ককেশাসের জাতিগুলোর প্রতিটির জন্য স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং ১৯২৪ সালের ৭ নভেম্বর 'ইঙ্গুশ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ' গঠন করা হয়। পরবর্তী এক দশকে ইঙ্গুশ ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়, প্রদেশটিতে ব্যাপক হারে শিল্পায়নের উদ্যোগ গৃহীত হয় এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতের উন্নতিসহ প্রজাতন্ত্রটির অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মানের প্রভূত উন্নতি হয়। ইঙ্গুশ ও চেচেন জাতির মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে ১৯৩৪ সালের ১৫ জানুয়ারি সোভিয়েত সরকার ইঙ্গুশ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ এবং চেচেন স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশকে একত্রিত করে 'চেচেন-ইঙ্গুশ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ' গঠন করে। ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ৫ ডিসেম্বর প্রদেশটিকে স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা প্রদান করা হয় এবং 'চেচেন-ইঙ্গুশ স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' নামকরণ করা হয়। চেচেন ও ইঙ্গুশদের একাংশ ১৯৪০ সালে সোভিয়েত শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহীদের সঙ্গে জার্মান গোয়েন্দা সংস্থার যোগাযোগ ছিল এবং ১৯৪১ সালের ২২ জুন জার্মানির নেতৃত্বে অক্ষশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের পর জার্মানরা সরাসরি এই বিদ্রোহীদের সমর্থন করতে শুরু করে। জার্মানরা এই বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং কিছুসংখ্যক জার্মান সৈন্যকে সোভিয়েতবিরোধী অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তাদের মধ্যে প্রেরণ করা হয়। জার্মান সমর্থিত বিদ্রোহের প্রতি ইঙ্গুশ ও চেচেনদের নিরঙ্কুশ সমর্থন ছিল না। হাজার হাজার ইঙ্গুশ ও চেচেন সৈন্য বীরত্বের সঙ্গে লাল ফৌজের অংশ হিসেবে অক্ষবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং তাদের অনেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সামরিক পদক অর্জন করে। ইঙ্গুশ ও চেচেন শ্রমিকরা যুদ্ধাস্ত্র ও আনুষঙ্গিক রসদপত্র উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং ইঙ্গুশ ও চেচেন ধর্মীয় নেতারাও যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য বিশেষ অবদান রাখে। ১৯৪২ সালের আগস্টে ককেশাসের তেলক্ষেত্রগুলো দখল করার উদ্দেশ্যে জার্মান সৈন্যরা দক্ষিণ দিকে ধাবিত হয় এবং বর্তমান ইঙ্গুশেতিয়ার মাল্গোবেক অঞ্চল দখল করে নেয়, কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণ ও লাল ফৌজের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। ১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত সরকার ইঙ্গুশ ও চেচেন রাজাকারদের জার্মানদের সঙ্গে সহযোগিতা, সোভিয়েতবিরোধী কার্যক্রম এবং দস্যুবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত করে এবং মধ্য এশিয়ায় নির্বাসিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও ১৯৪০ সাল থেকে ইঙ্গুশ ও চেচেনদের একাংশ সোভিয়েত শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত ছিল এবং জার্মানদের সঙ্গে সহায়তা করেছিল, তথাপি ইঙ্গুশ ও চেচেন জনসাধারণের সিংহভাগ ছিল সোভিয়েত সরকারের প্রতি অনুগত এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েতদের বিজয়ে তাদের যথেষ্ট অবদান ছিল। ১৯৪৪ সালের ৩ মার্চ চেচেন-ইঙ্গুশ প্রজাতন্ত্রটিকে বিলুপ্ত করা হয় এবং প্রজাতন্ত্রটির ভূমি পার্শ্ববর্তী স্তাভ্রোপোল সীমান্ত প্রদেশ, দাগেস্তান স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, উত্তর ওসেতীয় স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও জর্জীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়। এই অঞ্চলগুলোতে রুশ, ইউক্রেনীয়, ওসেতীয় ও অন্যান্য জাতিভুক্ত মানুষদের বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করা হয়। ১৯৪৮ সালের ২৬ নভেম্বর সোভিয়েত মন্ত্রিসভা ইঙ্গুশ ও চেচেন রাজাকারদের চিরস্থায়ী নির্বাসন প্রদান করে এবং তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। স্তালিনের মৃত্যুর পর নতুন সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ মধ্য এশিয়ার মাটিতে ইঙ্গুশ ও চেচেনদের জন্য একটি 'স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র' গঠনের পরিকল্পনা করছিল, কিন্তু এ ধরনের প্রস্তাবনার প্রতি মধ্য এশীয় জাতিগুলোর সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করে তারা পরিকল্পনাটি পরিত্যাগ করে। ১৯৫৬ সালের ১৬ জুলাই সোভিয়েত মন্ত্রিসভা নির্বাসিত ইঙ্গুশ ও চেচেনদের চলাচলের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি প্রদান করে। ১৯৫৮ সালে সোভিয়েত সরকার 'চেচেন-ইঙ্গুশ স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' পুন:প্রতিষ্ঠা করে।
https://jamestown.org/program/ruslan-aushev-resigns-from-federation-council/
ইঙ্গুশ ও চেচেনরা নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরে আসলেও তাদের আবাসস্থলগুলোতে অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত অভিবাসীরা বসতি স্থাপন করেছিল। তদুপরি প্রাক্তন ইঙ্গুশ অধ্যুষিত প্রিগরোদনি জেলা পার্শ্ববর্তী উত্তর ওসেতিয়ার নিকট হস্তান্তর করা হয়েছিল, যেগুলো ইঙ্গুশদের ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। ফলে ওসেতীয়দের সঙ্গে ইঙ্গুশদের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ১৯৭০ এর দশকে ইঙ্গুশ বুদ্ধিজীবীরা প্রিগরোদনিকে ইঙ্গুশদের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার জন্য দাবি জানান এবং ইঙ্গুশ জনসাধারণ এই দাবিতে বিক্ষোভ করে।
https://www.telegraph.co.uk/news/worldnews/europe/georgia/2663222/Russia-faces-news-Caucasus-uprising-in-Ingushetia.html
১৯৯১ সালের ১ অক্টোবর প্রাক্তন সোভিয়েত মেজর জেনারেল ঝোখার দুদায়েভের নেতৃত্বে চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদীরা চেচেন-ইঙ্গুশ প্রজাতন্ত্রের শাসনক্ষমতা দখল করে। ইঙ্গুশরা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের বিরোধী ছিল। তারা চেচেন-ইঙ্গুশ প্রজাতন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯৯২ সালে 'ইঙ্গুশেতিয়া প্রজাতন্ত্র' হিসেবে রুশ ফেডারেশনে যোগদান করে। ১৯৯২ সালের প্রথমদিক থেকে প্রিগরোদনি অঞ্চলে ইঙ্গুশ ও ওসেতীয়দের মধ্যে জাতিগত সংঘাত শুরু হয় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অঞ্চলটিতে রুশ সৈন্য মোতায়েন করা হয়। ৩০ অক্টোবর ইঙ্গুশ মিলিশিয়ারা প্রিগরোদনি দখলের চেষ্টা করলে ওসেতীয় মিলিশিয়াদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয় এবং এক সপ্তাহব্যাপী প্রিগরোদনিতে জাতিগত দাঙ্গা চলে। রুশ সৈন্যদের হস্তক্ষেপে সংঘাত বন্ধ হয়।
https://www.rferl.org/a/explainer-ingush-chechen-land-swap/29536507.html
১৯৯২ সালে রুশ কেন্দ্রীয় সরকার প্রিগরোদনিকে উত্তর ওসেতিয়ার অংশ হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পার্শ্ববর্তী ইচকেরিয়া চেচেন প্রজাতন্ত্রের সঙ্গেও সীমান্ত নিয়ে ইঙ্গুশেতিয়ার বিরোধ দেখা দেয়। ১৯৩০ এর দশকের মানচিত্র অনুযায়ী চেচেনরা পূর্ব ইঙ্গুশেতিয়ার অংশবিশেষ দাবি করছিল। ১৯৯৩ সালে ইঙ্গুশেতিয়া ও চেচনিয়ার মধ্যে সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং উভয় প্রজাতন্ত্র তৎকালীন সীমান্ত অপরিবর্তিত রাখতে সম্মত হয়। একই বছর আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইঙ্গুশ লেফটেন্যান্ট জেনারেল রুসলান আউশেভ ইঙ্গুশেতিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বিপুল জনপ্রিয়তার অধিকারী এই রাষ্ট্রনায়ক ১৯৯০ এর দশকের নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীলতার মধ্যে ইঙ্গুশেতিয়ায় শান্তি বজায় রাখতে সক্ষম হন।
https://oc-media.org/ingushetia-s-head-to-step-down-after-eight-months-of-turmoil/
১৯৯৪ সালে রাশিয়া ও চেচনিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে আউশেভ ইঙ্গুশেতিয়ার ওপর এই যুদ্ধের প্রভাব যথাসম্ভব সীমিত রাখার প্রয়াস পান। দেড় লক্ষাধিক শরণার্থী যুদ্ধবিধ্বস্ত চেচনিয়া থেকে ইঙ্গুশেতিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিল এবং প্রায়ই চেচেন যোদ্ধাদের পশ্চাদ্ধাবন করে রুশ সৈন্যরা ইঙ্গুশেতিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়তো। কিছুসংখ্যক ইঙ্গুশ চেচেন গেরিলাদের সঙ্গে যোগদান করেছিল, আবার চেচনিয়ায় মোতায়েনকৃত রুশ বাহিনীতেও বহুসংখ্যক ইঙ্গুশ সৈন্য ছিল। এসময় ইঙ্গুশেতিয়ায় অবস্থানরত রুশ সৈন্যরা বেসামরিক জনসাধারণের বিরুদ্ধে নানারকম অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। আউশেভ এর প্রতিবাদ জানিয়ে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে চেচনিয়া থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হলে এই পরিস্থিতির অবসান ঘটে। শরণার্থী সমস্যার চাপে ইঙ্গুশেতিয়ার অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পড়েছিল এবং পার্শ্ববর্তী চেচনিয়ায় (এবং অংশত দাগেস্তানে) অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও ধর্মীয় উগ্রপন্থার বিস্তারের প্রভাব ইঙ্গুশেতিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৯ সালে চেচনিয়াভিত্তিক জঙ্গীদের দাগেস্তান আক্রমণ এবং রাশিয়া জুড়ে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ বিস্তারের প্রেক্ষাপটে রাশিয়া দ্বিতীয় বারের মতো চেচনিয়া আক্রমণ করে এবং পূর্বের তুলনায় তুলনামূলকভাবে সুশৃঙ্খল রুশ সৈন্যরা চেচনিয়া পুনর্দখল করে নিতে সমর্থ হয়, কিন্তু উত্তর ককেশাস জুড়ে জঙ্গীদের আক্রমণ অব্যাহত থাকে। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে আউশেভ পদত্যাগ করেন এবং পরবর্তী নির্বাচনে প্রাক্তন কেজিবি/এফএসবি জেনারেল মুরাত জিয়াজিকভ ইঙ্গুশেতিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
https://www.fairobserver.com/politics/ingushetia-protests-yevkurov-kadyrov-chechnya-north-caucasus-russia-news-18212/
২০০২ সালে ইঙ্গুশেতিয়া ও উত্তর ওসেতিয়ার মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে প্রজাতন্ত্র দু'টি তাদের মধ্যকার বর্তমান সীমান্ত বজায় রাখতে সম্মত হয়। এর মধ্য দিয়ে সাময়িকভাবে ইঙ্গুশেতিয়া প্রিগরোদনির ওপর তাদের দাবিকে স্থগিত রাখে। ২০০৩ সালে ইঙ্গুশেতিয়া ও চেচনিয়ার মধ্যে অনুরূপ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৪ সালের ৬ এপ্রিল চেচেন জঙ্গীদের দ্বারা পরিচালিত গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে ইঙ্গুশ রাষ্ট্রপতি জিয়াজিকভ আহত হন এবং ২০০৪ সালের জুনে ইঙ্গুশেতিয়ার বৃহত্তম শহর নাজরানে চেচেন জঙ্গীদের আক্রমণে সামরিক-বেসামরিক মিলিয়ে প্রায় ১০০ মানুষ নিহত হয়। ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ইঙ্গুশেতিয়ায় 'ককেশাস আমিরাত' জঙ্গীরা বড়মাত্রার বিদ্রোহ শুরু করে এবং ২০০৮ সালের ৩০ অক্টোবর রুশ রাষ্ট্রপতি দিমিত্রি মেদভেদেভ দুর্নীতি ও ইঙ্গুশেতিয়ায় বিরাজমান অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অভিযোগে জিয়াজিকভকে অপসারণ করেন। দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধের রুশ প্যারাট্রুপার বাহিনীর ইঙ্গুশ মেজর জেনারেল ইউনুসবেক ইয়েভকুরভকে ইঙ্গুশেতিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত করা হয়। ইয়েভকুরভের শাসনামলের প্রথম বছরগুলোতে ককেশাস আমিরাত জঙ্গীদের সঙ্গে ইঙ্গুশ নিরাপত্তারক্ষীদের তীব্র সংঘর্ষ হয় এবং ইঙ্গুশেতিয়া জুড়ে জঙ্গীদের আক্রমণ বৃদ্ধি পায়। ২০০৯ সালের ১০ জুন ইঙ্গুশেতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের উপপ্রধান বিচারপতি আজা গাজগিরেইয়েভা এবং ১৩ জুন প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী বশির আউশেভ জঙ্গীদের হাতে নিহত হন। ২২ জুন গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে ইয়েভকুরভ গুরুতরভাবে আহত হহলেও প্রাণে বেঁচে যান। সুস্থ হওয়ার পর ইয়েভকুরভ ঘোষণা করেন যারা এই আক্রমণগুলোর সঙ্গে জড়িত তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হবে। ইঙ্গুশেতিয়ায় বিদ্রোহ দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, জঙ্গীদের নেতারা একে একে ইঙ্গুশ নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে নিহত হয় এবং এফএসবি সদস্যরা জঙ্গীদের অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের নেটওয়ার্কগুলো ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। ২০১৫ সালের মে মাসে ইয়েভকুরভ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন ইঙ্গুশেতিয়ায় জঙ্গীরা পরাজিত হয়েছে। ৮ বছরব্যাপী সংঘর্ষে জঙ্গীদের আক্রমণে প্রায় ৫০০ ইঙ্গুশ নিরাপত্তারক্ষী ও ৭১ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়। ২০১৩ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইয়েভকুরভ পুনরায় র্নিবাচিত হন এবং ইঙ্গুশেতিয়ায় স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য তাকে কৃতিত্ব প্রদান করা হয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ইঙ্গুশেতিয়া ও চেচনিয়ার মধ্যে বিদ্যমান সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য প্রজাতন্ত্র দু'টির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ইঙ্গুশেতিয়া প্রায় ২৬,৮০০ হেক্টর ভূমি (ইঙ্গুশেতিয়ার মোট আয়তনের প্রায় ৯%) চেচনিয়ার কাছে হস্তান্তর করে এবং বিনিময়ে চেচনিয়ার কাছ থেকে প্রায় ১,০০০ হেক্টর ভূমি লাভ করে। উভয় প্রজাতন্ত্রের আইনসভায় চুক্তিটি অনুমোদিত হয়। ইঙ্গুশ জনসাধারণ ইঙ্গুশেতিয়ার ভূমি চেচনিয়াকে হস্তান্তরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং দুই সপ্তাহব্যাপী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইঙ্গুশেতিয়ার সাংবিধানিক আদালত চুক্তিটিকে অবৈধ বলে রায় প্রদান করে। ইয়েভকুরভ রাশিয়ার কেন্দ্রীয় সাংবিধানিক আদালতে আপিল করলে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আদালত চুক্তিটিকে বৈধতা প্রদান করে। ইঙ্গুশেতিয়ায় আবার বিক্ষোভ শুরু হয় এবং ২০১৯ সালের মার্চে বিক্ষোভ তীব্র রূপ ধারণ করে। ২০১৯ সালের ২৬ জুন ইয়েভকুরভ প্রজাতন্ত্রের স্বার্থে পদত্যাগ করেন এবং এর মধ্য দিয়ে ইঙ্গুশেতিয়ায় বিক্ষোভের অবসান ঘটে। রুশ কেন্দ্রীয় সরকার ইয়েভকুরভের সামরিক পদমর্যাদা লেফটেন্যান্ট জেনারেলে উন্নীত করে এবং তাকে রাশিয়ার উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত করে। কাজাখ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও সামারা প্রদেশে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করা ইঙ্গুশ রাজনীতিবিদ মাখমুদ আলী কালিমাতভ ইঙ্গুশেতিয়ার নতুন রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত হন। ইঙ্গুশেতিয়া প্রজাতন্ত্রটির জনসংখ্যার প্রায় ৯৪.১% ইঙ্গুশ, ৪.৬% চেচেন, ০.৮% রুশ এবং ০.৫% অন্যান্য জাতিভুক্ত। ইঙ্গুশরা 'উত্তর-পূর্ব ককেশীয়' জাতিসমূহের অংশ এবং তাদের মাতৃভাষা ইঙ্গুশ। প্রজাতন্ত্রটি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং সেখানে খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, মার্বেল, ডলোমাইট ও কাঠসহ নানাবিধ খনিজ ও বনজ সম্পদ রয়েছে। প্রজাতন্ত্রটির প্রধান শিল্প হচ্ছে তেল উত্তোলন ও পরিশোধন। প্রজাতন্ত্রটিতে প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ টন খনিজ তেলের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং আরো প্রায় ৬ কোটি টন খনিজ তেলের মজুদ রয়েছে। প্রায় সম্পূর্ণভাবে মুসলিম অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রটি আধা স্বায়ত্তশাসিত এবং প্রজাতন্ত্রটির নিজস্ব রাষ্ট্রীয় পতাকা, প্রতীক, সঙ্গীত, আইনসভা, সংবিধান ও আদালত রয়েছে। প্রজাতন্ত্রটির রাষ্ট্রভাষা দু'টি- ইঙ্গুশ এবং রুশ। প্রজাতন্ত্রটির ৩২ সদস্যবিশিষ্ট আইনসভার নাম 'ইঙ্গুশেতিয়া প্রজাতন্ত্র গণপরিষদ'। বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান মাখমুদ আলী কালিমাতভ একজন ইঙ্গুশ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কনস্তান্তিন সুরিকভ একজন রুশ এবং আইনসভার বর্তমান স্পিকার মাগোমেদ ইয়ান্দিয়েভ একজন ইঙ্গুশ। তিনজনই ভ্লাদিমির পুতিনের 'সংযুক্ত রাশিয়া' দলের সমর্থক। প্রজাতন্ত্রটির বার্ষিক বাজেটের প্রায় ৮০% রুশ কেন্দ্রীয় সরকার সরবরাহ করে। ইঙ্গুশেতিয়ায় মদ্যপানের হার সমগ্র রাশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম।
Comments