অভিজিৎ এর ভক্তদের প্রতি (পর্ব-এক)

 


বর্তমানে বিজ্ঞান প্রযুক্তি হচ্ছে পুঁজিবাদের ক্রমবিকাশের একটি হাতিয়ার মাত্র। কেউ যদি ভেবে থাকে বিজ্ঞান মহৎ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে, সৃষ্টির রহস্য উদঘাটনে পথ দেখায়, রোগ হলে চিকিৎসা করে, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়- তাহলে বলবো এই ধারণা আংশিক সত্য হলেও ১২ আনাই মিছে। মানুষকে এই সকল সুবিধা করে দেয়ার পেছনে থাকে একদল লোভী মানুষের চিরাচরিত মুনাফা লাভের উদ্দেশ্য, যদি লাভ না থাকতো অথবা লাভের পরিমাণ কমে আসতো তাহলে মানুষ আর সেই সকল সুবিধাদি পেতো না। সিউডো সায়েন্সকে বিজ্ঞান হিসেবে চালিয়ে দিয়ে মানুষকে শোষণের রাস্তাগুলোকে বৈধতা দিতে পুঁজিবাদী বিজ্ঞান আর ধর্ম দু’টোই সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত এসব শোষণকে তথাকথিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিসংখ্যান এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সামনে হাজির করে মগজ ধোলাই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে সিগমুন্ড ফ্রয়েড এর গবেষণা। যেখানেই ধর্মীয় কিংবা প্রাচীনপন্থী সামাজিক বিধানগুলো মানুষকে নানা দিক থেকে শোষণ করতে ব্যর্থতা দেখিয়েছে, সেখানেই পুঁজিবাদীরা বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেছে। অভিজিৎ হুজুগেদের স্রোতে গা ভাসিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের তথাকথিত বিজ্ঞান বিরোধিতা কিংবা লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে ফেলা ইত্যাদি বিষয়গুলো তার বইগুলোতে উল্লেখ করেছেন। আর রেফারেন্স হিসেবে যেসব বইয়ের নাম উল্লেখ করেছেন, সেসব ক্রিমিনালদের বদমাইশির ফিরিস্তি বিভিন্ন লেখায় দেয়া হয়েছে। অভিজিৎ এর উল্লিখিত পশ্চিমাদের অধিকাংশ গবেষণাই খোদ পশ্চিমা অনেক বিজ্ঞানীর কাছে বিতর্কিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞান বিরোধিতার অভিযোগ আসলেই সত্যি কিনা সেটা জানার আগে পাঠকদের একটু এদের বিজ্ঞানের দুনিয়ায় ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে আসা যাক।

#উনিশ শতকের গোড়ার দিকে নিকোলা টেসলা এবং গুগলিয়েমো মার্কনির মধ্যে তারবিহীন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিযোগিতা চলছিল। এই ব্যাপারে টেসলা সাহায্য পাচ্ছিলেন ব্যবসায়ী জে۔পি۔ মরগান এবং বন্ধু ওয়েস্টিং হাউসের কাছ থেকে। মরগান শর্ত বেঁধে দিয়েছিলেন যে তিনি ,৫০,০০০ ইউ এস ডলারের বেশি দিতে পারবেন না। ১৯০১ সালের ১২ই ডিসেম্বর মার্কনি দাবী করেন, তিনি আটলান্টিকের ওপারে সফলভাবে সিগনাল ট্রান্সমিট করতে পেরেছেন, যা ছিল “S” এর মোর্স কোড। টেসলা শুধু তারবিহীন যোগাযোগ না, তারবিহীন শক্তি সরবরাহ (Wireless Power Transmission) এর পেছনে গবেষণা করছিলেন, তাই তার দেরি হচ্ছিলো। তিনি মরগান এর কাছে লেখা তৃতীয় চিঠিতে সবকিছু খুলে বলতে বাধ্য হন যে, তিনি আসলে একটি বৃহৎ পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের পিছনে কাজ করছেন যার মাধ্যমে পুরো পৃথিবীতে বিনামূল্যে তারবিহীন বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা সম্ভব হবে। টেসলা এই উদ্দেশ্যে একটি বড় কয়েল বানিয়েছিলেন যা “Wardenclyffe Tower” নামে পরিচিত ছিল। মরগান এই কথা শোনার সাথে সাথে টেসলাকে দেয়া সব ফান্ড বাতিল করেন। টাওয়ারটিও পরে ভেঙ্গে ফেলা হয়। বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দিয়ে দিলে তো ইলেক্ট্রিক কোম্পানিগুলোর লাভের পাল্লা শূন্যে নেমে আসবে! তাই তারা চায়নি এই ধরনের কোনো প্রযুক্তি বাজারে আসুক। বিনামূল্যে বিদ্যুৎ মানুষকে দেয়ার যে মহৎ উদ্দেশ্য টেসলার ছিল, তা পুঁজিবাদীদের বিরোধিতায় ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে।

#১৮৫৯ সালে প্রথম লেড এসিড ব্যাটারি দিয়ে ফরাসি বিজ্ঞানী Gaston Plante বৈদ্যুতিক গাড়ি বানান। আইডিয়াটা কিন্তু ১৮৫৯ সালের। California Air Resources Board (CARB) ১৯৯০ সালে Zero-emission vehicle নামে একটি ম্যানডেট পাশ করে; যেখানে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ৭টি অটোমোবাইল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যদি তাদের গ্যাসোলিন নির্ভর অটোমোবাইল শিল্প চালিয়ে রাখতে চায় তাহলে তাদের অবশ্যই বাজারে এর সাথে বৈদ্যুতিক গাড়িও নামাতে হবে। এই ঘোষণার ফলে বাজারে GM, Toyota, Nissan, Honda, Ford, Chrysler প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান ৫০০০ এর বেশি বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারে আনে যার মধ্যে অন্যতম ছিল General Motors EV1; দেখা গেলো মানুষ যখন বিদ্যুৎ দিয়ে গাড়ী চালাচ্ছে তখন আর তেল কোম্পানিগুলোর তেল কিনছে না। তাহলে এতগুলো তেল কোম্পানি, এতদিন ধরে যারা এত এত মুনাফা কামাতো তাদের কি হবে? তেল নিয়ে যে এত যুদ্ধ হয় এই যুদ্ধগুলো থেমে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসার কি হবে? সৌদি আরব যে কিনা এত ভালো বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের, তাদের কি হবে? OPEC এর কি হবে? কাজেই মধ্যপ্রাচ্য আর বুশের অধীনে ইউ এস ফেডারেল গভর্নমেন্ট থেকেও সমন এলো এসব গাড়ি চালানো যাবে না, তাদের তেল দিয়েই গাড়ি চালাতে হবে! সব বৈদ্যুতিক গাড়ি ধ্বংস করা হলো, কিছু দেয়া হয় জাদুঘরে আর কিছু বাচ্চাদের স্কুলে আকর্ষণীয় খেলনা হিসেবে। California Air Resources Board (CARB) তাদের ম্যান্ডেটটি তুলে নিতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সাগুলো বেশিরভাগ সময় চলতো অবৈধ বৈদ্যুতিক লাইন থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে, কারণ বাংলাদেশ সরকার এত বিশাল পরিমাণ অটোরিক্সাকে লাইসেন্স দেয়নি যে জাতীয় গ্রিড থেকে এত বিশাল চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। আস্তে আস্তে এই যানগুলোকে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে, এখন গ্রাম এলাকা ব্যতীত এই যানগুলোকে আর দেখতে পাওয়া যায় না।

#২০০০ সালে Peter Bramley লাইকোপিন-কে সাইক্লাইজড করে বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ চাল উদ্ভাবন করেন (গোল্ডেন রাইস নামে পরিচিত) যা ভিটামিন- এর ঘাটতি অনেকাংশে মেটাতে সক্ষম। তাছাড়া জৈব কীটনাশক ব্যবহার করলে জমির উর্বরতা অনেকাংশে বজায় রাখা সম্ভব। এগুলো সবই সাপোর্ট করে জেনেটিক্যালি মডিফাইড বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতিকে। কিন্তু পুঁজিবাদীরা চায় জমির যা খুশি হোক, তাদের সর্বোচ্চ উৎপাদনটুকুই করতে হবে। এজন্যই গত দুই যুগ ধরে জৈব কীটনাশকের চেয়ে রাসায়নিক কীটনাশক বেশি ব্যবহৃত হয়েছে, কারণ এগুলো জমির যতই ক্ষতি করুক না কেন ফলন অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। আফ্রিকা-মধ্যপ্রাচ্যে দারিদ্র আর ক্ষুধা না থাকলে আমেরিকার ব্যবসার কি হবে- এই ভয়ে জেনেটিক্যালি মডিফাইড বীজ বা প্রকরণ উৎপাদনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।

#২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ স্টেম সেলের উপর গবেষণায় সকল ফান্ডিং বন্ধ করে দেন। কারণ হিসেবে বলা হয়, মানুষের জীবন শুধু স্রষ্টাই বানাতে পারে; মানুষ মানুষের জীবন বানাবে এটা কেমন কথা! স্টেম সেল হলো অবিভাজিত জৈব কোষ যা পরে বিশেষায়িত জৈব কোষে মাইটোসিস বিভাজনের মাধ্যমে বিভাজিত হতে পারে। কেউ বোন ম্যারো, লিপিড কোষ বা রক্ত থেকে স্টেম সেল নিয়ে তাকে বিশেষায়িত কোষে (এক্টোডার্ম, এন্ডোডার্ম, মেসোডার্ম) ভাগ করে দিতে পারে। অর্থাৎ এরা এক ধরনের কোষ থেকে অন্য ধরনের কোষে পরিবর্তিত হতে পারে। ফলে এরা রক্ত, পুনরুৎপাদনমূলক কোষ, ইন্টেস্টিনাল টিস্যু প্রভৃতির টার্নওভার এর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। ধর্মান্ধ আমেরিকানদের ভয়ে পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর মনে ভয় ঢুকেছিল যে, এই প্রোডাক্ট এত টাকা দিয়ে নামিয়ে যদি পরে বাজারে না চলে? তাই তারা তখন সেই গবেষণাটি পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দিতে সরকারকে চাপ দেয়।

#কোল্ড ফিউশন একটি হাইপোথেসাইজড নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন যা রুম টেম্পারেচারেই সম্ভব; এখন পর্যন্ত এটির তাত্ত্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো মডেল দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি পুঁজিবাদ এর কারণে। যেখানে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর বানানোর পেছনে হাজার হাজার ডলার ব্যয় হচ্ছে, এখানে মাত্র একটি প্রিলিমিনারি টেস্ট ছাড়া আর কোনো বিশেষ প্রণোদনা এই প্রজেক্টকে দেয়া হয়নি! কারণ নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর থেকে বোমা বানানো যায়। আর কোল্ড ফিউশন থেকে যেসব সুবিধাদি পাওয়া যায় সেগুলো হচ্ছে-

//গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বিহীন জ্বালানী উৎস।
//
কোল মাইনিং বিহীন প্রক্রিয়া।
//
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আমদানি নির্ভর তেলের প্রয়োজন কমানো।
//
অয়েল ড্রিলিং কমানো।

স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, কেন পুঁজিবাদীরা কোল্ড ফিউশন এর পেছনে বিনিয়োগ করেনি! কোল্ড ফিউশন বাস্তবে সম্ভব না বলে পুঁজিপতিরা এতে আর বিনিয়োগ করেনি, কথাটি ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছু না। কোল্ড ফিউশন যদি বাস্তবে সম্ভবও হতো, তারপরও পুঁজিবাদীরা এতে বিনিয়োগ করতো না।

#১৯৭৪ সালে শেরউড রোল্যান্ড এবং মারিও মলিনা আবিষ্কার করেন বায়ুমন্ডলে ওজোন স্তর ভাঙ্গনের অন্যতম কারণ সিএফসি গ্যাস নির্গমন। পৃথিবীকে যদি বাঁচাতে হয় তাহলে সিএফসি নির্গমন বন্ধ করতে হবে। তখনকার সময়ে আমেরিকায় অ্যারোসল, রেফ্রিজারেটর কোম্পানি, উড়োজাহাজের ক্ষেত্রে হ্যালোন গ্যাসের ব্যবহার প্রভৃতির মাধ্যমে প্রচুর সিএফসি গ্যাস নির্গমন ঘটতো। যদি সিএফসি নির্গমন বন্ধ করে উৎপাদন করতে হয় তাহলে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে, যা পুঁজিবাদীরা চায়নি। তারা উঠে পড়ে লাগলো এই গবেষণাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য!

#বাজারে যদি কোনো নতুন ঔষধ আনতে হয় তাহলে যে ঔষধ কোম্পানি বাজারে ঔষধটি আনবে তাদের ঔষধটির উপর ট্রায়াল দিতে হয়। প্রথমে দেখা হয় পশুদের উপর এর প্রভাব। তারপর ৩টি আলাদা ধাপে মানুষের উপর এর প্রভাব দেখা হয়। তারপর এই রেজাল্ট একটা সায়েন্টিফিক লিটারেচারে প্রকাশ করতে হয়। যদি ঔষধ কোম্পানিগুলো দেখে রেজাল্ট নেগেটিভ আসছে, তাহলে সাথে সাথে ট্রায়াল বন্ধ করে দেয় যাতে এর খারাপ প্রভাব সম্পর্কে মানুষ জানতে না পারে; অনেক সময় এমন ঔষধ বাজারে ছেড়ে দেয়া হয় স্রেফ লাভের আশায়। যদি তারা দেখে রেজাল্ট পজিটিভ আসছে, তাহলে যত তাড়াতাড়ি পারে ট্রায়াল বন্ধ করে দিতে চেষ্টা করে। এতে ঔষধের লং টার্ম ইফেক্ট প্রকাশিত হয়না; ফলে এই ঔষধের যদি কোনো সাইড ইফেক্ট থাকে তা অপ্রকাশিত থাকে, ঔষধ বিক্রি সহজ হয়। সায়েন্টিফিক লিটারেচারগুলোতে সেই সব রেজাল্ট প্রকাশ করা হয়, যা ঔষধটি বিক্রিতে পজিটিভনেস প্রকাশ করে; মূল ফলাফল কখনো জনসাধারণ আর ডাক্তারদের জন্য প্রকাশ করা হয় না এর উপর কোম্পানিগুলোর পেটেন্ট করা থাকে বলে। কোম্পানিগুলোর এই কুকীর্তি ধরা পড়ে যদি কোনো সরকারি অর্থায়নে অথবা নন-প্রোফিটেবল কোনো সংগঠন আবার ঔষধটির ট্রায়াল করে। ২০০৭ সালে PLOS Medicine এর গবেষকরা একটি মেটা অ্যানালাইসিসে দেখেন, স্ট্যাটিন এর ১৯২টি ট্রায়ালের মধ্যে মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রি ফান্ডেড ট্রায়ালগুলো অন্যান্য ট্রায়ালের চেয়ে ২০ গুণ বেশি পজিটিভ রেজাল্ট দেখায় ইচ্ছা করে। এভাবে মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রিগুলো ইচ্ছা করে যে মিসক্যালকুলেশন ডাটার মধ্যে করে, তাকে বলা হয় পাবলিকেশন বায়াস।

#মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রিগুলো ঔষধের ট্রায়ালের জন্য মানুষকে ব্যবহার করে। এজন্য কোম্পানিগুলো যায় তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্য সীমার নিচে থাকা মানুষগুলোর কাছে। হিউম্যান ট্রায়াল যেখানে ভারতে %, আর্জেন্টিনায় % হারে বাড়ছে প্রতি বছর; সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে তা % হারে কমছে। একটা ঔষধ ভারতের মানুষের উপর যে প্রভাব ফেলবে, শীতপ্রধান স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর উপর তা ভিন্ন প্রভাব ফেলবে। মাল্টিন্যাশনাল যেসব কোম্পানি ঔষধের ব্যবসা করে তারা সব দেশের জন্য ঔষধের ট্রায়াল না দিয়ে যেকোনো একটা বা দু'টো দেশের জন্য ট্রায়াল দেয় যাতে কম টাকা খরচ হয়। সব মানুষের জীবনযাত্রার ধরন যেহেতু এক না, কাজেই ঔষধের প্রভাবও ভিন্ন ভিন্ন মানুষের উপর ভিন্ন ভিন্ন হবে। ১৯৯৬ সালে একবার নাইজেরিয়ায় এই কাজ করতে গিয়ে ১১ জন শিশু মারা গিয়েছিল। মেডিসিন কোম্পানি Pfizer মেনিনজাইটিস রোগের চিকিৎসায় একটি ঔষধের হায়ার ডোজ ট্রাই করতে গিয়ে ঘটনাটি ঘটায়। Ben Goldacre তার "Bad Pharma" বইতে বিষয়গুলো তুলে ধরেন।

#ডায়াবেটিসের ঔষধ Rosiglitazone কিছু মারাত্মক সাইড ইফেক্ট দেখায় হৃৎপিন্ডের ক্ষেত্রে। ১৯৯৯ সালে এটি বাজারে আসে। ২০০৩ সালে WHO পর্যবেক্ষণ করে যে ঔষধটি মারাত্মক হার্ট প্রবলেম তৈরি করে। ২০০৭ সালে একটি মেটা অ্যানালাইসিস দেখায় Rosiglitazone হার্ট প্রবলেম এর রিস্ক ৪৩% বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু GSK কোম্পানি কথাটি ডাক্তার এবং রোগীদের কাছ থেকে গোপন করে ১৯৯৯ সালে ঔষধটি বাজারে ছেড়েছিল। GSK এর অন্য একটি ঔষধ Antipressent Paroxetine আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ায়, পেইনকিলার Vioxx হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। উভয় ক্ষেত্রেই সাইড ইফেক্টের কথা প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করেনি।

#২০০৯ সালে Tamiflu নামে সোয়াইন ফ্ল প্রতিষেধক যুক্তরাজ্যের বাজারে ছাড়া হয়। এটির প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান Roche ড্রাগটির সকল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ডাটা তুলে নেয়। ঔষধটির অকৃতকার্যতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি এই কাজ করতে বাধ্য হয়।

#General Agreement on Tariffs and Trade (GATT) এর উরুগুয়ে রাউন্ডে স্বাক্ষরিত চুক্তিটি Trade Related Aspects of Intellectual Property Rights( TRIPS) নামে পরিচিত। এটি মেনে চলা World Trade Organisation(WTO) ভুক্ত সব দেশের জন্য বাধ্যতামূলক। এর মাধ্যমে কোম্পানিগুলো নিজেদের প্রোডাক্ট ২০ বছরের জন্য পেটেন্ট করানোর অধিকার লাভ করে। ফলে যদি একটি কোম্পানি এইডস এর একটি প্রতিষেধক ২০ টাকায় বানায় এবং তার পেটেন্ট করায়, তাহলে জনগণকে ২০ টাকায় বানানো প্রোডাক্টই কিনতে হবে। সেই কোম্পানি ইচ্ছা করে আর এর চেয়ে কমদামী ঔষধ বানাবে না লাভের জন্য এবং অন্যদেরও বানাতে দিবে না পেটেন্ট করা আছে দেখে। কেউ যদি বলে টাকায় এইডসের প্রতিষেধক বানিয়েছি, তাহলে সে তা বাজারে আনতে পারবে না পেটেন্ট এর কারণে।

#১৯৯৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার Medicine and Related Substances Control Amendment Act পাশ করে। যার মাধ্যমে Parallel Import সরকার ইচ্ছা করলে যেসব দেশে কোন কোম্পানি অপেক্ষাকৃত কম দামে ঔষধ বিক্রি করছে সেখান থেকে ঔষধ আমদানি করতে পারবে এবং Compulsory Licensing ড্রাগ কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করা যাবে যাতে তারা সেই ড্রাগ সম্পর্কিত সব তথ্য প্রকাশ করে যাতে করে সরকার আরো কম দামে সেই ঔষধ বানাতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের উপর সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের খড়গ নেমে আসে। এই বিল পাশ হলে তাদের দেশের মাল্টিন্যাশনাল ঔষধ প্রস্তুতুকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আর শোষণ চালাতে পারবে না দক্ষিণ আফ্রিকায়। দক্ষিণ আফ্রিকাকে “Trade Watch List” এর অন্তর্ভুক্ত করে তাদের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের হুমকি দেয়া হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার অভ্যন্তরীণ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোও সরকারের উপর চাপ দিতে থাকে বিলটি উঠিয়ে নেয়ার জন্য।

#প্রতি বছর ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির পেছনে বিরাট অঙ্কের টাকা ঢালে লবিংয়ের জন্য। তারা প্রতি বছর ৭৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে ডোনেশন হিসেবে। সরকারও তাদের পলিসি অনুযায়ী ওঠাবসা করে। ২০০০ সালে রিপাবলিকান দলের ৭০% ডোনেশন এই কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আসে। বিখ্যাত ৫টি ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানিকে একত্রে “The Big Five” নামে ডাকা হয়- Johnson and Johnson, Pfizer, GlaxosmithKline, Roche, Novartis.

#২০০৩ সালে Roche নামক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি Fuzeon নামের HIV প্রতিষেধক বানায়। প্রতিষেধকটি নেয়ার জন্য প্রতি বছর জন রোগীকে দিতে হবে ২০,০০০ ইউ এস ডলার! রোগীকে প্রতি বছরই ঔষধটি নিতে হবে, ঔষধটি ছাড়লে আবার এইডস বাসা বাঁধবে শরীরে। ঔষধটি পুরোপুরিভাবে কখনোই এইডস সারাবে না। একারণে কোম্পানিগুলো কখনো চায় না এইডস পুরোপুরি সারাতে পারে এমন কোনো ঔষধ আবিষ্কার হোক।

#২০০৭ সালে আবিষ্কার হয় Dichloroacetic Acid যা ক্যান্সার কোষে মাইটোকন্ড্রিয়াকে পুনরুৎপাদন করতে সক্ষম, যার ফলে ক্যান্সার কোষগুলো স্বাভাবিক কোষের মতো মারা যাবে। বিস্তারিত গবেষণার জন্য University of Alberta- গবেষকরা আরো ফান্ডিং আশা করেন এর ক্লিনিকাল ট্রায়ালের জন্য; অথচ কোনো প্রোফিটেবল অরগানাইজেশন এর ফান্ডিং এর জন্য এগিয়ে এলো না। ক্যান্সার যদি পুরোপুরি নিরাময় হয়ে যায়, তাহলে তাদের ব্যবসার কি হবে? পরে গবেষকদের নন-প্রোফিটেবল অরগানাইজেশনের কাছে হাত পাততে হয়।

#Generic Drug হচ্ছে কোনো পেটেন্টেড ঔষধের Identical Copy. যেমন- প্যারাসিটামল এর এরকম একটা Identical Copy হলোনাপা”; একই ঔষধ, কিন্তু কোম্পানি আলাদা। ইউ এস পেটেন্ট রুলের কারণে সেখানকার ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো একটা অযাচিত সুবিধা পায়। ধরা যাক, আমি একটা ঔষধ কোম্পানি চালাই। মনে রাখতে হবে কোনো ঔষধ কোম্পানি মানবতার সেবায় নিয়োজিত হওয়ার জন্য ব্যবসা করেনা, করে লাভের জন্য। আমিও একটা ঔষধ বানিয়ে অনেক বেশী দামে বিক্রি করে লাভ করলাম। এই অবস্থায় অন্য একটা কোম্পানি আমার ঔষধের একটা Generic Drug বানিয়ে সেটা কম দামে বাজারে ছেড়ে দিলো। তখন আমি আর ঔষধটা বাজারে বেশী দামে বিক্রি করতে পারবো না। তখন আমাকে সাহায্য করবে ইউ এস পেটেন্ট , যার মাধ্যমে আমি একটা ঔষধ বানিয়ে সেটার পেটেন্ট করাবো; যার ফলে অন্য কোনো কোম্পানি আমার ঔষধ বানাতে বা বিক্রি করতে আইনানুগ বাধার সম্মুখীন হবে। এই ঔষধ যদি হয় এইডস বা ক্যান্সার নিরাময়ের মতো জটিল রোগের প্রতিষেধক, তাহলে তো লাভের উপর লাভ। এই কাজটিই Pfizer, Glaxosmithkline এর মতো ইউ এস ঔষধ কোম্পানিগুলো করে আসছে। কিন্তু আমি যেই দামে প্রচুর লভ্যাংশসহ ঔষধ বিক্রি করতে চাই, সেই দাম দিতে যদি আমার কাস্টমাররা পুরোপুরি অপারগ হয় তাহলে আমিও ওদের কাছে ঔষধ বিক্রি না করে তা আলমারিতে সাজিয়ে রাখবো, এক সময় তাতে ট্যাগ লাগবে "মেয়াদোত্তীর্ণ আর ওরাও আমার কাছ থেকে ঔষধ কিনতে না পেরে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। আর আমি পেটেন্ট করিয়ে রেখেছি দেখে আমার এই ঔষধ অন্য কোনো কোম্পানি বাজারে আনতে পারবে না। কাজেই আমি নিজে কাজটা না করে অন্যকেও কাজটা না করতে দিয়ে বাজারে মনোপলি তৈরি করলাম। এইডস রোগী সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায় এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা আর আফ্রিকা অঞ্চলে। এসব দেশের অধিকাংশ রোগী এইডস রোগের প্রতিষেধক কেনার মত সামর্থ রাখে না। ২০০১ সালে Pfizer কোম্পানি এইডস এর ঔষধ “Fluconazole” বিক্রি করে প্রতি ট্যাবলেট ৪০ ডলার হিসেবে, যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকায় গড় সাপ্তাহিক বেতন মাত্র ৬৮ ডলার।

#এইডস রোগের ঔষধ প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৬৪ সালে। এইডস রোগ আসার (১৯৮১) আগেই তার ঔষধ এসেছিল, যার নাম Zidovudine বা Azidothymidine(AZT), এটি একটি Anti Retro Viral(ARV) ঔষধ। এর প্রথম ব্যবহার হয় ১৯৮৫ সালে। আমেরিকান কোম্পানি Glaxosmithkline এর কাছে এর পেটেন্ট ছিল। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই ঔষধকে Public Domain এর মধ্যে আনে, এর মাধ্যমেখন থেকে যেকোনো ঔষধ কোম্পানি Glaxosmithkline কে রয়্যালটি দেয়া ছাড়াই এই ঔষধের Generic Form বানাতে পারবে। ঔষধ আবিষ্কারের প্রায় ৪১ বছর পর এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়! ঔষধ কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগ অর্থই ব্যয় হয় অ্যাডভার্টাইজিং-এ। তারা গবেষণা খাতে অনেক কম অর্থ খরচ করে। এসব সমস্যার সমাধান নিয়ে ২০০১ সালে আসে ভারতীয় ঔষধ কোম্পানি CIPLA তারা বানায় Triple ARV Cocktail নামে এইডস প্রতিষেধক। অন্যান্য First Line এইডস মেডিসিনে তখনকার সময়ে খরচ পড়তো প্রতি বছর ১৫,০০০ ডলার। CIPLA এই খরচ নামিয়ে আনে প্রতি বছর ৩৫০ ডলারে! আফ্রিকায় শুরু হয় ঔষধ আমদানি, যা অনেক লোকের জীবন বাঁচায়। ইদানীং Generic Drug নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে TRIPS Agreement এর কারণে।

# একটা সময় ছিল, যখন ধূমপানের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ ছিল না। সিগারেট কোম্পানিগুলো নানা চিত্তাকর্ষক প্রক্রিয়ায় তাদের পণ্যের প্রচার করতো। এমনকি এর জন্য তারা ডাক্তারদের ব্যবহার করতো। বিভিন্ন গবেষণার দোহাই দিয়ে সিগারেট কোম্পানিগুলো তাদের ক্রেতাদের বোঝাতো তাদের সিগারেট তেমন কোনো ক্ষতি করে না। ১৯৫০ এর আগে ধূমপান যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এর কোনো পরীক্ষিত প্রমাণ ছিল না। সিগারেট ক্যান্সারের মধ্যে সম্পর্ক তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। ১৯৪০ এর দশকে এসে ফুসফুসের ক্যান্সার নিয়ে মানুষ ভীত হতে শুরু করে। রোগের ফলে মৃত্যুর হার ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। মানুষ নিশ্চিতভাবে জানতো না যে এটি সিগারেটের কারণে হতে পারে। তবে সিগারেটের ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে মানুষ কিছুটা হলেও চিন্তিত হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। মানুষের চিন্তা দূর করতে সিগারেট কোম্পানিগুলো ডাক্তার চিকিৎসাশাস্ত্রকে ব্যবহার করতে শুরু করে। খেলোয়াড়, অভিনেতা অন্যান্য সেলিব্রেটিদের পাশাপাশি সিগারেটের বিজ্ঞাপনে জায়গা করে নিতে থাকে ডাক্তাররা। তখন পেনিসিলিনসহ বিভিন্ন আবিষ্কারের মাধ্যমে চিকিৎসাবিজ্ঞান সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। এর ফলে  চিকিৎসাশাস্ত্র ডাক্তারদের  প্রতি তৈরি হয়েছিল বিশেষ আস্থা। সিগারেট কোম্পানিগুলো মানুষের সে আস্থাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। ডাক্তারদের কথা উল্লেখ করে মানুষকে সিগারেট বিষয়ে নিশ্চিন্ত করার চেষ্টা চালায় তারা। অন্যান্য বিজ্ঞাপনের মতো কোনো ব্যক্তি বিশেষ ডাক্তারের দ্বারা বিজ্ঞাপন করানো হতো না। কারণ ডাক্তারদের কোনো বিজ্ঞাপনে অংশ নেয়া সেসময় নৈতিকতা বিরোধী ছিল। তাই কোনো অভিনেতাকে ডাক্তারের মতো সাজিয়ে দেখানো হতো বিজ্ঞাপনে। ছবিগুলোতে তাদের দেখানো হতো একজন আদর্শ চিকিৎসক হিসেবে, যিনি বেশ আগ্রহের সাথে ধূমপানের অভ্যাসকে সঙ্গী করে নিয়েছেন। এসব বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তারা এমন বার্তা ছড়াতে চায় যে, একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক যদি কোনো নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের সিগারেট পান করেন তাহলে সেটি নিশ্চয়ই নিরাপদ হবে। জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিকেল এসোসিয়েশন এর মতো জার্নালগুলোতে প্রচারিত হতো এসকল বিজ্ঞাপন! এসময় চিকিৎসক সমাজ থেকে বিষয়ে তেমন জোরালো কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি। বিজ্ঞাপনগুলোতে  ডাক্তারদের বেশ অভিজাতভাবে তুলে ধরা হতো বলে তেমন কেউ নিয়ে খুব বেশি সোচ্চার হয়নি। সিগারেট কোম্পানিগুলো এর ফায়দা ভালোভাবেই লুটেছে। বিজ্ঞাপনে ডাক্তারদের ব্যবহারের ফলে সিগারেটের জনপ্রিয়তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। ক্যান্সার বা স্ট্রোকের মতো ভয়াবহ ক্ষতির বিষয়গুলো তো পরের কথা, ধূমপানের ফলে সরাসরি যে সমস্যাগুলো হতো (যেমন-  নাক গলায় খুসখুসে ভাব বা কাশি) সেসবও অস্বীকার করতো কোম্পানিগুলো। বিজ্ঞাপনে সর্বপ্রথম চিকিৎসকদের ব্যবহার করেছিল আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি। লাকি স্ট্রাইক নামের সিগারেট তৈরি করতো তারা। তাদের বিজ্ঞাপনী সংস্থা বহু চিকিৎসকের কাছে সিগারেটের কার্টুন পাঠিয়ে দিয়েছিল। এরপর তারা সেসকল চিকিৎসকদের জিজ্ঞেস করেছিল, “ সিগারেট কি গলায় কম জ্বালা ধরায়?”  চিকিৎসকদের অনেকেই প্রশ্নটির হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন। আমেরিকান টোব্যাকো তাদের উত্তরকে ব্যবহার করে বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে। ১৯৩০ সালের দিকে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে বলা হয়, “২০ হাজার ৬৭৯ জন চিকিৎসক বলেছেন লাকি স্ট্রাইক সিগারেট গলায় কম জ্বালা ধরায় ১৯৩৭ সালে প্রচারিত ফিলিপ মরিস কোম্পানির বিজ্ঞাপনটি ছিল আরো এক কাঠি সরেস। স্যাটারডে ইভিনিংয়ের একটি পোস্টে লেখা হয়, ডাক্তাররা একটি গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন  ধূমপায়ীরা যখন অন্য সিগারেট ছেড়ে ফিলিপ মরিস ধরেছে তখন তাদের নাক  গলার সমস্যা দূর হয়ে গেছে বা অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। গবেষণা যে, ফিলিপ মরিসের দেয়া তহবিলে হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি সে লেখায়। ফিলিপ মরিস ধরনের গবেষণার বিজ্ঞাপন চল্লিশের দশক ধরে চালিয়ে যায়। তাদের দেখাদেখি একই কাজ করে আরজে রেনল্ড টোব্যাকো কোম্পানি। এজন্য একটি মেডিকেল রিলেশন ডিভিশন গঠন করেছিল তারা। ফিলিপ মরিসের মতো তারাও বিভিন্ন গবেষণার জন্য তহবিল প্রদান করতে থাকে। এরপর তাদের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল উল্লেখ করতে থাকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে। ১৯৪৬ সালের দিকে “ডাক্তাররা অন্য সিগারেটের চেয়ে ক্যামেল সিগারেট বেশি পান করেন”  স্লোগান দিয়ে তারা একটি প্রচারাভিযান চালিয়েছিল।  বিজ্ঞাপনের কৌশল অনেকটা আমেরিকান টোব্যাকোর মতো ছিল। ফ্রি-তে ডাক্তারদের ক্যামেল সিগারেটের কার্টুন ধরিয়ে দেয়া হতো। এরপর তাদের জিজ্ঞেস করা হতো, “আপনারা কোন ব্র্যান্ডের সিগারেট পান করেন?” পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে শক্ত প্রমাণ মেলে যে, সিগারেটের কারণে দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো রোগের সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবগুলো সিগারেট কোম্পানি এক কাতারে এসে দাঁড়ায়। তারা নতুন ধারণা ছড়ানোর চেষ্টা করে যে, আমরা এখনো নিশ্চিতভাবে জানি না সিগারেট আসলেই ক্ষতিকারক কি না। ১৯৫৪ সালে বেশ কয়েকটি সিগারেট কোম্পানি একত্রিত হয়ে A Frank Statement to Cigarette Smokers শিরোনামে সকল ধূমপায়ীদের উদ্দেশ্যে একটি বিবৃতি প্রদান করে। এতে তারা বলার চেষ্টা করে যে, ফুসফুসের ক্যান্সার বিষয়ক সাম্প্রতিক গবেষণায় অনেকেই সিগারেটের সাথে এর সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু এখনো নিশ্চিতভাবে এটি জানা যায়নি। ফুসফুসের ক্যান্সার বাড়ানোর জন্যে সিগারেটকে যেমন সন্দেহ করা যায়, তেমনি আধুনিক সমাজের আরো অনেক বিষয়কেই সন্দেহ করা যায়। গবেষণাকে বিতর্কিত বলে আখ্যা দেয় তারা। এরপর কোম্পানিগুলো একসাথে একটি গবেষণা প্রকল্প চালু করে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য। এরপর থেকে সিগারেটের বিজ্ঞাপনে ডাক্তারদের ব্যবহার করা বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তাররাও ধূমপানের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে থাকে। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত ইউ এস সার্জন জেনারেল রিপোর্টে বলা হয়, ফুসফুস গলায় ক্যান্সার এবং ক্রনিক ব্রংকাইটিসের অন্যতম কারণ ধূমপান। এসব গবেষণার ফলাফল প্রকাশের পরও সিগারেট কোম্পানিগুলো কথা স্বীকার করে নিতে রাজি হয়নি। তারা তাদের গবেষক দলের বরাত দিয়ে এটিকে বিতর্কিত ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছিলো। সার্জনদের রিপোর্ট প্রকাশের বছর দুয়েক পর আমেরিকান কংগ্রেস সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে সতর্কবার্তা মুদ্রণের আইন পাশ করে  এটির বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে  কড়াকড়ি আরোপ করে। ২০০৬ সালে যখন ইউরোপে ইলেকট্রিক সিগারেটের বিপণন শুরু হয়, তখন এটিকে নিরাপদ আখ্যা দিয়ে কোম্পানিগুলো প্রচারণা চালাতে শুরু করে। বিষয়টি শুধুমাত্র সিগারেট বা -সিগারেটের ক্ষেত্রে নয়, অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও তাদের পণ্য বিক্রি করতে এভাবে অপবিজ্ঞানের আশ্রয় নিয়ে থাকে।

#১৯৯৪ সালের নভেম্বরেনিউজিল্যান্ড জার্নাল অভ মেডিসিন” ট্রোগ্লিটাজনের ঔষধি গুণ নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। এই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছিল, ট্রোগ্লিটাজন ইনসুলিন প্রতিরোধ্যতা কমানোর মাধ্যমে টাইপ- ডায়াবেটিস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জেরল্ড অলেফস্কাই ছিলেন এই গবেষণা প্রবন্ধের গুরুত্বপূর্ণ জ্যেষ্ঠ লেখক। তিনি মানব শরীরে ট্রোগ্লিটাজনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করার জন্য ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অভ ডায়াবেটিস এন্ড ডায়জেস্টিভ অ্যান্ড কিডনি ডিজিজে যান এবং ১৯৯৫ সালে সংস্থাটির অনুমতি পান। ওয়ার্নার-ল্যামবার্ট কোম্পানিরেজিলিননাম দিয়ে ট্রোগ্লিটাজন তৈরি করতে চায়। এজন্য কোম্পানিটি যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থার কাছে অনুমতি চায়। ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থার মেডিক্যাল অফিসার জন গুয়েরিগুয়আন তখনকার সময় ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের তুলনায় ট্রোগ্লিটাজনের কার্যকারিতা খুব বেশি নয় বলে উল্লেখ করেন। দু'টি ফেজ থ্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষে রোগীদের যকৃৎ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ক্ষতিকর লক্ষণ দেখা যাওয়ায় গুয়েরিগুয়আন ট্রোগ্লিটাজনের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে ট্রোগ্লিটাজন বাতিল করার পরামর্শ দিয়ে প্রতিবেদন জমা দেন। ওয়ার্নার-ল্যামবার্ট কোম্পানি প্রতিবেদনটি খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থার পরামর্শক কমিটিকে দেখায়নি। পরামর্শক কমিটি ট্রোগ্লিটাজনের ক্ষতিকর প্রভাব না জানার কারণে ট্রোগ্লিটাজনকে কার্যকর ওষুধ ভেবে ১৯৯৬ সালের ১১ ডিসেম্বর অনুমতি দিয়েছিল। ওয়ার্নার-ল্যামবার্ট কোম্পানি ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে ওষুধটি বাজারজাত করে। ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসের মধ্যে ট্রোগ্লিটাজন যুক্তরাষ্ট্রে ডায়াবেটিস চিকিৎসায় সেবন করা যায় এমন ওষুধের ১২% বাজার দখল করে ফেললো। যুক্তরাজ্যের গ্ল্যাক্সো ওয়েলকাম কোম্পানি ১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসে ট্রোগ্লিটাজন বাজারজাত করা শুরু করলো। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসের তারিখের মধ্যেই ওষুধটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় গ্ল্যাক্সো ওয়েলকাম কোম্পানি। যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানে যকৃত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ১৩৫টি ঘটনা শনাক্ত হয় এবং জন মারা গিয়েছিল। যুক্তরাজ্যে ট্রোগ্লিটাজন প্রত্যাহারের ফলে ওয়ার্নার-ল্যামবার্ট কোম্পানির শেয়ার ১৮.% কমে গিয়েছিল। এত কিছু ঘটার পরও যুক্তরাষ্ট্রে ট্রোগ্লিটাজনের ব্যবহার অব্যাহত থাকলো। এর ফলে ওয়ার্নার-ল্যামবার্ট কোম্পানির শেয়ার আবার বাড়তে লাগলো। ১৯৯৭ সালে অড্রেয় লারু জোন্স নামে একজন সুস্থ স্কুলশিক্ষক স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে ট্রোগ্লিটাজন ওষুধটি সেবন করেছিলেন। তার ইমপ্যায়ার্ড গ্লুকোজ টলারেন্স থাকায় ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ছিল। ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি প্রতিরোধ করতে জোন্স ট্রোগ্লিটাজন ওষুধটি সেবন করেছিলেন। ওষুধ সেবনের সাত মাস পর তার যকৃৎ অকার্যকর হয়ে ১৯৯৮ সালের ১৭ মে তিনি মারা যান। জোন্সের মৃত্যুর পর ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অভ ডায়াবেটিস অ্যান্ড ডায়জেস্টিভ অ্যান্ড কিডনি ডিজিজ ১৯৯৮ সালের জুন মাসের তারিখ ট্রোগ্লিটাজন নিয়ে চলমান পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করে। ওয়ার্নার-ল্যামবার্ট কোম্পানি একটি প্রেস রিলিজ প্রকাশ করে, যাতে তারা জোন্সের মৃত্যুর সাথে ট্রোগ্লিটাজন ওষুধটির কোনো যোগসূত্র নেই বলে উল্লেখ করে। ১৯৯৮ সালের ২৭ জুলাই সিডনি এম. ওলফে এবং ল্যারি স্যাসিচ পাবলিক সিটিজেনস হেলথ রিসার্চ গ্রূপের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থার মাইকেল ফ্রাইডম্যানের কাছে আবেদন করেন। এই আবেদনে তারা ট্রোগ্লিটাজনের ব্যবহার নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য বলেন। ট্রোগ্লিটাজনের ব্যবহার নিষিদ্ধের আবেদনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তৎকালীন অনেক প্রসিদ্ধ ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ বলেন, ট্রোগ্লিটাজন কোনোভাবেই নিষিদ্ধ করা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রোগ্লিটাজন ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত থাকলো। সাধারণ নাগরিকরা ট্রোগ্লিটাজন প্রত্যাহারের জন্য খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থার কাছে আবেদন করতে থাকলো। অন্যদিকে নেতৃস্থানীয় চিকিৎসকরা ট্রোগ্লিটাজন ব্যবহারের পক্ষে মতামত জানিয়ে বলেছিলেন, হতাহত ছাড়া কোনো যুদ্ধ হয় না। ১৯৯৯ সালের ১৮ আগস্ট ডায়াবেটিস চিকিৎসায় এককভাবে ট্রোগ্লিটাজন ব্যবহার না করার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বলা হলো। ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্য কোনো ওষুধের সাথে কম্বিনেশন ড্রাগ হিসেবে ট্রোগ্লিটাজনের ব্যবহার অব্যাহত থাকলো। সাংবাদিক ডেভিড উইলম্যান ট্রোগ্লিটাজনসহ তৎকালীন আরও কিছু ওষুধ নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস পত্রিকায় প্রতিবেদন লেখেন। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য ডেভিড পুলিৎজার পুরস্কার পান। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থার মেডিক্যাল অফিসাররা নেতৃস্থানীয় কয়েকজন রাজনীতিবিদের কাছে ট্রোগ্লিটাজনের ব্যবহার কতটুকু অনিরাপদ, তা নিয়ে কিছু তথ্য ফাঁস করেছিলেন। খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থা ২০০০ সালের ২১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে ট্রোগ্লিটাজন প্রত্যাহার করে। মার্চ ১৯৯৭ থেকে মার্চ ২০০০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় .৯২ মিলিয়ন মানুষ ট্রোগ্লিটাজন ওষুধটি সেবন করে। ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে খাদ্য এবং ওষুধ সংস্থার ডেভিড গ্রাহাম চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এতে উল্লেখ করা হয়, প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে একজন ট্রোগ্লিটাজন ওষুধ সেবনকারীর যকৃৎ অকার্যকর হয়েছিল। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০০০ সালের মার্চ পর্যন্ত ৯৪ জনের যকৃতের অকার্যকারিতা শনাক্ত হয়, ৬৬ জন মারা যায় এবং ১১ জনের যকৃত প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়।

 

 

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]