পাঠানদের বরবাদে ভারতের হাত

 


সোভিয়েত বলয় থেকে পাঠানদের দূরে রাখতে ভারত ব্রিটিশদের সহযোগিতা করেছিল। অথচ নিজেদের স্বার্থে তারা ঠিকই সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী সোভিয়েতকে কাজে লাগিয়েছিল-

#কাশ্মীরবাসীর স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রশ্নে তারা ভারতের আগ্রাসী নীতির সমর্থন করেছিল।

#ইন্দিরা সরকার জরুরি অবস্থা জারির পর ভারতের উপর যে বিভীষিকা নেমে এসেছিল স্তালিন পরবর্তী এসব কুলাঙ্গাররা সেটা সমর্থন করেছিল।

#কেন্দ্র কর্তৃক সেনাবাহিনী দিয়ে অন্যায়ভাবে গোয়া দখলের পদক্ষেপকেও এরা সমর্থন করেছিল।

#চীনের সাথে যুদ্ধের সময় তারা নেহরুর সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল (যিনি মার্কিনিদের সপ্তম নৌবহরকে এই অঞ্চলে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিলেন)।

#তাদের প্রযুক্তি দিয়ে এই সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতের জোঁকেদের শত শত কারখানা বানিয়ে দিয়েছিল, যেগুলোর অনেকগুলো এখনো আছে।

১৮৪৯ সালে পাঞ্জাব ও ১৮৭৮-৮০'র যুদ্ধে আফগানিস্তান দখল করে ব্রিটিশরা। আফগানিস্তানের পাখতুন এলাকা আর বর্তমানের খাইবার পাখতুনখোয়া তখন ছিল অবিভক্ত। ওয়াজিরিস্তানে অস্থিতিশীলতা ও দুই যুদ্ধের পর ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ ভারত থেকে আফগানিস্তানকে আলাদা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২ নভেম্বর স্যার মর্টিমার ডুরান্ড ও আফগান আমির আবদুর রহমান খানের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে সাক্ষরিত হয় চুক্তি। তখন থেকে আফগানিস্তান ও ব্রিটিশ ভারতের মধ্যকার বিভাজনরেখার নাম ডুরান্ড লাইন। এই এলাকায় পূর্বে মূলত বাস করতো পাখতুন ও পাঞ্জাবিরা। ডুরান্ড লাইনের বিভাজন সিন্ধু নদের অববাহিকা ও হিন্দুকুশ পর্বতমালার অবস্থানের ভিত্তিতে হয়েছিল। ফলে পাখতুন অধ্যুষিত পেশোয়ার, অ্যাবোটাবাদ, সোয়াত উপত্যকা ইত্যাদি রয়ে যায় ব্রিটিশ ভারতে এবং পাখতুনদের বাকি এলাকা চলে যায় আফগানিস্তানে। পাখতুনিস্তানের ব্রিটিশ ভারতীয় অংশটির নাম দেয়া হলো উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। আফগানিস্তানের পাখতুনরা এই অংশটিকে ফিরে পেতে চাইতো, এমনকি এপারের অনেক পাখতুনও চাইতো আফগানিস্তানে যোগ দিতে। 

https://www.nonviolent-conflict.org/khudai-khidmatgar-servants-god-movement-badshah-khan-northwest-frontier-british-india-1933-1937/

১৯৩৭ সালে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পায় প্রদেশটি। পাখতুনরা উত্তর-পশ্চিম ব্রিটিশ ভারতে পাঞ্জাবি আধিপত্যবাদকে দেখতো ঘৃণার চোখে। সাংস্কৃতিকভাবে তারা ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আজকের তালেবান অধ্যুষিত এই প্রদেশটিই ব্রিটিশ আমলে সবচেয়ে ধর্মনিরপেক্ষ প্রদেশের একটি ছিল। 

https://www.nytimes.com/2001/12/07/opinion/the-peacemaker-of-the-pashtun-past.html

সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশ হয়েও ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণে এখানকার মানুষের সমর্থন ছিল না। খিলাফত, হিজরত ইত্যাদি আন্দোলনে সক্রিয় ছিল এই প্রদেশের মানুষ। তাদের নেতা ছিলেন খান আবদুল গাফফার খান ওরফে বাচা খান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভারত যখন উত্তাল, তখন তিনি ও তার ভাই ড. আবদুল জব্বার খান তাদের সাথীদের নিয়ে 'খুদায়ি খিদমতগার' নামে এক অহিংস আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। 

https://defence.pk/pdf/threads/nwfp-history-referendum-and-the-pakhtunistan-demand.39251/

ভারতবর্ষের অল্প কিছু নেতার মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন, যিনি জাতীয় স্বার্থে ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন। খুদায়ি খিদমতগার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসকে আফগানিস্তান সীমান্ত হয়ে জার্মানি ও সর্বশেষ জাপানে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছিল। বাচা খান যখন দেখলেন তার সাথে আলোচনা না করে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ মিলে ভারতভাগের ছক কষে ফেলেছে, মর্মাহত হলেন তিনি। তিনি জানতেন ধর্মের আবেগকে পুঁজি করে সৃষ্ট বিভাজনকে তিনি বা সেক্যুলার খুদায়ি খিদমতগার কখনো ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু তিনি অনড় ছিলেন পাকিস্তানে যোগ না দিতে। এজন্য তিনি চেয়েছিলেন প্রদেশটিকে নিয়ে স্বাধীন দেশ 'পাখতুনিস্তান' গড়া হোক। 

https://pakteahouse.wordpress.com/2008/07/10/history-is-not-a-farce-the-nwfp-referendum/

পাকিস্তানের মুসলিম লীগ যে এই দাবি মানবে না, তা ছিল স্বাভাবিক। আর কংগ্রেসের ইগো সমস্যার কারণে আপত্তি ছিল না NWFP-কে পাকিস্তানে দিয়ে দিতে। খান ভ্রাতৃদ্বয় যদি নিজ থেকে পাকিস্তানে যোগ দিতে চাইতেন, তবে প্রদেশ অন্তর্ভূক্তির কৃতিত্ব মুসলিম লীগ পেতো না। মুসলিম লীগ চেয়েছিল তাদের দাবির প্রেক্ষিতে গণভোট হোক, NWFP পাকিস্তানে যোগ দিক এবং পাকিস্তানের গঠনের সবটুকু কৃতিত্ব তারা একচ্ছত্রভাবে পাক! NWFP-র প্রাদেশিক বিধানসভায় ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। জনপ্রিয় দুই নেতা বাচা খান ও তার ভাই ড. খানও পাকিস্তানের বিপক্ষশক্তি। ৩ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন জিন্নাহ ও নেহরুর সম্মতিতে সিলেটের আসামের সঙ্গে NWFP-এ গণভোটের সিদ্ধান্ত নিলেন। গণভোটে রাখা হলো কেবল দু'টি পছন্দ- হয় ভারত, নয় পাকিস্তান; স্বাধীন পাখতুনিস্তানের কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচিত প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা থাকার পরও প্রদেশের ব্যাপারে গণভোট নেওয়া ছিল অযৌক্তিক। গণভোটে রাজি হয়ে খান ভ্রাতৃদ্বয়কে হতবাক করলো কংগ্রেস। নেহরু জানতেন, তাদের মিত্র খান ভ্রাতৃদ্বয় ও প্রাদেশিক কংগ্রেসের দাবি হলো গণভোটে পাখতুনিস্তান চাইবার সুযোগ থাকুক। তা সত্ত্বেও নেহরু গণভোটে কেবল দু'টো অপশন রাখায় সমর্থন দিয়েছিলেন। ২১ জুন বান্নুতে বাচা খান প্রাদেশিক পরিষদের সকল সদস্য, মির্জা আলি খান ও অন্যান্য আদিবাসী নেতাদের নিয়ে পাখতুনিস্তানের দাবিতে ঐক্যমতে আসেন এবং বান্নু চুক্তি সাক্ষরিত হয়। দিল্লিতে দফায় দফায় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের নেতাদের সাথে সংলাপে বসেন তিনি। মুসলিম লীগ বান্নু চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। মহাত্মা গান্ধী ছাড়া নেহরু, প্যাটেলসহ কোনো নেতা চাননি পাখতুনিস্তান হোক। তাদের যুক্তি ছিল, পাখতুনিস্তানে সমর্থন দিতে গেলে দক্ষিণ ভারতের ত্রিভাঙ্কুর বেঁকে বসবে স্বাধীনতার দাবিতে। পূর্ব পাকিস্তান কায়দায় বিচ্ছিন্ন একটা ভূখণ্ডকে নিজেদের অংশ বানানোর ঝামেলায় যেতে রাজি ছিল না কংগ্রেস। ২৭ জুন খুদায়ি খিদমতগার গণভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়। পুঁজিবাদী ব্রিটিশরাও চায়নি আফগানিস্তান ও রাশিয়ার মদদপুষ্ট পাখতুন জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়ে এমন দেশের জন্ম দিতে, যারা দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত বলয়কে শক্তিশালী করবে। ৪ জুলাই এক টেলিগ্রাম বিবৃতিতে জানা যায় ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছে কংগ্রেস। বিবৃতি অনুযায়ী 'ছোট ও দুর্বল' একটি প্রদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে দেখতে চাননি নেহরু। নির্বাচনী মাঠে থেকে NWFP-কে ভারতে রাখার তৎপরতা দেখালেন না তিনি। বিশ্বের নানা দেশ মিলিয়ে পাখতুন বা পাঠানরা সংখ্যায় প্রায় ৫ কোটি। এদের একটা বিশাল অংশকে উপজাতি গণ্য করা হয়, কেননা রাজনৈতিকভাবে তারা পরিবার বা গোত্রভেদে পরিচালিত হয়। সে অনুযায়ী তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় উপজাতি। তৎকালীন NWFP-তে ৩৫ লাখ পাখতুনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজাতিদের বাদ দিয়ে মাত্র ৬ লাখকে ভোটাধিকার দেয়া হয়। প্রদেশটির সোয়াত উপত্যকা, দির, আম্ব ও চিত্রলের কাউকে দেয়া হয়নি ভোটাধিকার। নির্বাচনের আগে জওহরলাল নেহরু প্রদেশটির মুসলিম লীগপন্থী গভর্নর ওলাফ ক্যারোরের অপসারণের জোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন, সঙ্গী ছিলেন খান ভ্রাতৃদ্বয়। এর প্রেক্ষিতে ক্যারোর অপসারিত হন, দায়িত্বে আসেন স্যার লব রোকহার্ট। নির্বাচন আয়োজনের ভার পড়ে তার কাঁধে। নির্বাচনী মাঠে মুসলিম লীগ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পর্যন্ত কর্মী ভাড়া করে এনেছিল প্রচারণার জন্য। এমন প্রচারণাও চালানো হলো যে, "যারা মুসলিম লীগে ভোট দেবে না তারা কাফের!" ৫১% ভোটারের উপস্থিতিতে ২,৮৯,২৪৪ ভোট পড়লো পাকিস্তানের পক্ষে, আর ২,৮৭৪ ভোট পড়লো ভারতের পক্ষে। NWFP হয়ে গেলো পাকিস্তানের প্রদেশ। দেশভাগের পর খিদমতগার কংগ্রেসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তেরঙ্গার বদলে আনে লাল দলীয় পতাকা। প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ড. খান (বাচা খানের ভাই)-কে ছাঁটাই করে কাইয়ুম খানকে গদিতে বসান জিন্নাহ। বাচা খান ১৯৪৮ সালের ৮ মে প্রতিষ্ঠা করেন পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় বিরোধী দল, পাকিস্তান আজাদ পার্টি। এরপর থেকে জেলে অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন 'ফ্রন্টিয়ার্স গান্ধী' খ্যাত এই নেতা। ২০১০ সালে প্রদেশটির নাম বদলে রাখা হয় খাইবার পাখতুনখোয়া। গণভোটের আগে দিল্লিস্থ মার্কিন দূতাবাসের হেনরি গ্রিডি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ও NWFP গভর্নর লব রোকহার্ট মাউন্টব্যাটেনকে গোপন প্রতিবেদনে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানের পক্ষে রায় আসতে যাচ্ছে। 

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]