রাষ্ট্রপতির জামাতা মোসাদের চর


লন্ডনের কার্লটন হাউজ টেরেস স্ট্রিটের একটি ভবনের তিন তলার অফিসে ২০০৭ সালের ২৭ জুন দুপুর দেড়টা বাজে ওষুধ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ইউবিচেম পিএলসির চার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অপেক্ষা করছিলেন তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের জন্য, যিনি সংবাদ পাঠিয়েছিলেন তাদের সাথে জরুরী মিটিংয়ে বসতে চান। প্রতিষ্ঠানটির মালিকের বাসা পাশের ভবনটির পাঁচ তলায়, যার একপাশের বারান্দা এই অফিস থেকে দেখা যায়। ঐসময় চার কর্মকর্তার একজন হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন। বাকিরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পেলেন কোম্পানীর ৬২ বছর বয়সী মালিক তার পাঁচ তলা ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে একজন সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচের দিকে ছুটতে শুরু করলেন। ততক্ষণে তাদের মালিকের শরীর আছড়ে পড়েছে কনক্রিটের ফুটপাতে। একজন পুলিশের কাছে ফোন করলো। অ্যাম্বুলেন্স আসতে খানিকটা দেরি হয়ে গেলো। ততক্ষণে মারা গেছেন কোম্পানীটির মালিক। উপরে থাকা বাকি তিন কর্মকর্তার একজন যখন ফুটপাথ থেকে চোখ সরিয়ে বারান্দার দিকে তাকালেন, তখন দেখতে পেলেন আরব চেহারার দু'জন ব্যক্তি বারান্দা থেকে আড়ালে সরে যাচ্ছে। এই ব্যবসায়ী ছিলেন আশরাফ মারোয়ান। আশরাফ মারোয়ানের রহস্যজনক মৃত্যুকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারা প্রথমে আত্মহত্যা হিসেবে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ তদন্ত শেষে তারা আত্মহত্যার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ দেখাতে পারেনি। মারোয়ান কোনো সুইসাইড নোট রেখে যাননি, তিনি অবসাদে ভুগছিলেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ব্যবসায়িক কাজকর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি। তদন্ত কর্মকর্তাদের অনেকে এখন স্বীকার করে, মারোয়ান হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে কয়েক মাস ধরে মারোয়ান স্মৃতিকথা লিখছিলেন। তিনটি খন্ডে মোট ৬০০ পৃষ্ঠার পান্ডুলিপি প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। লেখার সুবিধার জন্য টেপ রেকর্ডারের মাধ্যমে ক্যাসেটে বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ রেকর্ড করে রাখার অভ্যাস ছিল তার। মারোয়ানের স্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মৃত্যুর পর তার ডেস্ক থেকে পান্ডুলিপি এবং ক্যাসেটগুলো গায়েব হয়ে যায়।

https://www.nytimes.com/2007/07/13/opinion/13iht-edblum.1.6645021.html

আশরাফ মারোয়ান সম্পর্কে এ পর্যন্ত অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। অধিকাংশ গ্রন্থ ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার এবং গোপন নথিপত্রের উপর ভিত্তি করে ইসরায়েলি সাংবাদিক এবং গবেষকদের দ্বারা লিখিত। সেগুলোর মধ্যে আছে ইউরি জোসেফ বার এর 'The Angel', হাওয়ার্ড ব্লামের 'The Eve of Destruction' এবং অ্যারন বার্গম্যানের 'The Spy Who Fell to Earth'। এসব বইয়ে অধিকাংশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা মারোয়ানকে তাদের এজেন্ট হিসেবে স্বীকার করে। অনেকে তাকে ইসরায়েলের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ গুপ্তচর হিসেবে বর্ণনা করেন। অন্যদিকে মিসরীয়রা এবং ইসরায়েলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা কর্মকর্তা মারোয়ানকে মিসরের ডাবল এজেন্ট হিসেবে বর্ণনা করে।

https://www.theguardian.com/world/2015/sep/15/who-killed-20th-centurys-greatest-spy-ashraf-marwan

https://www.thedailybeast.com/the-egyptian-spy-who-saved-israel-in-the-yom-kippur-war

https://www.tabletmag.com/sections/israel-middle-east/articles/yom-kippur-war-spymasters

যুদ্ধের প্রথম দিকে মিসর প্রায় বিনা বাধায় সুয়েজ খাল এবং সিনাই উপদ্বীপের বিশাল অংশ মুক্ত করে ফেলতে সক্ষম হয়। মারোয়ান ইসরায়েলকে সংবাদটা দিয়েছিলেন একেবারে শেষ সময়ে, যখন প্রস্তুতি নেয়ার মতো যথেষ্ট সময় ছিল না। মারোয়ান তাদের জানিয়েছিলেন মিসরীয় বাহিনী আক্রমণ শুরু করবে সন্ধ্যা ছয়টার সময়। বাস্তবে মিসর আক্রমণ করেছিল দুপুর দু'টোর সময়। ইসরায়েলি বাহিনীকে পরাজিত করতে মিসরের বেগ পেতে হয়নি।

https://youtu.be/YpW8MzbDdAA

১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে এবং ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে দু’বার তিনি ইসরায়েলকে জানিয়েছিলেন মিসর ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছে, যা ভুল প্রমাণিত হয়। ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে যখন তিনি মোসাদ প্রধান জাভি জামিরের কাছে সাংকেতিক ভাষায় ‘র‌্যাডিশ’ শব্দটি পাঠিয়েছিলেন, তখন জামির তেল আবিব থেকে গিয়েছিলেন লন্ডন সেফ হাউজে। তাদের গোপন সাংকেতিক ভাষায় শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার কথা যখন যুদ্ধ সম্পূর্ণ নিশ্চিত। মারোয়ান জামিরকে জানিয়েছিলেন, মে মাসের ১৫ তারিখ মিসর এবং সিরিয়া একযোগে ইসরায়েলের উপর আক্রমণ শুরু করতে যাচ্ছে। মারোয়ানের তথ্যের উপর ভিত্তি করে ইসরায়েল ১০,০০০ সৈন্যের রিজার্ভ বাহিনী সীমান্তে মোতায়েন করে। শেষ পর্যন্ত মিসর বা সিরিয়া ইসরায়েল আক্রমণ করেনি।

https://www.aljazeera.com/features/2016/10/14/the-egyptian-spy-who-saved-israel

প্রস্তুতি বাবদ ইসরায়েলের ক্ষতি হয় প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার! এসব কারণে আমান এর প্রধান জেনারেল এলি জেইরা মনে করেন মারোয়ান শুরু থেকে ছিলেন মিসরের ডাবল এজেন্ট। 

https://www.haaretz.com/1.4680891

মারোয়ান প্রথমে অন্যান্য তথ্য দিয়ে বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। এরপর একাধিকবার মিসরের ইসরায়েল আক্রমণ সংক্রান্ত ভুল তথ্য দিয়ে তাদের এমনভাবে প্রভাবিত করেছিলেন যে, ইওম কিপুর যুদ্ধের সময় সৈন্য মোতায়েন করা উচিৎ হবে কিনা সেটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তারা দেরি করে। এই সুযোগে মিসর সিনাই দখল করে। ইওম কিপুর যুদ্ধে ব্যর্থতার জন্য এলি জেইরাকে পদত্যাগ করতে হয়। ইসরায়েলকে হারাতে হয়েছিল মিসরের সিনাই উপদ্বীপের দখল, যেটা তারা ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে মিসরের কাছ থেকে দখল করে। জেইরা পরাজয়ের জন্য দায়ী করেন মারোয়ানের গোয়েন্দা তৎপরতাকে। ইসরায়েলি ম্যাগাজিনের সাথে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন-

"আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, মারোয়ান যে একজন ডাবল এজেন্ট ছিল, সেটা আমি বুঝতে পারিনি।"

মিসরীয় কর্তৃপক্ষ আশরাফ মারোয়ানকে নিজেদের এজেন্ট হিসেবে দাবি করে। মারোয়ানের এক পুত্রের বিয়ে হয় মিসরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে আরব লীগের মহাসচিব আমর মুসার মেয়ের সাথে। তার আরেক পুত্র ছিল হোসনি মোবারকের ছেলে জামাল মোবারকের বন্ধু। মারোয়ানের মৃত্যুর পর মিসর তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করে।মারোয়ানের জানাজা পড়িয়েছিলেন মিসরের সর্বোচ্চ ইমাম শেখ মোহাম্মদ সাইয়্যেদ তানতাউই। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন হোসনি মোবারকের ছেলে জামাল মোবারক এবং মিসরের গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান ওমর সুলাইমান। জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার পরদিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে  হোসনি মোবারক মারোয়ানকে ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি দাবি করেন, মারোয়ানের উপর অর্পিত দায়িত্ব এবং তার অপারেশনগুলো সম্পর্কে তিনি জানতেন। মিসরের জাতীয় স্বার্থে মারোয়ান এমন কিছু অপারেশন পরিচালনা করেন, যা প্রকাশ করার সময় এখনও আসেনি। মিসরের জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল মুনায়েম সাঈদের মতে, সেগুলো আসলেই সত্যিকার গোপনীয় তথ্য ছিল, যা মারোয়ানকে দেয়া হতো ইসরায়েলিদের বিশ্বাস অর্জন করার জন্য। তার মতে, ইসরায়েলের চোখ এড়িয়ে মিসর এবং সিরিয়ার পক্ষে বিশাল বাহিনী নিয়ে ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করতে যাওয়া সম্ভব হতো না। সেজন্য তাদের দরকার ছিল এমন এক ডাবল এজেন্ট, যে দরকারের সময় ইসরায়েলকে বিলম্বিত এবং ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করবে। মিসরের এই ব্যাখ্যার সাথে একমত নন ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ইসরায়েলের সাবেক সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান জেনারেল আহরন ফারকাশের মতে, ইসরায়েল বছরের পর বছর ধরে মারোয়ানের উপর তদন্ত করেছে, তার দেয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে তাকে বিশ্বাস করেছে। ইউরি বার জোসেফ 'দ্য এঞ্জেল' গ্রন্থে মারোয়ানকে ইসরায়েলের গোয়েন্দা হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। তার মতে, আনোয়ার সাদাত দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেই তথ্য মারোয়ানের মাধ্যমে ইসরায়েল আগেই পেয়ে গিয়েছিল। চূড়ান্ত আক্রমণের তারিখটি সাদাত কারও কাছে প্রকাশ করেননি। মারোয়ান শেষ মুহূর্তে তারিখটি জানতে পেরে মোসাদকে জানানোর ব্যবস্থা করেন। ইউরি বার জোসেফ মারোয়ানের ডাবল এজেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেন। তার মতে আশরাফ মারোয়ানের মতো সন্দেহভাজন ব্যক্তি, যিনি মিসরের প্রেসিডেন্টের জামাতা, তিনি নিজে থেকে মোসাদে যোগ দিতে চাইবেন আর মোসাদ তাকে সাথে সাথে বিশ্বাস করে ফেলবে - এটা সম্ভব না। তারা বিভিন্নভাবে মারোয়ানের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করে। তার দেয়া তথ্যগুলো অন্য গোয়েন্দাদের দ্বারা সত্যায়িত করে, আবার তাকে পাল্টা বিভিন্ন তথ্য দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে সেই খবর মিসরের গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে পৌঁছেছে কিনা। সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পর তারা মারোয়ানকে নিজেদের এজেন্ট হিসেবে বরণ করে। ইউরি বার জোসেফ মনে করেন, ষাট এবং সত্তরের দশকে মোসাদ ছিল বিশ্বের সেরা গোয়েন্দা বাহিনী। সেই তুলনায় মিসরের গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল নিম্নমানের। তার মতে, আশরাফ মারোয়ানের মতো ব্যক্তিকে ডাবল এজেন্ট হিসেবে পরিচালনা করে মোসাদকে ধোঁকা দেয়ার মতো সক্ষমতা সেসময় মিসরের অনভিজ্ঞ গোয়েন্দা বাহিনীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ১৯৯৩ সালে আমান এর সাবেক প্রধান জেনারেল এলি জেইরা সর্বপ্রথম 'The Yom Kippur War: Myth vs. Reality' বইয়ে আশরাফ মারোয়ানের কথা উল্লেখ করেন। সেসময় মারোয়ানের ছদ্মনাম ‘দ্য এঞ্জেল’ ব্যবহার করে তিনি দাবি করেন, এই এঞ্জেল ছিল মিসরের ডাবল এজেন্ট। পরবর্তীতে সাংবাদিক অ্যারন বার্গম্যানের তদন্তে যখন ‘দ্য এঞ্জেল’ এর প্রকৃত পরিচয় হিসেবে আশরাফ মারোয়ানের নাম বেরিয়ে আসে, তখন জেনারেল জেইরা ২০০৪ সালে প্রকাশিত তার বইয়ের নতুন সংস্করণে সরাসরি আশরাফ মারোয়ানের নাম উল্লেখ করেন এবং তাকে মিসরের ডাবল এজেন্ট হিসেবে অভিযুক্ত করেন। তৎকালীন মোসাদের পরিচালক জাভি জামির এক টিভি অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন, ইসরায়েলের গোপন এজেন্টের পরিচয় প্রকাশ করে জেইরা রাষ্ট্রের মূলনীতি ভঙ্গ করেছেন এবং এজন্য তার বিচার হওয়া উচিত। জেইরা তখন জামিরের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন। দুই বছরের বেশি সময় ধরে আইনী লড়াই চলার পর ২০০৭ সালে আদালত রায় দেয়, জেইরা মারোয়ানের নাম প্রকাশ করে আইন ভঙ্গ করেছেন। রায় জনসমক্ষে প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালের ৭ জুন। এর তিন সপ্তাহ পর প্রাণ দিতে হয় আশরাফ মারোয়ানকে।

https://www.washingtonpost.com/world/national-security/the-rise-and-fall-of-libyan-leader-moammar-gaddafi/2011/02/21/gIQA32NsdJ_story.html?utm_term=.8c764de2ec73

১৯৭৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর গুলিতে ভূপাতিত হয় লিবিয়ান আরব এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ১১৪ এর যাত্রীবাহী বোয়িং ৭২৭ বিমানটি। প্লেনটির ১১৩ জন যাত্রীর মধ্যে ঘটনাস্থলে নিহত হয় ১০৮ জন, যাদের অধিকাংশ ছিল লিবিয়ান এবং মিসরীয় নাগরিক। নিহতদের মধ্যে ছিলেন লিবিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালাহ বুসেইর। এর কয়েক বছর আগে পশ্চিমাপন্থী রাজা ইদ্রিস আল সেনুসীকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেন গাদ্দাফী। ইসরায়েল কর্তৃক বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সংবাদ শোনার সাথে সাথে গাদ্দাফী ফোন করেন আনোয়ার সাদাতের কাছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য গাদ্দাফী সাদাতের কাছে মিসরীয় সেনাবাহিনীর সাহায্য কামনা করেন। তার পরিকল্পনা ছিল প্রথমে ইসরায়েলের বন্দর নগরী হাইফাতে ফাইটার জেট দিয়ে আক্রমণ করবেন। পরবর্তীতে পূর্ণ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে মিসরীয় সেনাবাহিনীকে অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করবেন। সাদাত গাদ্দাফীর প্রস্তাবে রাজি হলেন না। 

https://m.huffpost.com/us/entry/us_57ace496e4b069e7e5045936

তিনি গাদ্দাফীকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেয়ার পরামর্শ দিলেন। ক্ষুদ্ধ লিবিয়ান জনতা নিহতদের জানাজা অনুষ্ঠানের দিন বেনগাজীতে মিসরীয় কনস্যুলেট আক্রমণ করে। গাদ্দাফী সিদ্ধান্ত নেন, সাদাতের সাহায্য ছাড়া তিনি ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করবেন।

https://www.nytimes.com/1973/02/27/archives/pandemonium-breaks-out-at-libyan-service-for-55-pilots-rule-out.html

সেসময় লিবিয়ার সাথে মিসরের সামরিক সহযোগিতা চুক্তি বিরাজমান ছিল। চুক্তির অধীনে ফ্রান্স থেকে ক্রয় করা কয়েকটি লিবিয়ান মাইরেজ থ্রি ফাইটার প্লেন নিয়োজিত ছিল মিসরে, যেগুলো দিয়ে মিসরীয় বিমান বাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে ক্রয় করা কয়েকটি মিসরীয় সাবমেরিন নিয়োজিত ছিল লিবিয়ার সমুদ্রসীমায়, যেগুলো লিবিয়ান নৌবাহিনীর অধীনে থেকে সমুদ্রে টহল দিচ্ছিল।

https://www.telegraph.co.uk/news/uknews/1450681/Terrorist-threat-to-QE2-cruise.html

১৯৭৩ সালের ১৭ই এপ্রিল ইসরায়েলের ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের জন্য ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন থেকে ১,৪০০ ইহুদী যাত্রী বোঝাই জাহাজ ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইসরায়েলের আশদুদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছিল।

https://www.ynetnews.com/articles/0,7340,L-4137370,00.html

গাদ্দাফী সিদ্ধান্ত নিলেন, ইসরায়েলের উপর প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে জাহাজটি ধ্বংস করবেন। তিনি লিবিয়ার নৌবাহিনীর অধীনে থাকা মিসরীয় সাবমেরিনের ক্যাপ্টেনকে তলব করলেন। তাকে নির্দেশ দিলেন, টর্পেডো নিক্ষেপ করে ‘কুইন এলিজাবেথ টু’ নামের জাহাজটি ধ্বংস করে দিতে হবে। ক্যাপ্টেন গাদ্দাফীর কাছ থেকে লিখিত নির্দেশ চেয়ে বসলেন। গাদ্দাফী তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে লিখিত নির্দেশ দেয়ার ব্যবস্থা করলেন।

https://journals.lib.unb.ca/index.php/jcs/article/view/4313/4928

পরদিন যাত্রা করলো সাবমেরিন। একদিন ভূমধ্যসাগরের পানির নিচ দিয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে যাওয়ার পর ভেসে উঠলো গন্তব্যস্থলের কাছাকাছি। 

http://jewsoflibya.com/LibyanJews/thejews.html

চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করার পূর্বে ক্যাপ্টেন মিসরীয় নৌবাহিনীর কমান্ডারের সাথে রেডিওতে যোগাযোগ করলেন। তিনি তাকে গাদ্দাফীর নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত করলেন।

https://www.palgrave.com/de/book/9780230607651

কমান্ডার ক্যাপ্টেনকে অপেক্ষা করতে বলে তাৎক্ষণিকভাবে এই সংবাদ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলেন সাদাতের কাছে। সাদাত মিশন বাতিল করে ক্যাপ্টেনকে আলেক্সান্দ্রিয়া বন্দরে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। ‘কুইন এলিজাবেথ টু’ নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন সাদাত।

https://www.amazon.com/Every-Spy-Prince-Intelligence-Community/dp/0395471028

এরপর গাদ্দাফীকে ফোন করে জানালেন সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন জাহাজটি ধ্বংস করতে চেয়েছিল, কিন্তু সে জাহাজটিকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে। গাদ্দাফী সাদাতের কথা বিশ্বাস করেননি।

https://sputniknews.com/politics/201709011056997468-gaddafi-libya-anniversary-coup/

তিনি ইসরায়েলের উপর আক্রমণের নতুন পরিকল্পনা শুরু করেন এবং সাদাতের উপর পুনরায় চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত সাদাত রাজি হন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নতুন অপারেশন পরিচালনা করার জন্য। সাদাত তখনও চাইছিলেন না ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লিবিয়া অভিযান পরিচালনা করুক।

https://www.amazon.com/Qadhafis-Libya-Jonathan-Bearman/dp/0862324343

ছাত্রজীবন থেকে গাদ্দাফী ছিলেন গামাল আবদেল নাসেরের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত। তিনি ছিলেন প্রচন্ড ইসরায়েল বিরোধী এবং আরব রাষ্ট্রগুলোতে পশ্চিমা বিশ্বের হস্তক্ষেপের কঠোর বিরোধী। তিনি ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যের ক্যানসার হিসেবে বিবেচনা করতেন।

https://www.amazon.com/Seeking-Gaddafi-Libya-West-Spring-ebook/dp/B006WV3E36

১৯৬৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর গাদ্দাফী লিবিয়া থেকে মার্কিন এবং ব্রিটিশ ঘাঁটি উচ্ছেদ করেন। তিনি সেসময় লিবিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকা ১২,০০০ সদস্যের ইতালিয়ান সম্প্রদায় এবং ৫০০ সদস্যের ইহুদী সম্প্রদায়কে লিবিয়া থেকে বহিষ্কার করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় রাজা ইদ্রিসের নির্লিপ্ত ভূমিকায় লিবিয়াব্যাপী ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

https://www.washingtoninstitute.org/policy-analysis/sadat-and-his-legacy-egypt-and-world-1977-1997

ত্রিপলী ও বেনগাজীতে পশ্চিমাবিরোধী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে এবং মিসরের প্রতি সমর্থন দেখাতে গিয়ে লিবিয়ান শ্রমিকরা তেল শোধনাগারগুলো বন্ধ করে দেয়। এসব ঘটনা গাদ্দাফী এবং তার গুপ্ত সংগঠন ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টকে অভ্যুত্থানের ব্যাপারে অনুপ্রেরণা যোগায়।

https://www.history.com/topics/middle-east/yom-kippur-war

মোসাদের সাবেক প্রধান জাভি জামির স্বীকার করেন সেসময় মোসাদ রাজা ইদ্রিস এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে এ ধরনের অভ্যুত্থানের সম্ভাবনার কথা জানিয়ে সতর্ক করে। ১৯৬৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর রাজা ইদ্রিস যখন তুরস্কে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন, তখন সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় গাদ্দাফী এবং ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টের সদস্যরা দুই ঘন্টায় ত্রিপলী এবং বেনগাজীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

https://news.google.com/newspapers?nid=1314&dat=19851128&id=Mg1XAAAAIBAJ&sjid=Ne8DAAAAIBAJ&pg=5762,7679241

গাদ্দাফীর নেতৃত্বে সংঘটিত বিপ্লবটি আউয়্যাল সেপ্টেম্বর বিপ্লব, আল-ফাতাহ বিপ্লব প্রভৃতি নামে পরিচিত হয়, কিন্তু ফিলিস্তিনের প্রতি ভালোবাসা থেকে গাদ্দাফী অপারেশনটির নাম দিয়েছিলেন ‘আমালিয়াত আল-ক্বুদস’।

https://www.nytimes.com/1973/08/30/archives/sadat-and-qaddafi-act-on-unification-sadat-and-qaddafi-proclaim-a.html

ক্ষমতায় আসার পর গাদ্দাফী পশ্চিমা হস্তক্ষেপ বন্ধ করার এবং ইসরায়েলের মোকাবেলার উদ্দেশ্যে উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলো নিয়ে একীভূত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। তার উদ্যোগে এবং নাসেরের সমর্থনে সেই বছর ডিসেম্বরে ‘ত্রিপলী চার্টার’ ঘোষিত হয়; যেখানে লিবিয়া, মিসর এবং সুদানের সমন্বয়ে একীভূত আরব রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক রূপরেখা প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে সিরিয়া এতে যোগ দেয়।

https://www.britannica.com/topic/Black-September-political-organization-Palestine

১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে নাসেরের মৃত্যুর পর আনোয়ার সাদাত ক্ষমতায় আসলে উদ্যোগ স্তিমিত হয়ে পড়ে। গাদ্দাফী এবং নাসেরের মতো সাদাত আরব জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। সমগ্র আরব বিশ্ব, মুসলিম বিশ্ব, ফিলিস্তিন বা জেরুজালেমের জন্য সংগ্রামের পরিবর্তে তার মূল লক্ষ্য ছিল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে হাতছাড়া হওয়া সিনাই উপদ্বীপ ইসরায়েলের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করা। সেজন্য তিনি ইসরায়েলের সাথে আংশিক সমঝোতায় গিয়ে ফিলিস্তিনের উপর দখলদারিত্ব মেনে নিতে রাজি ছিলেন! ১৯৭৩ সালে গাদ্দাফী যখন একের পর এক ইসরায়েল বিরোধী অপারেশনের পরিকল্পনা করে যাচ্ছিলেন তখন সাদাত সেগুলোতে বাধা দিচ্ছিলেন, সেসময় তিনি গোপনে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল আসাদের সাথে মিলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন; যে যুদ্ধ পরবর্তীতে রমাদান যুদ্ধ, অক্টোবর যুদ্ধ বা ইওম কিপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত হয়। ফিলিস্তিনকে মুক্ত করা বা ইসরায়েলকে ধ্বংস করা এ যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল না। এটি ছিল ইসরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে আয়োজিত সীমিত আকারের যুদ্ধ, যেন ইসরায়েল সিনাই উপদ্বীপ এবং গোলান পার্বত্যভূমি ফেরত দিতে বাধ্য হয়। গাদ্দাফী যদি হঠাৎ ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করে বসতেন, তাহলে বড় ধরনের যুদ্ধ বেধে সাদাতের পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আক্রমণের পর ইসরায়েল সতর্ক হয়ে যেতো, ফলে সাদাতের আক্রমণের মধ্যে চমক না থাকায় তা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো। এসব কারণে সাদাত গাদ্দাফীর পরিকল্পনায় বাধা সৃষ্টি করে আসছিলেন। সাবমেরিন হামলা ব্যর্থ হওয়ার পর গাদ্দাফী যান কায়রো। তিনি পূর্বের চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে সাদাতের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন যেন লিবিয়া এবং মিসর একত্রে যুক্ত হয়ে একীভূত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সেটা সফল হলে মিসরের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সাথে লিবিয়ার তেল বিক্রয় লব্ধ অর্থের সমন্বয়ে ইসরায়েল বিরোধী শক্তিশালী জোট সৃষ্টি হতে পারতো। সাদাতের উপর চাপ সৃষ্টি করতে লিবিয়া থেকে ৪০,০০০ মানুষ মিসর অভিমুখে লংমার্চ শুরু করে। মিসরীয় সেনাবাহিনী রোডব্লক এবং স্থলমাইন স্থাপন করে তাদের ফিরিয়ে দেয়। গাদ্দাফী লিবিয়া ফিরে এসে সাদাতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে শুরু করেন। তিনি বিপ্লবের মাধ্যমে সাদাতকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য মিসরীয়দের আহ্বান জানান। শেষ পর্যন্ত সাদাত গাদ্দাফীর সাথে সমঝোতায় আসেন। ১৯৭৩ সালের আগস্টের শেষ দিকে তারা দুই রাষ্ট্রকে একীভূত করার ব্যাপারে প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। গাদ্দাফী তখনও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার পরিকল্পনা থেকে সরে আসেননি। তার পরিকল্পনা সম্পর্কে আগে থেকে অবহিত হওয়ার জন্য এবং সুযোগ অনুযায়ী তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সাদাত গাদ্দাফীকে শর্ত দেন তিনি ইসরায়েল আক্রমণের ব্যাপারে গাদ্দাফীকে সাহায্য করবেন, তবে তাকে কথা দিতে হবে তিনি সম্পূর্ণ পরিকল্পনা মিসরের সাথে আগে থেকে শেয়ার করবেন। গাদ্দাফীর সাথে মিলে ইসরায়েল আক্রমণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার জন্য বিশেষ দূত হিসেবে সাদাত নিয়োগ দেন সিনিয়র উপদেষ্টা আশরাফ মারোয়ানকে। আশরাফ মারোয়ান ছিলেন গামাল আবদেল নাসেরের মেয়ে মুনা নাসেরের স্বামী এবং প্রেসিডেন্টের চীফ অফ স্টাফের সহকারী। নাসেরের মেয়ে মুনাকে আশরাফ মারোয়ান বিয়ে করেছিলেন প্রেম করে। তখনও তিনি মোসাদে যোগ দেননি। নাসের মিসরের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী দ্বারা মারোয়ানের উপর তদন্ত করিয়েছিলেন। তার অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় প্রথমে এ বিয়েতে নাসের রাজি ছিলেন না। বিয়ের পর মারোয়ানকে সামরিক বাহিনীতে না রেখে নিজের অফিসে নিয়ে আসেন নাসের। ইউরি বার জোসেফের ধারণা, শ্বশরের কাছে পাত্তা না পাওয়ার ক্ষোভে এবং আর্থিক লোভে মারোয়ান স্বপ্রণোদিত হয়ে মোসাদের সাথে যোগাযোগ করেন। মোসাদে মারোয়ানের কোড নেম ছিল ‘হালামাশ’, যার অর্থ 'এঞ্জেল'। প্রাথমিক তদন্ত শেষে মোসাদ ১৯৭০ সালে মারোয়ানকে গুপ্তচর হিসেবে বরণ করে। গাদ্দাফী সিদ্ধান্ত নেন তার দেশের যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস করার প্রতিশোধ নিতে হবে ইসরায়েলের বিমান ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে। চূড়ান্ত পরিকল্পনার দায়িত্ব এসে পড়ে লিবিয়ান কর্মকর্তা এবং আশরাফ মারোয়ানের উপর। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, রোমের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এয়ারপোর্টে অভিযান চালানো হবে। মারোয়ানের নির্দেশে মিসরীয় গোয়েন্দা বাহিনীর দুই সিনিয়র কর্মকর্তা রোমে যান এবং এয়ারপোর্টের লে-আউট, আশেপাশের এলাকার মানচিত্র, বিভিন্ন ফ্লাইটের সময়সূচী সংগ্রহ করেন। সেগুলো পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, এয়ারপোর্ট থেকে উড্ডয়নের পর পাশের ভবন থেকে এসএ-৭ স্ট্রেলা অ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইলের মাধ্যমে ৪০০ যাত্রী ধারণ ক্ষমতা বিশিষ্ট ইসরায়েলের এল আল এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৪৭ বিমান ভূপাতিত করা হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে পাওয়া অ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইলগুলো রোমে পৌঁছে দিবে মারোয়ানের নেতৃত্বে মিসরীয় গোয়েন্দারা, সেখান থেকে সেগুলো গ্রহণ করবে ফিলিস্তিনের ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর সংগঠনের সদস্যরা, যাদের নিয়োগ করার দায়িত্বে থাকবে লিবিয়ানরা। এর আগে জার্মানীর মিউনিখ অলিম্পিকে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের যে দলটি ১১ জন ইসরায়েলি খেলোয়াড় হত্যা করে, তাদের আর্থিক সহযোগিতা এবং আশ্রয় দিয়েছিল লিবিয়া। আগস্টের ২৯ তারিখ ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের বিশেষ দলটির দলনেতা আমিন আল হিন্দি দলটির আরো চার সদস্য সহ রোমে পৌঁছে। কিছুদিন পর মারোয়ানের নির্দেশে মিসরীয় সেনাবাহিনীর অস্ত্রভান্ডার থেকে দু'টি মিসাইল এবং মিসাইল লঞ্চার গোপনে সরিয়ে ফেলা হয়। মারোয়ান সেগুলো তার স্ত্রী মুনার নামে ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে প্যাক করেন। মুনার সেসময় ভিন্ন কাজে লন্ডনে যাওয়ার কথা ছিল, মারোয়ান তাকে অনুরোধ করেন ব্যাগ দু'টি নিয়ে তার সাথে রোমে দেখা করার জন্য। মুনার অজান্তেই মিসর থেকে কূটনৈতিক ব্যাগের ভেতরে মিসাইল দু'টি ইতালিতে পৌঁছে। মিসরীয় কর্মকর্তারা ব্যাগগুলো নিয়ে রোমে অবস্থিত ইজিপশিয়ান এয়ার অ্যাকাডেমিতে পৌঁছে দেয়। মারোয়ান রোমে পৌঁছেন পরদিন সকালে। তিনি নিজের গাড়িতে ব্যাগ দু'টি নিয়ে নিকটবর্তী বাজারে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর এর দলটির সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে গোপন সাংকেতিক কোড বিনিময় করার পর পরস্পরের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তাদের হাতে ব্যাগ দু'টি বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে আসেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর দলটির গাড়িতে করে মিসাইলগুলো নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাদের যে গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে, সে তথ্যটি কেউ তাদের আগে জানায়নি। তারা বাজারের একটি কার্পেটের দোকান থেকে কার্পেট কিনে, ব্যাগগুলোকে কার্পেটে পেঁচিয়ে ট্রেনে করে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসে। ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর দলটির রোমে পা দেয়ার পর থেকে শুরু করে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ নজরদারি করছিল মোসাদের একদল এজেন্ট। মিসাইলগুলো এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছানো, সেখান থেকে মিসরীয় এয়ার অ্যাকাডেমিতে স্থানান্তর, মারোয়ানের কাছ থেকে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের মিসাইলগুলো গ্রহণ, ট্রেনে করে তাদের অ্যাপার্টমেন্টে ফেরত আসা - কিছুই তাদের চোখ এড়ায়নি। পরিকল্পনার শুরু থেকে মারোয়ান ঘটনার বিস্তারিত মোসাদকে জানিয়ে রেখেছিলেন। মোসাদের প্রধান জাভি জামির হাজির হন রোমে। জামির শেষ মুহূর্তে রোমের পুলিশ বাহিনীকে জানিয়েছিলেন এয়ারপোর্টে সন্ত্রাসী হামলা হবে। এর আগে থেকেই তিনি বিশেষ কমান্ডো বাহিনী প্রস্তুত রেখেছিলেন এই উদ্দেশ্যে যে, যদি রোমের পুলিশ ব্যর্থ হয়, তাহলে নিজেরাই যেন ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর দলটিকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে পারেন। পরদিন সকালে ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ ইতালির নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান চালিয়ে অস্ত্র সহ আটক করে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর দলের পাঁচ সদস্যকে। ১৯৭৩ সালের ৫ অক্টোবর, রাত ১১টায় লন্ডনের একটি সেফ হাউজে বসে মোসাদের পরিচালক জাভি জামির অপেক্ষা করছিলেন মিসরীয় গোয়েন্দা ‘দ্য এঞ্জেল’ এর জন্য।

https://www.mossad.gov.il/eng/history/Pages/Zvi-Zamir-.aspx

এর ১৫ ঘণ্টার মধ্যে শুরু হতে যাচ্ছে ইওম কিপুর যুদ্ধ। আগের দিন জাভি জামির ছিলেন তেল আবিবে। রাত আড়াইটার সময় ঘুম থেকে জাগিয়ে সেক্রেটারি জানায়, মোসাদ হেডকোয়ার্টার থেকে ফোন এসেছে। ‘দ্য এঞ্জেল’ ছদ্মনামে মিসরীয় গোয়েন্দা প্যারিস থেকে মোসাদের লন্ডন হেডকোয়ার্টারে ফোন করে জানিয়েছে, পরের দিন তিনি লন্ডনে মোসাদ প্রধানের সাথে সরাসরি দেখা করতে চান। ফোনে এঞ্জেল বলেছে বিষয়টি জরুরী, কারণ এটি ‘কেমিক্যালস’ সম্পর্কিত।

https://www.history.com/topics/holidays/yom-kippur-history

এঞ্জেলের সাথে মোসাদের নির্ধারিত সাংকেতিক ভাষা অনুযায়ী ‘কেমিক্যালস’ শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার কথা যুদ্ধের সম্ভাবনা বোঝাতে। তিনি বুঝতে পারলেন, এঞ্জেলের কাছে মিসরের যুদ্ধ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। এর আগে এঞ্জেল কখনো নিজে থেকে সরাসরি তার সাথে দেখা করতে চায়নি। পরদিন ৬ অক্টোবর ছিল 'ইওম কিপুর' দিবস।

https://www.timesofisrael.com/topic/eli-zeira/

সকালের প্রথম ফ্লাইটে তিনি লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। ‘দ্য এঞ্জেল’ সেফ হাউজে এসে পৌঁছালো রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ। এটি ছিল সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের পর জামিরের সাথে তার প্রথম যোগাযোগ।

https://www.britannica.com/biography/Moshe-Dayan

সেসময় গাদ্দাফীর পরিকল্পায় সংঘটিত হতে যাওয়া ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি অপারেশনকে শেষ মুহূর্তে ব্যর্থ করে দিয়ে প্রায় চারশো ইসরায়েলি নাগরিকের প্রাণ বাঁচিয়েছিল এই মিসরীয়। জামির জানতে চাইলেন, সেপ্টেম্বরের ঐ ঘটনার পর তার কোনো বিপদ হয়েছিল কিনা। লিবিয়ান বা মিসরীয় কর্তৃপক্ষ তার ভূমিকা সম্পর্কে সন্দেহ করেছিল কিনা। এঞ্জেল তাকে আশ্বস্ত করলো তার কোনো বিপদ হয়নি কিংবা তাকে কেউ সন্দেহ করেনি। এঞ্জেল বললো-

"আজ আমি এখানে এসেছি শুধুমাত্র যুদ্ধের ব্যাপারে কথা বলতে, অন্য কিছু না। আমার আসতে একটু দেরি হয়েছে, কারণ পুরো বিকেলটা আমি কাটিয়েছি কেনসিংটনের মিসরীয় কনস্যুলেটে। আমি কায়রোর সাথে যোগাযোগ করে সর্বশেষ তথ্য নিশ্চিত করেছি। আগামীকালই সাদাত ইসরায়েল আক্রমণ করছে।"

https://www.biography.com/political-figure/golda-meir

জামির জানতেন মিসর এবং সিরিয়া তাদের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করছে, কিন্তু আক্রমণ যে এতো তাড়াতাড়ি হতে যাচ্ছে সে বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। সেই কারণে তাদের ২০% সৈন্য ছিল সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে, বাকি ৮০% সৈন্য ছিল ব্যারাকে সংরক্ষিত বাহিনী হিসেবে।

https://www.aljazeera.com/news/2010/1/25/profile-anwar-sadat

এঞ্জেলের দেয়া সংবাদের ভিত্তিতে জামির যোগাযোগ করেন আমান এর প্রধান এলি জেইরা এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহশে দায়ানের সাথে।

https://www.nytimes.com/2000/06/11/world/hafez-al-assad-who-turned-syria-into-a-power-in-the-middle-east-dies-at-69.html

পরদিন সকালে প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মায়ারের উপস্থিতিতে ইসরেয়েলি মন্ত্রীসভার বৈঠক বসে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংরক্ষিত বাহিনীকে প্রেরণ করা হয় সুয়েজ খালের উদ্দেশ্যে।

https://www.britannica.com/biography/Gamal-Abdel-Nasser

আশরাফ মারোয়ানের জন্ম ১৯৪৪ সালে মিসরে। তার বাবা মিসরের প্রেসিডেনশিয়াল ব্রিগেডে চাকরি করতেন।

https://www.britannica.com/biography/Anwar-Sadat

মারোয়ান ২১ বছর বয়সে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট ক্লাস অনার্স ডিগ্রিসহ কেমিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পাশ করে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৬৫ সালের শেষ দিকে মারোয়ান যখন কায়রোর হেলিওপোলিসে নিয়মিত টেনিস খেলতে যেতেন, তখন সেখানে তার পরিচয় হয় মুনা নাসেরের সাথে। ১৭ বছর বয়সী মুনা প্রেমে পড়ে যান মারোয়ানের। তারা দু’জন বিয়ে করার জন্য পরিবারের উপর চাপ দিতে থাকেন। নিরাপত্তার খাতিরে নাসের তার চিফ অফ স্টাফকে নির্দেশ দেন মারোয়ানের উপর তদন্ত করার জন্য। রিপোর্টে উঠে আসে মারোয়ানের উচ্চাভিলাষ, ক্ষমতার লোভ, অর্থের লোভ, সমাজের উচ্চ স্তরে পৌঁছার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি। রিপোর্টে মুনার প্রতি মারোয়ানের প্রকৃত ভালোবাসা এবং অঙ্গীকারের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। ১৯৬৬ সালে মারোয়ান এবং মুনা বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর প্রথম দুই বছর মারোয়ান সেনাবাহিনীতে ছিলেন। সেখানে তিনি দ্রুত উন্নতি করতে থাকেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী অফিসারদের সেনাবাহিনীতে রাখা যে ঝুঁকিপূর্ণ, সেটা সেনাবাহিনী থেকে বিপ্লব করে ক্ষমতায় আসা নাসের জানতেন। তিনি মারোয়ানকে সেনাবাহিনী থেকে বদলি করে প্রেসিডেন্ট অফিসে নিয়ে আসেন। মারোয়ানের সাথ নাসেরের সম্পর্ক ছিল শীতল। শ্বশুরের বিশ্বাস অর্জন করতে না পেরে মারোয়ান ছিলেন হতাশ এবং ক্ষুদ্ধ। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, লন্ডনে গিয়ে রসায়নে মাস্টার্স করবেন। নাসের অনুমতি দিলেন। মারোয়ানের জাঁকজমকপূর্ণ, বিলাসবহুল জীবনযাপনের তীব্র বাসনা ছিল। সেসময় প্রেসিডেন্টের অফিসে চাকরির জন্য নাসের তাকে বেতন দিতেন সামান্য। অতিরিক্ত খরচ জোগাড় করতে সেসময় মারোয়ান এক ধনী কুয়েতি শেখের স্ত্রীর সাথে পরকীয়ার সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যার কাছ থেকে তিনি বিভিন্ন অযুহাতে অর্থ সাহায্য নিতেন। নাসেরের কানে যখন এই সংবাদ পৌঁছায়, তখন তিনি মারোয়ানকে মিসরে ডেকে মুনাকে ডিভোর্স দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। মারোয়ান এবং মুনা উভয়কে ডিভোর্সের ব্যাপারে রাজি করাতে ব্যর্থ হন তিনি। তারা নিজেদের মধ্যে ব্যাপারটির মীমাংসা করেন। তিনি শর্ত দেন, মারোয়ান আর লন্ডনে থাকতে পারবে না। শুধু সময় হলে লন্ডনে গিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ কিংবা গবেষণাপত্র জমা দিয়ে আসতে পারবে। লন্ডনে থাকাকালীন সময়ে কিংবা লন্ডন থেকে ফেরার পর প্রেসিডেন্টের অফিসে মারোয়ানের চাকরি বহাল ছিল। জটিল বিষয়ে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেয়া, সুচিন্তিত পরামর্শ দেয়া সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে তার দক্ষতা লক্ষ্য করে নাসের তাকে কাজে লাগাতে শুরু করেন। মারোয়ানের সাথে নাসেরের সম্পর্ক কিছুটা সহজ হয়ে আসতে থাকে। প্রেসিডেন্টের অফিসে চিফ অফ স্টাফের অধীনে চাকরি করার সুবাদে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে তার সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৭০ সালের গ্রীষ্মের এক সকালে লন্ডনের এক ফোনবুথ থেকে মারোয়ান ফোন করলেন লন্ডনের ইসরায়েলি দূতাবাসে। অপারেটরকে বললেন, তিনি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধির সাথে কথা বলতে চান। মোসাদের লন্ডন প্রতিনিধি সেই মুহূর্তে অফিসে ছিল না, এজন্য অপারেটর কলটি ফরোয়ার্ড করে আইডিএফের মিলিটারি অ্যাটাশের কাছে। মারোয়ান নিজের পরিচয় না জানিয়ে শুধু নাম জানালেন এবং বললেন, তিনি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে কথা বলতে চান। সেসময় মারোয়ান গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিলেন না, ফলে মিলিটারি অ্যাটাশে তাকে চিনতে পারেনি। পরদিন তার মিসরে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, তাই তিনি পাল্টা যোগাযোগের জন্য কোনো ফোন নাম্বার বা ঠিকানা দেননি, শুধু বলেছিলেন পরে তিনি যোগাযোগ করে খবর নিবেন। মিলিটারি অ্যাটাশে মারোয়ানের কথাকে গুরুত্ব দিলেন না। তিনি চিরকুটে মারোয়ানের নাম এবং সংক্ষিপ্ত নোট লিখে তার ডেস্কের উপর আউটবক্স ফোল্ডারে ফেলে রাখলেন। ১৯৭০ সালের শেষদিকে মারোয়ান আবার লন্ডনে গেলেন। ততদিনে গামাল আবদেল নাসেরের স্থলাভিষিক্ত হন আনোয়ার সাদাত। মারোয়ান সাদাতের প্রিয়পাত্র ছিলেন, ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠতে থাকেন প্রেসিডেন্ট অফিসে তার অন্যতম প্রধান সহকারী। লন্ডনে এসে তিনি আবার যোগাযোগ করেন ইসরায়েলি দূতাবাসে। ফোন ধরেন আইডিএফ এর নতুন প্রতিনিধি মেজর জেনারেল শ্যামুয়েল ইয়াল। এবার মারোয়ান হোটেলের ফোন নাম্বার দিলেন, বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত মোসাদ বা অন্য কারো পক্ষ থেকে তার সাথে যোগাযোগ করা হলো না। ইয়াল মারোয়ানকে চিনতে পারেনি এবং তার সাথে মোসাদের লন্ডন প্রতিনিধি শ্যামুয়েল গোরেনের সুসম্পর্ক না থাকায় তিনি মেসেজটি গুরুত্ব না দিয়ে ফেলে রেখেছিলেন। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দু’জন সিনিয়র মোসাদ প্রতিনিধি লন্ডনে আসেন। গোরেন এবং ইয়েল মিলে একদিন গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছিলেন, তখন ইয়েল মোসাদ প্রতিনিধিদের সাথে মারোয়ানের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, আরবদের মতো উচ্চারণ বিশিষ্ট এক ব্যক্তি কয়েকবার ফোন করেছে। সে মোসাদের সাথে কথা বলতে চায়, কিন্তু নিজের বিস্তারিত পরিচয় জানাতে চায় না এবং সরাসরি দূতাবাসে আসতে চায় না। মোসাদের একজন লোকটির নাম জানতে চাইলে ইয়াল যখন বললেন ‘আশরাফ মারোয়ান’, তখন তারা একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগলেন। আইডিএফ না চিনলেও মোসাদ আশরাফ মারোয়ানকে চিনতো। মারোয়ানের উপর তাদের ফাইল ছিল, সেখানে মারোয়ানের বিয়ের দিনের একটা ছবি রাখা ছিল। শত্রু রাষ্ট্রগুলোর প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখা মোসাদের জন্য ছিল রুটিন কাজ। তারা সবসময় অনুসন্ধান করতো শত্রু দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কাউকে ব্ল্যাকমেইল করে, ফাঁদে ফেলে কিংবা লোভ দেখিয়ে নিজেদের কাজে লাগানো যায় কি না। প্রেসিডেন্টের আত্মীয় হওয়ায় এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার সুযোগ থাকায় মারোয়ান মোসাদের লিস্টে উপরের দিকে ছিল। মারোয়ান লন্ডনে ছিলেন কি না, মোসাদ প্রতিনিধিরা তা জানতো না। তারা এলেন অফিসে। ফোন করলেন মারোয়ানের দেয়া ফোন নম্বরে। তারা তাকে নির্দিষ্ট সময়ে লন্ডনের একটি হোটেলে তাদের সাথে দেখা করতে বললেন। ফাঁদ হতে পারে, এমন আশঙ্কায় মোসাদের এজেন্টরা আগে থেকে হোটেলের প্রবেশ পথ, লবিসহ বিভিন্ন জায়গায় সাদা পোশাকে অবস্থান নিলো। হাতে ব্রিফকেস নিয়ে হোটেলে হাজির হলেন মারোয়ান। লবিতে দাঁড়িয়ে মিনিট পাঁচেক কুশল বিনিময় এবং প্রাথমিক পরিচয় নিশ্চিত করার পর তাকে নিয়ে উপরের একটি কক্ষে চলে গেলো মোসাদের এক প্রতিনিধি, যার ছদ্মনাম ‘দুবি’। মারোয়ান জানালেন তিনি মোসাদের জন্য কাজ করতে চান। মিসরের রাষ্ট্রীয় এবং সেনাবাহিনী সম্পর্কিত গোপন তথ্য দিয়ে তিনি সাহায্য করতে চান ইসরায়েলকে। দুবি যখন জানতে চাইলেন কী ধরনের তথ্য তিনি দিতে পারবেন, তার উত্তরে মারোয়ান জানালেন "সকল তথ্য"। কোনো দেশের সরকার প্রধানের সাথে সাদাতের গোপন বৈঠকের আলোচ্য বিষয়, মিসরের সেনাবাহিনীর সামরিক মহড়া, অস্ত্র ক্রয়, যুদ্ধের প্রস্তুতি - সব ধরনের তথ্য মারোয়ানের হাতের নাগালে। মারোয়ান ব্রিফকেস খুলে একতোড়া কাগজ বের করে দুবির হাতে দিলেন। সেগুলো ছিল আরবিতে হাতে লেখা উচ্চ পর্যায়ের সামরিক বৈঠকের মেমোরেন্ডাম, যেখানে ছিল মিসরের যুদ্ধ পরিকল্পনা সম্পর্কে গোপনীয় বিভিন্ন তথ্য। দুবি আরবি জানতেন। তারপরও কয়েক ঘন্টা ব্যাপী তিনি মারোয়ানের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি তথ্য বিস্তারিত জেনে নিলেন। সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে চলে গেলেন মারোয়ান। মারোয়ান মিসরে ইসরায়েলের একমাত্র গুপ্তচর ছিল না। তারা মারোয়ানের দেয়া তথ্যগুলো বিভিন্ন উপায়ে যাচাই করে দেখলো। পরবর্তীতে শ্যামুয়েল গোরেন মন্তব্য করেছিলেন, এ ধরনের তথ্য হাজার বছরে একবার পাওয়া যায়। মোসাদ নিশ্চিত হয়েছিল, মারোয়ান আসলেই মোসাদের জন্য কাজ করতে চায়। ১৯৭০-১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ২৮ বছর তিনি মোসাদের জন্য কাজ করেন। অধিকাংশ ইসরায়েলি কর্মকর্তা ধারণা করেন, মারোয়ান অর্থের লোভে মোসাদে যোগ দিয়েছিলেন। প্রথম দিনের সাক্ষাতের শেষে দুবিকে কাগজপত্র দিয়ে বিদায় নেয়ার আগে মারোয়ান তাকে বলেছিলেন, তারা সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখুক, কিন্তু পরবর্তীতে যখন তিনি নতুন কোনো তথ্য নিয়ে আসবেন তখন তাকে দিতে হবে ১ লাখ ডলার! বিভিন্ন সময়ে মারোয়ান মোসাদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন অন্তত ৩০ লাখ ডলার! তার মূল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘কাবরা’, শব্দটির অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তার সম্পত্তির পরিমাণ হয়েছিল প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার! ব্রিটিশ ফুটবল ক্লাব চেলসির ৩.২% মালিকানা ছিল তার।




Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]