সোভিয়েত উজবেকিস্তান
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে উজবেকিস্তান রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর উজবেকিস্তান যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন অঞ্চলটির জনসাধারণের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৪%। বাকি ৯৬% ছিল সম্পূর্ণ নিরক্ষর।
https://www.tandfonline.com/doi/abs/10.2753/RES1060-939316111246
সোভিয়েত শাসনামলে প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের পশ্চাৎপদ প্রদেশগুলোতে ব্যাপকভাবে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো হয়। কমিউনিস্ট শাসনে মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে উজবেকিস্তানের শিক্ষাক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি ঘটে। ১৯৭৪ সালে উজবেকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল প্রায় ৯৯%। সোভিয়েত ইউনিয়ন শিক্ষাক্ষেত্রে প্রচুর বিনিয়োগ করেছিল। শিক্ষার ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নে জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা লিঙ্গভেদে কোনো বৈষম্য করা হতো না। উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষ ছেড়ে যায় তখন ভারতবর্ষের জনসাধারণের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১২%।
https://www.jstor.org/stable/2494934
অন্যদিকে ১৯৯১ সালে সোভিয়েতরা যখন উজবেকিস্তান ছেড়ে যায়, তখন উজবেকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল প্রায় ৯৯%। সোভিয়েত শাসনামলে উজবেকিস্তানের প্রথম বিশ্বকোষ প্রণীত হয়। এটি ছিল উজবেক ভাষায় রচিত প্রথম বিশ্বকোষ। উজবেকিস্তানের জনসাধারণের মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এটি ছিল বিশাল অগ্রগতি। 'উজবেক সোভিয়েত বিশ্বকোষ' নামক বিশ্বকোষটি ১৪টি খণ্ডে উজবেক ভাষার সিরিলিক লিপিতে রচিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে তাসখন্দে উজবেকিস্তান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের বিজ্ঞান আকাদেমি'র উদ্যোগে বিশ্বকোষটি প্রণয়নের কাজ আরম্ভ হয়। 'উজবেক সোভিয়েত বিশ্বকোষ প্রকাশনা সংস্থা' বিশ্বকোষটির প্রকাশনার কাজে নিযুক্ত ছিল। ১৯৭১-১৯৮০ সালের মধ্যে বিশ্বকোষটি প্রণয়নের কাজ সমাপ্ত হয়। প্রখ্যাত উজবেক পণ্ডিতরা বিশ্বকোষটির সম্পাদনায় অংশ নিয়েছিলেন। বিশ্বকোষটির প্রথম ৯টি খণ্ডের প্রধান সম্পাদক ছিলেন উজবেক সোভিয়েত বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্য ডক্টর ইব্রাহিম মুমিনভ এবং পরবর্তী ৫টি খণ্ডের প্রধান সম্পাদক ছিলেন উজবেক সোভিয়েত বিজ্ঞান আকাদেমির আরেক সদস্য ডক্টর কামিলজান জুফারভ। প্রায় ১,০০০ উজবেক পণ্ডিত বিশ্বকোষটির সম্পাদনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। জ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাখা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এখনো উজবেকিস্তানে গবেষণামূলক কাজে বিশ্বকোষটিকে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিশেষত সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি এবং ফলিত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্বকোষটি এখনো প্রাসঙ্গিক। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং উজবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে বিশ্বকোষটিতে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। উজবেকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ উজবেক জাতির জীবনধারার প্রতিটি ক্ষেত্র সম্পর্কে বিশ্বকোষটিতে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছে। উজবেক জাতির ইতিহাসে প্রখ্যাত রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও অন্যান্য ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বিশ্বকোষটিতে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে, যা বিশ্বের অন্য কোনো বিশ্বকোষে পাওয়া যাবে না। উজবেকিস্তানে ইসলাম ধর্মের বিস্তার এবং সুফি মতবাদ সম্পর্কে বিশ্বকোষটিতে প্রচুর তথ্য রয়েছে। খাজা আহমেদ ইয়াসাভি সহ অন্যান্য উজবেক সুফি দার্শনিকদের সম্পর্কে বিশ্বকোষটিতে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞানের যেসব শাখা সম্পর্কে বিশ্বকোষটিতে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, অর্থনীতি, শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ইতিহাস, আইন, দর্শন, সাহিত্য, লোককথা এবং অভিধান সংকলন। নবম শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত উজবেকিস্তানের সমরখন্দ, বুখারা এবং খরজেম নগরী জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম কেন্দ্র ছিল এবং মুসা আল খাওয়ারিজমী, আল বিরুনী, ইবনে সিনা ও উলুঘ বেগের মতো পণ্ডিতরা উজবেকিস্তানের মাটিতে জন্ম নিয়েছিলেন। উজবেকিস্তানে মাদ্রাসা, মিনার ও মাজারসমূহ, মধ্যযুগীয় পাণ্ডুলিপিগুলোর সংস্করণ, ইসলামি শাসনামলের প্রখ্যাত ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি, উজবেক প্রজাতন্ত্রের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে সমসাময়িক চিত্রকর্ম, উজবেক থিয়েটার ও নৃত্যকলা, সামাজিক, গোত্রীয় ও ধর্মগত স্বাতন্ত্র, পশুপাখি এবং উজবেক পোশাক, গহনাদি ও অন্যান্য কারুশিল্পের বিস্তৃত চিত্র বিশ্বকোষটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্তালিনের সময়ে শাস্তিপ্রাপ্ত বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের সম্পর্কেও বিশ্বকোষটিতে উল্লেখ আছে। উজবেক লেখক আব্দুরউফ ফিতরাত এবং আব্দুলহামিদ চোল্পান এর সমালোচনা করা হয়েছে বিশ্বকোষটিতে। আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির ক্ষেত্রে উজবেক সোভিয়েত বিশ্বকোষে উজবেক প্রজাতন্ত্রের আঞ্চলিক অবস্থানকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। বিশ্বকোষটির কিছু কিছু ভুক্তি (বিশেষত বিজ্ঞান সম্পর্কিত) রুশ ভাষায় রচিত 'সোভিয়েত মহাবিশ্বকোষ' থেকে অনুবাদ করা হয়েছিল। ১৯৮০ এর দশকের শেষদিকে উজবেক সোভিয়েত বিশ্বকোষকে রুশ ভাষায় অনুবাদ করার প্রকল্প নেয়া হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল উজবেক জাতি এবং উজবেকিস্তান সম্পর্কে সাধারণ রুশ ও অন্যান্য সোভিয়েত জাতির জ্ঞান বৃদ্ধি করা। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের ফলে প্রকল্পটি আর বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৮১ সালে উজবেক সোভিয়েত বিশ্বকোষের মূল বিষয়াবলিকে সংক্ষিপ্ত রূপে 'উজবেক সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' শিরোনামে একটি খণ্ডে প্রকাশ করা হয়। এটিও উজবেক ভাষায় লিখিত হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে খণ্ডটিকে রুশ ভাষায় অনুবাদ করা হয়। উজবেকিস্তানে সোভিয়েত শাসনের অবসানের পর উজবেকিস্তান সরকারের উদ্যোগে 'উজবেকিস্তান জাতীয় বিশ্বকোষ' নামে নতুন বিশ্বকোষ প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু নতুন বিশ্বকোষটি উজবেক সোভিয়েত বিশ্বকোষের তুলনায় ক্ষুদ্রতর এবং এটির বেশিরভাগ তথ্য উজবেক সোভিয়েত বিশ্বকোষ থেকে নেয়া। অধিকাংশ উজবেক পণ্ডিত ও গবেষক এখনো পুরাতন উজবেক সোভিয়েত বিশ্বকোষকে গবেষণামূলক কাজে ব্যবহার করে থাকেন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে রাষ্ট্র হিসেবে বজায় রাখা উচিত কিনা সে সম্পর্কে যে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে উজবেকিস্তানের প্রায় ৯৪% জনসাধারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছিল।
Comments