নাৎসী ভূমিতে এক টুকরো বিপ্লব
১৯৪৯ সালে পশ্চিম জার্মানির ক্ষমতায় আসেন কনরাড আডেনাওয়ার।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Konrad_Adenauer
তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে জার্মান যুদ্ধবন্দীদের দেশে ফেরত নিয়ে আসা বা অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু তার সরকার আর প্রশাসনের নানা পর্যায়ে নাৎসি পার্টির সমর্থক বা প্রাক্তন সদস্যদের নিয়োগ দেয়ায় জার্মান তরুণ সমাজ দারুণ ক্ষুব্ধ হয়। জার্মান মিডিয়াও তখন সরকারের কড়াকড়ির মধ্যে চলতো।
https://www.ft.com/content/3b5abe60-8efc-11e6-a72e-b428cb934b78
জার্মানির তরুণরা আন্তোনিও গ্রামসি, চে গুয়েভারা, রেজিস দেব্রে, মাও সে তুং কিংবা কার্লোস মারিঘেলার মতো গেরিলা যোদ্ধাদের কর্মকান্ড আর লেখনী পড়ে দারুণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো নিজেদের রক্ষণশীল সরকারের প্রতি।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Carlos_Marighella
ন্যাটো আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরশীলতা এবং ভিয়েতনামসহ অসংখ্য ফ্রন্টে পশ্চিমা সেনাদের উপস্থিতিতে এসব তাদের ঘোরতর আপত্তি ছিল। ষাটের দশকটা জুড়ে জার্মান শিক্ষার্থীরা সরকারকে বিক্ষোভ আর আন্দোলনে অতিষ্ঠ করে রেখেছিল। ১৯৬৭ সালে ইরানের শাহ জার্মানি সফরে এলে আন্দোলনকারী, শাহ সমর্থক এবং সরকার সমর্থকদের মধ্যে বিরাট দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়। বেনো ওনেহসোর্গ নামে এক তরুণ গুলি খেয়ে মারা গেলে গোটা জার্মানি উত্তাল হয়ে ওঠে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Shooting_of_Benno_Ohnesorg
গুডরুন এনস্লিন আর আন্দ্রিয়াস বাদের নামের দুই তরুণ-তরুণী এসবের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে একটি শপিং মলে ছোটখাট বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Gudrun_Ensslin
জার্মান পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে, তবে দলটা প্যারোলে মুক্তি পেয়ে পালিয়ে ফ্রান্সে চলে যায়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Andreas_Baader
এখানে রেজিস দেব্রের সাথে তাদের পরিচয় হয়। দেব্রে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের সাথে সাথে গেরিলা যুদ্ধের পাঠ দিলেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/R%C3%A9gis_Debray
দেব্রে বলিভিয়াতে চে গুয়াভারাকে সমর্থন করতে গিয়ে কারাবরণ করেছিলেন। ১৯৭০ সালে আন্দ্রিয়াস বাদেরের নেতৃত্বে রেড আর্মি ফ্যাকশন গঠিত হয়। কিছুদিনের মধ্যে বাদেরকে জার্মান পুলিশ গ্রেফতার করে। রেড আর্মি ফ্যাকশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য গুডরুন এন্সলিন তখন উলরিকে মেইনহফের সাথে দেখা করেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ulrike_Meinhof
বামপন্থী পত্রিকা কংক্রিটের একজন লেখিকা এবং তাত্ত্বিক হিসেবে তিনি বেশ সমাদৃত ছিলেন। উলরিকের সহযোগিতায় রেড আর্মি ফ্যাকশন বাদেরকে উদ্ধার করে। ডামাডোলের মধ্যে এক লাইব্রেরিয়ান গুলি খেলে উলরিকে তখন আন্দ্রিয়াস বাদেরের দলের সাথে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান যান। জার্মান মিডিয়া গ্রপটিকে বাদের-মেইনহফ গ্যাং নামে পরিচিতি দিয়েছিল। ১৯৭০-১৯৭২ সালের মধ্যে বাদের-মেইনহফ গ্যাং বেশ কিছু সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল ইয়ট ক্লাব, রক্ষণশীল মিডিয়া হাউজ এবং জার্মানিতে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলো।জার্মান পুলিশ উঠেপড়ে লাগে এই গেরিলাদের পাকড়াও করার জন্য। গ্রুপটির শুরুর দিককার সদস্যরা জর্ডানে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের ক্যাম্পে সামরিক ট্রেনিং নিয়েছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Palestine_Liberation_Organization
১৯৭২ সাল নাগাদ গুডরুন এনস্লিন, আন্দ্রিয়াস বাদের আর উলরিকে মেইনহফ সহ বেশ কয়েকজন সদস্য ধরা পড়ে। তাদের কড়া পাহারায় ১৯৭৫ সাল নাগাদ স্টেইমহাম কারাগারে পাঠানো হয়। ঐ বছর পশ্চিম বার্লিনের মেয়র প্রার্থী পিটার লরেঞ্জকে অপহরণ করা হয়। বন্দী বিনিময়ের মাধ্যমে পিটার মুক্তি পান।
https://m.dw.com/en/68-movement-brought-lasting-changes-to-german-society/a-3257581
সুইডেনের স্টকহোমে একদল গেরিলা জার্মান দূতাবাস কব্জা করে নেন। জার্মান সরকার দূতাবাসে অভিযান চালিয়ে দখল করে নেয়। আন্দ্রিয়াস বাদেরসহ বাকিদের বিচার কাজ আরম্ভ হয়ে যায়। অভিযুক্তরা যেসব আইনজীবীর সাহায্য চাইলেন তাদের আদালতে ঢুকতে তো দেয়া হলোই না, উল্টো তল্লাশী আর জেরায় তাদের অপদস্থ করা হলো। বন্দী গেরিলারা নিজেদের পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী এবং ভিয়েতনামের পক্ষের শক্তি হিসেবে আদালতে বারবার ঘোষণা জানাতে থাকেন।
https://www.headstuff.org/culture/history/blood-leaves-baader-meinhof-death-night/
জার্মানির প্রধান ব্যাংক ড্রেসড্রেন কর্পোরেশনের প্রধান ইয়ুর্গেন পন্টোকে ১৯৭৭ সালে রেড আর্মি ফ্যাকশন গুলি করে হত্যা করে। কিছুদিন পর জার্মানির প্রধান শিল্পপতিদের একজন হানস মার্টন শ্লেয়ারের গাড়িবহরে আক্রমণ করে হামলা করে গেরিলারা। বেশ কয়েকজনকে খুন করে হানস মার্টেনকে অপহরণ করা হয়। এরপরও বিচার চলতে থাকে।
https://special-ops.org/hijacking-of-lufthansa-737-airplane/
পপুলার ফ্রন্ট অব লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের আরব গেরিলাদের সাথে রেড আর্মি ফ্যাকশনের যোগাযোগ ছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Popular_Front_for_the_Liberation_of_Palestine
তারা একটি জার্মান বিমান অপরহরণ করে এবং আরব ও জার্মান বন্দীদের মুক্তির দাবি জানায়। জার্মান কমান্ডোরা বিমানটিতে হামলা চালিয়ে ৮৬ যাত্রীকেই উদ্ধার করে নিয়ে আসে। কেবল একজন পাইলটকে আরবরা হত্যা করে। এর কিছুদিন পর ফ্রান্সে অপহৃত শিল্পপতিকে গেরিলারা গুলি করে হত্যা করে লাশ ফেলে যায়। আন্দ্রিয়ার বাদেরদের যিনি বিচার করছিলেন, সেই বিচারপতি সিগফ্রিড বুবাককে গেরিলারা গুলি করে হত্যা করে। উলরিকে মেইনহফকে তার সেলে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। ডাক্তার একে আত্মহত্যা বলে সাব্যস্ত করেন। যেদিন জার্মান কমান্ডোরা অপহৃত বিমানটি উদ্ধার করে, সেদিন রাতে আন্দ্রিয়াস বাদের আর কার্ল রাস্পকে গুলিবিদ্ধ ও মৃত অবস্থায় তাদের সেলে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Jan-Carl_Raspe
রেড আর্মি ফ্যাকশনের তাত্ত্বিক নেতা গুডরুন এনস্লিনকে পাওয়া যায় ঝুলন্ত ও মৃত অবস্থায়। মোলারকে চারবার ছুরিবিদ্ধ হলেও বেঁচে যান। জার্মান সরকার ঘোষণা দেয় বন্দীরা সবাই আত্মহত্যা করেছে, কারণ বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা আর কোনো মুক্তির আশা দেখতে পারছিল না! পরবর্তীকালের তদন্তে এই সরকারী বক্তব্যের সব ছিদ্র আবিষ্কৃত হয়। বাদেরকে যে অবস্থায় আবিষ্কার করা হয়, সেভাবে আত্মহত্যা করা প্রায় অসম্ভব। তার মাথার বেশ কিছুটা পেছন থেকে গুলি করা হয়েছিল। গেরিলারা যেসব বন্দুক বা ছুরি ব্যবহার করেছিলেন, সেগুলোতে কোনো আঙুলের ছাপ ছিল না। মোলার জোর গলায় ঘোষণা করেন যে, তার সঙ্গীদের হত্যা করা হয়েছে।
জার্মান সরকার নিজেদের বক্তব্যে অটল থাকে। যদিও কিভাবে পরস্পরের সাথে কোনো যোগাযোগ করা ছাড়া চারজন বন্দী আত্মহত্যায় রাজি হলো বা কারাগারে আগ্নেয়াস্ত্র কে বন্দীদের হাতে তুলে দিলো তা নিয়ে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। সত্তরের দশক থেকেই পূর্ব জার্মানির গোয়েন্দা সংস্থা স্তাসি রেড আর্মি ফ্যাকশনকে নানাভাবে প্রশিক্ষণ আর সাহায্য দিতো।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Stasi
পুঁজিবাদী জোঁকদের নির্মমতার স্বীকার হওয়া এসব গেরিলাদের মৃত্যুর কারণে ১৯৯৮ সালে গ্রুপটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

Comments