মারিয়া ভাসিলয়েভনা
১৯০৫ সালের ১৬ আগস্ট ক্রিমিয়ার এক কৃষক পরিবারে জন্ম নেয় মারিয়া ভাসিল্য়েভ্না অক্টিয়াব্রিস্কায়া। দশ ভাই-বোন আর বাবা-মাকে নিয়ে গড়া সংসারের চাহিদা মেটাতে প্রথমে এক ফ্যাক্টরিতে ক্যানের ভেতর খাদ্য সংরক্ষণের চাকরি নেয় মারিয়া। তারপর এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে বেছে নেয় টেলিফোন অপারেটরের চাকরি। ২০ বছর বয়সে ১৯২৫ সালে লাল ফৌজের এক অফিসারের সাথে বিয়ে হয় মারিয়ার। এরপর থেকে সামরিক নানা ব্যাপারে আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে মারিয়ার মনে। কিছুদিন পর তিনি যোগদান করেন সামরিক বাহিনীর সদস্যদের স্ত্রীদের নিয়ে গঠিত কাউন্সিলে। এরপর তিনি সামরিক বাহিনীর নার্সের ট্রেনিং সেরে ফেলেন। কিছুদিন পর শিখে নেন বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র ও সাঁজোয়া যান চালানোর কৌশল। ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪১ সালের ২২ জুন থেকে শুরু হয় ‘দ্য গ্রেট প্যাট্রিয়টিক ওয়্যার’।
https://en.wikipedia.org/wiki/Great_Patriotic_War_(term)
২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় মারা যাওয়া প্রায় ৭ কোটি মানুষের মাঝে ৩ কোটির মতো মারা গিয়েছিলো শুধু এই ইস্টার্ন ফ্রন্টে! ‘দ্য গ্রেট প্যাট্রিয়টিক ওয়্যার’ শুরু হলে মারিয়াকে সরিয়ে নেয়া হয় টম্স্ক শহরে। সেখানে থাকাকালে মারিয়া জানতে পারেন কিয়েভের যুদ্ধে মারা গেছে তার স্বামী। মারিয়ার স্বামী আসলে মারা গিয়েছিলেন ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে। যুদ্ধের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় খবরটি তার কাছে এসে পৌঁছায় ১৯৪৩ সালে। মারিয়া সরাসরি চিঠি লিখলেন স্তালিনের কাছে-
“মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছেন আমার স্বামী। স্বামীর মৃত্যুর জন্য এবং সোভিয়েত জনগণের মৃত্যুর জন্য আমি এসব ফ্যাসিস্ট বর্বরগুলোর উপর প্রতিশোধ নিতে চাই। এজন্য আমি আমার কাছে থাকা সকল অর্থ ৫০,০০০ রুবল ন্যাশনাল ব্যাংকে জমা রেখেছি যাতে করে একটি ট্যাঙ্ক বানানো যায়। আমি অনুরোধ করছি যেন এ ট্যাঙ্কটির নাম রাখা হয় ‘ফাইটিং গার্লফ্রেন্ড’ এবং ফ্রন্ট লাইনে এ ট্যাঙ্কের ড্রাইভার হিসেবে আমাকে পাঠানো হয়।”
স্টেট ডিফেন্স কমিটি মারিয়ার আবেদন অনুমোদন করে মারিয়ার জন্য একটি টি-৩৪ মডেলের ট্যাঙ্ক দেয়। সাড়ে ছাব্বিশ টন ওজনের এই ট্যাঙ্কের দৈর্ঘ্য ছিলো ৬.৬৮ মিটার, প্রস্থ ৩ মিটার এবং উচ্চতা ২.৪৫ মিটার।
https://en.wikipedia.org/wiki/T-34
এরপর প্রায় ৫ মাসব্যাপী এক ট্রেনিংয়ে অংশ নেন মারিয়া। ট্রেনিং শেষে ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে ২৬তম গার্ডস ট্যাঙ্ক ব্রিগেডে ট্যাঙ্ক ড্রাইভার ও মেকানিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ‘ফাইটিং গার্লফ্রেন্ড’ নামটি নিজের ট্যাঙ্কে লিখে নিয়েছিলেন তিনি। মারিয়ার প্রথম যুদ্ধটি ছিলো ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর, স্মলেন্স্ক শহরে। শত্রূপক্ষের তুমুল গোলাবর্ষণ অগ্রাহ্য করে সেদিন এগিয়ে যাচ্ছিলো মারিয়ার ট্যাঙ্ক। মেশিনগান এবং অন্যান্য আর্টিলারি গানের জায়গাগুলো ধ্বংস করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি এবং তার ক্রূরা। যদি কোনো গোলার আঘাতে ট্যাঙ্কের ক্ষতি হতো, তাহলে ট্যাঙ্ক থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে যেতেন তিনি। প্রবল গোলাবর্ষণের মাঝে মারিয়ার মেরামতের পর আবার এগিয়ে যেতো ফাইটিং গার্লফ্রেন্ড। যুদ্ধে সাহসিকতা প্রদর্শনের স্বীকৃতিস্বরুপ তাকে লাল ফৌজের সার্জেন্ট পদে উন্নীত করা হয়। এক মাস পর ১৭-১৮ নভেম্বরের দিকে লাল ফৌজ বেলারুশের ভিতেব্স্ক শহরের নভোইয়ে সেলো এলাকাটি নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। ১৭ তারিখে নভোইয়ে সেলোর কাছাকাছি জার্মান ঘাঁটিগুলোতে গোলাবর্ষণ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলো ফাইটিং গার্লফ্রেন্ড। হঠাৎ শত্রূপক্ষের এক গোলার আঘাতে সমস্যা দেখা দেয় ট্যাঙ্কের ট্র্যাকে। বাহিরে চলতে থাকা তুমুল গোলাগুলি অগ্রাহ্য করে এক ক্রূকে নিয়ে ট্যাঙ্ক থেকে নেমে পড়েন মারিয়া। ট্যাঙ্ক মেরামত শেষ হলে কিছুদিন পর তারা মূল টিমের সাথে যোগ দেন। ১৯৪৪ সালের ১৭ জানুয়ারির রাতে আরেকটি যুদ্ধে অংশ নেন মারিয়া। এবারের যুদ্ধটি ছিলো ভিতেব্স্কের কাছাকাছি শ্ভেদী গ্রামে। এ যুদ্ধে তার ফাইটিং গার্লফ্রেন্ডের সামনে জার্মান প্রতিরক্ষা তছনছ হয়ে যাচ্ছিলো। বিভিন্ন ট্রেঞ্চে শত্রূসেনাদের প্রতিরোধ ভেঙে দিয়ে, মেশিনগানারদের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে এগোচ্ছিলেন মারিয়া। কিছুক্ষণ পর এক অ্যান্টি-ট্যাংক মাইনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফাইটিং গার্লফ্রেন্ডের ট্র্যাক। সেদিনও তুমুল গোলাবর্ষণের মাঝে ট্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এসে মারিয়া লেগে যান ট্র্যাক ঠিক করার কাজে। ট্র্যাক ঠিক করতে পারার পরমুহূর্তেই তার খুব কাছে একটি আর্টিলারি শেল বিষ্ফোরিত হয়।
https://en.wikipedia.org/wiki/Anti-tank_mine
এর ছোট ছোট অংশগুলো সরাসরি এসে তার মাথায় আঘাত হানে। সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যান তিনি।
https://en.wikipedia.org/wiki/Shell_(projectile)
মারিয়াকে কিয়েভের কাছাকাছি ফ্যাস্তভে লাল ফৌজের এক মিলিটারি ফিল্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রায় দু’মাস কোমায় থাকার পর ১৫ মার্চ মারা যান মারিয়া। ভিতেব্স্কের যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শনের স্বীকৃতি স্বরূপ আগস্ট মাসে তাকে ‘হিরো অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
https://en.wikipedia.org/wiki/Hero_of_the_Soviet_Union
Comments