সোভিয়েত আর্মেনিয়া

 


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত আর্মেনীয় ভূখণ্ড রুশ ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যদ্বয়ের মধ্যে বিভক্ত ছিল। রুশ সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল পূর্ব আর্মেনিয়া এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল পশ্চিম আর্মেনিয়া। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্যান্য জাতির মতো আর্মেনীয়দের মধ্যেও জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটে এবং সৃষ্টি হয় 'আর্মেনীয় বিপ্লবী ফেডারেশন'।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Armenian_Revolutionary_Federation

ওসমানীয়রা ১৮৯৪-১৮৯৬ সালের মধ্যে প্রায় ৫০,০০০ আর্মেনীয়কে হত্যা করে। ১৯০৯ সালের আদানা গণহত্যায় প্রায় ৩০,০০০ আর্মেনীয় নিহত হয়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Adana_massacre

ওসমানীয় সাম্রাজ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর ওসমানীয় আর্মেনীয়দের একাংশ রুশদের সহযোগিতা করে। ১৯১৫ সালে সারিকামিশের যুদ্ধে রুশদের নিকট ওসমানীয়রা পরাজিত হয়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Battle_of_Sarikamish

ওসমানীয় সরকার এই পরাজয়ের জন্য আর্মেনীয়দের 'বিশ্বাসঘাতকতা'কে দায়ী করে। ১৯১৫-১৯১৭ সালের মধ্যে পরিচালিত আর্মেনীয় গণহত্যায় ৮-১৫ লক্ষ আর্মেনীয় প্রাণ হারায়। ১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে রুশ সৈন্যরা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ভূখণ্ড থেকে পশ্চাৎপসরণ করলে আর্মেনীয় 'স্বেচ্ছাসেবক' ইউনিটগুলোর ওপর ওসমানীয়দের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। আর্মেনীয় সৈন্য ও জনসাধারণ ওসমানীয় ভূখণ্ড থেকে ক্রমশ পিছু হটতে থাকে এবং পথিমধ্যে অবস্থিত তুর্কি গ্রামগুলো ধ্বংস করে দেয়। ১৯১৮ সালের ২৮ মে পূর্ব আর্মেনিয়ায় 'আর্মেনিয়া প্রজাতন্ত্র' নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় এবং দাশনাকরা রাষ্ট্রটির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ওসমানীয় সৈন্যরা প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের ট্রান্সককেশাস অঞ্চল আক্রমণ করে অঞ্চলটির অধিকাংশ ভূমি দখল করে নেয় নিলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর তারা সৈন্য প্রত্যাহার করে ১৯১৪ সালের পূর্ববর্তী সীমারেখায় ফিরে যায়। মিত্রশক্তি ওসমানীয় আর্মেনিয়ার বৃহৎ একটি অংশ আর্মেনীয় রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করলেও এটি কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এসময় আর্মেনিয়া ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে আজারবাইজানের সঙ্গে প্রলম্বিত যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং জর্জিয়ার সঙ্গেও তাদের সংঘর্ষ দেখা দেয়। ১৯২০ সালের শুরুতে আর্মেনিয়ার আয়তন ছিল প্রায় ৬০,০০০ বর্গ কি.মি.। ১৯২০ সালের এপ্রিলে সোভিয়েত রাশিয়া আজারবাইজানি বলশেভিকদের সহায়তায় জাতীয়তাবাদী মুসাভাৎ দলীয় সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে আজারবাইজানকে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে পরিণত করে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Musavat

এর ফলে আজারবাইজানের সঙ্গে আর্মেনিয়ার যুদ্ধ বন্ধ হয়, অন্যদিকে তুর্কি স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত 'গ্র‍্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সরকার' এর সঙ্গে আর্মেনিয়ার সংঘর্ষ শুরু হয়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Government_of_the_Grand_National_Assembly

১৯২০ সালের জুন থেকে তুরস্ক ও আর্মেনিয়ার মধ্যে বিক্ষিপ্ত সীমান্ত সংঘর্ষ চলছিল এবং সেপ্টেম্বরে এটি পূর্ণ যুদ্ধের রূপ ধারণ করে। তুর্কি-আর্মেনীয় যুদ্ধে জেনারেল কাজিম কারাবেকিরের নেতৃত্বাধীন তুর্কি বাহিনীর নিকট আর্মেনীয় বাহিনী পর্যুদস্ত হয়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/K%C3%A2z%C4%B1m_Karabekir

এই যুদ্ধের সময় তুর্কি সৈন্যরা ২,৫০,০০০ বেসামরিক আর্মেনীয় হত্যা করে। তুর্কি-আর্মেনীয় যুদ্ধ চলাকালে ১৯২০ সালের নভেম্বরে আর্মেনিয়ার অভ্যন্তরে আর্মেনীয় বলশেভিকরা দাশনাক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং ২৯ নভেম্বর সোভিয়েত রুশ ও সোভিয়েত আজারবাইজানি সৈন্যরা আর্মেনিয়া আক্রমণ করে। ২ ডিসেম্বর ইয়েরেভান বলশেভিকদের হস্তগত হয় এবং দাশনাকরা আর্মেনীয় বলশেভিকদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। একই দিনে 'আর্মেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' প্রতিষ্ঠিত হয়। ৩ ডিসেম্বর দাশনাকরা তুরস্কের সঙ্গে আলেক্সান্দ্রোপোল চুক্তিতে স্বাক্ষর করে কার্স ও সুরমালি অঞ্চল তুর্কিদের কাছে হস্তান্তর করে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Treaty_of_Alexandropol

দাশনাকরা আগের দিন পদত্যাগ করায় এই চুক্তি করার বৈধ ক্ষমতা তাদের ছিল না। কিন্তু চুক্তির মাধ্যমে সমর্পিত অঞ্চল ইতিমধ্যে তুর্কিরা দখল করে নিয়েছিল। এভাবে আর্মেনিয়ার অর্ধেকের বেশি ভূখণ্ড তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং আর্মেনিয়ার অবশিষ্টাংশে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জর্জীয় বলশেভিকরা জর্জীয় মেনশেভিক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং সোভিয়েত রুশ, সোভিয়েত আজারবাইজানি ও সোভিয়েত আর্মেনীয় সৈন্যরা জর্জিয়া আক্রমণ করে। জর্জিয়া নিয়ে বলশেভিকদের ব্যস্ততার সুযোগে একই সময়ে সিমন ভ্রাৎসিয়ানের নেতৃত্বে দাশনাকরা আর্মেনিয়ায় বলশেভিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Simon_Vratsian

১৮ ফেব্রুয়ারি দাশনাকরা আর্মেনীয় বলশেভিকদের কাছ থেকে ইয়েরেভান দখল করে নেয়। জর্জীয় মেনশেভিকদের বিপর্যয়ের সুযোগে ২৩ ফেব্রুয়ারি তুর্কিরা জর্জিয়া আক্রমণ করে আর্তভিন ও আরদাহান অঞ্চল দখল করে বাতুমি শহরের উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়। জর্জীয় মেনশেভিকদের সঙ্গে মৌখিক সমঝোতা অনুযায়ী তুর্কি সৈন্যরা বাতুমিতে প্রবেশ করে, কিন্তু শহরটির বেসামরিক কর্তৃত্ব জর্জীয় মেনশেভিকদের হাতে ন্যস্ত থাকে। তুর্কিদের উদ্দেশ্য ছিল বাতুমি অঞ্চল দখল করে তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত করা। বলশেভিকরা তুর্কি অধিকৃত বাতুমির দিকে অগ্রসর হলে তুর্কি-বলশেভিক যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে তুর্কিরা ক্লাসিক রিয়েলপলিটিক
পদ্ধতি অনুসরণ করে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Realpolitik

তারা আর্মেনিয়ায় বিদ্রোহী দাশনাকদের সহায়তা প্রদান করতে শুরু করে! সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা চেকা'র সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, এসময় তুর্কিরা দাশনাকদের অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র সরবরাহ করে এবং গোয়েন্দা সংক্রান্ত সহায়তা প্রদান করে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Cheka

দাশনাকরা ২৭ ফেব্রুয়ারি-১ মার্চের মধ্যে আর্মেনীয় বলশভিকদের ইয়েরেভান পুনর্দখলের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। দাশনাকদের সহায়তা করার পশ্চাতে তুর্কিদের উদ্দেশ্য ছিল আর্মেনিয়ায় চলমান বলশেভিকবিরোধী বিদ্রোহকে আরো তীব্র করে তোলা। এর ফলে বলশেভিকরা বাধ্য হয়ে জর্জিয়া থেকে আর্মেনিয়ার দিকে মনোনিবেশ করতো এবং জর্জিয়া থেকে আর্মেনিয়ায় সৈন্য প্রেরণ করতো। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তুর্কিরা বাতুমি বন্দরকে স্থায়ীভাবে তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারতো। বাতুমিতে তুর্কিদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে সরাসরি যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনোভাবে সেটির নিয়ন্ত্রণ নেয়া সম্ভব হবে না এবং সেসময় যেহেতু সোভিয়েত রাশিয়া তুরস্কের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে ইচ্ছুক ছিল, সেহেতু তারা তুর্কিদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করতো না। দাশনাকদের সহায়তা প্রদানের পশ্চাতে তুর্কিদের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল। তুর্কিদের হিসেব অনুযায়ী দাশনাকরা বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হারুক অথবা জিতুক, উভয় ক্ষেত্রেই তুরস্ক লাভবান হতো। যদি দাশনাকরা বলশেভিকদের পরাজিত করতে সক্ষম হতো, সেক্ষেত্রে আর্মেনিয়ায় পুনরায় দাশনাকরা ক্ষমতা লাভ করতো। তাদের একদিকে থাকতো শত্রুভাবাপন্ন বলশেভিকরা, অন্যদিকে থাকতো তুরস্ক। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দাশনাকরা বাধ্য হয়ে তুর্কিদের আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য হতো এবং সেক্ষেত্রে দাশনাক নিয়ন্ত্রিত আর্মেনিয়া তুর্কি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হতো। দাশনাকদের তুর্কি কর্তৃত্ব স্বীকার করতে না চাওয়ার সম্ভাবনাই ছিল বেশি। তারা ক্ষমতায় ফিরে এলে তুরস্কের কাছে ১৯২০ সালে হারানো ভূখণ্ড ফিরে পাওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে পারতো। এক্ষেত্রেও তুরস্ক সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল, দাশনাক নিয়ন্ত্রিত আর্মেনিয়া যদি তুরস্কের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন আচরণ করতো, সেক্ষেত্রে আর্মেনিয়াকে সহজে তুর্কিরা দখল করে নিতে পারতো। তুর্কিরা ভেবেছিলো যদি বলশেভিকরা দাশনাকদের পরাজিত করতে সক্ষম হতো, সেক্ষেত্রে বিদ্রোহের শাস্তিস্বরূপ বলশেভিকরা দাশনাকদের ধ্বংস করে দিতো। এর ফলে আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদ দুর্বল হয়ে পড়তো এবং তুরস্কের প্রতি আর্মেনীয় হুমকি দূরীভূত হতো, কারণ আর্মেনীয় ও রুশ বলশেভিকরা তুরস্কের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিল। বলশেভিকরা তুর্কিদের পরিকল্পনা ভালোভাবেই আন্দাজ করতে পেরেছিল। এসময় তারা তুর্কিদের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলো এবং ১৬ মার্চ স্বাক্ষরিত মস্কো চুক্তি অনুযায়ী তুর্কিরা বাতুমির ওপর তাদের দাবি ছেড়ে দিতে সম্মত হয়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Treaty_of_Moscow_(1921)

তা সত্ত্বেও তুর্কি সৈন্যরা বাতুমি ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এমতাবস্থায় তুর্কিদের সঙ্গে যেন তাদের সরাসরি যুদ্ধ করতে না হয়, সেজন্য বলশেভিকরা জর্জীয় মেনশেভিকদের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছায়। ১৮ মার্চ জর্জীয় মেনশেভিক সৈন্যরা বাতুমি শহরে অবস্থানরত তুর্কি সৈন্যদের আক্রমণ করে এবং প্রচণ্ড যুদ্ধের পর ১৯ মার্চ তুর্কি সৈন্যরা শহরটি থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। ১৯২১ সালের ২৪ মার্চ নাগাদ বলশেভিকরা আর্মেনিয়ায় অভিযান চালায় এবং ২ এপ্রিলের মধ্যে ইয়েরেভানসহ আর্মেনিয়ার অধিকাংশ ভূখণ্ড থেকে দাশনাকদের বিতাড়িত করে। দাশনাকরা জাঙ্গেজুর অঞ্চলে পশ্চাৎপসরণ করে এবং ২৬ এপ্রিল সেখানে 'পার্বত্য আর্মেনিয়া প্রজাতন্ত্র' নামক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Republic_of_Mountainous_Armenia

১৩ জুলাই বলশেভিকরা জাঙ্গেজুর দখল করে দাশনাক নিয়ন্ত্রিত প্রোটো-আর্মেনীয় রাষ্ট্রটির বিলুপ্তি ঘটায়। জাঙ্গেজুরে বলশেভিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দাশনাক নেতারা ইরানে পালিয়ে যায়। ১৯২১ সালের অক্টোবরে স্বাক্ষরিত কার্স চুক্তির মধ্যে দিয়ে তুরস্ক ও সোভিয়েত আর্মেনিয়ার মধ্যবর্তী সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ ঘটে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Treaty_of_Kars


Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]