ইরানকে যারা ভরসার প্রতীক মনে করে
রিপাবলিকান প্রার্থী রোনাল্ড রিগ্যানের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল যেকোনো মূল্যে তিনি কমিউনিজম প্রতিহত করবেন। রিগ্যানের শাসনামলে সিআইএ'র সহযোগীতায় সারা বিশ্বে কমিউনিস্ট বিরোধী গেরিলাদের প্রকাশ্যে ও গোপনে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়া হতো।
https://www.brown.edu/Research/Understanding_the_Iran_Contra_Affair/iran-contra-affairs.php
নিকারাগুয়ায় ১৯৭৯ সালে কিউবার সহায়তায় কমিউনিস্টপন্থী 'স্যান্ডানিস্টাস' দলটি ক্ষমতা দখল করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Nicaraguan_Revolution
স্যান্ডানিস্টাসদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল ডানপন্থী গেরিলা সংগঠন ‘কন্ট্রা’। রিগ্যান কন্ট্রা গেরিলাদের মার্কিন জাতির পিতাদের সাথে তুলনা করে অভিহিত করেন ‘Moral equivalent of our founding fathers’ এবং যেকোনো মূল্যে এদের সহায়তা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
https://www.c-span.org/video/?c4565114/user-clip-moral-equivalent-founding-fathers
এরা মধ্য আমেরিকার কোকেন বাণিজ্যের সাথে যুক্ত ছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Contras
এই তথ্য যখন সামনে এলো তখন এরকম একটা গেরিলা দল যারা মাদক চোরাকারবারের সাথে যুক্ত, তাদের সামরিক সহায়তা দেয়ার কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকে না। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ‘বোল্যান্ড অ্যামেন্ডমেন্ট’ নামক আইন পাস করে, যার মূল বক্তব্য ছিলো কোকেন বাণিজ্যে যুক্ত সংগঠনটিকে কোনো প্রকার সহায়তা করা যাবে না।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Boland_Amendment
সিআইএ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় উভয়কে কন্ট্রাকে কোনো প্রকার সাহায্য না করার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু রিগ্যান সিআইএ'কে নির্দেশ দিলেন কন্ট্রাকে গোপনে অর্থ আর অস্ত্র দিয়ে যেতে। ১৯৭৯ সালে ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামিক বিপ্লবীরা ক্ষমতায় আসে। ঐসময় ইরানী বিপ্লবীরা ইরানের মার্কিন দূতাবাস দখল করে ৫২ মার্কিনী জিম্মি করে। একারণে মার্কিন সরকার ইরানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ইরানের উপর বাণিজ্যিক ও সামরিক অবরোধ আরোপ করে। ইসলামী বিপ্লবের আগপর্যন্ত পূর্বের মার্কিন অনুগত সরকার ঢালাওভাবে মার্কিনী অস্ত্র পেয়ে আসতো। ফলে তৎকালীন ইরানের অস্ত্রভান্ডার ছিলো মার্কিনী অস্ত্রে পরিপূর্ণ। ইরান যাতে কোনোভাবেই অস্ত্র না পায় সেজন্য মার্কিন সরকার ‘অপারেশন স্টান্স’ নামক কূটনৈতিক মিশন হাতে নেয়, যার উদ্দেশ্য ছিলো সারা বিশ্বে মার্কিন কূটনৈতিকদের দ্বারা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও অস্ত্র উৎপাদনকারীদের বোঝানো যে ইরান সন্ত্রাসবাদের সমর্থক, সুতরাং ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা অনৈতিক!
http://www.iran.org/tib/krt/fanning_ch7.htm
১৯৮০ সালে ইরাকের সাথে ইরানের যুদ্ধ বেঁধে যায়। ইরানী অস্ত্র ভান্ডার মার্কিনী অস্ত্রে ঠাসা। এগুলোর গোলাবারুদ ও যন্ত্রাংশ যা লাগে তা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাওয়া সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে ইতিমধ্যে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ ঘোষণা করেছে, ফলে কোনো দিক থেকে ইরানকে সহায়তার প্রশ্নই আসে না। ১৯৮১ সালের এক গবেষণার পর রিগ্যানের কিছু উপদেষ্টা তাকে বোঝালেন ইরানের উপর এই সামরিক নিষেধাজ্ঞার মূল্য নেই। কারণ ইরান চাইলেই যেসব দেশের কাছে মার্কিনী অস্ত্র আছে, তাদের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করে নিতে পারে। আর মার্কিনীরা অস্ত্র বিক্রি না করলে ইরান সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারস্থ হয়ে সোভিয়েত বলয়ে চলে যেতে পারে। ১৯৮৫ সালে লেবাননে ইরানপন্থী গেরিলা গ্রুপ ৭ জন আমেরিকান অপহরণ করে। প্রেসিডেন্ট রিগ্যান তার উপদেষ্টাদের নির্দেশ দেন যেকোনো উপায়ে জিম্মিদের উদ্ধার করার। রিগ্যান ইরানের সাথে গোপনে চুক্তি করেন যে প্রায় ১,৫০০ ক্ষেপণাস্ত্র তাদের দেয়া হবে। বিনিময়ে ইরানকে লেবাননের গেরিলা গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করে জিম্মিদের মুক্তি দিতে হবে। এই গেরিলারা ইরানপন্থী এবং এদের উপর ইরান সরকারের প্রভাব ছিলো। ইরান কথা দেয় অস্ত্র সরবরাহ করা হলে তারা মার্কিন জিম্মিদের মুক্তির সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। ইরানের কাছে বিভিন্ন মেয়াদে প্রায় ১,৫০০ ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করা হয়। এর বিনিময়ে ইরান সরকারের প্রচেষ্টার ফলে গেরিলারা ৩ জন জিম্মিকে মুক্তি দেয়। অস্ত্রের বিনিময়ে মার্কিন সরকার ৩০ মিলিয়ন ডলার পায়। এই ৩০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে মাত্র ১২ মিলিয়ন জমা হয়। বাকি ১৮ মিলিয়ম ডলার নিকারাগুয়ার কন্ট্রা গেরিলাদের সহায়তা হিসেবে পাঠানো হয়। ১৯৮৬ সালের ৩ নভেম্বর লেবাননের আস-শীরাআ পত্রিকা ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির ঘটনা ফাঁস করে দেয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ash-Shiraa
কীভাবে জিম্মিরা ছাড়া পেয়েছে সেটা বুঝতে আর কারো বাকি রইলো না। মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল এ নিয়ে তদন্ত শুরু করেন। এক মেরিন কর্নেল অলিভার নর্থ কিছু কাগজ ও প্রমাণাদি নষ্ট করতে গিয়ে ধরা পড়েন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Oliver_North
তদন্তে দেখা যায়, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উচ্চপদস্থ ৫-৬ জন এই কাজে লিপ্ত এবং তারা প্রেসিডেন্টের নির্দেশেই এই কাজ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র যেসময় এই অস্ত্র সরবরাহ করেছিলো, ঠিক একই সময়ে মার্কিন কূটনীতিবিদরা ‘অপারেশন স্টান্স’ এর মাধ্যমে সারা বিশ্বকে লেকচার দিয়ে বেড়াচ্ছিলো কেন ইরানকে অস্ত্র বিক্রি করা ঠিক না! তদন্তে দেখা যায় ইরানের কাছ থেকে পাওয়া ৩০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৮ মিলিয়ন ডলার গায়েব, যা ‘বোল্যান্ড অ্যামেন্ডমেন্ট’ ভঙ্গ করে রিগ্যান নিকারাগুয়ার কন্ট্রা গেরিলাদের পাঠিয়েছেন। কন্ট্রা গেরিলাদের বেশ কয়েকটি বিমানে করে অস্ত্র পাঠানো হয়েছিলো, যার মধ্যে একটি বিমান নিকারাগুয়ার বামপন্থী স্যান্ডনিস্টাস গেরিলারা ভূপাতিত করে পাইলটদের আটক করে। আটক পাইলট ধরা পড়ে সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেন যে তিনি সিআইএ’র হয়ে অস্ত্র নিয়ে আসছিলেন। রিগ্যান প্রশাসনের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার জেল হয়।
https://www.nytimes.com/1991/10/20/us/north-says-reagan-knew-of-iran-deal.html
১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরানের ওপর ইরাকি আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইরাক-ইরান যুদ্ধ আরম্ভ হয়। এই যুদ্ধ চলাকালে সাদ্দাম হুসেইন ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভ করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ba%27athist_Iraq
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশাপাশি ফ্রান্স, ব্রিটেন, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, গ্রিস, সৌদি আরব, কুয়েত ও আরো বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে এই যুদ্ধের সময় ইরাককে সহায়তা করে। অন্যদিকে, এই যুদ্ধের সময় আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বাধীন ইরানি ইসলামি বিপ্লবী সরকার কার্যত আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল এবং সিরিয়া, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়া ছিল তাদের প্রধান সমর্থক। এর বাইরে ইজরায়েল এই যুদ্ধ চলাকালে ইরানকে ব্যাপক সহায়তা প্রদান করে, কিন্তু ইরানি সরকার কখনো তথ্যটি স্বীকার করেনি। পাহলভি রাজবংশের শাসনামলে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। ইরান ছিল ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদানকারী দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্র। এসময় ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ব্যাপক সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের অনারব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার অংশ হিসেবে এবং নিজস্ব জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, বেসামরিক বাণিজ্যের বিস্তার, গোয়েন্দা সহায়তা, সোভিয়েত হুমকির মোকাবিলা ও অস্ত্র রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে ইসরায়েল এসময় ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। ১৯৭৯ সালে ইরানি ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানে যে সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, সেটি ছিল বাহ্যিকভাবে ইসরায়েলবিরোধী। তারা ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে তেহরানে অবস্থিত ইসরায়েলি দূতাবাস বন্ধ করে দিয়ে সেটিকে 'ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা'র কাছে হস্তান্তর করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Palestine_Liberation_Organization
ইরানি নেতৃবৃন্দ ইসরায়েলকে 'শয়তান-এ কুচাক' বা 'ছোট শয়তান' হিসেবে অভিহিত করে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তারা 'বড় শয়তান' হিসেবে অভিহিত করতো) এবং ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকারকে অস্বীকার করে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ইসরায়েলবিরোধী গ্রুপকে (যেমন- হিজবুল্লাহ) ইরান সক্রিয় সহায়তা প্রদান করতে শুরু করে।
https://www.washingtonpost.com/archive/politics/1990/11/05/reagan-calls-israel-prime-mover-in-iran-contra/71b08cdd-eaa8-43aa-a744-e5949f93764e/
তা সত্ত্বেও এই যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েল ইরানকে ব্যাপকভাবে সহায়তা প্রদান করে। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে যখন ইরাকি বাহিনী ইরানের বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করছিল, সেসময় ইসরায়েলি অস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সহায়তা ইরানকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সহায়তা করে। যুদ্ধ শুরুর পর ইরানি সরকার গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং ইসরায়েলি সহায়তা লাভের জন্য দেশটির সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছায়। যুদ্ধ শুরুর তিন দিন পর ইসরায়েলি সামরিক প্রশিক্ষকরা ইরানে পৌঁছে ইরানি সেনা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। ১৯৮০ সালে ইরানের বিভিন্ন বিমানঘাঁটিতে প্রায় ৩৫০ জন ইসরায়েলি টেকনিশিয়ান কাজ করছিল। ইরানি সরকারের জন্য কর্মরত অস্ত্র ব্যবসায়ী আহমাদ হায়দারির মতে, ইরাক-ইরান যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইরানের ব্যবহৃত প্রায় ৮০% অস্ত্রশস্ত্র এসেছিল ইসরায়েল থেকে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও গোয়েন্দা কার্যক্রম বিশেষজ্ঞ মার্ক ফাইথিয়ানের মতে, ইরাক-ইরান যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইরানি বিমানবাহিনী যে সচল ছিল, তার মূল কারণ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতিক্রমে ইসরায়েল ইরানকে তাদের মার্কিন নির্মিত বিমানগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় খুচরো যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছিল। তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের 'জাফে ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ' কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮১-১৯৮৩ সালের মধ্যে ইসরায়েল ইরানকে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে। মার্কিন সরকারের প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, ১৯৮১-১৯৮৩ সালে প্রতি বছর ইসরায়েল ইরানকে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের অস্ত্র সরবরাহ করে। ১৯৮১ সালে ইসরায়েল কর্তৃক ইরানের নিকট সরবরাহকৃত সামরিক সরঞ্জামের মধ্যে ছিল ১৫০টি 'এম-৪০' ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী কামান, ২৪০০০ গোলা, ট্যাঙ্কের খুচরো যন্ত্রাংশ ও যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন এবং TOW ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/M40_Gun_Motor_Carriage
https://en.m.wikipedia.org/wiki/BGM-71_TOW
১৯৮১ সালের জুলাইয়ে ইরানে নিযুক্ত প্রাক্তন ইসরায়েলি সামরিক অ্যাটাশে (১৯৫৫-১৯৭৯) ইয়াকোভ নিমরোদি ইরানি জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে গোপনে চুক্তি করেন এবং চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল ইরানকে ১৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Yaakov_Nimrodi
এগুলোর মধ্যে ছিল 'ল্যান্স' ফিল্ড আর্টিলারি সারফেস-টু-সারফেস ক্ষেপণাস্ত্র, 'কপারহেড' গোলা এবং 'হক' বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Surface-to-surface_missile
https://en.m.wikipedia.org/wiki/M712_Copperhead
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Tomahawk_(missile)
১৯৮২ সালে ইসরায়েল ইরানকে ৪৫,০০০ উজি সাব-মেশিনগান, ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চার, ক্ষেপণাস্ত্র, কামান ও যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে। ১৯৮২ সালের লেবানন যুদ্ধে ইসরায়েল পিএলও'র কাছ থেকে যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র জব্দ করেছিল, সেগুলোর বড় একটি অংশ ইরানের নিকট হস্তান্তর করা হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Uzi
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Tank_destroyer
১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে ইসরায়েল ইরানকে যথাক্রমে ১০০ মিলিয়ন ও ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে। ১৯৮৪ সালের জুলাইয়ে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ইয়াকোভ নিমরোদি, সিরীয় উপরাষ্ট্রপতি রিফাত আল-আসাদ এবং ইরানি কর্মকর্তাদের মধ্যে গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Rifaat_al-Assad
এই বৈঠকের পর ইসরায়েল ইরানকে শত শত টন বিস্ফোরক ও ডিনামাইট সরবরাহ করে। ইরান ইসরায়েলকে জ্বালানি তেল সরবরাহ করে এবং এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েল কর্তৃক সরবরাহকৃত সিংহভাগ অস্ত্রশস্ত্রের মূল্য পরিশোধ করে। এসময় ইরানের তেল রপ্তানির ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থাকায় ইসরায়েল ইরানকে গোপনে তেল বিক্রি করতে সহায়তা করে। ১৯৮৫-১৯৮৭ সালের মধ্যে ইসরায়েলের মধ্যস্থতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে ২,৫০২টি TOW ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, অন্তত ১৮টি 'হক' বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং এগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় খুচরো যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে। ইসরায়েলের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্র ইরানের নিকট অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ নিকারাগুয়ার 'কন্ট্রা' বিদ্রোহীদের প্রদান করে। যুদ্ধ শুরুর আগে থেকে ইরাক পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো। ১৯৮০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইরানি বিমানবাহিনী 'অপারেশন স্কর্চ সোর্ড' এর মাধ্যমে ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরের ওপর আক্রমণ চালিয়ে এটি ধ্বংস করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালায়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Operation_Scorch_Sword
ইরানি আক্রমণে ইরাকি রিঅ্যাক্টরটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ধ্বংস হয়নি। ১৯৮১ সালের ৭ জুন ইসরায়েলি বিমানবাহিনী 'অপারেশন অপেরা' পরিচালনা করে ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরটি ধ্বংস করে দেয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Operation_Opera
সেসময় ইসরায়েল ইরানের তুলনায় ইরাককে নিজেদের জন্য বেশি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতো। আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইরাক ফিলিস্তিনিদের জোরালো সমর্থক এবং তীব্র ইসরায়েলবিরোধী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ১৯৪৮-১৯৪৯, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধগুলোতে ইরাক সক্রিয়ভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ইরাকের ক্ষমতাসীন দল ছিল জায়নবাদের তীব্র বিরোধী এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জোরালো সমর্থক। ইরাকের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রচারণায় সাদ্দামকে রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার ও সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর উত্তরসূরি হিসেবে প্রচার করা হতো। ইরাক বিভিন্ন ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক দলকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা প্রদান করতো। ১৯৭০ এর দশকের শেষদিকে ইরাকের সামরিক শক্তি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং অত্যাধুনিক সোভিয়েত ও ফরাসি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইরাকি সশস্ত্রবাহিনী ক্রমশ আরব বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্রবাহিনীতে পরিণত হচ্ছিলো। ইসরায়েল ইরাকের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ভীতির দৃষ্টিতে দেখছিল। ইরানে পাহলভি রাজবংশের শাসন চলাকালে ইরানের ছিল বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম সশস্ত্রবাহিনী এবং ইসরায়েল ইরাককে প্রতিহত করার জন্য ইরানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু ইরানি বিপ্লবের পর আয়াতুল্লাহ খোমেনির সরকার ইরানি সশস্ত্রবাহিনীতে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান চালানোর ফলে ইরানি সশস্ত্রবাহিনীর শক্তিসামর্থ্য হ্রাস পায়। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান তাদের সশস্ত্রবাহিনীর পশ্চিমা নির্মিত অস্ত্রশস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় খুচরো যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে তাদের সামরিক সরঞ্জামের বড় একটি অংশ অকেজো হয়ে পড়ে। ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরু হলে ইসরায়েলের আশঙ্কা আরো ঘনীভূত হয়, এই যুদ্ধে ইরান পরাজিত হলে ইরানের তেলসমৃদ্ধ বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইরাকের হস্তগত হতো এবং ইরাক মধ্যপ্রাচ্যের অবিসংবাদিত প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতো। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক পরিস্থিতি ইসরায়েলের জন্য মারাত্মক প্রতিকূল হয়ে উঠতো। ইরানের সামরিক বাহিনীর তৎকালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইরান যে সহজে ইরাককে পরাজিত করতে পারবে না, এটি সকলের কাছে স্পষ্ট ছিল। এজন্য ইরাকও যাতে ইরানকে সহজে পরাজিত করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা ছিল ইসরায়েলের লক্ষ্য। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইরাক বা ইরান কেউই সহজে এই যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারবে না এবং এর ফলে উভয় পক্ষ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এর মধ্য দিয়ে তাদের উভয়ের শক্তিক্ষয় ঘটবে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো শত্রুভাবাপন্ন কার্যক্রম চালানোর সুযোগ তাদের থাকবে না। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের আগে ইরান ছিল ইসরায়েলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। ইরানের অভ্যন্তরে প্রভাব বিস্তারের জন্য ইসরায়েল বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ইসরায়েলের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ইসরায়েল ইরানকে আরব বিশ্বের প্রান্তে অবস্থিত এমন একটি ইসরায়েলি মিত্র হিসেবে বিবেচনা করতো, যেটির মাধ্যমে ইসরায়েল কর্তৃক আরব বিশ্বকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ ছিল। ইসরায়েল নিজেই আরব রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল এবং শত্রুভাবাপন্ন আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে শক্তির ভারসাম্য নিজেদের পক্ষে আনার উদ্দেশ্যে ইসরায়েল আরব বিশ্বের প্রান্তিক অঞ্চলে অবস্থিত অনারব রাষ্ট্রগুলোর (যেমন- ইরান, তুরস্ক ও ইথিওপিয়া) সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার নীতি গ্রহণ করেছিল। ইরানের ইসলামি বিপ্লব ছিল এক্ষেত্রে ইসরায়েলের জন্য বড় সঙ্কট। এই বিপ্লবের ফলে ইসরায়েল কয়েক দশক ধরে ইরানের অভ্যন্তরে যে প্রভাব বিস্তার করেছিল, সেটি অকস্মাৎ বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু ইরাক-ইরান যুদ্ধ ইসরায়েলকে পুনরায় ইরানের ওপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। অ্যারিয়েল শ্যারনের মতে, ইরানে সংঘটিত বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পর ইসরায়েল চাইছিলো ইরানের সঙ্গে সংযোগ সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন না করে একটি 'ক্ষুদ্র জানালা' খোলা রাখতে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ariel_Sharon
এই উদ্দেশ্য নিয়ে ইসরায়েল ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ইরানকে সহায়তা প্রদান করে। ইসরায়েলি নেতৃবৃন্দের ধারণা ছিল, এর মধ্য দিয়ে ইরানের ওপর ইসরায়েলের অন্তত আংশিক প্রভাব বজায় থাকবে এবং ইরানি সরকারের তীব্র ইসরায়েলবিরোধী নীতি আংশিকভাবে প্রশমিত করা সম্ভবপর হবে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের আগে ইরান ছিল ইসরায়েলি অস্ত্রের বৃহৎ বাজার। ইরানি সশস্ত্রবাহিনীর সামরিক সরঞ্জামের বড় একটি অংশ আসতো ইসরায়েল থেকে। ইসরায়েলি মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের জন্য ইরানের অস্ত্রের বাজার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর এই বিরাট বাজার ইসরায়েলিদের হাতছাড়া হয়ে যায়। এটি ছিল ইসরায়েলি সামরিক শিল্পের জন্য বড় মাত্রার ক্ষতি। এজন্য ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইরান যখন অস্ত্রশস্ত্র ও খুচরো যন্ত্রাংশের অভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছিলো, ইসরায়েল তখন সুযোগটি কাজে লাগিয়ে ইরানকে অস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে। ইসরায়েলি মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো মূল্যে ইরানের বাজার ধরে রাখা।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Defense_industry_of_Israel
ইরানের নিকট রপ্তানিকৃত অস্ত্রশস্ত্রের বিনিময়ে ইরান ইসরায়েলকে যে অর্থ সরবরাহ করে, সেটির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় বাজেটের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ইসরায়েলি বিশ্লেষকদের মতে, এই অর্থের একটি বড় অংশ ইসরায়েলে ক্ষমতাসীন লিকুদ দল ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের অনানুষ্ঠানিক ফান্ডে জমা হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Likud
১৯৭৯ সালের বিপ্লবের প্রাক্কালে ইরানে ৮০,০০০-১,০০,০০০ ইহুদি বসবাস করতো। পাহলভি রাজবংশের শাসনামলে ইরানি ইহুদিদের প্রতি সেরকম কোনো বৈষম্য বা নিপীড়ন করা হতো না। কিন্তু ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর ইরানি সরকার যে তীব্র ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে, এতে ইরানে বসবাসরত ইহুদিদের ওপর নিপীড়ন শুরু হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। এই আশঙ্কা থেকে ইসরায়েল ইরানি ইহুদিদের দেশত্যাগের বন্দোবস্ত করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ইসরায়েল কর্তৃক ইরানকে অস্ত্র সরবরাহের পেছনে এই বিষয়টির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ইসরায়েল কর্তৃক ইরানকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের বিনিময়ে ইরানি সরকার ইরানি ইহুদিদের একটি বড় অংশকে দেশত্যাগের অনুমতি প্রদান করে। প্রায় ৬০,০০০ ইরানি ইহুদি ইরান ত্যাগ করতে সমর্থ হয়। এদের মধ্যে প্রায় ৩৫,০০০ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, প্রায় ২০,০০০ ইসরায়েলে এবং প্রায় ৫,০০০ ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে চলে যায়। ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ইসরায়েল কর্তৃক ইরানকে সহায়তা প্রদান এবং ইরান কর্তৃক সেই সহায়তা গ্রহণের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি উভয় রাষ্ট্রের তীব্র ভীতি। ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আরব রাষ্ট্রগুলোকে ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে এবং ১৯৬৭-১৯৭০ সালের মিসরীয়-ইসরায়েলি সংঘাতে সোভিয়েত সৈন্যরা সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মিসর (১৯৭৩ সাল পর্যন্ত), সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া ও দক্ষিণ ইয়েমেনের মতো তীব্র ইসরায়েলবিরোধী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং এই রাষ্ট্রগুলোর সামরিক শক্তির অন্যতম প্রধান উৎস ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
https://www.amazon.com/Secret-War-Iran-Clandestine-Dangerous/dp/1416577009
সোভিয়েতরা পিএলও'কে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করতো এবং ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। ইসরায়েল সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিজস্ব অস্তিত্বের জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতো। পাহলভি রাজবংশের শাসনামলেও ইরান সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিজস্ব রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতো। ১৯৪৫-১৯৪৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরানি আজারবাইজান ও ইরানি কুর্দিস্তানে দু'টি সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত কমিউনিস্ট রাষ্ট্র স্থাপনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এবং পরবর্তীতে ইরানের রাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে কমিউনিস্ট তুদেহ দলকে ইরানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার জন্য সোভিয়েতরা সচেষ্ট ছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Tudeh_Party_of_Iran
এমতাবস্থায় ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে, যার অন্যতম কারণ ছিল সোভিয়েত ভীতি। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর ইরানের নতুন ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নের তীব্র বিরোধী ছিল।
https://www.amazon.com/Treacherous-Alliance-Secret-Dealings-Israel/dp/0300143117
তারা আফগানিস্তানে চলমান আফগান কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জঙ্গী গ্রুপকে সহায়তা প্রদান করে এবং সোভিয়েত সরকারের আশঙ্কা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের দক্ষিণাঞ্চলীয় মুসলিম অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রগুলোতে ইরান ধর্মীয় উগ্রপন্থা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ ছড়িয়ে দিতে পারে।
https://www.washingtonpost.com/archive/politics/1990/11/05/reagan-calls-israel-prime-mover-in-iran-contra/71b08cdd-eaa8-43aa-a744-e5949f93764e/
এমতাবস্থায় ইরাক-ইরান যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরপেক্ষতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালালেও পরবর্তীতে তারা ইরাকের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং ইরাককে বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে। এই পরিস্থিতিতে ইরানি সরকার সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইরাকের বিরুদ্ধে মিত্র খুঁজতে থাকে। ইসরায়েল ইরাক ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়কে ভীতির দৃষ্টিতে দেখতো এজন্য এবং ইরান ও ইসরায়েল পরস্পরের সঙ্গে গোপন ও অনানুষ্ঠানিক মৈত্রীতে আবদ্ধ হয়। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকি সমরযন্ত্রকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয় এবং একই বছর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্য ইরান ও ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
................................................................................
কাসেম সোলেইমানির আগে রাজপরিবারের কর্মচারী হিসেবে কাজ করলেও পরে খোমেনী ক্ষমতায় আসার পর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ইরান-ইরাক যুদ্ধে তিনি সাদ্দাম বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে সংগঠিত করেছিলেন। উল্লেখ্য, এই যুদ্ধে ইরান পশ্চিমাদের ছাড়াও ইজরায়েল, চীন ও উত্তর কোরিয়ার সহায়তা পেয়েছিল।
![]() |
পর্দার ধ্বজাধারী ইরান মাদক গ্রহনে বিশ্বে এক নম্বর |
সাধারণ জনগণের মগজ ধোলাই করতে পশ্চিমী দাপটের বিরোধিতার অজুহাতকে সামনে রেখে মোল্লারা ইরানের ক্ষমতা দখল করেছিল। আমেরিকার আশীর্বাদধন্য অত্যাচারী শাহ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন। ক্ষমতার রাশ গেলো খোমেনীর হাতে। তীব্র শ্রেণি বিভাজিত সমাজ, সবটুকু উন্নয়নের সুবিধা নিচুতলা অবধি এসে না পৌঁছানো, অপরিসীম দারিদ্র্য, বেকারত্বের সমস্যায় জর্জরিত ইরানিরা ১৯৭৯ সালে খোমেনীর মধ্যে মসীহা খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু তারপর মেয়েরা পরিণত হলো ইসলামী বিপ্লবের সেবাদাসী। সদ্যোজাত ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বেদিতে বলি হলো মেয়েদের স্বাধীনতা। ধর্মীয় বিধির ধারালো ছুরিতে ডানাগুলো ছেঁটে দেয়া হলো। তাতে নিম্নবিত্ত পরিবারের পিতৃতান্ত্রিকতার চাপে হাঁসফাঁস করতে থাকা মেয়েদের অবস্থার বিশেষ তফাত হলো না; কিন্তু খোমেনীর জমানা গলার ফাঁস হলো উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের তুলনায় স্বাধীন মেয়েদের।
এই বইয়ের প্রচ্ছদে দুই কালো পোষাকে আবৃত কন্যা মন দিয়ে মাথা নিচু করে দেখছে। তার উপরে ক্রিম রংয়ের প্রচ্ছদে লাল হরফে লেখা 'Reading Lolita in Tehran', তলায় লেখা ‘A memoir in Books’. গল্পটি সাত কন্যার - মান্না, মাহশিদ, ইয়াসসি, আজিন, মিত্রা, সানায আর নাসরিন। এরা একে অপরের থেকে আলাদা। প্রত্যেকের পারিবারিক পরিস্থিতি আলাদা। কেউ বিবাহিত, কেউ অবিবাহিত। কেউ ঘোর রক্ষণশীল বাড়ির মেয়ে, কেউ আবার প্রগতিপন্থী। মিল একটাই। এরা সাহিত্যের কারণেই সাহিত্য পাঠে একাগ্র। তবে বইটা উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সুবিধাভোগী মেয়েদের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। নিম্নবিত্ত পরিবারের গৃহ সহায়িকা গল্পের গতিতে পাঠকের মাঝখানে এসে পড়লেও তার ভাষ্য অনুচ্চারিত থাকে। আযার নাফিসি'র লক্ষ্য ছিল সাহিত্যের সঙ্গে জীবনের যোগসূত্রের সন্ধান। সাহিত্যের আঙিনায় সেই পরিচারিকার পায়ের ছাপ না থাকারই কথা। লেখিকা শাহতন্ত্রের বিরোধী। ১৯৭৯ সালে ইরানের প্রায় সব অভিজাত যখন দেশত্যাগে ব্যস্ত, তখন তিনি উল্টো দেশে ফিরে তেহরান ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে শুরু করেন। ১৯৮১ সালে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় হিজাব পড়তে রাজি না হওয়ায়। ১৯৮৭ সালে অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে শুরু করেন তিনি। ১৯৯৫ সালের হেমন্তে রাষ্ট্রের নিরন্তর খবরদারিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পদত্যাগ করেন তিনি। চাকরি ছাড়ার পর এই সাত কন্যাকে আমন্ত্রণ করলেন নিজের বাড়িতে। একটি সাপ্তাহিক পুস্তকালোচনার আসর বসালেন। মাত্র বছর দুয়েক ছিল সেই আসরের মেয়াদ। তারপর নাফিসি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ইসলামিক বিপ্লবের আগেও প্রথাগত পিতৃতান্ত্রিকতার প্রেক্ষাপটে সদ্যজাগ্রত নারী স্বাধীনতাকে কতখানি সতর্ক হয়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়েছে শিরিন এবাদি তা লিখেছেন। এই গল্প উপমহাদেশেও অচেনা নয়। বিপ্লবের পর ইরানের মাটিতে ধর্মের ছায়ায় মেয়েদের জীবন আরও কঠিন হয়ে যায়। শাহ চলে যাওয়ার পর খোমেনীর হাতে ইরানকে তুলে দিতে নাফিসির মত অধিকাংশ শাহ বিরোধীর পূর্ণ সম্মতি ছিল! নিজের ক্লাসে নাফিসি ফিটজেরাল্ড এর দ্য গ্রেট গ্যাটসবি পড়াতে গেলেন - বস্তুগত সম্পদ আর ক্ষমতালাভের আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষিতে বোনা আমেরিকান স্বপ্ন। সবার সাহিত্য দেখার চোখ, মন একইরকম পরিণত হয় না। তর্ক শুরু হয়, সদ্যোজাত ইসলামিক নীতিবোধ অনুসারে এই বই কি অনৈতিক? আসলে সকল পশ্চিমী সাহিত্যকেই কাঠগড়ায় তোলা হয় দেশটিতে। বলা হতো যে মেয়েরা নতুন ইরানের বিধান অনুযায়ী পর্দা প্রথা মানে না, তারা বেশ্যা এবং শয়তানের সহচর। মেয়েরা কিন্তু চুপচাপ মেনে নেয়নি। অকাট্য যুক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করে গেছে এই স্বৈরাচারী নিয়মের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ঘোষণা দিয়ে মেয়েদের পর্দা মানা বাধ্যতামূলক হয়। ইরানের সরকার গায়ের জোরে সবাইকে নীতি মানানোর চেষ্টা করে। নৈতিক পুলিশবাহিনী তৈরি হয়, রাস্তায় রাস্তায় টহল দেয়া শুরু করে তারা। মেয়েদের জন্য হরেকরকম নিষেধের তালিকা তৈরী হয়। বেচাল দেখলেই জরিমানা, বেত্রাঘাত কিংবা জেল। নাফিসি বলেন-
"our world under the mullah’s rule was shaped by the colorless lenses of the blind censor."
সেই অসহ্য টুঁটি টিপে ধরা বাস্তবতা থেকে পালানোর পথ খুঁজে নিতে বই নিয়ে আলোচনার আসর হয়ে উঠলো মেয়েদের কাঙ্ক্ষিত মুক্তির জায়গা। ভার্জিনিয়া উলফের ভাষায়-
“A space of their own”.
নাফিসির বাড়িতে অন্য কোনো পুরুষ ছিল না। সেই সুযোগে মেয়েরা বাধ্যতামূলক কালো বোরখা-হিজাব খুলে ফেলতে পারতো। ইসলামী রাষ্ট্রের দায় নেই মেয়েদের ব্যক্তি পরিচয় মনে রাখার, বোরখা তাকে শুধু মেয়ে বলেই দাগিয়ে দেয়। তারা প্রকাশ্যে মাথা নিচু করে, নিজেকে লোকচক্ষুর কাছে অপ্রকাশিত রেখে চলতে বাধ্য হয়। পুরুষহীন ঘরের সীমিত পরিসরে মেয়েরা বোরখা খুলে ফেলতো। গুটি থেকে প্রজাপতি বের হওয়ার মতন একেকজন স্বাতন্ত্র্যে ভরপুর ব্যক্তি মানুষের দেখা মেলে বইটিতে। পড়ার সময় পাঠক ধীরে ধীরে চিনে ফেলে তাদের চিন্তাভাবনা, জানতে থাকে তাদের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা, আঁচ পায় তাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার। সাহিত্যালোচনার আসর ছেড়ে গল্প ঢুকে পড়ে তাদের ব্যক্তিগত কথামালার, গোপন অনুভূতির অন্দরে। মেয়েদের চোখ দিয়ে খোমেনীর ইরান দেখতে থাকে পাঠক। ততদিনে সেদেশে মেয়েদের বিয়ের বয়স আঠারো থেকে কমে নয় হয়েছে! আইনের চোখে মেয়েদের দাম ছেলেদের অর্ধেক বলে মেনে নেয়া হয়েছে! শরিয়তি বিধান আইন হয়ে উঠেছে! সাত কন্যা একসঙ্গে ভ্লাদিমির নবোকভ পড়ে, জেন অস্টিন পড়ে। সাহিত্য যেন নাফিসির বসার চেয়ারের উল্টোদিকের দেয়াল আয়না যা দূরের তুষারকিরীটধারী পর্বতশীর্ষের টুকরো ছবি বুকে ধরে রাখে - জীবনের টুকরো টুকরো ছবিও ধরা থাকে সাহিত্যে। পাঠক শোনে 'লোলিটা' উপন্যাসের মূল কথা অপার যৌনতা নয়, একের ফ্যান্টাসির খাঁচায় অন্যের জীবন আটকে যাওয়া। লোলিটা'র কেন্দ্রীয় চরিত্র হুম্বার্টের মধ্যে নাফিসি খুঁজে পান খোমেনীর ছায়া। দু'জনেই নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা দিয়ে অন্যের জীবন চালাতে চান। দেশে দেশে যুগে যুগে ব্যক্তি মানুষের আড়ালে থেকে পিতৃতন্ত্রও এভাবেই মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। সাহিত্য শুধু অসাড় দর্পণ নয়, তা জীবনকে গভীরভাবে দেখতে শেখায়। নাফিসি বলেন-
"উপন্যাস রূপক মাত্র নয় - উপন্যাসের কাল্পনিক জগতের পাত্র-পাত্রীদের সঙ্গে একাত্ম হতে না পারলে, তাদের সহমর্মী হয়ে উঠতে না পারলে, তাদের অভিজ্ঞতা নিজের ন্যায় ভাবতে না পারলে উপন্যাস পাঠ অসমাপ্ত রয়ে যাবে।"
![]() |
এনসিয়েহ খাজালি, যিনি কিনা খোমেনীর প্রতিনিধি হয়ে ইরানের নারীদের উপর ফতোয়া বাস্তবায়নের কাজ করেন; অন্যদিকে তার ছেলে কানাডায় বিলাসবহুল লাইফস্টাইলে বসবাস করছে। |
![]() |
ইসলাম ধুয়ে পানি খাওয়া ইরানের কেবল রাজধানীতেই অভাবের কারণে পতিতায় পরিণত হওয়া ১০,০০০ নারীর খোঁজ পাওয়া গেছে! [আফতাব সোসাইটি, ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান] |
![]() |
ইরানী কূটনীতিকের ছেলে বনাম সাধারণ ইরানী নারী |
Comments