সংস্কৃতি যখন শোষণের হাতিয়ার

 


https://youtu.be/Ce2hWx8fqHM

সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ বলতে বোঝায় খর্ব শক্তির কোনো দেশের উপর নিজেদের সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে সে দেশের উপর মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Cultural_imperialism

ব্রিটিশরা পুরো বিশ্ব জুড়ে তাদের উপনিবেশগুলোতে নিজেদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে সে অবস্থানটি দখল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রাচীনকালে গ্রিক আর রোমানরা একই কাজ করেছে। ছোট পরিসরে ভারত, তুরস্ক, চীনের মতো দেশগুলো আঞ্চলিকভাবে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করে চলেছে। সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টির পেছনে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিয়ামক কাজ করে। দেশের সীমার বাইরে পণ্যের বাজার ধরা, প্রচারণার মাধ্যমে জনমত নিয়ন্ত্রণ করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাই সাম্রাজ্যবাদীদের মূল লক্ষ্য। একদিকে বিনোদন রপ্তানি করে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের মুনাফা, অন্যদিকে নিজেদের সাংস্কৃতিক উপনিবেশের অধিবাসীদের স্বকীয়তা ও প্রথাগত ঐতিহ্যকে মিডিয়াসৃষ্ট চাহিদা দ্বারা প্রতিস্থাপন করছে। সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদীদের প্রধান শিকার হচ্ছে তরুণরা। নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে কিংবা সুবিধামতো রাজনৈতিক মতাদর্শ জনপ্রিয় করতে তারা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘আধুনিকতা’ বিক্রি করছে। তরুণ সমাজও তাদের প্রচারণার ফাঁদে পা দিয়ে তাদের দেখানো বিষয়গুলোকে আধুনিকতা মনে করে সানন্দে গ্রহণ করছে। সাম্রাজ্যবাদীদের এই সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব তৃতীয় বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে আচ্ছন্ন করে তাদের আচার, প্রথা, বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে পুনর্বিন্যস্ত করে শাসক ও উঁচু শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর শোষণ উপযোগী করে তোলে। এতে সাম্রাজ্যবাদীদের উপর সে দেশের শাসক শ্রেণী সন্তুষ্ট থাকে এবং তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অতীতে চার্চ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকার আর প্রশাসনকে ধর্ম ও দেশপ্রেমের নামে সাধারণ জনগণের মন-মগজে দাসত্বের বীজ বপন করতে দেখা গেছে। কর্তৃত্বের এই হাতিয়ারগুলোকে আধুনিককালে প্রতিস্থাপিত করেছে গণমাধ্যম, প্রচার-প্রচারণা ও বিজ্ঞাপন এবং বুদ্ধিজীবীগণ। আধুনিককালে ভ্যাটিকানের চার্চ কিংবা বাইবেলের বক্তৃতার চেয়ে অধিক প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে হলিউড, বলিউড আর ডিজনিল্যান্ডের মতো বিনোদন পণ্যগুলো। গত শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ক ধারণার সাথে এ শতাব্দীতে যুক্ত হয়েছে নতুন বৈশিষ্ট্য যাকে পণ্ডিতগণ ‘কনটেম্পোরারি কালচারাল কলোনিয়ালিজম’ নামে অভিহিত করেছেন। এটি এখন অভিজাত শ্রেণীর মাঝে প্রভাব বিস্তারের চেয়ে সাধারণকে নিয়ন্ত্রণে আনতে অধিক আগ্রহী। আধুনিক গণমাধ্যম সাম্রাজ্যবাদের বীজ নিয়ে সরাসরি এবং আগের চেয়ে শক্তিশালীরূপে মানুষের গৃহে প্রবেশ করছে।আধুনিক সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের মূল শক্তি হচ্ছে বিশ্বায়ন। নব্য উদারবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যম অভিজাতকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে যা আদতে সাম্রাজ্যবাদকে শক্তিশালী করছে। মুক্ত বাজারের মরীচিকা সদৃশ সাফল্যের গালগল্প শুনিয়ে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদীরা বিনোদন পণ্যের বাজার দখল করে নিজেদের প্রভাব বলয় বৃদ্ধি করছে। জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে আন্তর্জাতিকতাবাদ, নিজস্ব সংস্কৃতির স্থলে বিশ্বসংস্কৃতি, ঐতিহ্যের স্থলে আধুনিকতার মতো শব্দগুলো ব্যবহার করছে সাম্রাজ্যবাদীরা, যেগুলো আপাত দৃষ্টিতে ইতিবাচক মনে হবে। অথচ আধুনিকতা আর ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে তৃতীয় বিশ্বের আচার প্রথা, পারিবারিক আর সামাজিক বন্ধন, শিল্প-সংস্কৃতি সবকিছু বিনষ্ট হচ্ছে। বর্তমান পৃথিবীতে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে আলোচনা হলে তার অধিকাংশই আমেরিকান আধিপত্য নিয়ে হতে বাধ্য। যুক্তরাষ্ট্র দেশীয় সীমানার বাইরে সংস্কৃতি প্রচারের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার গণমাধ্যমের সিংহভাগ দখল করে রেখেছে। গণমাধ্যম ব্যবসা মার্কিনীরা এতটাই নিজেদের করে নিয়েছে যে, এখন তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তিগণ গণমাধ্যম দিয়েই ধনী হচ্ছেন। ১৯৮২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ৪০০ ধনী ব্যক্তির তালিকায় গণমাধ্যম ব্যবসায়ী মাত্র ৯.৫%। অথচ বর্তমানে সর্বোচ্চ ধনীদের প্রতি ৫ জনে একজন গণমাধ্যম মালিক! এভাবেই সংবাদ, শিল্প, সাহিত্যকে পণ্যে রূপান্তরিত করে সর্বোচ্চ মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীরা। রোনাল্ড রিগ্যান যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন প্রথমবারের মতো তার সরকার আন্তর্জাতিক রাজনীতির কড়চা থেকে নিজ দেশের সুশীল সমাজকে দূরে রাখতে গণমাধ্যমের আধেয় নিয়ে কাজ শুরু করেন। তারপর থেকে এই সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণে অন্যান্য দেশে ছড়িয়েছে। তৃতীয় বিশ্বে নানাবিধ মার্কিন নীতির খপ্পরে পড়ে নাভিশ্বাস অবস্থা সেখানকার জনগণের। অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধনী-গরীব বৈষম্য বৃদ্ধি- কী না ঘটছে সেসব দেশে? বোধবুদ্ধি মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখালেও সেই প্রতিক্রিয়াকে ধীরে ধীরে স্তিমিত করে এনেছে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিনোদন বিপণনের মাধ্যমে। প্রচুর পরিমাণে বিনোদন সামগ্রী সরবরাহ করে সমালোচনায় মুখর মুখগুলোকে নিষ্ক্রিয় দর্শকে পরিণত করছে গণমাধ্যমের সাম্রাজ্যবাদ।সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করতে মিডিয়াকে ‘ডি-সেনসিটাইজেশন’ নামক ভয়ানক কাজে ব্যবহার করা হয়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Desensitization_(psychology)#:~:text=In%20psychology%2C%20desensitization%20is%20a,after%20repeated%20exposure%20to%20it.

ইরাক যুদ্ধের সময় মার্কিন বাহিনীর বোমায় হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে নাড়া দেয়ার কথা। কিন্তু এই সংবেদনই এখন নিষ্ক্রিয় রূপ নিয়েছে। তৈরি করা হয়েছে এমন ভিডিও গেম, যেখানে ইরাকের সন্ত্রাসীদের (!) উপর বোমা ফেলে ফেলে একেকটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়।

https://www.linkedin.com/pulse/critical-examination-cultural-imperialism-its-impact-global-drys%C3%A9n

সাধারণ মানুষ নিহতের ঘটনায় মানুষের মনে যে সংবেদন সৃষ্টি হওয়ার কথা, তা আধুনিক যুদ্ধশাস্ত্র শেখানোর নামে প্রশমিত করে দিচ্ছে ভিডিও গেম! আর সিনেমায় প্রতিপক্ষকে বর্বর, অসভ্য ও অমানবিক হিসেবে তুলে ধরার ব্যাপার তো আছেই (সোভিয়েতদের আর ভিয়েতনামীদের এই কাজটা করে মার্কিনিরা, পাকিস্তানীদের বেলায় এই কাজটা করে ভারত)। নিওলিবারেল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপরিকাঠামো বেশ ইতিবাচক এবং সাম্যবাদী মনে হতে পারে। কেননা নব্য উদারবাদ নিয়ন্ত্রণহীন বাজারের কথা বলে, যেখানে ধনী-গরীব সকলে সমান সুযোগ পাবে ব্যবসা করার! ধরা যাক, বাংলাদেশের বাজারে নিওলিবারেল কাঠামো প্রয়োগ করা হয়েছে। ফলে দেশি আর বিদেশি পণ্য সমান সুযোগ পাচ্ছে এবং কোনোটাকেই অতিরিক্ত কর প্রদান করতে হচ্ছে না। এখন এই বাজারে যখন কোনো আমেরিকান পণ্য প্রবেশ করবে, তাদের পণ্যের উপর যদি কোনো অতিরিক্ত ট্যাক্স আরোপ করা না হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই দেশীয় পণ্য প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পড়বে। এভাবেই উদারবাদের নামে দেশীয় পণ্যের বাজার দখল করে নিচ্ছে অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলো। বর্তমানে উদারবাদের দোহাই দিয়ে খর্ব শক্তির সংস্কৃতি আর প্রভাবশালী বড় সংস্কৃতিকে একই সমতলে দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে, যেখানে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে ছোট সংস্কৃতি। প্রভাবশালী দেশগুলোর সিনেমা আর স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো অবাধে প্রবেশ করছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো তা গ্রহণ করছে দু'হাত ভরে। ফলে তাদের দেশীয় বিনোদন খাত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে, প্রভাবিত হয়ে অন্যদের অনুকরণের চেষ্টা করে স্বকীয়তা হারাচ্ছে (ঠিক যেটা ঘটেছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে)। একইভাবে বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতির আধিপত্য দেখা যায় সর্বত্র, যদিও এখানে পঞ্চাশ এর অধিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ বাস করে।

https://iskrathespark.blogspot.com/2021/03/blog-post_26.html?m=1

ডিজনি, ভায়াকম, সিবিএসের মতো মিডিয়া কোম্পানিগুলো অবাধ তথ্য প্রবাহের সুযোগ নিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নিজেদের ইচ্ছামতো জনমত গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী থেকে ভৌগোলিক উপনিবেশবাদ মুছে গেলেও সূচিত হয়েছে মনস্তাত্ত্বিক উপনিবেশবাদের এবং সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদের। কার্ল মার্ক্সের শ্রেণী সংগ্রামের আলোচনায় বলা হয়েছিল সমাজের শাসক বা বুর্জোয়া শ্রেণী কোনো না কোনোভাবে শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণ করছে। ইতালিয়ান দার্শনিক অ্যান্তনিও গ্রামস্কি সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।

https://www.thoughtco.com/cultural-hegemony-3026121

তার মতে, মিডিয়া ও এর দ্বারা প্রচারিত সংস্কৃতি এতটাই প্রভাব ফেলতে সক্ষম যে তা শ্রমিক শ্রেণীকে একটি অসম সমাজব্যবস্থা গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করবে। তার তত্ত্বের সারাংশ হচ্ছে- আধুনিক পুঁজিপতিদের মূল হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে মিডিয়া, যা শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার মতো যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। ফলে সাধারণ মানুষ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় তারা শোষিত হচ্ছে এবং প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে সর্বোত্তম বলে গ্রহণ করে নেয়। ম্যাকডোনাল্ডসের বিশ্বজুড়ে আউটলেটের সংখ্যা বর্তমানে ৩৭ হাজার ছাড়িয়েছে! মার্কিন গবেষক এরিক স্ক্লোসার বলেছিলেন-

"খ্রিস্টানদের ক্রুশের চেয়ে ম্যাকডোনাল্ডসের লোগো অধিক পরিচিত!"

https://www.thoughtco.com/mcdonaldization-of-society-3026751

বিশ্বব্যাপী ম্যাকডোনাল্ডসের অস্বাভাবিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে আছে মার্কিন সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী কর্মকান্ড। কোনো দেশের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ তাদের খাদ্যাভ্যাস। সংস্কৃতিতে কর্তৃত্ব করতে হলে পরিবর্তন আনতে হবে খাদ্যাভ্যাসে। তাত্ত্বিকগণ এ ব্যাপারটিকে প্রকাশ করতে 'ম্যাকডোনাল্ডাইজেশন' শব্দটির প্রচলন করেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/McDonaldization

শব্দটি জর্জ রিটজারের বই ‘দ্য ম্যাকডোনাল্ডাইজেশন অব সোসাইটি’ থেকে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/The_McDonaldization_of_Society

ঠিক একইভাবে হলিউডের দাপটকে ‘হলিউডাইজেশন’, বলিউডের দাপটকে 'বলিউডাইজেশন', ইন্টারনেটে ‘গুগলাইজেশন’, ‘ফেসবুকাইজেশন’, মিডিয়া জগতে ‘ডিজনাইজেশন’ আর সামরিক সংবাদের ক্ষেত্রে ‘পেন্টাগনাইজেশন’ এর মতো শব্দগুলো ব্যবহার করলে খুব একটা ভুল হবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে মিডিয়ার মাধ্যমে আমেরিকান সংস্কৃতি ছড়িয়ে যাচ্ছে পুরো বিশ্বে। আর তাতে করে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন ও নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। আঞ্চলিক আধিপত্যবাদ কায়েমের চেষ্টা করা ভারতের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতেও যুক্তরাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির প্রভাব অসীম। ২০১১ সালের এক জরিপে দেখা গেছে পুরো ইউরোপে প্রতিবছর যত চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়, তার ৯০% হলিউডের ছবি; যেখানে ইউরোপীয় সিনেমা মাত্র ৫%! চলচ্চিত্র যে কত বড় প্রচার যন্ত্র, তা আমেরিকান চলচ্চিত্রের সাথে পরিচয় থাকলে সহজেই বুঝতে পারা যায়। বিজ্ঞানভিত্তিক আর কাল্পনিক চলচ্চিত্র বাদে অধিকাংশ আমেরিকান সিনেমা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে সর্বোত্তম বলে প্রচার করে। রাশিয়া, চীন, ইরান আর উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো আমেরিকান সিনেমায় সবসময় নেতিবাচকভাবে ফুটে উঠে। আর আমেরিকাকে বর্ণনা করা হয় মানবতা আর ন্যায় বিচারের ধারক-বাহক হিসেবে! আমেরিকার অযাচিত যুদ্ধের ফলে লাখো বেসামরিক মানুষ নিহত হয় ভিয়েতনামে। মার্কিন বাহিনীর গণ্ডায় গণ্ডায় ফেলা বোমাগুলো এখনো ভিয়েতনামের মাটিতে অবিস্ফোরিত অবস্থায় পাওয়া যায়। অথচ ‘অ্যাপোক্যালিপস নাও’, ‘দ্য ডিয়ার হান্টার’, ‘রেসকিউ ডন’ সহ অসংখ্য সিনেমা নির্মিত হয়েছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের উপর; যেখানে মার্কিন সৈন্যদের মহানুভবতা, বীরত্ব, মানবতাবোধ আর ভিয়েতনামিদের পৈশাচিকতা’ নির্মমতা ফুটে উঠেছে!

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Apocalypse_Now

https://en.m.wikipedia.org/wiki/The_Deer_Hunter

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Rescue_Dawn

সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা মগজ ধোলাই এর স্বীকার জ্ঞানপাপী দালালরা সাফাই গায় এভাবে যে, একটি শক্তিশালী সংস্কৃতি একটি দুর্বল সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে না, বরং ঝিমিয়ে পড়া সংস্কৃতিগুলোকে উজ্জীবিত করে! কিন্তু বিশ্বায়ন কিংবা উদারবাদই কতটা সাম্যের উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছে? বরং বিশ্বায়নের ফলে শক্তিশালী সংস্কৃতি আরো শক্তিশালী হচ্ছে, দুর্বল সংস্কৃতি আরো ক্ষীণকায় হয়ে একসময় হারিয়ে যাচ্ছে। যে আধুনিকায়নের কথা বলা হচ্ছে, সেই আধুনিকায়নের বৈশিষ্ট্য বা মাপকাঠি কী? যা কিছু পাশ্চাত্য, যা কিছু আমেরিকান, তা-ই কী আধুনিকতা?

এবার দেখা যাক পশ্চিমা গেমগুলো কিভাবে মানুষকে সহিংস বানাচ্ছে তার কয়েকটি নমুনা-

#নরওয়ের আন্দ্রে ব্রেভিক ২০১১ সালের জুলাই মাসের ২২ তারিখ নরওয়ের সরকারি ভবন ও এক রাজনৈতিক যুবশিবিরে হামলা চালিয়ে হত্যা করে প্রায় ৭৭ জন মানুষ। সে তার প্রথম হামলাটি চালিয়েছিল একটি ভ্যানের মাধ্যমে। ভ্যানটি নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী জেন্স স্টলেনবার্গের কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ইউরোপিয়ান সময় বেলা ৩টা ২৫ মিনিটের মাথায় বিস্ফোরিত হয়। সেই বিস্ফোরণে নিহত হয় ৮ জন এবং আহত হয় সর্বমোট ২০৯ জন। দুই ঘণ্টা পর ব্রেভিক পুলিশের পোশাক পরে এক ফেরিতে করে বাস্কারুডের উটোয়া দ্বীপে পৌঁছায় এবং যুবশিবির লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। আক্রমণে ১১০ জন মানুষ আহত হয় এবং এর মধ্যে ৬৯ জন পরে মৃত্যুবরণ করে। নিহতদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের বন্ধু এবং নরওয়ের রাজকুমারীর সৎ ভাই। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে ব্রেভিককে উটোয়া দ্বীপ থেকে গ্রেফতার করে। ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল-২২ জুন পর্যন্ত তার বিচারকার্য পরিচালনা করা হয় এবং বিচারের এক পর্যায় সে দোষ স্বীকার করে। ব্রেভিক ছিল ডানপন্থী মতবাদে বিশ্বাসী চরমপন্থী। এছাড়া সে প্রাচীন অডিনতত্ত্বে বিশ্বাস করতো। একসময় সে নিজেকে জাতীয়তাবাদী যোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা শুরু করে। সে মনে করতো, অনেক ইউরোপীয় দেশের তরুণ সমাজ ইসলামী জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে এবং কোনো এক সময় তার দেশের মুসলিম সহ অন্যান্য অভিবাসীরা নরওয়েজিয়ানদের বিশুদ্ধ রক্তের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। আর সেই হুমকির বীজ বপন করছে নরওয়ে লেবার পার্টি। তাদের ঠেকাতে সে কয়েক বছর পরিকল্পনার পর হামলা দু'টি চালায়। বিচারে তার ২২ বছরের জেল হয়। ব্রেভিকের দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী, সে ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ারক্র্যাফট ও কল অফ ডিউটি: মডার্ন ওয়ারফেয়ার টু-এর একজন একনিষ্ঠ খেলোয়াড় ছিল। ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ারক্র্যাফট গেমটি বিনোদনের জন্য খেললেও সে কল অফ ডিউটি: মডার্ন ওয়ারফেয়ার টু গেমটি ব্যবহার করতো ট্রেনিং সিমুলেটর হিসেবে। গেমটিকে ত্রিমাত্রিক রূপ দেয়ার জন্য সে একধরনের হলোগ্রাম ডিভাইস ব্যবহার করতো এবং তার খেলা গেমের সেই সংস্করণে ‘নো রাশিয়ান’ নামের এক বিশেষ মোড ছিল, যেখানে গেমারকে এক বিমানবন্দরে নির্দোষ বেসামরিক নাগরিকদের উপর সন্ত্রাসী হামলা চালাতে হতো!

#১৯৯৯ সালের এপ্রিলের ২০ তারিখ বেলা ১১টা ১৯ মিনিটে কলোরাডোর কলাম্বাইন স্কুলের দুই সিনিয়র ছাত্র হ্যারিস ও ক্লেবল্ড ট্রেঞ্চকোট পরিহিত অবস্থায় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে স্কুলের ক্যাফেটেরিয়াতে প্রবেশ করে সেখানে অবস্থানরত ছাত্রছাত্রীদের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। প্রায় ১১টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত গোলাগুলির পর তারা ১২ জন শিক্ষার্থী ও একজন শিক্ষককে হত্যা করে এবং আহত করে ৩৩ জনকে। ১২টার কিছু সময় পর তারা আত্মহত্যা করে। প্রাথমিক অবস্থায় কোনো কারণ না জানা গেলেও ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যে পুলিশী তদন্তের পর জানা যায়, তারা দুজনেই স্কুলের অন্যান্য শিক্ষার্থীর দ্বারা হয়রানির শিকার হতো। অনেকে তাদের ‘দ্য লুজারস অব দ্য লুজারস’ বলে টিটকারী দিতো। প্রায় চার বছর সেসব হয়রানীর শিকার হওয়ার পর তারা এই পথ বেছে নেয়। পরে তথ্যটি নাকচ করে দেয়া হয়। কলম্বাইনের পঞ্চম বার্ষিকীর দিন এফবিআই এর প্রধান তদন্তকারী ও কয়েকজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ একটি সংবাদ নিবন্ধে তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন। সেখানে লেখা হয়, হ্যারিস ছিল একজন ক্লিনিকাল সাইকোপ্যাথ, অন্যদিকে ক্লেবল্ড প্রচণ্ড বিষণ্ণতায় ভুগতো। তাদের এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারণ হিসেবে ধারণা করা হয় ক্রোধ, বিচ্ছিন্নতা ও মানসিক অসুস্থতার পাশাপাশি ডুম গেমের নেতিবাচক প্রভাব। তারা দুজনে এই গেমের প্রচণ্ড ভক্ত ছিল। হ্যারিস এই গেম নিয়ে স্কুলের একটি প্রজেক্টও লিখেছিল। পরে সে নিজে গেমের বিভিন্ন লেভেল তৈরি করে সেগুলো অনলাইনে ছাড়তে শুরু করে। তার বানানো লেভেলগুলোর নাম ছিল ‘দ্য হ্যারিস লেভেলস’। সেই লেভেলগুলোর তীব্র সহিংসতা থেকে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছিলো, এর সাথে কীভাবে সেই হত্যাকাণ্ড এক সুতোয় মেলে।

#১৯৮১ সালে জন্ম নেয়া ইভান রামসির বয়স যখন মাত্র সাত বছর, তখন পুলিশের সাথে গোলাগুলির কারণে তার বাবাকে গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনার পর তার মা নিয়মিত অত্যদিক মদ্যপান করলে ইভান ও তার ভাইবোনকে ফস্টার হোমে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ইভান একবার যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়। একটু বোকাসোকা স্বভাবের ছিল বলে স্কুলের সহপাঠীরা প্রায়ই তাকে ‘বুদ্ধি প্রতিবন্ধী’ বলে খেপাতো। ছোটবেলা থেকে নানা ধরনের নিপীড়ন সহ্য করতে করতে সে একসময় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে। তার বয়স যখন ১৬ বছর, তখন তার বাবা প্যারোলে ছাড়া পায়। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখ ইভান একটি শটগান নিয়ে তার স্কুলে যায়, প্রথমে স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ও পরে একজন ছাত্রকে খুন করা সহ আরও দু'জনকে আহত করে। পরে সে আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করলে গুলি করার আগেই পুলিশ তাকে ঘিরে ফেলে নিরস্ত্র করে। পুলিশের জানানো তথ্য অনুযায়ী, মোট বিশ জন মানুষ তার এই অপরাধের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত ছিল। এমনকি এর মধ্যে দু'জন তাকে শটগান চালানো শিখিয়েছে। খুন করার সময় ইভান আসলে ডুম গেমটিকে অনুকরণ করছিল। ডুম গেমার হিসেবে তার পরিচিতি ছিল; এমনকি যে বন্দুক দিয়ে সে হত্যাকাণ্ড চালায়, একই বন্দুক সে গেম খেলার সময় প্রায়ই ব্যবহার করতো। ইভানের বাবাও মিডিয়াকে জানায় যে, তিনি বিশ্বাস করেন তার ছেলে গোলাগুলির সময় ডুম গেম অনুকরণ করছিল। এক সাক্ষাৎকারে, ইভান নিজেও তার অপরাধের জন্যে ঐ গেমকে দায়ী করে। বিচারে তাকে ১৯৯ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। ২০৬৬ সালে তাকে প্যারোলে বের হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়।

#২০০৭ সালে পছন্দের হালো থ্রি গেম না খেলতে দেয়ার কারণে ড্যানিয়েল প্যাট্রিক নামে এক মার্কিন কিশোর তার বাবা-মাকে খুন করে। তাদের বাসায় হালো থ্রি গেমটি খেলা নিষেধ ছিল। সে নিষেধ অমান্য করে গেম খেলার কারণে বাবা-মা তার কাছে থেকে গেমটি বাজেয়াপ্ত করে। সেদিন রাতে সে বাবার ৯ মিলিমিটার পিস্তল দিয়ে তার মাকে হত্যা করে এবং বাবাকে গুরুতরভাবে আহত করে। বাবা-মা দুজনকে গুলি করার পর সে গেমটি নিয়ে ফ্যামিলি ভ্যানে করে পালিয়ে যায়। সেদিন প্যাট্রিকের বড় বোন ও তার স্বামী ক্লিভল্যান্ডের খেলা দেখতে বাড়িটিতে পৌঁছে বাবা-মাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে ফোন করে। এর কিছুক্ষণ পর হালো থ্রি গেমটি সহ পেট্রিককে গ্রেফতার করা হয়। বিচারের দিন প্যাট্রিকের আইনজীবী আদালতে যুক্তি দেখায়, স্নো-বোর্ডিং দুর্ঘটনায় শয্যাশায়ী হওয়ার পর প্যাট্রিক হালো থ্রি গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। আর বাইরে বের হতে পারতো না বলে সে সারাদিন ঐ গেম নিয়ে পড়ে থাকতো, যার কারণে একসময় সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। উকিলের এই কৌশলে আদালতে কাজ হয়নি। বিচারক প্যাট্রিককে ২৩ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন।

#২০০৮ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে মুক্তি পায় রকস্টার গেমের ‘গ্র্যান্ড থেফট অটো ৪’ গেমটি। শিশু-কিশোরদের মধ্যে এই সিরিজটি বেশ ভালোই জনপ্রিয়। সবার মতো থাইল্যান্ডের ১৮ বছর বয়সী পলোয়াত চিনো অপেক্ষা করছিল গেমটির জন্য। কিন্তু তার বাবা-মার সেটা কিনে দেয়ার সামর্থ্য ছিল না। শেষমেশ কোনো উপায় না পেয়ে সে ঠিক করে গেমে যেরকম টাকা ছিনতাই করে, সে-ও একই উপায়ে টাকা জোগাড় করবে। পরিকল্পনা মোতাবেক এক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ছুরি ধরে টাকা চাওয়ার পর ড্রাইভার টাকা দিতে অস্বীকার করলে চিনো ড্রাইভারকে ছুরি দিয়ে মারাত্মকভাবে আঘাত করে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ ডেডবডি ও ট্যাক্সি সহ চিনোকে গ্রেফতার করে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেই বছর থাইল্যান্ডে ‘গ্র্যান্ড থেফট অটো ৪’ গেমটি নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর থেকে থাইল্যান্ডের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় সেই দেশে নৃশংস গেম বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।






Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]