সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য
শিল্প বিপ্লবের ফলে অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থায় কিছু চরম পরিবর্তন এসেছিল, যার প্রাদুর্ভাবের শিকার হচ্ছিলো শ্রমিক শ্রেণী। শিল্প ব্যবস্থার ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিপতিরা বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়ে তাদের কোষাগার ফুলেফেঁপে উঠছিল, কিন্তু সেই একই সমান্তরালে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছিলো সাধারণ শ্রমিকরা। শিল্পপতিরা রক্ত চুষে খাচ্ছিলো শ্রমিকদের।উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে আবির্ভাব ঘটে
হেনরি ডি সেইন্ট সাইমন, রবার্ট ওয়েন এবং চার্লস ফুরিয়ার এর মতো গুরুত্বপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক দার্শনিকদের।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Henri_de_Saint-Simon
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Robert_Owen#:~:text=Robert%20Owen%20(%2F%CB%88o%CA%8A%C9%AA,socialism%20and%20the%20cooperative%20movement.&text=In%20the%20early%201800s%2C%20he,mill%20at%20New%20Lanark%2C%20Scotland.
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Charles_Fourier
তারা সমাজতন্ত্র প্রসঙ্গে তাদের নিজস্ব মডেল উপস্থাপন করলেন, যেখানে গুরুত্বারোপ করা হলো সমাজকে নতুন রূপে ঢেলে সাজানোর। এমন একটি সমাজের স্বপ্ন তারা দেখলেন, যেখানে পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা প্রতিযোগিতা নয়, বরং প্রাধান্য পাবে সমাজের সকল মানুষের মধ্যকার সহযোগিতা ও ঐক্যবদ্ধতা। সেই সমাজে মুক্ত বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে সকল পণ্যের চাহিদা ও যোগান। এরপর এলেন বিশ্বখ্যাত জার্মান রাজনৈতিক দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্ক্স। ফ্রেডরিক এঙ্গেলসকে সাথে নিয়ে ১৮৪৮ সালে প্রকাশ করলেন 'দ্য কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো'।
https://www.marxists.org/bangla/archive/marx-engels/1848/communist-manifesto/istahar.pdf
এ বইয়ের একটি বিশেষ অধ্যায়ে তারা তুলোধুনো করলেন ইতিপূর্বের সকল সমাজতান্ত্রিক মডেলকে। তাদের মতে, সেগুলো ছিল পুরোপুরি ইউটোপিয়ান। মার্ক্স বললেন, শ্রমিক শ্রেণী প্রলেতারিয়েত আর পুঁজিপতি শ্রেণী হলো বুর্জোয়া। তিনি ঘোষণা দিলেন, মানব সমাজের ইতিহাস মূলত শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। মার্ক্সের মতে, শ্রেণী সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে এবং পূর্বের সমাজ ব্যবস্থাগুলোর মতো পুঁজিবাদও তার অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও শ্রেণী সংগ্রামের ফলস্বরূপ ভেঙে পড়বে। তখন জন্ম হবে সমাজতন্ত্রের। এর কারণ, অস্থিতিশীল ও সংকটপ্রবণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে শ্রেণী সংগ্রাম ঘটবে, তা শোষিত ও উৎপীড়িত প্রলেতারিতদের মাঝে শ্রেণীচেতনার জন্ম দেবে। ফলে প্রলেতারিয়েতদের মাঝে অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে উঠবে। ঐক্যবদ্ধ প্রলেতারিয়েতরা তখন এক শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলবে। মার্ক্স এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করে দেন যে, বুর্জোয়াদের আধিপত্য বিলীন করে দিয়ে শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রলেতারিয়েতদের ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র ও সহিংস বিপ্লবের কোনো বিকল্প নেই।
সাম্যবাদ কিংবা বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রও জন্ম নিয়েছে শিল্প বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। মার্ক্সের তত্ত্ব অনুসারে, এটি শ্রেণী সংগ্রামের চরম পরিণতি। মার্ক্সবাদীরা অনেক সময় সমাজতন্ত্রকে দাবি করে থাকে পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের পথে প্রথম ধাপ হিসেবে। তবে মার্ক্স ও এঙ্গেলস নিজেরা কখনো সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্যগুলো নির্দিষ্ট করে দেননি।
সাম্যবাদে ব্যক্তি মালিকানা বলে কোনো ধারণার অস্তিত্ব নেই। সেখানে যাবতীয় সম্পদ সমাজ, সম্প্রদায় বা রাষ্ট্রের মালিকানাধীন। একজন মানুষ সেখান থেকে একটা অংশ পাবে, যেটুকু তার প্রয়োজন হবে। একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা রাষ্ট্র অর্থনৈতিক উৎপাদনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। রাষ্ট্রই নাগরিকদের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি সরবরাহ করবে।
সমাজতন্ত্রে গণ মালিকানার কথা বলা হলেও এখানে একজন ব্যক্তিবিশেষ ব্যক্তিগত সম্পদেরও মালিক হতে পারবে। অবশ্য শিল্প উৎপাদন কিংবা সম্পদ সৃষ্টির প্রধান যে উপাদান, সেগুলো সাম্প্রদায়িক মালিকানার অধীনে থাকবে এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার সেগুলোর দেখভাল ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে।
যেহেতু সাম্যবাদে কোনো ব্যক্তি মালিকানার জায়গা নেই, তাই শ্রেণী ব্যবধানের কোনো অস্তিত্ব নেই। একজন ব্যক্তি আরেকজন ব্যক্তির চেয়ে বেশি আয় করবে বা সম্পদের মালিক হবে, সে সুযোগ নেই। কিন্তু সমাজতন্ত্রে শ্রেণীর অস্তিত্ব থাকলেও 'ব্যবধান' ধারণাটি উহ্য থাকবে। তারপরও একজন ব্যক্তির পক্ষে আরেকজন ব্যক্তির চেয়ে বেশি আয় করা বা সম্পদের মালিক হওয়া অসম্ভব কিছু হবে না।
১৮৭৫ সালে মার্ক্স তার 'ক্রিটিক অভ দ্য গোথা প্রোগ্রাম' বইয়ে সাম্যবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এভাবে-
"From each according to his ability, to each according to his needs."
অর্থাৎ একটি আদর্শ সাম্যবাদী সমাজে জনগণের যা যা প্রয়োজন, সেগুলো সবই জোগান দেবে সরকার।
https://www.marxists.org/archive/marx/works/download/Marx_Critque_of_the_Gotha_Programme.pdf
অপরদিকে সমাজতন্ত্রে 'ন্যায্য পাওয়া' ধারণাটি বিদ্যমান। একজন ব্যক্তি ঠিক ততটুকু পাবে, যতটুকু অবদান সে অর্থনীতিতে রেখেছে। সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিবিশেষের শ্রম, প্রয়াস ও উদ্ভাবনকে পুরস্কৃত করা হয়।
সাম্যবাদ অনুযায়ী যদি একটি খাঁটি সাম্যবাদী সমাজ বা রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হয়, তাহলে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ শ্রেণীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র ও সহিংস বিপ্লবের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সমাজতন্ত্র অনেকটা নমনীয় একটি আদর্শ। এটিও পরিবর্তন ও সংস্কার প্রত্যাশী হলেও এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর পুরোপুরি উৎখাত চায় না। এটি চায় বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিবর্তন ও সংস্কারগুলো করতে।
সাম্যবাদে ধর্মকে পুরোপুরি বিলুপ্ত মনে করা হয়। কেননা সাম্যবাদ ও ধর্মের সহাবস্থান সম্ভব নয়। কিন্তু সমাজতন্ত্র কারো উপর কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম চাপিয়ে দেয় না, বরং জনগণকে স্বাধীনতা দেয়া হয় কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম পালন কিংবা না পালনের।
গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র হলো এমন একটি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শ যেখানে বলা হয় সমাজ ও অর্থনীতি গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হলেও তাদের কাছে অগ্রাধিকার পাবে সামষ্টিকভাবে জনগণের চাহিদা মেটানো, পুঁজিবাদের ন্যায় ব্যক্তিবিশেষের উন্নতি নয়। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীরা চায় সমাজের পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে রূপান্তর যেন মৌলিক মার্কবাদীদের বলা বিপ্লবের পরিবর্তে বিদ্যমান অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। এ ধরনের দর্শন একাধারে যেমন বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত চাহিদাগুলো যেমন আবাসন, পরিবহণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রভৃতির সরকারি নিয়ন্ত্রণকে সমর্থন করে, ঠিক তেমনি ভোগ্যপণ্যসমূহের সরবরাহ পুঁজিবাদী মুক্তিবাজার অর্থনীতির মাধ্যমে হওয়াকে শ্রেয় বলে মনে করে।
https://thisonevsthatone.com/socialism-vs-communism/
https://www.thoughtco.com/difference-between-communism-and-socialism-195448
https://www.investopedia.com/ask/answers/100214/what-difference-between-communism-and-socialism.asp
https://www.austriancenter.com/shattering-myth-nordic-socialism/
https://www.washingtonpost.com/politics/2019/03/05/what-is-socialism/
https://www.independent.co.uk/news/world/americas/do-you-know-difference-between-communist-and-socialist-a6708086.html
Comments