ইয়েমেন ধ্বংসে মার্কিনিদের হাত
একের পর এক বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে ইয়েমেনের রাস্তাঘাট, স্কুল, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের সেবামূলক ব্যবস্থা।
https://www.theguardian.com/world/2018/sep/19/yemen-famine-million-more-children-at-risk-
এই বিমান হামলাগুলোর প্রায় সবগুলো পরিচালনা করেছে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বাহিনী। হুথি বিদ্রোহীদের মিসাইল আক্রমণেও সেখানে বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের বিমান হামলায় বেসামরিক জনগণের মৃত্যু এবং ক্ষয়ক্ষতির অনুপাত বিদ্রোহীদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি।
https://www.washingtonpost.com/world/middle_east/us-allies-have-killed-thousands-of-yemenis-from-the-air-after-22-died-at-a-wedding-one-village-asks-why-us/2018/07/25/3c3e4801-164e-42ae-ac08-bec09044e52a_story.html
শুধুমাত্র ২০১৮ সালের আগস্টে একটি স্কুল বাসের উপর সৌদি বিমান হামলায় নিহত হয়েছিল ৫১ জন, যাদের মধ্যে ৪০ জন ছিল স্কুল ছাত্র। একই বছরের এপ্রিলে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে বিমান হামলায় নিহত হয়েছিল ২১ জন, যাদের মধ্যে ১১ জন ছিল শিশু। আহত হয়েছিল আরো ৯৭ জন, যাদের মধ্যে ৪৮ জন ছিল শিশু।
https://reliefweb.int/sites/reliefweb.int/files/resources/ERC%20USG%20Mark%20Lowcock%20on%20Yemen%2024May2018.pdf
প্রতিটি হামলার মিসাইলগুলো এসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে! এখনো অধিকাংশ আমেরিকান জানেই না যে, ইয়েমেন যুদ্ধে আমেরিকা কোনোভাবে জড়িত আছে।
https://www.aljazeera.com/news/2018/09/17/why-were-they-killed-saudi-uae-attack-hits-children-in-yemen/
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের বিমান হামলায় নিহত অধিকাংশ বেসামরিক মানুষের রক্তের দাগ শুধু সৌদি আরব, আরব আমিরাত কিংবা জোটের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের হাতে না, যুক্তরাষ্ট্রের হাতেও লেগে আছে।
https://www.independent.co.uk/news/world/middle-east/yemen-civil-war-saudi-arabia-houthis-uk-airstrikes-un-report-us-a8511361.html
যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে, তাদের প্রশিক্ষণে, তাদের দেয়া অস্ত্র দিয়ে সৌদি জোট হত্যা করছে ইয়েমেনের শিশুদের।
https://edition.cnn.com/2018/08/09/middleeast/yemen-bus-intl/index.html
সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী তাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে এবং তাদের যুদ্ধ বিমানগুলোকে আকাশে জ্বালানি ভরতে সহায়তা করছে, যেন তারা দীর্ঘক্ষণ ইয়েমেনের আকাশে অবস্থান করতে পারে।
https://edition.cnn.com/2018/08/17/middleeast/us-saudi-yemen-bus-strike-intl/index.html
ইয়েমেনে বেসামরিক জনগণের উপর বিমান আক্রমণে মার্কিন ক্ষেপনাস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়টি গণমাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসে মার্কিন টিভি নেটওয়ার্ক সিএনএনের তদন্তের ফলে। ২০১৮ সালের আগস্টের ৯ তারিখ ইয়েমেনের একটি স্কুলবাসের উপর বিমান হামলায় ৪০ জন শিশুর মৃত্যুর ঘটনার পর স্থানীয় সংবাদকর্মী এবং অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় সিএনএনের অনুসন্ধানী টিম দেখতে পায় ঐ হামলায় ২২৭ কেজি ওজনের যে মিসাইলটি ব্যবহৃত হয়েছিল, সেটি ছিল মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ লকহেড মার্টিন নামক অস্ত্র উৎপাদন কোম্পানী নির্মিত লেজার গাইডেড এমকে-৮২ বোমা।
https://www.theatlantic.com/ideas/archive/2018/09/trumps-dirty-war-in-yemen/570940/?utm_source=twb
সিএনএনের রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর মু’আতানা নামে ইয়েমেন ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা তাদের সাথে যোগাযোগ করে। মু’আতানা সংস্থাটি যুদ্ধে জড়িত উভয়পক্ষ কর্তৃক মানবাধিকার লংঘনের উপর কাজ করে।
https://www.wsj.com/articles/top-u-s-diplomat-backed-continuing-support-for-saudi-war-in-yemen-over-objections-of-staff-1537441200
তাদের ২০১৭ সালে তারা হিউম্যান রাইটস ফার্স্ট নামে একটি মার্কিন সংস্থার কাছ থেকে পুরস্কার পেয়েছিল। সংস্থাটি ২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনের বিভিন্ন স্থানে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর সৌদি কোয়ালিশনের বিমান হামলার ঘটনাস্থল থেকে মিসাইলগুলোর টুকরো এবং সেগুলোর ছবি সংগ্রহ করে আসছিল। সেই ছবিগুলো তারা সিএনএনের কাছে হস্তান্তর করে।
https://edition.cnn.com/interactive/2018/09/world/yemen-airstrikes-intl/index.html
সিএনএনের তদন্ত টিম ছবিগুলোর সত্যতা যাচাই করে। তারা ছবিগুলোর মেটাডাটার সাথে ঐসময় সংঘটিত হামলাগুলোর ঘটনা মিলিয়ে সেগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করে। তারা আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন একটি অস্ত্র বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে মিসাইলগুলোর ছবি এবং সিরিয়াল নাম্বার থেকে সেগুলোর উৎসের সন্ধান বের করে। তাদের তদন্তে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অস্ত্রগুলো মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ খ্যাতনামা বিভিন্ন অস্ত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের নির্মিত অস্ত্র।
https://mobile.twitter.com/CNN/status/1043817560721018880
মু’আতানার চেয়ারপার্সন রাদিয়া আল-মুতাওয়াকেল সিএনএন এর সাথে সাক্ষাৎকারে সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে বলেন-
"প্রতিদিন ইয়েমেনের শিশুরা মারা যাচ্ছে, কারণ আমেরিকা এই যুদ্ধে রসদ যোগাচ্ছে।"
যুক্তরাষ্ট্র যদিও ইয়েমেন যুদ্ধের পক্ষে তাদের অবস্থানকে মার্কিন নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্নভাবে যৌক্তিক বলে প্রমাণের চেষ্টা করে, কিন্তু তারা যে মূলত অস্ত্র ব্যবসার কারণে এই যুদ্ধে সৌদি আরবকে সমর্থন দিয়ে আসছে, তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। গোপন মেমো এবং সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে ঐ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবকে দেয়া মার্কিন সহায়তা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন, কারণ তা না হলে দেশটির কাছে ২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রয়ের সম্ভাবনা নাকচ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ঐ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ইয়েমেন যুদ্ধে মার্কিন সম্পৃক্ততার ভবিষ্যত নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চেয়েছিলেন, কারণ কংগ্রেস থেকে এই যুদ্ধে সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপারে চাপ আসছিল। অধিকাংশ মধ্যপ্রাচ্য এবং সামরিক বিশেষজ্ঞ যুদ্ধে বেসামরিক জনগণের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। এদের মধ্যে ইউএস এইড পরিষ্কারভাবে যুদ্ধে সহায়তা বন্ধ করে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ অ্যাফেয়ার্স টিম যখন পম্পেওকে জানায় যে, সহায়তা কিংবা সমর্থন বন্ধ করলে সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের কাছে ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ১ লাখ ২০ হাজার প্রিসিশন গাইডেড মিসাইল বিক্রয়ের সম্ভাবনা বাতিল হয়ে যেতে পারে, তখন পম্পেও তাদের পক্ষে অবস্থান নেন।

Comments