সোভিয়েত বেঈমান (পর্ব-এক)
গেনরিখ সামোয়লোভিচ লিউশকভ ১৯০০ সালে রুশ সাম্রাজ্যের বন্দরনগরী ওদেসায় এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Odessa
১৮৮১ সালের পর ওদেসা থেকে বহু ইহুদি ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ফিলিস্তিনে চলে যায় এবং ওদেসা ছিল জায়নবাদের শক্তিশালী কেন্দ্র। ১৯০৮ সালে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত স্কুলে লিউশকভের শিক্ষাজীবন শুরু হয় এবং ১৯১৫ সাল পর্যন্ত সে সেখানে পড়াশোনা করে। তার ৬ ভাই-বোনের মধ্যে এক ভাই ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং লিউশকভ নিজেও বলশেভিক দলে যোগদান করে। ১৯১৭ সালের নভেম্বরের বলশেভিক বিপ্লবে লিউশকভ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯১৮ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ওদেসায় যে ক্ষণস্থায়ী সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রটি কার্যকর ছিল, সেটির প্রতিষ্ঠায় লিউশকভ অংশ নিয়েছিল। ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে জার্মানরা ইউক্রেন আক্রমণ করলে লিউশকভ বলশেভিক সৈন্যদলের সঙ্গে যোগ দিয়ে জার্মান আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে। ১৯১৯ সালের প্রথমদিকে সে বলশেভিক ক্রিমিয়া রেজিমেন্টের রাজনৈতিক সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হয় এবং একই বছরের এপ্রিলে কিয়েভে অবস্থিত কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হয়। এখানে পড়াশোনা করার সময় সে রুশ গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে এবং তাকে বলশেভিক ১৪তম সৈন্যদলের একটি রাইফেল ব্রিগেডে রাজনৈতিক কাজে নিযুক্ত করা হয়।
https://www.rbth.com/arts/history/2017/06/09/the-3-most-notorious-defectors-in-soviet-history_779302
এই বাহিনীর অংশ হিসেবে সে জেনারেল আন্তন দেনিকিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক বিরোধী শ্বেতবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং ১৯১৯-১৯২০ সালের পোলিশ-সোভিয়েত যুদ্ধে পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Anton_Denikin
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Polish%E2%80%93Soviet_War
মাত্র ২০ বছর বয়সে সে তার ব্রিগেডের রাজনৈতিক কমিশার হিসেবে নিযুক্ত হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Political_commissar#:~:text=In%20the%20military%2C%20a%20political,political%20education%20(ideology)%20and%20organization
১৯২০ সালে লিউশকভ চেকা'য় যোগদান করে এবং ইউক্রেন ও মস্কোয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Cheka
এরপর তাকে ১৯৩০ সালের দিকে জার্মানিতে প্রেরণ করা হয়। সেখানে সে জার্মান ভাষায় নৈপুণ্য প্রদর্শন করে এবং জার্মান বিমান ও বিমানের ইঞ্জিন নির্মাতা কোম্পানি জাঙ্কার্সের ওপর নজরদারি করে। জাঙ্কার্স কোম্পানির কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে সে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে এবং স্তালিন স্বয়ং জার্মানিতে লিউশকভের কার্যক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Junkers
রুশ গৃহযুদ্ধে এবং জার্মানিতে তার কৃতিত্বের জন্য লিউশকভ দুইবার 'অর্ডার অফ দ্য রেড ব্যানার' লাভ করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Order_of_the_Red_Banner
এরপর সোভিয়েত সরকার তাকে এনকেভিডি'র আজভ সাগরীয় ও কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান নিযুক্ত করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Sea_of_Azov
https://en.m.wikipedia.org/wiki/NKVD
লিউশকভ সুপ্রিম সোভিয়েতে'র এবং সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Supreme_Soviet_of_the_Soviet_Union
স্তালিনের শুদ্ধি অভিযানে এনকেভিডি মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং এনকেভিডির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে লিউশকভ এই শুদ্ধি অভিযানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী ও সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির লেনিন ইনস্টিটিউটের পরিচালক লেভ কামেনেভ এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সভাপতি গ্রিগোরি জিনোভিয়েভকে রাষ্ট্রবিরোধী ও প্রতিবিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Lev_Kamenev
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Grigory_Zinoviev
লিউশকভ এই দু'জনের জিজ্ঞাসাবাদ পরিচালনা করে। লিউশকভ ১৯৩৭ সালে 'অর্ডার অফ লেনিন' লাভ করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Order_of_Lenin
১৯৩৭ সালের ৩১ জুলাই তাকে সোভিয়েত দূরপ্রাচ্যের বিস্তৃত অঞ্চলে এনকেভিডির প্রধান নিযুক্ত করা হয়। সেখানে তার কর্তৃত্বাধীনে ছিল ৩০ হাজার প্রশিক্ষিত এনকেভিডি সৈন্য। লিউশকভকে দূরপ্রাচ্যে প্রেরণের সময় তাকে দূরপ্রাচ্যে কর্মরত এনকেভিডির প্রধান ভসেভলোদ বালিতস্কি, সোভিয়েত আর্মি প্রধান মার্শাল ভাসিলি ব্লুখার এবং সোভিয়েত এয়ারফোর্স প্রধান আলেক্সান্দর লাপিন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Vsevolod_Balitsky
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Vasily_Blyukher
লিউশকভ দূরপ্রাচ্যের খাবারোভস্ক শহরে পৌঁছানোর পর বালিতস্কিকে গ্রেপ্তার করে মস্কোয় প্রেরণ করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। লাপিন বন্দি অবস্থায় আত্মহত্যা করে। ১৯৩৮ সালের দিকে লিউশকভকে মস্কোয় ডেকে পাঠানো হয়। কিন্তু লিউশকভ সোভিয়েত ইউনিয়ন ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। যেহেতু তার কর্মস্থল ছিল সোভিয়েত দূরপ্রাচ্যে এবং দূরপ্রাচ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে জাপান নিয়ন্ত্রিত মাঞ্চুকুয়োর সীমান্ত ছিল, তাই সে জাপানে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Manchukuo
সেসময় তার পদমর্যাদা ছিল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ক ৩য় শ্রেণির কমিশার এবং এই পদমর্যাদা ছিল সোভিয়েত সেনাবাহিনীর একজন ডিভিশনাল কমান্ডার বা জাপানি সেনাবাহিনীর একজন মেজর জেনারেলের সমতুল্য। লিউশকভ তার স্ত্রী ইন্না লিউশকোভা এবং তাদের ১১ বছর বয়সী মেয়েকে নিরাপদে দেশের বাইরে প্রেরণের উদ্দেশ্যে তার মেয়ের চিকিৎসা করানোর অজুহাতে পোল্যান্ড যাওয়ার ব্যবস্থা করে। তাদের পরিকল্পনা ছিল ইন্না পোল্যান্ডে পৌঁছে লিউশকভকে একটি টেলিগ্রাম পাঠাবে এবং টেলিগ্রামটিতে একটি সংকেত থাকবে, যেটি দেখে লিউশকভ বুঝতে পারবে যে তার পরিবার নিরাপদ স্থানে পৌঁছে গেছে। এরপর লিউশকভ সোভিয়েত ইউনিয়ন ত্যাগ করে জাপানে চলে যাবে। কিন্তু লিউশকভ সময়মতো তার স্ত্রীর কাছ থেকে টেলিগ্রাম পায়নি এবং এই বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে তার ধরা পড়ার সম্ভাবনা ছিল। এজন্য সে পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৩৮ সালের ১৩ জুন সোভিয়েত-মাঞ্চুকুয়ো সীমান্ত অতিক্রম করে এবং মাঞ্চুকুয়োর সীমান্ত পুলিশের হাতে বন্দি হয়। তাকে মাঞ্চুকুয়োর সীমান্ত পুলিশের সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তার পরিচয়পত্র দেখে তারা লিউশকভের পরিচিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। লিউশকভের সঙ্গে ছিল ২টি পিস্তল (যেগুলো তিনি সীমান্ত পুলিশের কাছে জমা দিয়েছিলেন), ১টি ঘড়ি, রুশ সিগারেট, একজোড়া সানগ্লাস, ৪১৫৩ জাপানি ইয়েন (জাপান, কোরিয়া ও মাঞ্চুকুয়োর ব্যাঙ্ক থেকে মুদ্রিত), ১৬০ সোভিয়েত রুবল, ৩টি পদক (১টি অর্ডার অফ লেনিন এবং ২টি অর্ডার অফ দ্য রেড ব্যানার), স্ত্রী ইন্নার একটি ছবি এবং রুশ ভাষায় লেখা কিছু কাগজপত্র। কাগজগুলোতে সমগ্র দূরপ্রাচ্যে অবস্থিত সকল সোভিয়েত সেনাঘাঁটি, বিমানঘাঁটি, সীমান্ত চৌকি ও অস্ত্র কারখানা সম্পর্কে তথ্য ছিল। মাঞ্চুকুয়োর সীমান্ত পুলিশ লিউশকভকে জাপানি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার হুঞ্চুন শাখায় প্রেরণ করে। হুঞ্চুনে যে জাপানি মেজর জাপানি সেনা গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বে ছিলেন, তিনি ছিলেন একজন রুশ ভাষাবিদ এবং লিউশকভের পরিচয় পাওয়ার নির্দেশনার জন্য সিউলে অবস্থিত জাপানি সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে যোগাযোগ করেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Hunchun
লিউশকভ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পালিয়ে আসার সময় যেসব গোপন কাগজপত্র নিয়ে এসেছিল সেগুলো থেকে জাপানিরা জানতে পারে যে, ঐ অঞ্চলে সোভিয়েত সামরিক শক্তি সম্পর্কে তাদের গোয়েন্দা সংস্থায় যে তথ্য ছিল তাতে মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। জাপানিদের প্রাপ্ত তথ্যের তুলনায় দূরপ্রাচ্যে সোভিয়েত সামরিক শক্তির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। এসময় জাপানিরা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে সোভিয়েত দূরপ্রাচ্য ও সাইবেরিয়াসহ উরাল পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে নিতে আগ্রহী ছিল এবং এজন্য এতদঞ্চলে সোভিয়েত সামরিক শক্তি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা তাদের জন্য অত্যাবশ্যক ছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ural_Mountains
লিউশকভের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জাপানিরা দূরপ্রাচ্যে তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে এবং ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে পরপর দুই বার সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। ১৯৩৮ সালে সংঘটিত খাসান হ্রদের যুদ্ধে সোভিয়েতরা জয়লাভ করে, কিন্তু জাপানি সৈন্যদের হাতে সোভিয়েতদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯৩৯ সালে তারা মঙ্গোলিয়ার খালখিন গোল নদী অঞ্চলে আরেকবার সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, কিন্তু এবার তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Soviet%E2%80%93Japanese_border_conflicts#:~:text=The%20Battle%20of%20Lake%20Khasan,claimed%20by%20the%20Soviet%20Union.
জাপানি সরকার প্রথমে লিউশকভের পক্ষত্যাগের খবর গোপন রেখেছিল, কিন্তু লিউশকভ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ ত্যাগ করা সবচেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং এরকম একজন কর্মকর্তা জাপানে পালিয়ে এসেছে; জাপানের জন্য এটির প্রচারণামূলক মূল্য ছিল অপরিসীম। ১৯৩৮ সালের ১৩ জুলাই টোকিওতে একটি হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে খবরটি বিশ্ববাসীকে জানানো হয়। খাসান হ্রদের যুদ্ধের পর দূরপ্রাচ্যে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর কমান্ডার মার্শাল ভাসিলি ব্লুখারকে গ্রেপ্তার করা হয়। খাসান হ্রদের যুদ্ধে সোভিয়েত সৈন্যদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হয় এবং লিউশকভের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ও জাপানি গুপ্তচর হওয়ার অভিযোগে তিনিও অভিযুক্ত হন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ত্যাগের পর লিউশকভ স্তালিনের শাসনব্যবস্থার কঠোর সমালোচকে পরিণত হয়েছিল। এসময় সে নিজেকে রুশ বিপ্লবের অন্যতম নায়ক ও ট্রটস্কির রাজনৈতিক মতাদর্শকে গ্রহণ করে, কিন্তু তার জাপানি সহকর্মীদের মতে সে একজন উদারপন্থী কমিউনিস্টে পরিণত হয়েছিল। সে শ্বেত রুশদের সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উৎখাত করার পরিকল্পনাকে সমর্থন করেনি (রুশ বিপ্লবের পর প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের যেসব নাগরিক সোভিয়েত সরকারের বিরোধিতা করেছিল, তাদের 'শ্বেত রুশ' বলে অভিহিত করা হতো)। রুশ গৃহযুদ্ধে শ্বেত বাহিনীর পরাজয়ের পর এই শ্বেত রুশদের অনেকে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে এবং চীনে পালিয়ে গিয়েছিল। জাপান নিয়ন্ত্রিত মাঞ্চুকুয়োয় বহু সংখ্যক শ্বেত রুশ বসবাস করতো এবং এদের একটি অংশ সোভিয়েত সরকারকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে জাপানিদের সঙ্গে সহযোগিতায় লিপ্ত ছিল। শ্বেত রুশদের প্রতি লিউশকভের অবিশ্বাস সত্ত্বেও স্তালিনকে খুন করার জন্য তাদের গৃহীত এক পরিকল্পনায় সে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। মাঞ্চুকুয়োয় সক্রিয় একটি শ্বেত রুশ দল এই পরিকল্পনা করেছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল তাদের একটি দল সোভিয়েত-তুর্কি সীমান্ত অতিক্রম করে সোভিয়েত ইউনিয়নের সোচি শহরে যাবে। লিউশকভ এনকেভিডির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা হওয়ায় স্তালিনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে সে বিস্তারিত জানতো এবং সেসব সম্পর্কে এই দলটিকে জানিয়ে দেন। তার সুপারিশে জাপানিরা এই পরিকল্পনায় সহায়তা করতে রাজি হয়। কিন্তু উক্ত শ্বেত রুশ দলটিতে একজন সোভিয়েত গুপ্তচর প্রবেশ করেছিল এবং সে এই পরিকল্পনা সম্পর্কে মস্কোকে অবহিত করে। এর ফলে পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়। এসময় লিউশকভ টোকিওতে অবস্থান করছিল। টোকিওতে থাকাকালে একবার সেখানকার সোভিয়েত দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে লিউশকভ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, কারণ সোভিয়েতরা তাকে খুন করার চেষ্টা করতে পারে বলে তার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু জাপানে কর্মরত সোভিয়েত কর্মকর্তারা লিউশকভকে তাকে খুন করার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকে। অবশ্য জাপানি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, সোভিয়েত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জাপানি কমিউনিস্ট পার্টিকে লিউশকভকে খুন করার নির্দেশ দিয়েছিল। লিউশকভ দূরপ্রাচ্য ও সাইবেরিয়ায় সোভিয়েত সামরিক বাহিনী সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জাপানিদের সরবরাহ করে এবং এর পাশাপাশি সোভিয়েত সামরিক সংকেত সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তাদের প্রদান করে। জাপানিরা এই তথ্য জার্মান গোয়েন্দা সংস্থার কাছে হস্তান্তর করে, যার ফলে ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের সময় জার্মানরা সহজেই সোভিয়েত সামরিক পরিকল্পনাগুলো সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। ১৯৪১ সালের ২২ জুন জার্মানি ও এর অন্যান্য ইউরোপীয় মিত্র রাষ্ট্রগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। এসময় জাপানি সেনাবাহিনীর একটি উগ্রপন্থী অংশ পূর্ব দিক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের জন্য জাপানি সরকারকে চাপ দিতে থাকে, কারণ তাদের ধারণা ছিল সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থা শীঘ্রই ভেঙে পড়বে! লিউশকভ তাদের মতামতের সঙ্গে একমত ছিল না। তার মতামত ছিল, জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নকে সহজে পরাজিত করতে সক্ষম হবে না এবং এজন্য জার্মানির পক্ষে যোগ দেয়ার আগে জাপানিদের সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি বিবেচনা করা উচিত। লিউশকভের মতামতকে মাথায় রেখে এবং অন্যান্য কারণে জাপানি সরকার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ থেকে বিরত থাকে। এসময় লিউশকভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার এবং সেখানে গিয়ে তার জীবনবৃত্তান্ত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে বই লেখার পরিকল্পনা করছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সে জোগাড় করতে শুরু করেছিল। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার নৌঘাঁটি আক্রমণের মধ্য দিয়ে জাপানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ শুরু হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে লিউশকভের বই লেখার স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়। ১৯৪৫ সালের ৯ মে মিত্রপক্ষের কাছে জার্মানির আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলেও দূরপ্রাচ্যে তখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তির সঙ্গে জাপানের তীব্র যুদ্ধ চলছিল। ১৯৪৫ সালের ২০ জুলাই লিউশকভকে মাঞ্চুকুয়োয় মোতায়েনকৃত জাপানি কুয়ান্টাং সৈন্যবাহিনীর বিশেষ গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করার জন্য পাঠানো হয়। ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপান নিয়ন্ত্রিত মাঞ্চুকুয়ো, অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়া ও কোরীয় উপদ্বীপে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। লাল ফৌজের তীব্র আক্রমণের মুখে জাপানিরা দ্রুত পিছু হটতে বাধ্য হয়। লিউশকভকে শেষ দেখা গিয়েছিল মাঞ্চুকুয়োর দালিয়ান শহরের একটি রেল স্টেশনে ভিড়ের মধ্যে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Genrikh_Lyushkov
কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, লিউশকভ মাঞ্চুকুয়োয় অগ্রসরমান সোভিয়েত সৈন্যদের হাতে বন্দি হয় এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। আবার কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, লিউশকভ যাতে সোভিয়েতদের হাতে ধরা না পড়ে সেজন্য জাপানিরাই তাকে খুন করে। কারণ লিউশকভ জাপানি সশস্ত্রবাহিনী সম্পর্কে অনেক গোপন তথ্য জানতো এবং সে সোভিয়েতদের হাতে বন্দি হলে এসব তথ্য সোভিয়েতরা জেনে যেতো।
Comments