ইয়াসির আরাফাত হত্যা
১৯৮২ সালের ২৩ অক্টোবর বিকেলে ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ মেজর জেনারেল ডেভিড ইভরি তেল আবিবের কেন্দ্রে বিমান বাহিনীর ভূগর্ভস্থ প্রধান কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে (ছদ্মনাম ক্যানারি) বসেছিলেন। https://www.nytimes.com/2018/01/23/magazine/how-arafat-eluded-israels-assassination-machine.html
গ্রিস ছেড়ে ভূমধ্যসাগরের আকাশে প্রবেশ করার কিছুক্ষণের মধ্যে ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর দু'টি এফ-১৫ যুদ্ধ বিমানের রাডারে ধরা পড়লো ফিলিস্তিনি যাত্রীবাহী ডিএইচসি-৫ বাফেলো প্লেনটি।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/McDonnell_Douglas_F-15_Eagle
https://en.m.wikipedia.org/wiki/De_Havilland_Canada_DHC-5_Buffalo
দু'জনের মধ্যে সিনিয়র পাইলট রেডিওতে যোগাযোগ করলেন বিমান বাহিনীর কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে। এফ-১৫ ফাইটার প্লেনের পাইলট যখন আরাফাতকে বহন করা বিমান ধ্বংস করার অনুমতি চাইলেন, সবাই নিশ্চিত ছিল ইভরি সাথে সাথে অনুমতি দিবেন। কিন্তু মেজর জেনারেল ইভরি সেদিন সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গেলেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/David_Ivry
হামলার নির্দেশ এসেছিল তৎকালীন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনের কাছ থেকে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ariel_Sharon
বিমান বাহিনীর কাজ শুধু নির্দেশ অনুযায়ী বিমান আক্রমণ করা। কিন্তু তিনি রেডিও হাতে তুলে পাইলটদের উদ্দেশ্যে করে বললেন-
"নেগেটিভ! আই রিপিট, নেগেটিভ অন ওপেনিং ফায়ার।"
পিএলও’র চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতকে হত্যার পরিকল্পনাটি আগের দিন প্রস্তুত করেছিল মোসাদ। সেসময় পিএলও-তে মোসাদের দু’জন গুপ্তচর নিযুক্ত ছিল। তাদের কাছ থেকে মোসাদ সংবাদ পায়, ২৩ তারিখ বিকেলে ইয়াসির আরাফাত একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন বিমানে চড়ে গ্রিস থেকে মিসরের উদ্দেশ্যে রওনা দিবেন।মোসাদের মধ্যে যে বিভাগটি নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যার দায়িত্বে নিযুক্ত, সেটির নাম সিজারিয়া।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Kidon
আরাফাতের অবস্থান জানার পর সিজারিয়ার দু'জন এজেন্টকে গ্রীসে পাঠিয়ে দেয়া হলো বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। সেসময় এথেন্স এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব একটা মজবুত ছিল না দেখে এজেন্ট দু'জন প্রায় বিনা বাধায় ব্যক্তি মালিকানাধীন প্লেনগুলো যেখানে পার্ক করা থাকে সেখানে পৌঁছে যায়। আরাফাত ঠিক কোন প্লেনটিতে ওঠে, তা নিশ্চিত করার জন্য তারা সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। তেল আবিবে এরিয়েল শ্যারন তার অধীনে থাকা ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের চিফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাফায়েল এইতানকে চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন আরফাতকে হত্যার মিশন যেন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় তা নিশ্চিত করার জন্য।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Israel_Defense_Forces
রাফায়েল এইতানের নির্দেশে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী তেল নোফ বিমান ঘাঁটিতে তাদের দু'টি এফ-১৫ ফাইটার জেটকে প্রস্তুত করে রাখে যেন সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে যাত্রা শুরু করতে পারে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Rafael_Eitan
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Tel_Nof_Airbase
বিমান বাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ ডেভিড ইভরি জানতেন যদি ভুলক্রমে আরাফাত নেই এরকম কোনো যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস করে দেয়া হয়, তাহলে সেই ঘটনার রাজনৈতিক প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে। তিনি নিজে গিয়ে পাইলট দু'জনকে নির্দেশ দিলেন-
"আমার সম্মতি ছাড়া তোমরা আক্রমণ করবে না। পরিষ্কার? এমনকি যদি যোগাযোগ ব্যবস্থায় সমস্যা হয়, যদি তোমরা আমার নির্দেশ শুনতে না পাও, তাহলেও তোমরা আক্রমণ করবে না।"
২৩ তারিখ দুপুর ২টা ৫ মিনিটে এথেন্স থেকে সিজারিয়া এজেন্টদের একজন মোসাদ হেডকোয়ার্টারে ফোন করলো। সে জানালো তারা ইয়াসির আরাফাতকে সনাক্ত করেছে। তার বর্ণনা অনুযায়ী আরাফাত তখন তার সঙ্গীসাথী সহ একটি ডিএইচসি-৫ বাফেলো বিমানে চড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ফাইটার জেটের পাইলটরা যেন সহজে প্লেনটিকে সনাক্ত করতে পারে, সেজন্য সে প্লেনটির লেজের নীল এবং বাদামী বর্ণের প্রতীকের বিবরণ এবং এতে লেখা রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটি জানিয়ে দিলো। তার দেয়া তথ্য মোসাদ বিমান বাহিনীর কন্ট্রোল সেন্টার ক্যানারিতে পাঠিয়ে দিলো। ডেভিড ইভরি ভেবে পাচ্ছিলেন না, ঐসময় আরাফাত কেন মিসরে যাবেন? গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী সেসময় আরাফাতের গ্রীসে বা মিসরে যাওয়ার মতো কারণ ঘটেনি। যদি গিয়েও থাকেন, তাহলেও তিনি কেন বাফেলো বিমানে চড়বেন? তার মতো পদমর্যাদার একজন ব্যক্তির জন্য বাফেলো বিমানগুলো সম্মানজনক ছিল না। ইভরি আবারও তথ্য নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিলেন। সিজারিয়ার এজেন্ট দু'জন আবারও জানালো তারা সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে প্লেনে চড়া ব্যক্তি ইয়াসির আরাফাত। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, গোয়েন্দাদের বিভ্রান্ত করার জন্য আরাফাত লম্বা দাড়ি রাখলেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো তিনি আরাফাত ছাড়া অন্য কেউ নন। বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে সিজারিয়া এজেন্টরা মোসাদ হেডকোয়ার্টারে ফোন করে জানালো, আরাফাতকে বহনকারী প্লেনটি আকাশে উড়েছে। ইভরি প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান রাফায়েল এইতানের কাছ থেকে সরাসরি নির্দেশ পেলেন-
“ধ্বংস করে দাও প্লেনটি।”
ইভরি পাইলটদের উড়তে নির্দেশ দিলেন। তিনি আবারও ফোন করলেন মোসাদের কাছে। তাদের বললেন ভিন্ন কোনো উৎস থেকে নিশ্চিত করতে যে ঐ ব্যক্তি আসলেই আরাফাত, তার মতো দেখতে অন্য কেউ না। ইভরি জানতেন, এরকম মুহূর্তে ফাইটার প্লেনের পাইলটরা যেকোনো অযুহাতে মিসাইল নিক্ষেপের জন্য উদগ্রীব থাকে। রেডিওতে সামান্য শব্দ হলেও তারা সেটাকে সম্মতি হিসেবে ধরে নিতে চায়। তাই উড়তে নির্দেশ দেয়ার পরও তিনি আবার তাদের সাথে যোগাযোগ করে স্মরণ করিয়ে দিলেন যেন তারা কোনো অবস্থাতেই তার পরিষ্কার নির্দেশের আগে আক্রমণ না করে। রাফায়েল এইতান, মোসাদ এবং আমান বারবার ইভরির কাছে ফোন করে খোঁজ নিচ্ছিলো অপারেশনের অগ্রগতি কতটুকু।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Military_Intelligence_Directorate_(Israel)
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mossad
ইভরি তাদের বলছিলেন যে, তখনও নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি আসলেই প্লেনে আরাফাত আছেন কিনা। এমন সময় স্পীকারে পাইলটের কন্ঠস্বর ভেসে আসে যে, তারা বাফেলো প্লেনটির দেখা পেয়েছে। ইভরি তখনও দ্বিতীয় উৎস থেকে নিশ্চয়তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন দেখে তিনি আক্রমণ না করার নির্দেশ দিলেন। বিকেল ৫টা বাজে ক্যানারির একটি ফোন বেজে উঠলো। এটি ছিল সরাসরি মোসাদের হেডকোয়ার্টারের সাথে সংযুক্ত সুরক্ষিত লাইন। অপর প্রান্ত থেকে জানানো হলো, মোসাদ ভিন্ন একটি উৎস থেকে নিশ্চিত করেছে যে ইয়াসির আরাফাত আসলে গ্রিসে যাননি। যে ব্যক্তি প্লেনে উঠেছেন, তিনি আরাফাত হতে পারেন না। সম্ভবত তিনি একই চেহারার অন্য কেউ। ইভরি বাফেলো বিমানটিকে অনুসরণ করতে থাকা পাইলটদের জানালেন, তারা যেন আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। ৫টা ২৩ মিনিটে আরেকটি রিপোর্ট এলো ক্যানারিতে। মোসাদের দ্বিতীয় আরেকটি উৎস এবং আমানের একটি উৎস পৃথক পৃথক ভাবে নিশ্চিত করলো, প্লেনে চড়া ব্যক্তি আসলে ইয়াসির আরাফাতের ভাই ফাতহি আরাফাত।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Fathi_Arafat
ফাতহি ছিলেন ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা। সেদিন তিনি ৩০ জন শিশুকে সাথে করে গ্রিস থেকে মিসরে যাচ্ছিলেন তাদের চিকিৎসার জন্য, যারা মাত্র এক মাস আগে লেবাননের সাবরা-শাতিলা শরণার্থী শিবিরে খ্রিস্টানদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও আহত হয়েছিল গুরুতরভাবে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Sabra_and_Shatila_massacre
ইভরি এফ-১৫ পাইলটদের নির্দেশ দিলেন-
“ফিরে এসো। ঘরে ফিরে এসো।”
ইয়াসির আরাফাতকে এর আগে-পরে অনেকবার হত্যার চেষ্টা করেছে ইসরায়েল। আরাফাতকে হত্যাচেষ্টার এসব পরিকল্পনা এবং সেগুলো থেকে আরাফাত কীভাবে বারবার রক্ষা পেয়েছেন, তা বিস্তারিত উঠে এসেছে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত সাংবাদিক রনেন বার্গম্যানের একটি প্রবন্ধে।প্রবন্ধটি তার “Rise and Kill First: The Secret History of Israel’s Targeted Assassinations” বইটির একটি অধ্যায়।
https://www.amazon.com/Rise-Kill-First-Targeted-Assassinations/dp/1400069718
সাংবাদিক রোনান বার্গম্যান এ পর্যন্ত ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের শত শত কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবং হাজার হাজার গোপন নথিপত্র দেখেছেন। তার নিজের ভাষায় এসব নথিপত্রে ইসরায়েলের ইতিহাসের এমন এক গোপন দিকের সন্ধান পাওয়া যায়, যা এমনিতেই ভয়ংকর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করা ইসরায়েলের জন্যও আশ্চর্যজনক। ইসরায়েল রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে এটির কর্মকর্তারা যে পরিমাণ হত্যা এবং গুপ্তহত্যা করেছে, তা ইউরোপের যেকোনো রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে। অনেক সময় তারা এসব পরিকল্পনা এবং এগুলোর বাস্তবায়ন করেছে বেসামরিক জনগণের ক্ষয়ক্ষতির তোয়াক্কা না করে। ১৯৫৯ সালে ইয়াসির আরাফাত যখন আল-ফাতাহ প্রতিষ্ঠা করেন, তখন ইসরায়েল তাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Fatah
কিন্তু ১৯৬৫ সালে ফাতাহ যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে, তখন মোসাদের ইউরোপ শাখার প্রধান রাফি এইতান সর্বপ্রথম মোসাদের পরিচালক মায়ার আমিতকে পরামর্শ দেন সিজারিয়াকে নির্দেশ দেয়ার জন্য যেন তারা আরাফাতকে হত্যা করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Rafi_Eitan
পূর্ব জার্মানীর সাথে ইয়াসির আরাফাতের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Meir_Amit
এইতান আমিতকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তারা সহজেই আরাফাতের জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুর্ট ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করতে পারবেন। আমিত এই প্রস্তাবে রাজি হননি। কিন্তু পরবর্তী কয়েক দশক ধরে মোসাদ সহ ইসরায়েলি বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরা অনেকে আরাফাতকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছে। তাদের দৃষ্টিতে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই নেতাকে দুনিয়ার বুক থেকে সরিয়ে দেয়াটা ছিল ইসরায়েলের স্থিতিশীলতার জন্য জরুরী। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে যখন পূর্ব জেরুজালেম এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলিদের উপর গেরিলা আক্রমণ চলছিল, তখন গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ইসরায়েলি সেনারা আরাফাতের বাসায় হানা দিয়েছিল। মাত্র কয়েক মিনিট আগে তাদের আগমন টের পেয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন আরাফাত। ইসরায়েলি সৈন্যরা যখন তার বাসায় প্রবেশ করে, তখনও টেবিলের উপর থাকা তার খাবারগুলো থেকে গরম ধোঁয়া উড়ছিল। ১৯৬৮ সালে ইসরায়েলের গোয়েন্দা বাহিনী তিন মাস ধরে এক ফিলিস্তিনি বন্দীকে ব্রেইন ওয়াশ করে তাকে দিয়ে ইয়াসির আরাফাতকে হত্যা করানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। কিন্তু তাকে ছেড়ে দেয়ার পাঁচ ঘন্টার মধ্যেই সে অস্ত্রসহ স্থানীয় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং ইসরায়েলের গোয়েন্দা বাহিনীর প্রকল্পের কথা ফাঁস করে দেয়। ইয়াসির আরাফাতকে পূর্ব জার্মানীর নেতা এরিখ হনেকার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মতো বিপ্লবী হিসেবে সম্মান করতেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Erich_Honecker
তার গোয়েন্দা বাহিনী আরাফাতকে নিয়মিত গোপন তথ্য এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতো। ১৯৮১ সালে এরিয়েল শ্যারন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর ইয়াসির আরাফাতকে ইসরায়েলের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং নতুন করে তাকে হত্যার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেন। তার নির্দেশে ইসরায়েল আয়োজন করে ‘অপারেশন অলিম্পিয়া’। ১৯৮২ সালের ১লা জানুয়ারি পিএলও লেবাননের বৈরুত স্টেডিয়ামে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আক্রমণের বার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। সেই অনুষ্ঠানে ইয়াসির আরাফাত সহ পিএলও এবং ফাতাহ’র প্রধান প্রধান নেতারা উপস্থিত থাকার কথা ছিল। ইসরায়েল পরিকল্পনা করে, সেই অনুষ্ঠানের মঞ্চের নিচে শক্তিশালী বোমা স্থাপন করে ফিলিস্তিনের সব নেতাকে একসাথে নির্মূল করে ফেলা হবে। মঞ্চের নিচে বোমাও স্থাপন করা হয়ে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে ইসরায়েলের ডেপুটি প্রতিরক্ষামন্ত্রী আমানে'র একদল কর্মকর্তা সহ প্রধানমন্ত্রী বেগিনের সাথে গিয়ে দেখা করে তাকে বোঝান যে, এরকম ভয়াবহ হত্যাকান্ড ঘটালে পুরো বিশ্ব একসাথে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিবে। শেষপর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে শ্যারনের এই পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Menachem_Begin
শ্যারন ইয়াসির আরাফাতকে হত্যা করার জন্য গঠন করেন নতুন স্পেশাল টাস্ক ফোর্স ‘সল্ট ফিশ’। এর দায়িত্ব দেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মায়ার দাগান এবং মোসাদের সাবেক ইউরোপীয় প্রধান রাফি এইতানকে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Meir_Dagan
আমানের সাহায্যে তারা আরাফাতের অবস্থান জানার জন্য বৈরুতের টেলিফোন এক্সচেঞ্জগুলোতে আড়িপাতা যন্ত্র স্থাপন করে। তাদের পরিকল্পনা ছিল, আরাফাতের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারলে সেখানে বিমান হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হবে। কিন্তু ইয়াসির আরাফাত কোনো নিয়মিত সময়সূচী অনুসরণ করা বন্ধ করে দিলেন। ১৯৮২ সালের জুলাই মাসে সল্ট ফিশ আরাফাতকে হত্যার নতুন পরিকল্পনা করলো। সেসময় ইসরায়েলের একটি বামপন্থী পত্রিকার সম্পাদক ইউরি আভনারি বৈরুতে গিয়ে ইয়াসির আরাফাতের সাক্ষাৎকার নেয়ার আয়োজন করছিলেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Uri_Avnery
ইসরায়েলের বামপন্থীদের অনেকে শুরু থেকে ফিলিস্তিনের উপর ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, আরাফাত এই সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হলেন। ইসরায়েল জুড়ে এ সাক্ষাৎকারের উদ্যোগটি প্রচন্ড সমালোচনার শিকার হলেও সল্ট ফিশ সিদ্ধান্ত নেয় তারা সাক্ষাৎকারে বাধা না দিয়ে সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আরাফাতকে হত্যার চেষ্টা করবে। জুলাই মাসের ৩ তারিখ ইউরি আভনারি তার এক রিপোর্টার এবং এক ফটোগ্রাফার সহ বৈরুতে প্রবেশ করেন। কিন্তু তাদের অজান্তেই বৈরুতে ঢুকে যায় সল্ট ফিশের একদল গুপ্ত ঘাতক। ইয়াসির আরাফাত অনুমান করতে পেরেছিলেন যে, মোসাদ তাকে হত্যা করার এই সুযোগ হাতছাড়া করবে না। তার সহকারীরা সাংবাদিকদের নিয়ে বৈরুতের অলিগলিতে ঘুরতে ঘুরতে শেষপর্যন্ত যখন নিশ্চিত হন যে তারা অনুসরণকারীদের খসিয়ে দিতে পেরেছেন, তখনই কেবল তারা আরাফাতের আস্তানায় যান। সেবার সাংবাদিকরা আরাফাতের সাক্ষাৎকার নিয়ে ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছিল। আইডিএফ প্রধান রাফায়েল এইতান বুঝতে পারছিলেন যেসব স্থানে ব্যাপক প্রাণহানির সম্ভাবনা ছিল, সেসব স্থানে ইভরি এবং দায়ান আক্রমণ করছিলেন না। তারা অযুহাত দেখাচ্ছিলেন যে, ইন্টালিজেন্স রিপোর্ট যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য না। আগস্টের ৪ তারিখে যখন এইতানের কাছে বৈরুতের কেন্দ্রে অবস্থিত একটি বাড়িতে আরাফাতের সম্ভাব্য একটা মিটিংয়ের তথ্য এল, তিনি দায়ান এবং ইভরিকে না জানিয়ে সরাসরি বিমান বাহিনীর অপারেশন্স বিভাগের প্রধান এভিয়েম সেলার কাছে গেলেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Aviem_Sella
এভিয়েম সেলাকে নিয়ে এইতান একটি এফ-৪ ফাইটার জেটে চড়ে বসলেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/McDonnell_Douglas_F-4_Phantom_II
সেলা যখন জানতে চাইলেন তারা কোথায় যাচ্ছেন, এইতান তখন উত্তর দিলেন,
“আমরা বৈরুতে বিমান হামলা করতে যাচ্ছি।”
তারা উড়ে চললেন পশ্চিম বৈরুতের একটি অফিস ব্লকের উদ্দেশ্যে, যেখানে সল্ট ফিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ইয়াসির আরাফাতের একটি মিটিংয়ে যোগ দেয়ার কথা ছিল। নির্দিষ্ট বিল্ডিংটির উপরে পৌঁছে এইতান পরপর দু'টি বোমা নিক্ষেপ করেন। কিছুক্ষণ পর ঘুরে এসে তিনি আরো একটি বোমা নিক্ষেপ করেন বিল্ডিংটির ধ্বংস নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু সেদিনও ইয়াসির আরাফাত নির্ধারিত সময়ে মিটিংয়ে হাজির না হওয়ায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। শ্যারন সিদ্ধান্ত নিলেন, আরাফাতকে এমনভাবে হত্যা করতে হবে যেন সেটাকে দুর্ঘটনা বলে মনে হয়। অপারেশন সল্ট ফিশের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দিলেন অপারেশন গোল্ডফিশ। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, আরাফাতকে হত্যা করার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হবে গভীর সমুদ্রের উপর তার প্লেন মিসাইল দিয়ে ধ্বংস করে দেয়া। তারা ভূমধ্যসাগরের উপর নির্দিষ্ট এলাকা বাছাই করে ফেললেন যা কোনো রাডারের আওতাভুক্ত না, কিন্তু যার উপর দিয়ে বাণিজ্যিক বিমান নিয়মিত যাতায়াত করে। ফলে সেখানে যদি মিসাইলের মাধ্যমে হামলা করা হয়, তার কোনো প্রমাণ থাকবে না। ঐ স্থানের সমুদ্রের গভীরতা এত বেশি ছিল যে, বিমান বিধ্বস্ত হলেও সেটা সন্ত্রাসী হামলা ছিল নাকি নিছকই দুর্ঘটনা সেটা কেউ জানতে পারবে না। ইসরায়েলি বিমান বাহিনীকে সেসময় একটি বোয়িং ৭০৭ বিমানের মধ্যে রাডার স্থাপন করে সমুদ্রের উপর অস্থায়ী উড়ন্ত কমান্ড পোস্ট সৃষ্টি করতে হয়েছিল কমান্ড সেন্টারের মধ্য থেকে অপারেশন পরিচালনা করার জন্য।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Boeing_707
শ্যারনের নির্দেশে চারটি এফ-১৬ এবং এফ-১৫ ফাইটার জেটকে সদা প্রস্তুত রাখা হয়েছিল, যেন নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে তারা উড়ে গিয়ে আক্রমণ করতে পারে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/General_Dynamics_F-16_Fighting_Falcon
https://en.m.wikipedia.org/wiki/McDonnell_Douglas_F-15_Eagle
১৯৮২ সালের নভেম্বর-১৯৮৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ইসরায়েলি বিমান বাহিনী এই অপারেশনের আওতায় অন্তত পাঁচটি প্লেন ধ্বংস হওয়ার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেলেও শেষ মুহূর্তে অপারেশনগুলো বাতিল করা হয়। এক্ষেত্রে
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন আমানে'র গবেষণা বিভাগের পরিচালক আমোস গিলবোয়া।
https://www.thriftbooks.com/a/amos-gilboa/822350/
তার দায়িত্ব ছিল যেকোনো অপারেশনের পর তার রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক ফলাফল কী হতে পারে তা বিশ্লেষণ করা। তার বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী প্লেন ধ্বংস করার মতো এ ধরনের অধিকাংশ পরিকল্পনা যদি সফল হতো, তাহলে শেষ পর্যন্ত তা ইসরায়েলের জন্য ক্ষতিকর হতো। এরিয়েল শ্যারন এবং রাফায়েল এইতান ইয়াসির আরাফাতকে হত্যার ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর হলেও সবাই তাদের সাথে সব বিষয়ে একমত ছিলেন না। অনেক ক্ষেত্রে পরিষ্কার নির্দেশ পাওয়া সত্ত্বেও তারা কখনো রেডিও'র ফ্রিকোয়েন্সি ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বল করে যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটিয়ে, কখনো ভুল তথ্য দিয়ে, কখনো প্লেন খুঁজে না পাওয়ার অযুহাত দেখিয়ে হামলাগুলো ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। ততদিনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি ইসরায়েলি জনগণও এরিয়েল শ্যারনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল।আন্তর্জাতিক সমালোচনায় এবং জনগণের চাপে বৈরুত শরণার্থী শিবিরে সংঘটিত বর্বর হত্যাকান্ডে এরিয়েল শ্যারনের ভূমিকা তদন্ত করার জন্য বিশেষ কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী বেগিন। কমিশন খ্রিস্টানদের হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী করলেও তারা এটাও উল্লেখ করে যে, শ্যারনই তাদের সেখানে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিলেন। শ্যারনকে পদত্যাগ করতে হয়। ২০০১ সালে শ্যারন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রথম দিকে বুশ প্রশাসের সাথে সমোঝতায় এসে শ্যারন অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ স্থগিত এবং আরাফাতকে হত্যার লক্ষ্য থেকে সরে আসলেও শেষপর্যন্ত তিনি আবারও পুরনো নীতিতে ফিরে যান। ২০০৪ সালের ২২শে মার্চ অবরুদ্ধ গাজাতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারের গানশিপ থেকে গুলি করে হত্যা করে হামাসের প্রধান শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Attack_helicopter
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ahmed_Yassin
এপ্রিলের ২৩ তারিখ সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎকারে এরিয়েল শ্যারন জানান, বুশ প্রশাসনের সাথে তার পুরনো সমঝোতা অনুযায়ী চলতে তিনি বাধ্য নন। সেই অঙ্গীকার এখন আর কার্যকর না। সাংবাদিকরা যখন তাকে আবার জিজ্ঞেস করে, এর অর্থ কি তিনি প্রয়োজনে ইয়াসির আরাফাতের উপরও আক্রমণ করবেন? উত্তরে শ্যারন বলেন,
“আমি মনে করি না, ব্যাপারটি এর চেয়ে আর পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।”
কিছুদিনের মধ্যে ইয়াসির আরাফাত হঠাৎ করে রহস্যজনকভাবে অসুস্থ হয়ে স্ট্রোক করেন। ২০০৪ সালের ১১ই নভেম্বর ফ্রান্সের একটি হাসপাতালে মৃত্যু ঘটে তার।
https://youtu.be/KBT7o0piZ8E
https://youtu.be/qr2DULWPzAs
https://www.thriftbooks.com/a/amos-gilboa/822350/
তার দায়িত্ব ছিল যেকোনো অপারেশনের পর তার রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক ফলাফল কী হতে পারে তা বিশ্লেষণ করা। তার বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী প্লেন ধ্বংস করার মতো এ ধরনের অধিকাংশ পরিকল্পনা যদি সফল হতো, তাহলে শেষ পর্যন্ত তা ইসরায়েলের জন্য ক্ষতিকর হতো। এরিয়েল শ্যারন এবং রাফায়েল এইতান ইয়াসির আরাফাতকে হত্যার ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর হলেও সবাই তাদের সাথে সব বিষয়ে একমত ছিলেন না। অনেক ক্ষেত্রে পরিষ্কার নির্দেশ পাওয়া সত্ত্বেও তারা কখনো রেডিও'র ফ্রিকোয়েন্সি ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বল করে যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটিয়ে, কখনো ভুল তথ্য দিয়ে, কখনো প্লেন খুঁজে না পাওয়ার অযুহাত দেখিয়ে হামলাগুলো ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। ততদিনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি ইসরায়েলি জনগণও এরিয়েল শ্যারনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল।আন্তর্জাতিক সমালোচনায় এবং জনগণের চাপে বৈরুত শরণার্থী শিবিরে সংঘটিত বর্বর হত্যাকান্ডে এরিয়েল শ্যারনের ভূমিকা তদন্ত করার জন্য বিশেষ কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী বেগিন। কমিশন খ্রিস্টানদের হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী করলেও তারা এটাও উল্লেখ করে যে, শ্যারনই তাদের সেখানে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিলেন। শ্যারনকে পদত্যাগ করতে হয়। ২০০১ সালে শ্যারন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রথম দিকে বুশ প্রশাসের সাথে সমোঝতায় এসে শ্যারন অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ স্থগিত এবং আরাফাতকে হত্যার লক্ষ্য থেকে সরে আসলেও শেষপর্যন্ত তিনি আবারও পুরনো নীতিতে ফিরে যান। ২০০৪ সালের ২২শে মার্চ অবরুদ্ধ গাজাতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারের গানশিপ থেকে গুলি করে হত্যা করে হামাসের প্রধান শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Attack_helicopter
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ahmed_Yassin
এপ্রিলের ২৩ তারিখ সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎকারে এরিয়েল শ্যারন জানান, বুশ প্রশাসনের সাথে তার পুরনো সমঝোতা অনুযায়ী চলতে তিনি বাধ্য নন। সেই অঙ্গীকার এখন আর কার্যকর না। সাংবাদিকরা যখন তাকে আবার জিজ্ঞেস করে, এর অর্থ কি তিনি প্রয়োজনে ইয়াসির আরাফাতের উপরও আক্রমণ করবেন? উত্তরে শ্যারন বলেন,
“আমি মনে করি না, ব্যাপারটি এর চেয়ে আর পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।”
কিছুদিনের মধ্যে ইয়াসির আরাফাত হঠাৎ করে রহস্যজনকভাবে অসুস্থ হয়ে স্ট্রোক করেন। ২০০৪ সালের ১১ই নভেম্বর ফ্রান্সের একটি হাসপাতালে মৃত্যু ঘটে তার।
https://youtu.be/KBT7o0piZ8E
https://youtu.be/qr2DULWPzAs
Comments