সমাজতান্ত্রিক আলবেনিয়া

 

বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো, বসনিয়া, রোমানিয়াসহ বেশ কিছু দেশ নিয়ে বলকান অঞ্চল গঠিত। অটোমান শাসনামলে তুর্কিরা বলকান অঞ্চলের অনেকটা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। আলবেনিয়া এসময় তুর্কি শাসনের অধীনে ছিল। অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো আর গ্রিস বলকান অঞ্চলে তুর্কিদের যুদ্ধে পরাস্ত করে। ডামাডোলের মধ্যে আলবেনীয় নেতা ইসমাইল কেমালি স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ismail_Qemali

১৯২৫ সালে আলবেনীয় প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। তবে তিন বছর পর ক্ষমতা চলে যায় রাজপরিবারের হাতে। রাজা জগু রক্ষণশীল শাসনে মুড়ে ফেলেন দেশটিকে।

https://www.historytoday.com/archive/king-zog-i-albania

১৯৩৯ সালে মুসোলিনির ইতালী আলবেনিয়া দখল করে। ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত জার্মান আর ইতালীয় কর্মকর্তারা আলবেনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতো। দখলদারিত্বের মধ্যেই দেশটির কমিউনিস্টরা গড়ে তোলে ‘আলবেনিয়ান ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি’।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/National_Liberation_Movement_(Albania)

প্রায় লক্ষাধিক গেরিলা এই বাহিনীর হয়ে ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৪৪ সালের নভেম্বরে আলবেনিয়া মুক্ত হয়। পরে যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধেও আলবেনিয়া সৈন্য পাঠায়। রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং এনভার হোক্সার নেতৃত্বে ১৯৪৬ সালে পিপলস রিপাবলিক অব আলবেনিয়া নামের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। দক্ষিণ আলবেনিয়ার এক ছোট্ট শহরে এনভার হোক্সার জন্ম হয় ১৯০৮ সালে। বাবা কাপড় বেচতেন। হোক্সা পড়াশোনায় ভাল ছিলেন। স্কুল-কলেজ শেষ করে তিনি প্যারিসে যান পড়তে। সেখানে রাজতন্ত্র বিরোধীদের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। হোক্সা পড়াশোনা শেষ না করে দেশে ফিরে আসেন। হোক্সা রাজনীতি নিয়ে সচেতন হলেও রাজনীতি করতেন না। আলবেনিয়াতে ছোটখাট নানা কাজ করে সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। ফ্যাসিস্ট ইতালী আলবেনিয়া দখল করে নিলে তিনি তার এক কমিউনিস্ট বন্ধুর সূত্রে আলবেনিয়ার সমাজতান্ত্রিকদের সাথে জড়িয়ে পড়েন।

https://www.theguardian.com/books/2016/apr/30/enver-hoxha-iron-fist-of-albania-blendi-fevziu-review

হোক্সা ছিলেন দক্ষ বাগ্মী এবং রাজনৈতিক সংগঠক। দ্রুত তিনি আলবেনীয় সমাজতান্ত্রিকদের নেতা হয়ে দাঁড়ান। কসোভো প্রশ্নে জোসেফ টিটোর সাথে তিনি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। টিটো স্বীকার করতেন যে কসোভো আলবেনীয় জমি। কিন্তু বলে বেড়াতেন কসোভোর মারমুখী সার্বদের শান্ত রাখবার জন্য ঐ অঞ্চলকে আলবেনিয়ার হাতে তুলে দেয়া যাবে না। এসব বিরোধ সত্ত্বেও যুদ্ধে দুই পক্ষ একসাথে লড়তো। ১৯৪৪ সালে স্বাধীন হওয়ার পর এনভার হোক্সা আলবেনিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হয়ে রাজতন্ত্রকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। হোক্সা যখন ক্ষমতায় বসেন তখন দেশের সিংহভাগ লোক অশিক্ষিত, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই, অর্থনীতির অবস্থা খুব খারাপ। দশ লক্ষ লোকের মধ্যে আশি হাজার মানুষ যুদ্ধের কারণে নিহত, আহত বা বন্দী হয়। সোভিয়েত সাহায্য পেয়ে হোক্সা আলবেনিয়াকে অনেক এগিয়ে নেন। স্তালিনের মতো তিনি আলবেনিয়াতে পরিকল্পিত অর্থনীতির প্রচলন করেছিলেন। টিটো চাইতেন আলবেনিয়া অন্যান্য স্লাভ দেশগুলোর মতো যুগোশ্লাভিয়াতে যোগদান করুক। আলবেনিয়ার ব্যবসা বাণিজ্যের ওপর যুগোশ্লাভরা কড়া সব আইন কানুন প্রয়োগ করে। অন্যদিকে হোক্সা ছিলেন স্তালিনপন্থী। বিপুল অর্থ সাহায্য পেয়ে তিনি নিজের দেশে নানা শিল্প গড়ে তুলেন। ১৯৪৮ সালের দিকে আলবেনিয়ার সাথে যুগোশ্লাভিয়ার সম্পর্ক একদম নষ্ট হয়ে যায়।

http://www.acarindex.com/dosyalar/makale/acarindex-1423902522.pdf

স্তালিন মারা গেলে ক্ষমতায় আসেন ক্রুশ্চেভ। তিনি যুগোশ্লাভিয়ার সাথে সম্পর্ক ভালো করার দিকে জোর দেন। ফলশ্রুতিতে তিনি হোক্সার শত্রু হয়ে দাড়ান। মূলত ক্রুশ্চেভের কারণে হোক্সা ঝুঁকে পড়েন সমাজতান্ত্রিক চীনের দিকে। মাও সে তুং এর কাছে ক্রুশ্চেভের পশ্চিমা বিশ্বের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি মোটেও পছন্দ ছিল না। ১৯৬১ সালের পর সম্পর্ক আরো খারাপ হতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আলবেনিয়াকে সমস্ত সাহায্য দেয়া বন্ধ করে দেয়। অনানুষ্ঠানিকভাবে আলবেনিয়াকে ওয়ারশ চুক্তি থেকে বাদ দেয়া হয়।

https://www.history.com/this-day-in-history/the-warsaw-pact-is-formed

১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ করলে হোক্সা ওয়ারশ প্যাক্ট থেকে আলবেনিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরিয়ে নেন। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আর চীনা নেতা ঝৌ এন লাই এর সাক্ষাত এবং মাও পরবর্তী নেতা হুয়া গোয়োফেং এর নরমপন্থী বৈদেশিক নীতি হোক্সাকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Zhou_Enlai

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Hua_Guofeng

এসময় তিনি ক্রমেই চীনা আর সোভিয়েত শিবির থেকে আলাদা হয়ে পড়ছিলেন। এর ফলে সত্তরের দশকে হোক্সাইজম তত্ত্ব সৃষ্টি হয়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Hoxhaism

হোক্সাইজম চীন, যুগোশ্লাভিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের অভিযোগে দোষী মনে করে।

http://ciml.250x.com/to/question_dating_formation_hoxhaism_july_2015.html

হোক্সাইস্টদের মতে, স্তালিনীয় শাসনের মাধ্যমে প্রকৃত সমাজতন্ত্র আনা সম্ভব এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের সাথে যেকোনো রকমের বোঝাপড়া হচ্ছে আত্মহত্যার নামান্তর। লাতিন আমেরিকাসহ অনেক দেশে হোক্সার এই নীতি সমাদৃত হয়েছিল। আত্মনির্ভরশীল আলবেনিয়া গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে মাঠে নামলেন হোক্সা। অনেক সমাজতান্ত্রিক দেশের মতো আলবেনিয়াতে বিনামূল্যে শিক্ষা আর স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হতো। হোক্সার মতে দেশের সমস্ত লোককে যদি সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা যায়, তাহলে যুগোশ্লাভিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলেও আলবেনিয়া টিকে যাবে।

https://www.atlasobscura.com/places/bunkers-of-albania

দেশজুড়ে নিয়মিত সামরিক প্রশিক্ষণ আর মহড়ার আয়োজন করা হতো। গোপন পুলিশ সিগুরিমি দেশময় কড়া নজরদারি চালাতো।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Sigurimi

হোক্সার শাসনামলে আলবেনীয়রা বিদেশে যেতে পারতো না। পুরুষদের দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ ছিল। আলবেনিয়া ছিল বিশ্বের প্রথম স্বঘোষিত নাস্তিক দেশ। আলবেনিয়া শিক্ষার হারে পশ্চিমা বিশ্বের সমকক্ষ হয়ে ওঠে তার আমলে। রাজধানী তিরানায় স্থাপিত হয় দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। মেয়েদের উন্নতির জন্য হোক্সা অনেক চেষ্টা করেছিলেন। মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে সমানতালে অংশ নিতো। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি আর রাজনৈতিক পদে মেয়েরা আসীন ছিল। আশির দশকে আলবেনিয়ার মোট শ্রমশক্তির ৪৬% ছিল নারী, যা পশ্চিমা বিশ্বের থেকেও বেশি। তিনি দেশের কৃষিজমির সুষ্ঠু বিলি ব্যবস্থা করেছিলেন।




Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]