পশ্চিমাদের কর্মী শোষণ

 

ক্রাঞ্চিং বলতে গেম ডেভেলপারদের দীর্ঘসময় ধরে কাজ করাকে বোঝায়। আমেরিকায় একজন মানুষ সপ্তাহে গড়ে ৪৪-৪৫ ঘণ্টা কাজ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে মানুষের স্বাভাবিক কর্মঘণ্টা সপ্তাহে ৪০ এর কাছাকাছি। কিন্তু একজন গেম ডেভেলপারকে সাপ্তাহিক স্বাভাবিক কর্মঘণ্টার চেয়ে বাধ্য হয়ে বেশি কাজ করতে হয়। তাদের এই বাড়তি কাজের চাপ কখনো কখনো সপ্তাহে ১০০ ঘণ্টা বা তার বেশিও অতিক্রম করে। একজন ডেভেলপার অনেক সময় সাপ্তাহিক ছুটিটুকু উপভোগ করতে পারে না। এই বাড়তি শ্রমের জন্য তারা মাইনের বাইরে বেশি কিছু পায় না।

কর্মক্ষেত্রে অন্যান্য বৈষম্যও ক্রাঞ্চের পর্যায়ে পড়ে-

#ওভারটাইম কাজের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ মজুরি না দিয়ে অনেক কোম্পানি কর্মীদের ভবিষ্যত ছুটি ও ফ্রি মিল অফার করে।

#গেম ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি করার জন্য অনেকেই মুখিয়ে থাকার কারণে তারা অনেকসময় তাদের পদের জন্য বরাদ্দ বেতনের চেয়ে কম টাকা নিয়ে থাকে। এজন্য বেশি ঘণ্টা কাজ করেও তারা ঘণ্টার হিসেবে অনেক কম মজুরি পায়।

#অনেক ডেভেলপার ইন্ডাস্ট্রিতে স্বাধীন চুক্তির মাধ্যমে প্রবেশ করলেও তাদেরও বেতনভুক কর্মচারীর মতো বিবেচনা করা হয়। তারা ওভারটাইমের জন্য বেতন পায় না।

#অনেক কোম্পানি কর্মীদের এমন সব চুক্তি করতে বাধ্য করে, যেখানে লেখা থাকে কর্মীরা বাড়তি ক্ষতিপূরণ ছাড়া সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার বেশি কাজ করবে।

https://cotneycl.com/the-dangers-of-crunch-culture-part-1/

সত্তরের দশকে গেম ডেভেলপাররা ছিল সাধারণ কর্মী, সৃজনশীল নির্মাতা নয়। দ্য ইউনিভার্সিটি অভ টেক্সাস অ্যট অস্টিন এর অধ্যাপক ডেভিড কোহেন বলেন, সেসময় কর্তৃপক্ষ তাদের সাথে এমন আচরণ করতো যেন তাদের চাকরি দিয়ে উদ্ধার করেছে। বর্তমান সময়েও ক্রাঞ্চ বন্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো আইনি পথ নেই। জরিপে দেখা গেছে, বছরে একাধিকবার ক্রাঞ্চের স্বীকার হয় নির্মাতারা।

https://reporter.rit.edu/tech/crunch-culture-how-game-development-becomes-toxic

সাপ্তাহিক ৪০ ঘণ্টা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি কাজ করতে হয় তাদের। কখনো কখনো তা ১০০ ঘণ্টা পেরিয়ে যায়! বিখ্যাত গেমগুলোর নতুন নতুন ভার্সন রিলিজের জন্য গেমাররা মুখিয়ে থাকে। তাই শিডিউল মোতাবেক গেম মুক্তি দেয়ার জন্য নির্মাতাদের বেশি সময় ধরে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকতে হয়।

https://time.com/5603329/e3-video-game-creators-union/

আবার কখনো দেখা যায়, মুক্তির কিছুদিন আগে হঠাৎ কর্তৃপক্ষ গেমের গঠনে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন। প্রিভিউ ফুটেজ বা প্রি-রিলিজ বেটা টেস্টিংয়ের মাধ্যমে প্লেয়ারদের কাছ থেকে ফিডব্যাক পেয়ে সে অনুযায়ী চূড়ান্ত পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। যেমন- কোনো মোড বাদ দেয়া বা তার স্থলে নতুন কোনো মোড ইনস্টল করা, নতুন কারেক্টার বা ইভেন্ট যোগ করা ইত্যাদি। এতে গেম ডেভেলপারদের অল্প সময়ের মধ্যে নতুন করে প্রোগ্রাম লিখতে ও সম্পাদনা করতে হয়। কয়েক দশক আগে কনসোল গেমগুলো তৈরিতে ক্রাঞ্চ হতো শুধু গেম মুক্তির কয়েক সপ্তাহ আগে।

https://variety.com/2018/gaming/features/video-game-union-crunch-industry-practice-1202985642/amp/

কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে সাথে গেমের ধরন পাল্টাচ্ছে, গ্রাহকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় গেমের চাহিদা বাড়ছে, গেম নির্মাণে বেশি প্রাযুক্তিক দক্ষতা ও রিসোর্সের প্রয়োজন হচ্ছে। এতে ক্রাঞ্চের হার দিন দিন বেড়ে চলছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা আগে কম থাকায় বেশিরভাগ গেমের নিয়মিত কোনো আপডেটের প্রয়োজন হতো না। কিন্তু বর্তমানে গেম কনসোলগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি অংশ ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত।

https://www.businessinsider.in/slideshows/miscellaneous/grueling-100-hour-work-weeks-and-crunch-culture-are-pushing-the-video-game-industry-to-a-breaking-point-heres-whats-going-on-/slidelist/69254967.cms

তাই একটি গেম সারা বছর আপডেট হতে থাকে। আবার এর সাথে রয়েছে, 'ডাউনলোডেবল কনটেন্ট' বা ডিএলসি, যা গেমে অগ্রসর হওয়ার মাধ্যমে পাওয়া যায়। ডিএলসি হতে পারে নতুন অস্ত্র, চরিত্র, অ্যাভাটার, ম্যাপ ইত্যাদি।

নাথান অ্যালেন ওর্তেগা টেলটেইল-এ কাজ শুরু করেন ২০১৫ সালে। অতিরিক্ত পরিশ্রমে তার শরীরে আলসার বাসা বাঁধে।

২০০৪ সালের নভেম্বরে 'লাইভ জার্নাল' এর একটি ব্লগে গেইম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইলেক্ট্রনিক আর্টসের এক কর্মী'র স্ত্রী এরিন হফম্যান তার স্বামীর কর্মক্ষেত্রের ক্রাঞ্চ কালচার নিয়ে বলেছিলেন-

"আমার স্বামী গভীর রাতে ঘরে ফেরে মাথাব্যথা নিয়ে। এমন নিদারুণ ব্যথা, যা কখনো দূর হবে না। সাথে আছে হজমের সমস্যা। সেটিও দীর্ঘদিনের। এদিকে তার দিকে চেয়ে চেয়ে আমার পাশে থাকার নিশ্চয়তাসূচক হাসিটাও দিনে দিনে একঘেয়ে আর ম্লান হয়ে আসছে।"

২০১০ সালে রকস্টার গেমসের কয়েকজন কর্মীর স্ত্রী তাদের স্বামীর কর্মক্ষেত্রের পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খোলেন। ইএ স্পাউজ লেটারে কোম্পানির অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা, ওভারটাইম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।

টেলটেইল কোম্পানির সাবেক ডেভেলপার ব্র্যান্ডন কেবেঙ্কা টুইটারে তার সহকর্মীদের অবৈতনিক ওভারটাইম না করার আহ্বান জানিয়ে লেখেন-

"নিজেদের শরীরের দিকে খেয়াল রাখুন। কোম্পানি আপনাদের দু' পয়সার মূল্যও দেয় না।"

গেম ডিজাইনার বায়রন অ্যাটকিনসন-জোন্স ব্রিটিশ ও কানাডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার সময় ক্রাঞ্চের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন-

"গেম ইন্ডাস্ট্রিতে আমার প্রথম চাকরিজীবনে আমি পাগলের মতো কাজ করেছিলাম। তো একরাতে আমরা কয়েকজন মিলে ঠিক করলাম, যথাসময়ে বাড়ি ফিরবো। কিন্তু কপালের ফেরে সেদিনই কোম্পানির এক ডিরেক্টর আমাদের কাজের ঘর খালি দেখে ফেলেন। তখন সন্ধ্যা সাতটা। পরদিন সকালে আমাদের মিটিং রুমে নিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হলো যদি আমরা রাতে তাড়াতাড়ি কাজ ছেড়ে ফিরে যাই, তাহলে চাকরিটা আর বেশিদিন করতে পারবো না।"

অ্যাটারি'র প্রাক্তন কর্মী জ্যারেড রিয়াকে তার প্রথম চাকরিতে দৈনিক ১২ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়েছিল। তিনি বলেন-

"সকাল সাতটায় ঘর থেকে বেরোতাম, রাত ১১টার আগে ফিরতে পারতাম না। কয়েক সপ্তাহ পর আমার খাওয়া-দাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে গেলো। ঠিকমতো ঘুমাতেও পারতাম না। মনে হচ্ছিলো শরীর আর কাজ করছে না। গাড়িতে বসে লাঞ্চ ব্রেক কাটাতাম; ওই সময়টুকু কখনো একটু ঘুমিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতাম, নয়তো বসে বসে কাঁদতাম।"

জিল মুরে নামক এক গেম স্টোরি রাইটার জানায় মানসিক সমস্যা শুরু হলেও তার ম্যানেজাররা মোটেই তা বিশ্বাস করেনি। বরং কর্তৃপক্ষ মনে করতো যাদের এ চাপ নেয়ার মুরোদ নেই, এ ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের কোনো জায়গা নেই।

https://medium.com/@TexLedger/video-game-industry-faces-crunchtime-crisis-67ea4cae7184

২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া 'ফোর্টনাইট' প্রাথমিকভাবে জনপ্রিয়তা না পেলেও পরে 'ব্যাটল রয়াল' মোড যোগ করার পর গেমটি বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় গেমে পরিণত হয়। পলিগনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে একজন কর্মী জানিয়েছে, তিনি সপ্তাহে গড়ে ৭০ ঘণ্টা কাজ করেছেন।
ঐ ইন্ডাস্ট্রিতে তার মতো আরও শ'খানেক লোক রয়েছে, যাদের একই দুর্দশার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তিনি বলেন, এমন কর্মীও তার চেনা আছে যারা সপ্তাহে ১০০ ঘণ্টা কাজ করেছে। আরেকজন জানিয়েছে তিনি কদাচিৎ ঘুমোতেন, বাসায় সবসময় মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকতো। কোনো সপ্তাহান্তে ছুটি পাওয়া তার কাছে বিশাল কিছু বলে মনে হতো।

#২০১৮ সালের অক্টোবরে মুক্তি পাওয়া 'রেড ডেড রিডেম্পশন ২' গেমটি তৈরিতে সময় লেগেছে প্রায় ৭ বছর! হাজার রকমের অ্যানিমেশন, অসংখ্য সংলাপ আর ৬০ ঘণ্টার গল্প নিয়ে তৈরী গেমটি তৈরিতে অনেককে সপ্তাহে ১০০ ঘণ্টা কাজের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। ভালচারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন সব তথ্য জানায় রকস্টার গেমস এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ড্যান হাউজার। গেমিং ওয়েবসাইট কোটাকু এরপর ৭৫ জনের বেশি সাবেক ও বর্তমান কর্মী'র সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

https://kotaku.com/inside-rockstar-games-culture-of-crunch-1829936466

কর্মীরা সপ্তাহের ছয়দিন দৈনিক ৫৫ থেকে ৬০ ঘণ্টা কাজ করার অভিযোগ করে। তারা আরও জানায়, তাদের যতদূর সম্ভব বাড়তি ওভারটাইম খাটার জন্য বাধ্য করা হয়েছিল। এসময় কর্মীরা কাজের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়া বা চাকরি হারানোর ভয়ে থাকতো। এতে তাদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্ণতা সৃষ্টি হয়।

https://www.digitaltrends.com/gaming/video-game-companies-accused-of-crunch/

#২০১৯ সালের প্রথমদিকে 'অ্যানথেম' ও 'মাস ইফেক্ট: অ্যান্ড্রোমিডা' গেমগুলোর নির্মাতা বায়োওয়্যার ক্রাঞ্চের জন্য অভিযুক্ত হয়। 'অ্যানথেম' তৈরির সময় দুর্বল পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা ক্রাঞ্চ সৃষ্টি করে। গেমটি নির্মাণের একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে গল্পে অনেক পরিবর্তন আনা হয়, যা ডেভেলপারদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।

#অ্যাক্টিভিশন এর ট্রেয়ার্ক স্টুডিও 'কল অভ ডিউটি: ব্ল্যাক অপস ৪' বানাতে গিয়ে অনেকে ক্রাঞ্চের শিকার হয়। 'ক্যাম্পেইন মোড' বাদ দিয়ে তার স্থলে 'ব্যাটল রয়াল মোড' চালু ও অগমেন্টেশন ইত্যাদি কারণে কর্মীদের কর্মঘণ্টা বেড়ে যায়। কোটাকু এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে গেমটির মান নিশ্চায়ক দল। তাদের সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়।

#এপিক গেইমস এর মাস্টারপিস 'ফোর্টনাইট' এর জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে গিয়ে কর্মীরা ক্রাঞ্চের শিকার হয়। পলিগন এর রিপোর্ট অনুযায়ী আপডেট, ডিএলসি, প্যাচ রিপোর্ট ইত্যাদির জন্য কর্মীদের সপ্তাহে ৭০-১০০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়েছিল।

#ভ্যারাইটিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে টেলটেইল এর সাবেক কর্মী জব স্টফার জানায়, কোম্পানিটিতে চিরস্থায়ী ক্রাঞ্চ বিদ্যমান। প্লেয়ারদের ফিডব্যাকের ওপর নির্ভর করে কোম্পানিটি নিয়মিত গেমের সংস্কার করতো।

#মর্টাল কমব্যাট এর জনক নেদাররিয়ালম কোম্পানিতে ২০১১ সাল থেকে ক্রাঞ্চ কালচারের অভিযোগ ওঠে। একজন কর্মী জানায়, তিনি নেদাররিয়ালম এ কাজ করার সময় দিনে ১৪ ঘণ্টাও কাজ করেছিলেন।

এপিক গেমস এর 'ফোর্টনাইট' তৈরির সময় ক্রাঞ্চের কথা প্রথম প্রকাশ্যে আনেন পলিগন এর সাংবাদিক কলিন ক্যাম্পবেল। তিনি জানান, তার সাথে তখন অনেক কর্মী কথা বলতে চায়নি। অধিকাংশ কর্মী ভয়ে ছিল যে, সাংবাদিকদের কাছে মুখ খুললে তাদের চাকরি চলে যাবে।
















Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]