ইয়েমেনে সৌদি, ইরানি আর মার্কিনিদের স্বার্থ

২০১৫ সালের মার্চে সৌদি আরবের নেতৃত্বে 
সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, মিশর, জর্ডান, মরক্কো, সেনেগাল ও সুদান মিলে আক্রমণ শুরু করে ইয়েমেনের হুতিদের বিরুদ্ধে এবং সামরিক সাহায্য দিতে শুরু করে সৌদি সমর্থিত ইয়েমেনের মনসুর হাদি সরকারকে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Saudi_Arabian-led_intervention_in_Yemen

প্রথম চার সপ্তাহ ধরে চলে 'অপারেশন ডিসিসিভ স্টর্ম', এরপর শুরু হয় 'অপারেশন রিস্টোরিং হোপ'। এসব দেশকে সমর্থন দেয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স। অন্যদিকে হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয় ইরান ও রাশিয়া।

https://www.cfr.org/article/yemens-spiraling-crisis

ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা আয়াতুল্লাহ খোমেনি সৌদি আরবকে সরিয়ে আঞ্চলিক নেতৃত্বের স্থানে ইরানকে বসানোর চেষ্টা করেন। দুই দেশের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে মক্কা ও মদীনার দুই মসজিদের সেবক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা।

https://www.ft.com/content/bf963377-12cf-4ace-8aa5-484f18b603ba

প্রথাগতভাবে সৌদি আরব এই দুই মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেয় এবং নিয়ন্ত্রণ করে আঞ্চলিক রাজনীতি। আশির দশকেই ইরানের সাথে ইরাকের যুদ্ধে সৌদি আরব সমর্থন দেয় ইরাককে, দেয় সামরিক সাহায্য।

https://www.bbc.com/news/world-middle-east-42008809

সিরিয়াতে ইরান টিকিয়ে রেখেছে বাশার আল আসাদের সরকারকে, আর সৌদি আরবের সমর্থন পেয়েছে বিদ্রোহীরা। লেবাননে ইরানের সমর্থক হচ্ছে হিজবুল্লাহ, অন্যদিকে সৌদি আরবের সমর্থন ছিল সাদ হারিরির প্রতি।

https://www.middleeasteye.net/opinion/why-saudi-arabia-cannot-go-war-iran

ইয়েমেনে মনসুর হাদির সরকারের সমর্থনে সামরিক হামলা চালিয়েছে সৌদি আরব, আর ইরান সমর্থন দিয়েছে হুতিদের। দুই পক্ষ নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে বিপুল সামরিক ব্যয় করেছে, চেষ্টা করেছে কৌশলগত অবস্থানগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে। দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থান দীর্ঘায়িত করেছে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধকে।

https://www.wsj.com/articles/saudi-arabia-and-iran-four-proxy-conflicts-explained-1512772971

জলপথে বাণিজ্য হওয়া তেলের ৩০% পরিবাহিত হয় হরমুজ প্রণালী দিয়ে, অপরিশোধিত তেলের ৮৫% পরিবাহিত হয় এই পথে। প্রতিদিন পরিবাহিত হওয়া মোট তেলের পরিমাণ প্রায় ২০ মিলিয়ন ব্যারেল। এই তেল রপ্তানি হয় জাপান, ভারত, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ায়।

https://www.worldoil.com/news/2021/2/26/all-eyes-on-opec-as-global-oil-supply-imbalance-may-force-an-output-revision

হরমুজ প্রণালীর উপর নির্ভরশীল সৌদি আরবের তেল রপ্তানি। প্রণালীটির অপর পাড়ে রয়েছে ইরান, যারা প্রণালীকে কেন্দ্র করে সাজিয়েছে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। যেকোনো সময় ইরান হরমুজ প্রণালীতে অস্থিরতা তৈরি করলে সৌদি আরবকে তেল সরবারহের বিকল্প পথ হিসেবে ঝুঁকতে হবে লোহিত সাগরের দিকে। এই বিকল্প রাস্তায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান হলো এডেন বন্দর, যেখানে দুই পাড়ের দূরত্ব মাত্র ১৮ কিলোমিটার।

https://www.newsweek.com/yemen-civil-war-us-saudi-arabia-airstrikes-houthi-rebels-587018

এজন্যই ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণ সবসময় সৌদি আরব ও ইরানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এডেন বন্দরে হুতিদের পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপিত হলে ইরান দুই দিক থেকে সৌদি আরবের তেল রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারবে। এই সমীকরণকে মাথায় রেখে উভয় পক্ষ বিপুল বিনিয়োগ করেছে ইয়েমেন সংকটে। ২০১৫ সালে যখন সালমান ইবনে আব্দুল আজিজ সৌদি আরবের বাদশাহ হিসেবে মনোনীত হন, তখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন তার পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানকে।

https://www.brookings.edu/blog/order-from-chaos/2019/08/15/saudi-arabia-and-the-civil-war-within-yemens-civil-war/

প্রিন্স সালমান শুরু থেকে চেষ্টা করতে থাকেন সৌদি আরবের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার, তিনি চাইছিলেন নিজের রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি করতে। নিজেকে দাদা আবদুল আজিজ ইবনে সউদের যোগ্য উত্তরসূরি প্রমাণের চেষ্টা ছিল তাতে। সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ ইবনে সউদ বেশ কয়েকবার হস্তক্ষেপ করেছিলেন ইয়েমেনের রাজনীতিতে, সামরিক অভিযান চালিয়েছেন বেশ কয়েকবার; নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন আসির, তিহামার মতো শহরগুলো।

https://www.slow-journalism.com/delayed-gratification-magazine/why-yemens-civil-war-is-personal-for-mohammed-bin-salman-saudi-arabias-involvement-in-yemen-explained

প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রথম বড় পদক্ষেপ ছিল ইয়েমেন আক্রমণ। সৌদি আরবের অর্থনীতির উপর চাপ তৈরি করছে ইয়েমেনের যুদ্ধ, সৌদি আরবে আসছে হাজারো শরণার্থী এবং সীমান্তে বাড়ছে চোরাকারবার।

https://www.aljazeera.com/news/2016/4/25/yemen-war-al-qaeda-fighters-leave-mukalla

এসবের পরও ইয়েমেনের যুদ্ধ থেকে সৌদি আরব নিজেদের প্রত্যাহার করতে পারছে না, কারণ মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য ইয়েমেন যুদ্ধে জয় প্রয়োজন। এ কারণে দীর্ঘায়িত হচ্ছে ইয়েমেন যুদ্ধ।

https://studies.aljazeera.net/en/reports/covid-19-lingering-conflict-and-regional-balance-power-yemen

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু কারণে ইয়েমেন সংকট সমাপ্তিতে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখেনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভাব ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের, স্নায়ুযুদ্ধের পরিসমাপ্তি আর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর আবির্ভূত হয় একক পরাশক্তি হিসেবে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আধিপত্যবাদ আবর্তিত হয় সৌদি আরবকে কেন্দ্র করে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক সৌদি আরব। ফলে নিজেদের আধিপত্যবাদ বজায় রাখতে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের দিকে ঝুঁকেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
তাছাড়া ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের অংশগ্রহণের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে। ওবামা প্রশাসনের শেষ সময় থেকে বিপুলভাবে বেড়েছে সৌদি আরবের অস্ত্র ক্রয়, সৌদি আরব হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা। নিজেকে সেরা প্রেসিডেন্টদের কাতারে নিয়ে যেতে অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রয়োজন ছিল বারাক ওবামার, তাই তিনি সক্রিয় কোনো ভূমিকা নেননি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে। ট্রাম্প প্রশাসনের নজর নিবদ্ধ ছিল ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যে বৈধতা দেয়ার দিকে, সেই কাজে সৌদি আরব সঙ্গী হওয়ায় আড়ালে পড়ে যায় ইয়েমেন সংকট। 

 

















































































Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]