সরাসরি আক্রমণ না করেও

 

নব্বইয়ের দশকে পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডিট বিশ্ব মানচিত্রকে বিভাজিত করেন ব্রান্ডিট লাইন দিয়ে। ব্রান্ডিট রেখার উত্তরে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপসহ প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। এশিয়া মহাদেশ থেকে এ রেখার উত্তরে আছে দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডও পড়েছে এই রেখার উত্তরে। দক্ষিণে আছে লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল আর উন্নয়নশীল এশিয়ার দেশগুলো, মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলো এই রেখার দক্ষিণে, আছে উপ-সাহারা অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো। সম্পদশালী উত্তরের রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি, দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর অর্ধেকের বেশি নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ব্রান্ডিট রেখার দক্ষিণে আছে ১৪৪টি রাষ্ট্র, বাকি রাষ্ট্রগুলো পড়েছে এর উত্তরে। বৈশ্বিক জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ বাস করে উত্তরে, বাকি ৮০% লোক বাস করে দক্ষিণে। বৈশ্বিক অর্থের এক-পঞ্চমাংশ দক্ষিণের নিয়ন্ত্রণে, বাকি অংশটা সম্পদশালী উত্তরের নিয়ন্ত্রণে। দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর গড় মাথাপিছু আয় যেখানে ২৭৮০ ডলার, সেখানে উত্তরের রাষ্ট্রগুলোর গড় মাথাপিছু আয় ৪২ হাজার ৪১৫ ডলার। আমদানি-রপ্তানির আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ বেশি উত্তরের রাষ্ট্রগুলোর, নারীর ক্ষমতায়নে পিছিয়ে আছে দক্ষিণ। তারা পিছিয়ে আছে গড় আয়ুর হিসাবে, পিছিয়ে আছে শিশুমৃত্যুর হারে, অর্ধেক মানুষের নেই স্যানিটেশন সুবিধা। দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোতে মোবাইল নেটওয়ার্কের সাম্প্রতিক সময়ে বিপুল সম্প্রসারণের পরও তারা পিছিয়ে আছে উত্তরের রাষ্ট্রগুলো থেকে, পিছিয়ে আছে সেবার মানের দিক থেকে। উত্তরের আগ্রাসী পদক্ষেপের ফলে দক্ষিণের অধিকাংশ প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ উত্তরের কাছে। এর ফলে গড়ে ওঠেনি পরিণত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, বিকশিত হয়নি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। সাম্রাজ্যবাদের যুগে দক্ষিণের অধিকাংশ রাষ্ট্র ছিল উত্তরের রাষ্ট্রগুলোর উপনিবেশ শাসনের অধীনে। লাতিন আমেরিকার দেশগুলো স্বাধীনতা পেয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে, এশিয়ার দেশগুলো পেয়েছে বিংশ শতাব্দীতে। আফ্রিকার উপ-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলো স্বাধীনতা পেয়েছে গত শতাব্দীতে। সাম্রাজ্যবাদের যুগে ভিন্ন ভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল শাসন করেছে, কিন্তু সব শক্তি-সম্পদ লুট করে পাচার করেছে উত্তরে। ক্রমেই সম্পদশালী হয়েছে উত্তরের রাষ্ট্রগুলো, আর দারিদ্র্যচক্রে বাঁধা পড়েছে দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলো। ইউরোপে শিল্পবিপ্লব শুরু হওয়ার পর উত্তরের প্রায় সকল রাষ্ট্র প্রযুক্তিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের মাধ্যমে সু্যোগ পেয়েছে দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর উপর প্রভাব বিস্তারের। দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলো দক্ষ জনশক্তি না থাকায় প্রযুক্তির ব্যবহারে রয়েছে পিছিয়ে, অধিকাংশ খাত এখনও শ্রমনির্ভর রয়ে গেছে। শিল্প বিপ্লবের পর উত্তরের রাষ্ট্রগুলো দ্রুত শিল্পায়নের দিকে গেছে, দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলো এখনো রয়ে গেছে কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে। দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোতে শ্রমশক্তির ৬৫% কৃষিকাজের সাথে জড়িত। শ্রমনির্ভর এই অংশটা দক্ষিণের অর্থনীতিতে বড় সংযোজন করলেও উৎপাদনশীলতা কম হওয়ায় সেটা পিছিয়ে থাকে উত্তরের রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে। দক্ষিণের অধিকাংশ রাষ্ট্র শিল্পের প্রাথমিক কাঁচামাল রপ্তানি করে। উত্তরের রাষ্ট্রগুলো সেই কাঁচামাল ব্যবহার করে সেকেন্ডারি প্রোডাক্ট তৈরি করে অর্জন করে বিপুল মুনাফা। দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে স্বাক্ষরতার হার বাড়লেও মানসম্পন্ন শিক্ষা পৌঁছায় একটা ক্ষুদ্র অংশের কাছে। ফলে এই অংশটা দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তৈরি হয়না, উৎপাদনশীলতা থেকে যায় উত্তরের নাগরিকদের চেয়ে বহু কম। মানব উন্নয়ন সূচকে বরাবরই ভালো করছে উত্তরের রাষ্ট্রগুলো, পিছিয়ে আছে বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে থাকা দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলো। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ক্ষুদ্র অংশগ্রহণ থাকা দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোকে বাজারে টিকে থাকতে মুখোমুখি হতে হয় তীব্র প্রতিযোগিতার। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণের শুরুতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো যে পলিসি সমস্যার মুখোমুখি প্রথমে হয়, সেটা হলো তার অর্থনীতি কতটুকু উন্মুক্ত হবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য আর সামাজিক বৈশিষ্ট্য থাকা রাষ্ট্রগুলোতে কোন কোন খাত উন্মুক্ত হবে? বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ এরকম অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তি দেয় সকল খাত বেসরকারিকরণে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সে সুযোগ নেই। উন্মুক্ত বাজারে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো টিকতে পারবে না প্রতিযোগিতায়; স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো মৌলিক খাতগুলোর সেবা চলে যাবে জনগণের আয়ত্তের বাইরে।

অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে কোনো রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেয়া অর্থনৈতিক শাস্তি। বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই শাস্তি কার্যকর করা হয়। শাস্তিপ্রাপ্ত রাষ্ট্রটির নিকট পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া হতে পারে, রাষ্ট্রটির কাছ থেকে পণ্য আমদানি করা বন্ধ করা হতে পারে, বিদেশে থাকা রাষ্ট্রটির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে, রাষ্ট্রটির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত এরকম রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের ওপর অনুরূপ নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়া হতে পারে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা যখন চূড়ান্ত ও সর্বব্যাপী আকার ধারণ করে, তখন সেটিকে 'অর্থনৈতিক অবরোধ' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যখন শাস্তিপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে আর্থিক ও বাণিজ্যিক লেনদেন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন সেটিকে অর্থনৈতিক অবরোধ বলে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কার্যপদ্ধতি অর্থনৈতিক; কিন্তু প্রায়শই এর উদ্দেশ্য থাকে রাজনৈতিক, সামরিক বা সামাজিক কোনো লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা। সাধারণত কোনো রাষ্ট্র তার বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ স্বার্থ রক্ষার জন্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকে। কার্যত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি হাতিয়ার। দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের মধ্যে বাকযুদ্ধ এবং সশস্ত্র সংঘর্ষের মাঝামাঝি পর্যায় হলো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। কোনো রাষ্ট্রের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং এর মাধ্যমে রাষ্ট্রটিকে নিজের মর্জিমাফিক কাজ করতে বাধ্য করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকার পরিবর্তন। এক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে রাষ্ট্রটি অর্থনৈতিক দুর্দশার সম্মুখীন হবে এবং রাষ্ট্রটির নাগরিকদের জীবনমানের অবনতি ঘটবে। এর ফলে রাষ্ট্রটির জনসাধারণ ক্ষিপ্ত হয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন করবে এবং সরকারের পতন ঘটাবে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা একপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক এবং সার্বজনীন হতে পারে। কোনো রাষ্ট্রের ওপর যদি কেবল একটি রাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে সেটি একপাক্ষিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। যেমন- ২০১৫ সালে তুরস্ক রুশ বিমান ভূপাতিত করার পর তুরস্কের ওপর আরোপিত রুশ নিষেধাজ্ঞা ছিল একপাক্ষিক। কোনো রাষ্ট্রের ওপর যদি একাধিক রাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে সেটি বহুপাক্ষিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। যেমন- ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া কর্তৃক সম্মিলিতভাবে রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ছিল বহুপাক্ষিক। কোনো রাষ্ট্রের ওপর যদি বিশ্বের অন্য সকল রাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে সেটি সার্বজনীন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। সাধারণত জাতিসংঘ কর্তৃক কোনো রাষ্ট্রের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা হয় সার্বজনীন। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আমদানি এবং রপ্তানি উভয়ের ওপর আরোপিত হতে পারে। আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞার অর্থ কোনো রাষ্ট্র থেকে কিছু বা সকল পণ্য আমদানি হ্রাস কিংবা বন্ধ করা। অন্যদিকে রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞার অর্থ কোনো রাষ্ট্রের নিকট কিছু বা সকল পণ্য রপ্তানি হ্রাস কিংবা বন্ধ করা। সাধারণত কোনো রাষ্ট্রের নিকট রপ্তানি করার নিষেধাজ্ঞার চেয়ে কোনো রাষ্ট্রের কাছ থেকে আমদানি করার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ঐ রাষ্ট্রটির বেশি ক্ষতি করে, কারণ কোনো রাষ্ট্রের পণ্য আমদানি করা বন্ধ করে দিলে তার আয় হ্রাস পায়। অন্যদিকে কোনো রাষ্ট্রের কাছে পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিলে তারা সাধারণত সেই পণ্য নিজেদের দেশে উৎপাদন করার চেষ্টা করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন কর্তৃক ব্রিটেনের বিরুদ্ধে সৃষ্ট 'মহাদেশীয় ব্যবস্থা'য় ফ্রান্স ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রকে ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করেছিল। নেপোলিয়নের এই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়নি। নিষেধাজ্ঞার ফলে ব্রিটেনের যেমন ক্ষতি হচ্ছিলো, নিষেধাজ্ঞা আরোপে বাধ্য হওয়া ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোরও তেমনই ক্ষতি হচ্ছিলো। তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য করতে শুরু করে এবং এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা ফ্রান্সের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের মূল কারণ ছিল 'মহাদেশীয় ব্যবস্থা' উপেক্ষা করে রাশিয়া কর্তৃক ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্যে লিপ্ত হওয়া। ১৯৩৫ সালে বেনিতো মুসোলিনির নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদী ইতালি ইথিওপিয়া আক্রমণ করে এবং এর প্রত্যুত্তরে জাতিপুঞ্জ ইতালির ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই নিষেধাজ্ঞা ছিল অকার্যকর, কারণ ইতালির নিকট কিছু কিছু পণ্য রপ্তানি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলেও তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি কিংবা ইতালির জন্য সুয়েজ খাল বন্ধ করে দেয়া হয়নি। এর ফলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ইতালির সমরযন্ত্রকে অচল করতে পারেনি আর ইথিওপিয়ায় সৈন্য প্রেরণ আটকাতে পারেনি। ১৯৩৬ সালের মধ্যে ইতালি সম্পূর্ণ ইথিওপিয়া দখল করে এবং সেটিকে ইতালির উপনিবেশে পরিণত করে। একই বছর জাতিপুঞ্জ ইতালির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪০ সালে জাপান ফরাসি উপনিবেশ ইন্দোচীনে সৈন্য মোতায়েন করলে এর প্রত্যুত্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস ও চীন জাপানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং এর ফলে প্রাকৃতিক সম্পদবিহীন জাপানের জন্য তেল, লৌহ আকরিক ও ইস্পাত আমদানির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এই ঘাটতি পূরণ করতে জাপান 'ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ' আক্রমণ ও দখল করে এবং এর আগে এই অভিযানে যাতে কোনো বাধা না আসে সেটি নিশ্চিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার নৌঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়, ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৫৯ সালে কিউবান বিপ্লবের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্যকার সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে এবং ১৯৬২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার ওপর প্রায় পূর্ণ অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এখন পর্যন্ত এই অবরোধ বজায় আছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য কিউবায় কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটেনি। ১৯৯০ সালে ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখলের পর কুয়েত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার জন্য ইরাককে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরাকের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইরাক সৈন্য প্রত্যাহারে সম্মত হয়নি এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক জোটকে যুদ্ধের মাধ্যমে কুয়েত থেকে ইরাকিদের বিতাড়িত করতে হয়েছিল। ২০০৪ সালে ইউক্রেনে কমলা বিপ্লবের মাধ্যমে পশ্চিমাপন্থী ভিক্তর ইয়ুশ্চেঙ্কো ক্ষমতা লাভ করে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের জন্য সচেষ্ট হন। প্রত্যুত্তরে রাশিয়া ইউক্রেনকে কম দামে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো রুশ গ্যাসের জন্য যে মূল্য প্রদান করে, ইউক্রেনের কাছে সেই মূল্য দাবি করে। এর ফলে ইউক্রেনের জ্বালানি আমদানির ব্যয় চতুর্গুণ বৃদ্ধি পায় এবং ইউক্রেন এই মূল্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। ২০০৬ সালে রাশিয়া ইউক্রেনকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয় এবং ইউক্রেনীয় জনসাধারণ ভোগান্তির সম্মুখীন হয়। ইয়ুশ্চেঙ্কোর জনপ্রিয়তা দারুণভাবে হ্রাস পায় এবং ২০১০ সালের নির্বাচনে তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। ১৯৯৭ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুদানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছিল এবং তাৎক্ষণিকভাবে দেশটির সরকার পরিবর্তন না ঘটলেও দীর্ঘদিনব্যাপী চলমান নিষেধাজ্ঞার ফলে সুদানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ২০১৯ সালে সুদানে বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং রাষ্ট্রপতি ওমর আল বশির ক্ষমতাচ্যুত হন, এক্ষেত্রে মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের ফলে ইরানের মার্কিনপন্থী শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন এবং ইসলামপন্থী ও তীব্র মার্কিনবিরোধী শিয়া সরকার দেশটির শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে। তখন থেকে ইরানের সরকার পরিবর্তন করা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটি লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই উদ্দেশ্যে মার্কিনিরা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ১৯৭৯ সালে একদল ইরানি মিলিট্যান্ট তেহরানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস দখল করে নেয় এবং মার্কিন কূটনীতিকদের জিম্মি করে। প্রত্যুত্তরে ১৯৭৯ সালের ১৪ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থাকা ইরানি সরকারের সকল সম্পদ সাময়িকভাবে জব্দ করা হয়। জব্দকৃত সম্পত্তির মূল্য ছিল প্রায় ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ক্রমশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যের ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ১৯৮১ সালের ১৯ জানুয়ারি উভয় পক্ষের মধ্যে 'আলজিয়ার্স অ্যাকর্ড' স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্য দিয়ে ইরান জিম্মিকৃত মার্কিন নাগরিকদের মুক্তি দিতে সম্মত হয়, বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে জব্দকৃত সম্পত্তি ফিরিতে দিতে এবং অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নিতে রাজি হয়। ১৯৮৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের নিকট অস্ত্র বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং ইরানকে সকল প্রকার অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান বন্ধ করে দেয়। ১৯৮৭ সালে মার্কিন সরকার ইরানকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী গ্রুপগুলোকে সমর্থন প্রদান ও পারস্য উপসাগরে বেসামরিক জাহাজের ওপর আক্রমণ পরিচালনার দায়ে অভিযুক্ত করে ইরান থেকে সকল প্রকার পণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং মার্কিন নাগরিকদের ইরানের তেলশিল্পের সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত থাকতে নিষেধ করা হয়। তেল ইরানের প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ বিধায় ইরানি তেলশিল্পে মার্কিন বিনিয়োগের অভাব ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রত্যাহারের ফলে ইরান অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ১৯৯৬ সালে ইরানি পারমাণবিক প্রকল্প ও বিভিন্ন মিলিট্যান্ট গ্রুপের প্রতি ইরানি সমর্থনের কারণ দেখিয়ে মার্কিন কংগ্রেস 'ইরান নিষেধাজ্ঞা আইন' জারি করে। এই আইনের মাধ্যমে যেসব বিদেশি কোম্পানি ইরানি তেলশিল্পে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করবে, তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারির বিধান রাখা হয়। ২০১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে 'Comprehensive Iran Sanctions, Accountability and Divestment Act' জারির মধ্য দিয়ে ইরানের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় যেসব ফাঁকফোকর ছিল সেগুলো পূর্ণ করা হয়। এর আগ পর্যন্ত ইরান থেকে কিছু খাদ্যদ্রব্য ও কার্পেট আমদানির অনুমতি ছিল, কিন্তু এই আইনে সেগুলো নিষিদ্ধ করা হয় এবং এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত জরিমানা ও ২০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড প্রদানের বিধান রাখা হয়। ১০০ মার্কিন ডলার বা তার কম মূল্যের উপহার, তথ্য এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছাড়া ইরান থেকে অন্য কোনো কিছু নিয়ে আসার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। অনুরূপভাবে ১০০ মার্কিন ডলার বা তার কম মূল্যের উপহার, মানবিক সহায়তা, বিশেষ কিছু দ্রব্য, ঔষধ ও তথ্যসামগ্রী ছাড়া অন্য কোনো কিছু ইরানে প্রেরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কোনো ইরানি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞার মাত্রা আরো বৃদ্ধি করে। যেসব বিদেশি কোম্পানি ইরানি তেল ও রাসায়নিক শিল্পের জন্য যন্ত্রপাতি ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান ইরানি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে জড়িত, তাদের এই নিষেধাজ্ঞার আওতাধীনে আনা হয়। এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার দায়ে বেশ কয়েকটি মার্কিন, ব্রিটিশ, ফরাসি, জার্মান, ডাচ, চীনা ও আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইরানি পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য ইরানের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। ২০১৫ সালে ইরান ও ৬টি বৃহৎ শক্তির মধ্যে 'জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন' চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মধ্যে দিয়ে ইরান কর্তৃক ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করার বিনিময়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে সম্মত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মাত্রা হ্রাস করে। ফলে পরবর্তী দুই বছর ইরানি অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে বের হয়ে যায় এবং ইরানের ওপর পূর্বাপেক্ষা কঠোরতর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২০১৮ সালে জারিকৃত 'Countering America's Adversaries Through Sanctions Act' এর মাধ্যমে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পে জড়িত থাকা, ইরানের নিকট অস্ত্র বিক্রি বা ইরানি ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে যেকোনো রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন। নতুন এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ২০১৮ সালে ইরানের জিডিপি ৪.৮% এবং ২০১৯ সালে ৯.৫% হ্রাস পায়। ইরানে ব্যাপক হারে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় এবং ইরানি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মাত্র ১০% এর ওপর ইরানের কর্তৃত্ব বজায় থাকে। ২০১৫-২০১৭ সালে ইরানের তেল রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, কিন্তু নতুন করে আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে এটি মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।   

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]