নানকিং গণহত্যা
১৯৩৭ এর শেষের দিকে জাপান চীন দখল করতে শুরু করেছে। মিত্র বাহিনীর সহায়তায় চীন জাপানের সাথে লড়াই করেছিল যেন প্যাসিফিক ও ইস্ট এশিয়ায় জাপানী প্রভুত্ব ঠেকানো যায়। এই লড়াইয়ে ২০ মিলিয়ন চীনা নাগরিক প্রাণ হারায়।
https://www.theguardian.com/books/2013/jun/06/china-war-japan-rana-mitter-review
২০ মিলিয়নের ১৭ মিলিয়নই ছিল নিরীহ চীনা বেসামরিক নাগরিক, যাদের নিরস্ত্র অবস্থায় নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে জাপানীরা। এক রক্তাক্ত লড়াইয়ে জাপানীদের হাতে সাংহাইয়ের পতন হওয়ার পর চীনা সৈন্যরা পিছু হটতে শুরু করে। চীনা সৈন্যদের নানকিং থেকে সরিয়ে আরও ভেতরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। জাপানীরা যখন নানকিং এসে পৌঁছায়, তখন শহরের ভেতর ৫ লক্ষ অধিবাসী বসবাস করছিল। নানকিং এর দিকে এগিয়ে আসার সময় জাপানীরা পথে যা পেয়েছে তা-ই ধ্বংস করেছে। যারাই ওদের হাতে ধরা পড়েছে তাদেরই হত্যা করা হয়েছে।
https://warfarehistorynetwork.com/2015/08/17/the-fall-of-shanghai-prelude-to-the-rape-of-nanking-wwii/
জাপানী সৈন্যদের উপর নির্দেশ ছিল সকল বন্দীকে হত্যা করতে হবে। পথের গ্রামগুলো পোড়াতে পোড়াতে তারা একসময় নানকিং পৌঁছে যায়। বেশিরভাগ লাশকে যেখানে হত্যা করা হয়েছে সেখানেই খোলা অবস্থায় রেখে জাপানীরা অগ্রসর হয়েছে। বিজিতদের লুট, হত্যা ও ধর্ষণ করা সৈন্যদের অধিকারে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন বিচিত্র উপায়ে তারা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করতো। কে কার আগে নিজ হাতে ১০০ জন চীনাকে হত্যা করতে পারবে সে নিয়ে দু'জন জাপানী অফিসার মুকাই এবং নদার মাঝে ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল! এই প্রতিযোগিতায় কে কয়টি খুন করেছে তার অগ্রগতির প্রতিবেদন শীর্ষস্থানীয় জাপানী পত্রিকাগুলো প্রতিদিনের আর্কষণীয় সংবাদ হিসেবে প্রচার করেছিল! ১৯৩৭ সনের ১৩ ডিসেম্বর থেকে পরের ছয় সপ্তাহে জাপানীরা নানকিংয়ের সাধারণ মানুষদের হত্যা ও নির্বিচারে ধর্ষণ করে। এসময় প্রায় ৮০,০০০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। জাপানী সেনারা বিভিন্ন ঘরে চীনা সৈন্য খোঁজার নাম করে নারী ও কন্যা শিশুদের বের করে এনে গণধর্ষণ করে। ধর্ষণ শেষে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষিতাদের হত্যা করা হয়েছে। হত্যা ও ধর্ষণের ব্যাপকতা দেখে পরবর্তীতে ধারণা করা হয়, ব্যাপারগুলো ছিল পরিকল্পিত এবং সৈন্যদের এমন কাজ করার জন্য নিদের্শনা প্রদান করা হয়েছিল। খুনের আগে যতভাবে মহিলাদের কষ্ট দেয়া সম্ভব তার প্রায় সব বর্বরতা জাপানীরা দেখিয়েছিল। গর্ভবতী মহিলাদের পেট কেটে খালি হাতে গর্ভের শিশুকে বের করে ফেলতো সৈন্যরা। যুবতী মেয়েদের দিনে ছয়-সাতবার ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়। তরুণীদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের জন্য নানকিং থেকে বিভিন্ন জাপানী ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়েছিল। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বহু শিশুকে হত্যা করা হয়। নিউইর্য়ক টাইমসের এক সাংবাদিক ছিলেন এ গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি পরবর্তীতে লিখেছিলেন, সমুদ্রের পাড়ে যাওয়ার পথে লাশের স্তুপ মাড়িয়ে উনাকে যেতে হয়েছে। সমুদ্রতীরে তার চোখের সামনে মাত্র দশ মিনিটে ২০০ বন্দীকে হত্যা করা হয়। জাপানী জেনারেলরা তাদের অধীনস্থদের এমন আচরণ জানার কথা কখনো স্বীকার করেনি। চীনে জাপানী বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল মাতসুই দাবী করেন, সৈন্যদের এমন বর্বরতার মাত্রা সর্ম্পকে তিনি কখনও অবহিত ছিলেন না। যুদ্ধের পর ইন্টারন্যাশন্যাল মিলিটারি ট্রাইবুনাল ফর ফার দ্য ইস্ট জেনারেল মাতসুইকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে। ১৯৩৮ সালে জাপানের সর্মথনপুষ্ট পুতুল সরকারকে জাপানীরা ক্ষমতায় বসানোর পর নানকিংয়ের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটে। নানকিং গণহত্যায় কয়েক সপ্তাহের ভেতর প্রায় তিন লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়। জাপান সরকার বহু বছর এ বর্বরতার দায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করে বিভিন্ন সময় চীনের প্রকাশিত সংবাদ ও তথ্যকে একপেশে হিসেবে দাবী করেছে। ১৯৯৫ সালের ১৫ আগস্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের ৫০ বছর উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তমিচি মুরায়ামা চীনসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জাপান যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। কিন্তু জাপান কখনো লিখিতভাবে নানকিং গণহত্যার জন্য চীনের কাছে দুঃখ প্রকাশ কিংবা ক্ষমা চায়নি। পরবর্তী জাপানী সরকারগুলোও এ ব্যাপারে কোনো দায় নিতে অস্বীকার করে আসছে। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শিনজো এ্যাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৭০ বছর উপলক্ষ্যে যে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেন তাতে চীনে জাপানের এই বর্বরতার বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়।
Comments