সন্ত্রাসবাদী প্রধানমন্ত্রী
লেহি শব্দটি ‘ফাইটার্স ফর দ্য ফ্রিডম অফ ইসরায়েল’ এর হিব্রু নামের সংক্ষিপ্ত রূপ।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Lehi_(militant_group)
সংগঠনটির জন্ম হয় ১৯৪০ সালের আগস্ট মাসে সন্ত্রাসী সংগঠন ইরগুন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Irgun
লেহির প্রতিষ্ঠাতা ছিল উগ্র জায়নবাদী নেতা আভরাহাম স্টার্ন, যার নামানুসারে লেহি'কে ক্ষমতাসীন ব্রিটিশরা স্টার্ন গ্যাং বলে সম্বোধন করতো।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Avraham_Stern
https://www.theguardian.com/world/on-the-middle-east/2014/apr/23/israel-palestinian-territories
বাস্তবেও লেহি যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল, সেটি পরবর্তীকালে স্বীকার করেছিল সংগঠনটির অপারেশন বিভাগের প্রধান এবং পরবর্তীকালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইতজাক শামির।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Yitzhak_Shamir
চল্লিশের দশকে সমগ্র ফিলিস্তিনি ভূমি ছিল ব্রিটিশ ম্যাণ্ডেট শাসনের অধীনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশরা অটোমানদের পরাজিত করে ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে জাতিপুঞ্জ ব্রিটিশদের ফিলিস্তিন শাসনের অনুমতি দিয়েছিল, যা স্থায়ী হয়েছিল ১৯২২-১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। পুরো ব্রিটিশ ম্যাণ্ডেটের শাসনামল জুড়ে জায়নবাদী ইহুদীরা সক্রিয় ছিল ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে নিজেদের জন্য ইহুদী রাষ্ট্র গড়ে তোলার কাজে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mandate_for_Palestine
১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর ইহুদী নেতা লায়নেল ওয়াল্টার রথশিল্ডের প্রতি ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদীদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Arthur_Balfour
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Walter_Rothschild,_2nd_Baron_Rothschild
https://www.aljazeera.com/features/2018/11/02/more-than-a-century-on-the-balfour-declaration-explained/
কিন্তু ব্রিটিশরা দ্রুত ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ না নিয়ে ফিলিস্তিন শাসন করে যেতে থাকে। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পথে আরবদের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন ব্রিটিশরাও হয়ে উঠতে থাকে উগ্রপন্থী ইহুদীদের শত্রু। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, দ্রুত ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করার উপায় হলো ব্রিটিশ অফিসারদের উপর একের পর এক আক্রমণ এবং গুপ্তহত্যা। চল্লিশের দশকে লেহি'র অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ ম্যাণ্ডেটের সিআইডির কমাণ্ডার টম উইলকিন। উইলকিন ছিলেন সিআইডির বিশেষ একটি ইউনিটের প্রধান, যাদের কাজ ছিল লেহি তথা স্টার্ন গ্যাংসহ অন্যান্য গুপ্ত ইহুদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা। তিনি হিব্রু ভাষা জানতেন এবং দীর্ঘ ১৩ বছর চাকরির সুবাদে হিব্রু ভাষায় পারদর্শী তার বিশাল গুপ্তচর নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল। তাদের মাধ্যমে তিনি ইহুদীদের অনেকগুলো গোপন অপারেশনের সংবাদ আগেই পেয়ে যেতেন এবং অভিযান চালিয়ে তা ব্যর্থ করে দিতেন। টম উইলকিনের অভিযানগুলোর কারণে লেহি এবং অন্যান্য গুপ্ত ইহুদী সংগঠনগুলো তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারছিল না। তাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা উইলকিনের অভিযানে ধরা পড়ে, অনেকের বিচারে শাস্তি হয়, কারো কারো মৃত্যুদণ্ড হয়। বাকিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সংগঠনের অনেক গোপন তথ্য জেনে নেয় উইলকিন। লেহির বেশ কয়েকটি গোপন অস্ত্রভাণ্ডার বাজেয়াপ্ত হয় উইলকিনের তৎপরতায়। এসব কারণে উইলকিনকে হত্যা করা লেহির জন্য জরুরী ছিল। লেহির অপারেশন বিভাগের প্রধান ইতজাক শামির টম উইলকিনকে হত্যার নির্দেশ জারি করে। হত্যাকান্ডের দায়িত্ব এসে পড়ে ডেভিড শমরন এবং ইয়াকভ বানাইয়ের উপর।
https://lehi.org.il/?p=3351
https://www.amazon.com/Global-Conspiracy-David-Shomron/dp/1941905064
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Yaakov_Banai
এর প্রায় তিন বছর আগে ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে লেহির প্রথম অপারেশনটির প্রধান লক্ষ্য ছিল জোফ্রি মর্টন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Geoffrey_J._Morton
১৯৪২ সালের ২০ জানুয়ারির ঐ অপারেশনে লেহি'র গুপ্তঘাতকরা তেল আবিবের ইয়েল স্ট্রিটের একটি ভবনের ভেতরে এবং ছাদের উপর বোমা পেতে আসে। মর্টন এবং উইলকিনের ঐ ভবনটিতে যাওয়ার কথা থাকলেও একটু দেরি হওয়ায় তারা পৌঁছার আগে বোমা বিস্ফোরিত হয়। নিহত হয় তিনজন ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তা এবং দু'জন ইহুদী ও একজন ব্রিটিশ বেসামরিক নাগরিক। সেই ঘটনার পর ব্রিটিশ ডিফেন্স সিকিউরিটি অফিস (এমআই৫ এর ঔপনিবেশিক শাখা) স্টার্ন গ্যাংকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করে। তাদের অভিযানে লেহির প্রতিষ্ঠাতা আভ্রাহাম স্টার্ন, অপারেশন প্রধান ইতজাক শামিরসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতারা গ্রেপ্তার হয়। বন্দী থাকা অবস্থায় জোফ্রি মর্টনের গুলিতে মারা যায় আভ্রাহাম স্টার্ন। লেহি'র অন্য সদস্যরা মর্টনের উপর আবার আক্রমণ করে। এবারের আক্রমণে মর্টন গুরুতরভাবে আহত হয়ে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যান। মর্টনের স্থলে দায়িত্ব নেন টম উইলকিন, আর বন্দী অবস্থা থেকে পালাতে সক্ষম হওয়া ইতজাক শামির পুনরায় দায়িত্ব পায় লেহির অপারেশন প্রধান হিসেবে।
ইতজাক শামিরের নির্দেশে ডেভিড শমরন এবং ইয়াকভ বানাই টম উইলকিনের উপর হামলার প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে। জেরুজালেমের রুমানিয়ান চার্চের বাসভবনে উইলকিনের অবস্থান নিশ্চিত করার পর তারা তাদের অভিযান শুরু করে। শমরন এবং বানাই অবস্থান নেয় সেইন্ট জর্জ স্ট্রিটের এক অন্ধকার সরু গলির ভেতর। তাদের পকেটে ছিল রিভলভার এবং গ্রেনেড। রাস্তার অপর পাশে মুদির দোকানের সামনে এবং অন্যান্য জায়গায় অবস্থান নেয় লেহির অন্যান্য এজেন্টরা। তাদের পরনে ছিল পরিচ্ছন্ন স্যুট এবং হ্যাট, যেন তাদের ব্রিটিশ বলে মনে হয়। টম উইলকিন যখন রাশিয়ান কম্পাউণ্ডে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সেইন্ট জর্জ স্ট্রিটে এসে পৌঁছেন, তখন মুদির দোকানের সামনে অবস্থান নেয়া লেহির এক এজেন্ট উঠে দাঁড়ায় এবং তার হ্যাটটি মাটিতে ফেলে আবার কুড়িয়ে নেয়। এটি ছিল শমরন এবং বানাইয়ের প্রতি তার বিশেষ সিগনাল। তারা গলি থেকে বের হয়ে উইলকিনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমে তারা উইলকিনকে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে যায়। পকেট থেকে তাদের সরবরাহ করা উইলকিনের ছবি বের করে নিশ্চিত হয়ে নেয় তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে। এরপর ঘুরে উল্টোদিকে হেঁটে আসতে থাকে। পকেটে শক্ত হাতে ধরে রাখে রিভলভার এবং গ্রেনেড। অপারেশনের আগে বানাই শমরনকে অনুরোধ করেছিল যে, সে প্রথমে উইলকিনকে গুলি করবে। কিন্তু কাছাকাছি যাওয়ার পর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে শমরন পকেট থেকে রিভলভার বের করে গুলি করতে শুরু করে। দু'জনেই পুরো ম্যাগাজিন শেষ করে ফেলে উইলকিনের উপর। তাদের ১৪টি গুলির মধ্যে ১১টি আঘাত করে উইলকিনের শরীরে। উইলকিন ঘুরে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে তার রিভলভারটি বের করলেও তার শরীরে আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। সামনের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে তার। বহু বছর পর এক সাক্ষাৎকারে শমরন স্বীকার করেছিল, উইলকিন হত্যাকাণ্ড নিয়ে তার মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। তারা বিশ্বাস করতো যত বেশি ব্রিটিশ অফিসারের লাশবাহী কফিন ব্রিটেনে ফেরত যাবে, তাদের ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য তত দ্রুত অর্জিত হবে। তার শুধু একটাই আফসোস, সেদিন উইলকিনকে হত্যার পর তাড়াহুড়া করে পালাতে গিয়ে তারা তার সাথে থাকা ব্রিফকেসটা নিয়ে যেতে পারেনি! সেটা নিতে পারলে তারা ব্রিটিশ গোয়েন্দাবাহিনীর অনেক গোপন তথ্য জানতে পারতো, যা তাদের পরবর্তী অপারেশনগুলোতে কাজে আসতো।
Comments