রবীন্দ্রনাথের ছদ্ম প্রগতিশীলতা

 

রবীন্দ্রনাথের নারী স্বাধীনতা বিরোধিতা সংক্রান্ত হুমায়ুন আজাদের 'নারী' বইয়ের অংশ-

https://drive.google.com/file/d/1-1TTg9fQrjRnYVGOEJuENhxohcNApINk/view?usp=drivesdk

২০২১ সালে চীন কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষে পা রেখেছে।

http://www.chinatoday.com/org/cpc/

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে চীন কেবল আফিমের নেশা থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। চীন বুঝতে শুরু করেছে পশ্চিমা দাসত্ব কখনো মুক্তি দেবে না। তাই পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে হবে নিজেদেরই। তৎকালীন চীনা তরুণরা জ্ঞানের অনুসন্ধান এবং চর্চা করতে শুরু করেছে। সমন্বয় স্থাপন করেছে জ্ঞানস্পৃহা ও জ্ঞানচর্চার মধ্যে। ভাববাদের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে তারা তখন বস্তুবাদের ওপর ভর করে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে বিভোর, কেননা তারা দেশের মানুষের বঞ্চনার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন এবং সে বঞ্চনা দূর করার দায়িত্ব তরুণদেরই। তারা পড়তে শুরু করেছে, লিখছে, যেকোনো বক্তব্য পেলে চলছে সে বক্তব্যের অতি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চলছে যাচাই এবং পরিশেষে গ্রহণ অথবা সরাসরি বর্জন। তরুণরা ১৯২১ সালে গড়ে তুলেছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। চারিদিকে তখন প্রবল উত্তেজনা; প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে চলছে বিপ্লবের প্রস্তুতি। এমনই এক বিপ্লবের প্রস্তুতিকালে ১৯২৪ সালের ১২ই এপ্রিল চীন ভ্রমণ করেন রবীন্দ্রনাথ। ৪৯ দিনের এই ভ্রমণের প্রথম সপ্তাহের এক বক্তৃতার সারমর্ম ছিল-

“ভাববাদকে ফিরিয়ে আনতে হবে, সে কারণে ধ্বংস করতে হবে বস্তুবাদকে।"

শুরুতেই এমন বক্তব্য দেয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই অনেকের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। চীন ভ্রমণে রবীন্দ্রনাথকে বেশ নাকাল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত বাংলা ভাষার কবি, কিন্তু ভাষাগত পার্থক্যের কারণে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ তেমন হয়ে ওঠেনি। সমগ্র ভ্রমণে তিনি একবারের বেশি সাহিত্য নিয়ে আলোচনার সুযোগ পাননি, তাই বার বার ফিরে যেতে হয়েছে মতাদর্শে।  রবীন্দ্রনাথ শুধু যে ভাববাদের পক্ষে বলেছেন তা নয়, অনেক বক্তব্যে একইসাথে বস্তুবাদের বিরোধিতা করেছেন। উপস্থিত তরুণদের মধ্যে সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন মাও সে তুং। তারা তখন উঠতি বিপ্লবী। শ্রেণিসংগ্রামের প্রতি প্রবল বিশ্বাস। তরুণ বিপ্লবীরা আশঙ্কা করেছিলেন, এটা আয়োজকদের ষড়যন্ত্র আর তাদের হয়ে দালালী করছেন রবীন্দ্রনাথ! পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের বিরুদ্ধে লেখালেখি হয়েছে, লেখাগুলো রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়ায়নি। তিনি পড়েছেন, প্রতিক্রিয়া হিসেবে বক্তব্য প্রদান অনুষ্ঠান স্থগিত করেছেন। এমনকি বক্তৃতা করার সময় প্রবল বিক্ষোভের মুখে বক্তৃতা দানে ইস্তফা প্রদানও করতে হয়েছিল। বক্তব্য চলাকালীন তাকে শুনতে হয়েছে-

"পরাধীন দেশের চাকর ফিরে যাও। আমরা দর্শন চাই না। চাই বস্তুবাদ।"

ঠিক তার কিছু বছর পরেই চীনে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। চীন এগিয়ে গিয়েছিল মুক্তির পথে। বিগত তিন দশকের মধ্যেই চীনের প্রায় ৮০ কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার উপরে উঠে এসেছে। ভ্রমণকাহিনী লেখায় রবীন্দ্রনাথের জুড়ি নেই, তবুও চীন ভ্রমণ সম্পর্কে তেমন কিছুই লিখেননি বিরক্তির কারণে।

[সূত্র: বিতর্কিত অতিথি: (রবীন্দ্রনাথ ও চীন), শিশিরকুমার দাশ]

এবার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর মূল্যায়ন শোনা যাক-

১৯৬০ এর দশকে নিমাই চট্টোপাধ্যায়কে লেখা এক চিঠিতে বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'রহস্যময়তা' এবং 'অর্থহীন প্রলাপ' বকার প্রবণতা পছন্দ করেন না। তিনি আরও লিখেছিলেন বহু ভারতীয় যে ভাষা ভঙ্গিমার সমাদর করছে, তার কোনও অর্থই নেই।

জর্জ বার্নার্ড শ রবীন্দ্রনাথের অনুসরণে 'স্টুপেন্দ্রনাথ বেগর (Stupendranath Begorr)' চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন। 'A Glimpse of the Domesticity of Franklyn Barnabas' এ তিনি রবীন্দ্রনাথের পরিবারকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন।

গ্রাহাম গ্রিন বলেছিলেন-

"আমি বিশ্বাস করি না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাকে ইয়েটস ছাড়া আর কেউ বেশি গুরুত্ব দেয়।" 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Graham_Greene

তিনি আরও বলেছেন, চেস্টারটন যে থিয়সফিস্টদের 'চকচকে পাথরের মতো চোখ' এর কথা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের কথা বললে তাদের কথাই তার মনে পড়ে।

আনা আখমাতোভা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছিলেন- 

"হিন্দুধর্মের শক্তি থেকে গঙ্গার মতো যার উদ্ভব এবং যার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।"

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Anna_Akhmatova

১৯৩০ সালে ইজভেসতিয়া'য় দেয়া সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত রাশিয়ায় স্বাধীনতার তথাকথিত অনুপস্থিতির নিন্দা করেন এভাবে-

"আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য, যাদের আপনারা শত্রু বলে মনে করেন তাদের বিরুদ্ধে আপনাদের শিক্ষানবিশদের মনে ক্রোধ, শ্রেণী-হিংসা এবং প্রতিহিংসার প্রবৃত্তি জাগিয়ে তুলে আপনাদের আদর্শের কী ধরনের সেবা করছেন? সত্যকে গ্রহণ করবার জন্যে চাই মনের স্বাধীনতা। আতঙ্ক তাকে হত্যা করে এবং শুধু নিরাশারই জন্ম দেয়। মানবতার স্বার্থে আমি আশা করবো আপনারা হিংসার এমন কোনও অপশক্তিকে কখনওই জাগিয়ে তুলবেন না যা হিংসা ও নিষ্ঠুরতার এক অন্তহীন শৃঙ্খল বয়ন করে চলবে। জারের আমলের অন্য অনেক খারাপ জিনিসকে আপনারা নির্মূল করবার চেষ্টা করেছেন। এটিকেও ধ্বংস করবেন না কেন?"

এই সাক্ষাৎকারটি ১৯৮৮ সালে একই পত্রিকার প্রকাশিত হওয়ার আগে অন্য কোথাও বের হয়নি।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Izvestia

অবশ্য তার 'রাশিয়ার চিঠি' ব্রিটিশ ভারতে নিষিদ্ধ ছিল এবং দেশ ভাগের আগে এটির কোনো ইংরেজি সংস্করণ আর প্রকাশিত হয়নি। ১৯৩৪ সালে বইটির কিছু কিছু অংশ ইংরেজিতে অনুবাদ করা হলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া বলেছিলেন, "তথ্য বিকৃত করে এ বই এমনভাবে লেখা হয়েছে যাতে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের নিন্দা ও দুর্নাম হয়।"

সূত্র: 'দি আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান', অমর্ত্য সেন

গর্বাচেভ তার পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করে স্তালিনের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবে সাক্ষাৎকারটি ১৯৮৮ সালে ছাপানোর ব্যবস্থা করলেও পুঁজিবাদী ইংল্যান্ড ১৯৩০ সালেই এটির কপি জোগাড় করে 'ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান' পত্রিকায় ছাপার ব্যবস্থা করে।

সূত্র: 'বলা যায়', অমর্ত্য সেন

ঠাকুরবাড়ির সেক্যুলারিজম চর্চা সংক্রান্ত মিথ উপমহাদেশে বহুল প্রচারিত হলেও আসল সত্যিটা দেখা যাক। রবীন্দ্রনাথ মারাঠাদের উগ্র হিন্দুত্ববাদী শাসক শিবাজিকে বিষয়বস্তু করে 'শিবাজি উৎসব' শিরোনামে দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন। তার জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন-

"কবি তিলক (মহারাষ্ট্রের নেতা বালগঙ্গাধর তিলক) কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে কবিতা লিখলেন।"

কিন্তু পরে 'সঞ্চয়িতা' সংকলন গ্রন্থ থেকে কবিতাটি বাদ দেন তিনি। উগ্র হিন্দুত্ববাদী বালগঙ্গাধর তিলক শিবাজি উৎসবের প্রবর্তন করেন এবং তিনি রবীন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন। টড এর রাজস্থানের কাল্পনিক মিথগুলোর সংকলন থেকে কাহিনী আহরণ করে তার বড় বোন স্বর্ণকুমারী দেবী অনেকগুলো উপন্যাস লিখেছিলেন। এমনকি তার বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত রাজস্থানের কথিত আর্য গৌরব আবিষ্কারে ব্যস্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি সরলা দেবী চৌধুরানী বাংলার ইতিহাসে হিন্দু মহিমা সন্ধান করতে গিয়ে প্রতাপাদিত্যের সাক্ষাৎ পান। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে প্রতাপাদিত্যের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরতে 'প্রতাপাদিত্য উৎসব' চালু করেন তিনি। রাজনারায়ণ বসুর উগ্র হিন্দুত্ববাদী রচনা 'বৃদ্ধ হিন্দুর আশা' ঠাকুর বাড়ির উৎসাহেই লিখিত হয়েছিল। ঠাকুর বাড়ির উৎসাহ ও আর্থিক সহায়তায় 'হিন্দু মেলা'র আয়োজন সম্ভব হয়। রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন লেখায় তার উপনিষদ প্রীতির কথা উল্লেখ করেছেন।

[সূত্র: আহমদ ছফা রচনাবলী]

তথাকথিত প্রগতিশীল রবীন্দ্রনাথ ১৯০২ সালে এক প্রবন্ধে বলেছিলেন-

"ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই, তাহা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটা দুঃস্বপ্ন কাহিনী মাত্র।কোথা হইতে কাহারা আসিল, কাটাকাটি মারামারি পড়িয়া গেল, বাপে- ছেলেয়, ভাইয়ে-ভাইয়ে সিংহাসন লইয়া টানাটানি চলিতে লাগিল, এক দল যদি বা যায় কোথা হইতে আর একদল উঠিয়া পড়ে- পাঠান, মোগল, পর্তুগিজ, ফরাসি, ইংরাজ সকলে মিলিয়া এই স্বপ্নকে উত্তরোত্তর জটিল করিয়া তুলিয়াছে।"

সাহানা দেবীর বিয়ে হয়েছিল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক পাগল ছেলের সাথে। ঐ পাগলকে ঘুম পাড়াতে ভদ্রমহিলাকে সারা রাত গান গাইতে হতো। পাগল স্বামী মারা যাওয়ার পর সাহানা দেবীর বাবা কিশোরী মেয়েকে আবার বিয়ে দিতে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। খবর পেয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর খুব রেগে যান এবং বলেন যে, এতে নাকি ঠাকুর বাড়ির সম্মান থাকবে না। তার কথায় অন্যরা প্রতিবাদ করলেও রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন সাহানা দেবীকে ফিরিয়ে আনতে।

[মৌষলকাল, সমরেশ মজুমদার]

.........................................................................................

থিওজফিক্যাল সোসাইটির রমরমা কমলেও মানুষের মন থেকে যে নির্মূল হয়নি, তার প্রমাণ মাঝে-মধ্যেই পাই উঠে আসা প্রশ্নের ভিতর দিয়ে। থিওজফিস্টরা প্রেততত্ত্ববিদ। একসময় বাংলার বহু বিশ্লিষ্ট ব্যক্তিই ছিলেন থিওজফিস্ট। তাঁদের নানা প্রেতচর্চার বিষয় নিয়ে এবং থিওজফিক্যাল সোসাইটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাক্তিত্ব অ্যানি বেশান্ত (Annie Besant)-এর প্রেতচর্চার সাড়া জাগানো নানা ঘটনা নিয়ে বহু প্রশ্নই উচ্চ শিক্ষিত একটি বিশেষ মহল থেকেই সাধারণত উঠে আসে। উঠে আসা প্রশ্নগুলি সাধারণভাবে সব সময়ই এই ধরনের - ওঁরা প্রত্যেকেই কি তবে মিথ্যাচারী ছিলেন? যে থিওজফিক্যাল সোসাইটি প্রেততত্ত্ব নিয়ে চর্চা করতো, প্ল্যানচেটে আত্মা নামিয়ে আনতো, তাদের সম্বন্ধে সামান্য হলেও কিছুটা আলোচনা করে নেওয়া তাই একান্তই জরুরি বলে মনে করি।

১৮৭৫ সালের ১৭ নভেম্বর থিওজফিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে হেলেনা পেট্রোভনা ব্লাভাৎস্কিকে সামনে রেখে। অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কর্নেল হেনরি অলকট। 

https://en.wikipedia.org/wiki/Helena_Blavatsky

https://en.wikipedia.org/wiki/Henry_Steel_Olcott

ব্লাভাৎস্কি প্রেতাত্মাদের বা বিদেহী আত্মাদের খুব প্রিয় ও বিশ্বস্ত ছিলেন। তাঁর আহ্বানে আলো-আঁধারী ঘরে প্রেতাত্মারা টেবিল ঠকঠক করতো। বিদেহী 'মহাত্মা'রা রেখে যেতেন নানা লিখিত নির্দেশ, উপদেশ ইত্যাদি। 'মহাত্মা' কারা? অলকটের কথায়, 

'মহাত্মা' এমনই একজন, যিনি নিজের অধ্যাত্মশক্তি ও নিজের ইচ্ছাশক্তিকে উন্নত করে সেই পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যেখানে তিনি ক্ষুদ্র বাসনা-কামনার দ্বারা আচ্ছন্ন নন, নিজের শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছেন। পবিত্র, কামনাহীন। (থিওজফিস্ট পত্রিকা, জুন, ১৯০১ সাল) 

মহাত্মারা শুধু যে লেখাই পাঠাতেন, তেমন নয়। মাদাম ব্লাভাৎস্কির সঙ্গে অনেক কথাও বলতেন, এক মহাত্মার ওভারকোটের পকেট থেকে জাপানি টি পট বের করে মাদাম ভক্তদের তা দেখিয়েও ছিলেন।

অলকটের জীবনের এক প্রেতাত্মা ঘটিত ঘটনার কথা বলার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। এক প্রেত বৈঠকে অলকট নিয়েছিলেন একটি গোলাপ নিয়ে। ভরগ্রস্ত মিডিয়াম তাঁকে বললেন গোলাপটি শক্ত মুঠোয় চেপে ধরতে। যখন মিডিয়াম হাত খুলতে বললেন তখন মুঠো খুলে দেখেন গোলাপের ভিতর একটি সোনার আংটি। তারপর বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে। সিমলায় অলকট তাঁর এক বান্ধবীকে বলছিলেন বিদেহী আত্মার আংটি দেওয়ার লোম খাড়া করা ঘটনার কথা। ঘটনাটি শুনে বান্ধবী আংটিটি নিজের হাতে নিয়ে দেখার কৌতূহল সামলাতে পারলেন না। অলকট আঙুল থেকে আংটি খুলে বান্ধবীর হাতে তুলে দিলেন। মাদাম ব্লাভাৎস্কি বান্ধবীর হাতের মুঠোটা চেপে ধরলেন। মুঠো বন্দী হয়ে রইলো আংটি। মাদাম আহ্বান জানালেন এক 'মহাত্মা'কে। তারপর মুঠো খুলতেই অবাক কান্ড। সোনার আংটি হয়ে গেছে তিনটে হিরে বসানো আংটি।

থিওজফিস্টদের আত্মা নামিয়ে কাণ্ডকারখানা ঘটানোর কথা সেই সময়ে সারা পৃথিবী জুড়ে বহু পত্র-পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছে। আমরা জেনেছি মাদামের আহ্বানে আত্মাদের ঘণ্টা বাজাবার কথা, শূন্য থেকে জিনিস আনার কথা - ওমনি কত কী! ১৮৮৮ সালে মাদামের বিখ্যাত গ্রন্থ 'Secret Doctrine' প্রকাশিত হলো। প্রেততত্ত্ব বিষয়ক গুপ্ত বিদ্যা শিখতে বহু মানুষের আগ্রহ জাগিয়ে তুললো এই গ্রন্থটি। ১৮৯১ সালে মাদাম মারা গেলেন। তাতে কিন্তু ফিওজফিক্যাল সোসাইটির

রমরমা একটুও কমলো না। কারণ ইতিমধ্যে বহু বিশিষ্টরাই তখন মাদ্যমের বিশাল ভক্ত। ১৮৮২ সালে মাদাম ও অলকটের আশীর্বাদ নিয়ে গড়ে উঠেছে 'বেঙ্গল থিওজফিক্যাল সোসাইটি'। সভাপতি হলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, যেই প্যারীচাঁদ একসময় চিহ্নিত হয়েছিল, 'ডিরোজিয়ান হিসেবে', বুদ্ধিবাদী-যুক্তিবাদী হিসেবে। সোসাইটির সহ সভাপতি হয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল ঠাকুর ও রাজা শ্যামাশংকর রায়। সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ নরেন্দ্রনাথ সেন। সহ সম্পাদক বলাইচাঁদ মল্লিক ও মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও মাদাম ও অলকটের পায়ের ধুলো পড়তো প্রায়ই। '৮২ সালেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে স্বর্ণকুমারী দেবীকে সভানেত্রী করে গড়ে উঠেছিল 'লেডিস থিয়োজফিক্যাল সোসাইটি'। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকা হয়ে উঠেছিল থিওজফি প্রচারের এক পত্রিকা। 'অমৃতবাজার' পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এক সময়ের 'নাস্তিক' বলে চিহ্নিত শিশিরকুমার ঘোষও একসময় ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করে পরে একই সঙ্গে পরম বৈষ্ণব ও ঘোর থিওজফিস্ট বা প্রেততত্ত্ববিদ হয়ে উঠেছিলেন। অমৃতবাজারও সেই সময় থিওজফিস্টদের প্রশংসা করে অনেক লেখা প্রকাশ করেছে। এবং তারই পরস্পরা বজায় রেখে আজও 'অমৃতবাজার' ও তাদের গোষ্ঠীরই বাংলা দৈনিক 'যুগান্তর' অক্লান্তভাবে প্রচার করে চলেছে বৈষ্ণব ও ফিওজফিস্ট ভাবধারা।

থিওজফিক্যাল সোসাইটি যে কি বিপুলভাবে প্রধানত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে প্রভাব ফেলেছিল, তারই উদাহরণ - ১৯০০ সালে সোসাইটির আমেরিকাতে শাখা ছিল ছ'শো এবং ভারতে তিনশো। আমেরিকায় সোসাইটি বিস্তৃতি লাভ করেছিল যার কাঁধে ভর দিয়ে, তিনি থিওজফিক্যাল সোসাইটির অন্যতম প্রাণপুরুষ উইলিয়ম জাজ।

- অলৌকিক নয়, লৌকিক (৪র্থ), প্রবীর ঘোষ

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]