স্তালিন ও মাও এর অযোগ্য উত্তরসূরিরা
চীন
১৯২০ সালে দেং জিয়াওপিং ১৬ বছর বয়সে উচ্চশিক্ষার জন্য ফ্রান্সে পাড়ি জমান। এরপর সাত বছর তিনি কাটালেন ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নে। ১৯৭৮ সালের অক্টোবর মাসে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় সফরে জাপানের মাটিতে পা রাখলেন দেং।
https://www.eastasiaforum.org/2011/09/27/china-under-deng-xiaopings-leadership/
উদ্দেশ্য জাপানের সাথে দীর্ঘদিনের বৈরিতা দূর করতে চীন-জাপান শান্তি ও মৈত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর করা। সেই সফরে সম্রাট হিরোহিতোর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন দেং।
http://www.chinadaily.com.cn/a/201808/09/WS5b6b7a9ea310add14f384b66_2.html
জাপান সফর শেষে দেশে ফিরে দেং আহবান করে বসলেন কম্যুনিস্ট পার্টির একাদশ কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ সেশন।
https://www.nytimes.com/1997/02/20/world/deng-xiaoping-is-dead-at-92-architect-of-modern-china.html
১৯৭৮ সালের সেই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো, চীনে আগের মতো সমাজতন্ত্র থাকবে না। বরং সেখানকার কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতিতে নিয়ে আসা হবে পরীক্ষামূলক বাজার উপাদানের সম্মিলন, যাকে উপস্থিত নেতারা অভিহিত করেন চীনা ভাবধারার সমাজতন্ত্র হিসেবে। দেং চীনে গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামোর পক্ষপাতী ছিলেন না এবং ক্ষমতার এখতিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির করতলে রেখে দিতে আগ্রহী ছিলেন, তারপরও তিনি নিজের অফিসের গুরুত্ব কমিয়ে এনে ক্ষমতার কিঞ্চিৎ বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিয়েছিলেন।
https://www.aljazeera.com/features/2018/12/18/forty-years-of-chinas-reform-and-opening-up-a-personal-tale/
ক্ষমতায় বসার প্রথম বছরেই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামগ্রিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্সের মত দেশগুলোর সাথেও নতুন করে কূটনৈতিক মৈত্রী গড়ে তুলেছিলেন। বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির ফলে বিদেশীরা চীনে বিনিয়োগে আগ্রহী হতে থাকলে ক্রমশ ফুলে-ফেঁপে চীনের অর্থনীতি।
https://www.aljazeera.com/economy/2018/12/18/marking-40-years-of-reform-xi-says-china-wont-be-dictated-to/
১৯৮৯ সালে তিয়ান আনমেন স্কয়ারের ঘটনার পর দেং সেই বছরই চীনের কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেন।
https://m.dw.com/en/number-of-chinese-millionaires-sees-rapid-surge/a-39322859
১৯৯২ সালে রাজনীতি থেকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেন। ব্যক্তিগতভাবে দেং তার উত্তরসূরীদের শাসনব্যবস্থা নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলেন না। যখন তিনি দেখতে পেলেন নতুন শাসকদের অধীনে তার অর্থনৈতিক এজেন্ডা পূরণ হচ্ছে না, তখন তিনি চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরগুলোতে এক ঐতিহাসিক সফরের সূচনা করেন। একে একে তিনি গুয়ানজাও, শেনজেন, জুহাই শহরগুলো ভ্রমণ করেন, এবং নববর্ষ পালন করেন সাংহাইতে। ভ্রমণের আড়ালে তিনি এসব শহরে নতুন করে তার অর্থনৈতিক মূলনীতির প্রচারণা চালাতে থাকেন। ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলাকালে ভিয়েতনাম চীনের কাছ থেকে সক্রিয় সহায়তা লাভ করেছিল। সেসময় চীনারা ভিয়েতনামকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র, রসদপত্র, খাদ্যদ্রব্য ও পণ্যসামগ্রী সরবরাহ করতো এবং অসংখ্য চীনা সামরিক উপদেষ্টা ও সৈন্য ভিয়েতনামি সশস্ত্রবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য ভিয়েতনামের মাটিতে মোতায়েনকৃত ছিল। কিন্তু ১৯৭৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রায় ৬ লক্ষ চীনা সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী চীন-ভিয়েতনাম সীমান্ত অতিক্রম করে ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চল জুড়ে আক্রমণ চালায়। ভিয়েতনামি সৈন্যরা চীনাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং প্রায় এক মাসব্যাপী যুদ্ধের পর ১৯৭৯ সালের ১৬ মার্চের মধ্যে চীন ভিয়েতনাম থেকে সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। পশ্চিমা ঐতিহাসিকদের মতে এই যুদ্ধে প্রায় ২৬,০০০ চীনা সৈন্য নিহত এবং প্রায় ৩৭,০০০ চীনা সৈন্য আহত হয়। অন্যদিকে ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ ভিয়েতনামি সৈন্য নিহত এবং প্রায় ৩২,০০০ ভিয়েতনামি সৈন্য আহত হয়। ১৯৭৯ সালের চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধের তাৎক্ষণিক কারণ ছিল সেসময় চলমান কম্পুচিয়া-ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম কর্তৃক কম্পুচিয়া (বর্তমান কম্বোডিয়া) দখল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালে উত্তর ভিয়েতনামের সমর্থনপুষ্ট দক্ষিণ ভিয়েতনামি কমিউনিস্টরা যেমন মার্কিন সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনামি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল, তেমনি কম্পুচীয় কমিউনিস্টরাও মার্কিন সমর্থিত কম্পুচীয় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। এসময় ভিয়েতনামি ও কম্পুচীয় কমিউনিস্টরা ছিল পরস্পর মিত্র। ১৯৭৫ সালে উত্তর ভিয়েতনামের সৈন্যদের নিকট দক্ষিণ ভিয়েতনামের পতন ঘটে এবং ১৯৭৬ সালে দুই ভিয়েতনাম একত্রিত হয়ে 'ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে ১৯৭৫ সালে কম্পুচীয় কমিউনিস্টদের নিকট কম্পুচীয় সরকারের পতন ঘটে এবং পল পটের নেতৃত্বাধীন 'খেমার রুজ' দল 'গণতান্ত্রিক কম্পুচিয়া' নামক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে। ঐতিহাসিকভাবে ভিয়েতনামিরা পার্শ্ববর্তী কম্পুচিয়াকে নিজেদের প্রভাব বলয়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে এবং কম্পুচীয় কমিউনিস্টদের আশঙ্কা ছিল যে, ভিয়েতনামি কমিউনিস্টরা তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে। কম্পুচিয়া সম্ভাব্য ভিয়েতনামি আধিপত্যবাদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে গড়ে তোলে। অন্যদিকে ভিয়েতনাম সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছিল।খেমার রুজ কম্পুচিয়ায় বসবাসকারী হাজার হাজার ভিয়েতনামিকে হত্যা করে এবং একই সঙ্গে কম্পুচীয় রাজনৈতিক শ্রেণির ভিয়েতনামপন্থী অংশটিকে নিশ্চিহ্ন করতে শুরু করে। পাশাপাশি তারা ভিয়েতনামের অভ্যন্তরে আক্রমণ পরিচালনা করতে শুরু করে এবং ১৯৭৫-১৯৭৮ সালের মধ্যে ভিয়েতনামে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ৩০,০০০ বেসামরিক ভিয়েতনামি হত্যা করে। আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়ে ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে ভিয়েতনাম কম্পুচিয়ার অভ্যন্তরে পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ চালায় এবং ১৯৭৯ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কম্পুচীয় খেমার রুজ সরকারের পতন ঘটে। ভিয়েতনামিরা কম্পুচিয়ায় ভিয়েতনামপন্থী ও সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। চীন কম্পুচিয়ায় ভিয়েতনামি আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে কম্পুচিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য ভিয়েতনামকে আহ্বান জানায়। খেমার রুজ ক্ষমতাচ্যুত হলেও তারা কম্পুচিয়ার নতুন সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। এজন্য ভিয়েতনাম কম্পুচিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতি জানায়। চীনের সঙ্গে কম্পুচিয়ার কোনো সীমান্ত সংযোগ না থাকার কারণে চীনের পক্ষে সরাসরি কম্পুচিয়ায় সৈন্য প্রেরণ করে খেমার রুজকে সহায়তা করা সম্ভব ছিল না এবং কম্পুচিয়ার সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রগুলোর (মার্কিনপন্থী ও কমিউনিস্টবিরোধী থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামপন্থী কমিউনিস্ট লাওস এবং ভিয়েতনাম) মধ্য দিয়ে দেশটিতে সৈন্য প্রেরণ করাও চীনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এর পরিপ্রেক্ষিতে কম্পুচিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে তাদের বাধ্য করার জন্য চীন ভিয়েতনামের ওপর আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের ধারণা ছিল, চীন ভিয়েতনামের ওপর আক্রমণ চালালে ভিয়েতনাম তার সমস্ত শক্তি চীনের বিরুদ্ধে নিয়োজিত করতে বাধ্য হবে এবং এজন্য তাদের কম্পুচিয়া থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে। এই সুযোগে খেমার রুজ কম্পুচিয়ার নতুন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে এবং তাদের উৎখাত করতে সমর্থ হবে। চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বে ভিয়েতনাম সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ অবলম্বন করেছিল এবং এজন্য চীন ভিয়েতনামের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নও ভিয়েতনামকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছিল এবং সোভিয়েত সামরিক সরঞ্জাম, সামরিক উপদেষ্টাবৃন্দ ও গোয়েন্দা সহায়তা ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিনিদের পরাজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ঐতিহাসিকভাবে চীনারা ভিয়েতনামকে নিজেদের প্রভাব বলয়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করতো। এজন্য ভিয়েতনামি কমিউনিস্টরা চীনাদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতো এবং সম্ভাব্য চীনা আধিপত্যবাদকে ভিয়েতনামের কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ হিসেবে বিবেচনা করতো।
তাছাড়া ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে ১৯৭০ এর দশকের প্রথমদিকে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্থাপিত আঁতাত ভিয়েতনামি কমিউনিস্টদের ক্ষুব্ধ করে। এই প্রেক্ষাপটে ভিয়েতনাম সম্ভাব্য চীনা সম্প্রসারণবাদ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারা সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা Council for Mutual Economic Assistance, 'COMECON এ যোগদান করে এবং ১৯৭৮ সালের ৩ নভেম্বর ভিয়েতনাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে 'বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি' স্বাক্ষর করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Comecon
চীনাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ভিয়েতনাম এবং সমগ্র ইন্দোচীন (ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্পুচিয়া) ছিল তাদের প্রভাব বলয়ের অংশ। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে চীনা নেতা দেং জিয়াওপিং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারের নিকট ভিয়েতনাম সম্পর্কে মন্তব্য করেন-
"ছোট বাচ্চাটি দুষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাকে শাস্তি দেয়া দরকার!"
ভিয়েতনাম নিজে চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ নিয়েছিল, ভিয়েতনামিপন্থী লাওস ভিয়েতনামের পথ অনুসরণ করেছিল এবং কম্পুচিয়ায় খেমার রুজের পতনের পর কম্পুচিয়া অনুরূপ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিল। চীনাদের দৃষ্টিতে, ভিয়েতনাম 'প্রাচ্যের কিউবা' হয়ে উঠছিল এবং চীনাদের প্রাকৃতিক প্রভাব বলয়কে সোভিয়েতদের হাতে সমর্পণ করছিল। ভিয়েতনামের ওপর আক্রমণ পরিচালনার জন্য চীনা সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে যে তিনটি কারণ দেখিয়েছিল তার মধ্যে প্রথমটি ছিল কম্পুচিয়ার ওপর ভিয়েতনামের আগ্রাসন এবং দ্বিতীয়টি ছিল ভিয়েতনামে বসবাসরত চীনাদের ওপর ভিয়েতনামি সরকার কর্তৃক পরিচালিত নিষ্পেষণ। ভিয়েতনামে সেসময় কয়েক লক্ষ চীনা বসবাস করতো, যাদের 'হোয়া' জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। চীনারা কার্যত পুঁজিবাদী দক্ষিণ ভিয়েতনামের অর্থনীতির ৭০%-৮০% নিয়ন্ত্রণ করতো। ১৯৭৫ সালে উত্তর ভিয়েতনাম কর্তৃক দক্ষিণ ভিয়েতনাম দখলের পর ভিয়েতনাম সরকার দক্ষিণ ভিয়েতনামে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এই নীতি চীনাদের উদ্দেশ্য করে নেয়া হয়নি, বরং ভিয়েতনামের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় আদর্শের বাস্তবায়ন। ভিয়েতনামে বসবাসকারী প্রতিটি জাতির ব্যবসায়ীরা এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু চীনাদের বাণিজ্যের পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ায় তারা এই নীতির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চীনারা ভিয়েতনামি সরকারের এই নীতি প্রতিরোধ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে এবং বেশকিছু চীনা প্রাণ হারায়। চীন-ভিয়েতনাম সম্পর্কের ক্রমাবনতি এবং কম্পুচিয়া-ভিয়েতনাম সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ভিয়েতনাম সরকার আশঙ্কা করে যে, চীন সরকার ভিয়েতনামে বসবাসকারী চীনাদের ভিয়েতনামি সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। ১৯৭৮ সালের মধ্যে প্রায় ১,৭০,০০০ চীনা ভিয়েতনাম থেকে পালিয়ে চীনে আশ্রয় নেয়। ভিয়েতনামি চীনা শরণার্থীদের চীনে প্রবেশের প্রেক্ষাপটে চীন-ভিয়েতনাম সীমান্তে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। চীন সরকার চীনাদের ওপর ভিয়েতনামি সরকারের নিষ্পেষণের নিন্দা জানায় এবং এটিকে ভিয়েতনাম আক্রমণের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করে। খেমার রুজ কম্পুচিয়ায় বসবাসকারী হাজার হাজার চীনাকে হত্যা করেছিল। কিন্তু খেমার রুজ সরকার চীনপন্থী হওয়ার কারণে চীন কম্পুচীয় চীনাদের ওপর নিষ্পেষণ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ জানায়নি সেসময়। অন্যদিকে ভিয়েতনামে চীনাদের 'ব্যক্তিগত সম্পত্তি' বাজেয়াপ্তকরণ ছিল ভিয়েতনামিদের সমাজতান্ত্রিক নীতির অংশ। বিশ্লেষকদের মতে, ভিয়েতনামি সরকার সেদেশে বসবাসকারী চীনাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করছে, সেটি নিয়ে চীনের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু ভিয়েতনাম যদি খেমার রুজের মতো চীনাপন্থী হতো, সেক্ষেত্রে ভিয়েতনামে চীনাদের ওপর নিষ্পেষণ চীনা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতো না। ভিয়েতনাম আক্রমণের জন্য চীনা সরকার যে তিনটি যুক্তি প্রদান করেছিল, তাদের মধ্যে সর্বশেষ যুক্তিটি ছিল ভিয়েতনামিরা অবৈধভাবে 'স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জ' দখল করে আছে। ১৯৩০ এর দশকে ফ্রান্স দ্বীপপুঞ্জটির ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে এবং এটিকে তাদের উপনিবেশ ভিয়েতনামের অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু চীন এটিকে তাদের হাইনান প্রদেশের অংশ হিসেবে দাবি করতে থাকে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালে দ্বীপপুঞ্জটি দক্ষিণ ভিয়েতনামের অংশ ছিল এবং তখন উত্তর ভিয়েতনাম চীনা সহায়তা লাভের জন্য দ্বীপপুঞ্জটিকে চীনের অন্তর্গত বলে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৪ সালে তারা এই স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নেয় দ্বীপপুঞ্জটিকে ভিয়েতনামের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনামের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য চীন আনুষ্ঠানিকভাবে এই কারণটিকে উল্লেখ করে। অথচ ১৯৭৯ সালের চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালে চীন ভিয়েতনাম নিয়ন্ত্রিত স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জ আক্রমণ বা দখলের চেষ্টা করেনি। এজন্য স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জ সংক্রান্ত বিরোধ ১৯৭৯ সালের চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধের পেছনে কেবল গৌণ ভূমিকা রেখেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। ১৯৭৮ সালের নভেম্বরে স্বাক্ষরিত সোভিয়েত-ভিয়েতনামি বন্ধুত্ব চুক্তি অনুযায়ী, ভিয়েতনাম কোনো তৃতীয় পক্ষের দ্বারা আক্রান্ত হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিয়েতনামকে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। কিন্তু সোভিয়েত মূল ভূখণ্ড থেকে ভিয়েতনাম অনেক দূরে অবস্থিত এবং এজন্য ভিয়েতনাম কোনো রাষ্ট্রের দ্বারা আক্রান্ত হলে তাকে সরাসরি সামরিক সহায়তা প্রদান করা ছিল সোভিয়েতদের জন্য অত্যন্ত কঠিন। নৌপথে ভিয়েতনামে সৈন্য প্রেরণ করা ব্যতীত ভিয়েতনামকে সরাসরি সহায়তা করার অন্য কোনো উপায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ছিল না, কিন্তু এ রকম কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ মস্কোর জন্য হতো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে ভিয়েতনামকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করার একমাত্র কার্যকরী উপায় ছিল, চীন-সোভিয়েত সীমান্ত বরাবর চীনের ওপর আক্রমণ চালানো। কিন্তু এটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ চীনের বিপুল জনবল ও পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার সোভিয়েতদের জন্য বিপজ্জনক হতো। তদুপরি চীন-সোভিয়েত যুদ্ধ আরম্ভ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধে চীনের পক্ষে যোগদানের সম্ভাবনা ছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Khmer_Rouge
এই প্রেক্ষাপটে চীনা সরকার হিসেব করে দেখেছিল, তারা ভিয়েতনাম আক্রমণ করলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি এই যুদ্ধে যোগ দেবে না। সেক্ষেত্রে ভিয়েতনাম ও অন্যান্য সোভিয়েতপন্থী রাষ্ট্রগুলো সোভিয়েত মৈত্রীর ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মর্যাদা হ্রাস পাবে। এর ফলে কমিউনিস্ট বিশ্বে চীনের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এবং ভিয়েতনাম চীনের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে বাধ্য হবে। ভিয়েতনামের ওপর আক্রমণ পরিচালনার পেছনে চীনের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ভিয়েতনামি সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান ইউনিটগুলো ধ্বংস করে দেয়া এবং উত্তর ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক অবকাঠামো বিধ্বস্ত করা। চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনকে চারদিক থেকে শত্রুরাষ্ট্র দিয়ে পরিবেষ্টিত করে ফেলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। চীনের উত্তরে সোভিয়েত দূরপ্রাচ্য ও মঙ্গোলিয়ায় সোভিয়েতরা প্রায় ৬ লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছিল এবং দক্ষিণ দিক থেকে চীনকে ঘিরে ফেলার জন্য সোভিয়েতরা ভারত ও ভিয়েতনামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। ভিয়েতনামের অভিজ্ঞ ও তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী সশস্ত্রবাহিনী সম্ভাব্য চীন-সোভিয়েত যুদ্ধের সময় দক্ষিণ দিক থেকে চীনের ওপর আঘাত হানতে পারতো। এজন্য চীনের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের মাধ্যমে ভিয়েতনামি সশস্ত্রবাহিনীর মূল ইউনিটগুলো ধ্বংস করে দেয়া। ভিয়েতনামিরা যাতে চীনের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার পরিবর্তে নিজেদের অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠনের কাজে ব্যস্ত থাকতে বাধ্য হয়, সেজন্য চীনারা ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক অবকাঠামো ধ্বংস করে দিতে আগ্রহী ছিল। এই যুদ্ধ শুরু করার পেছনে চীনা নেতা দেং জিয়াওপিংয়ের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ছিল। তিনি চীনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার এবং চীনা সশস্ত্রবাহিনীর আধুনিকায়ন করতে আগ্রহী ছিলেন। এজন্য তার অভ্যন্তরীণ সমর্থন বৃদ্ধি করার প্রয়োজন ছিল। যদি যুদ্ধে চীনারা বিজয়ী হতো, সেক্ষেত্রে চীনা সরকারের অভ্যন্তরীণ সমর্থন বৃদ্ধি পেতো এবং দেং সেটার ভিত্তিতে নিজস্ব সংস্কার কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন। অন্যদিকে যুদ্ধে যদি চীনারা বিজয়ী না হতো, সেক্ষেত্রে সকলের নিকট চীনা সশস্ত্রবাহিনীর সংস্কার ও আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠতো। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চীন ভিয়েতনামের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। কিন্তু ভিয়েতনামিদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে এক মাসের মধ্যেই তারা ভিয়েতনাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। ভিয়েতনাম কম্পুচিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেনি এবং আরো প্রায় ১০ বছর তারা কম্পুচিয়ায় অবস্থান করে। ভিয়েতনামিরা চীনা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য কেবল সীমান্তরক্ষী ও মিলিশিয়া বাহিনীকে ব্যবহার করেছিল, ফলে ভিয়েতনামি সশস্ত্রবাহিনীর মূল ইউনিটগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। চীনারা উত্তর ভিয়েতনামের অধিকাংশ গ্রাম ও প্রধান প্রাদেশিক শহরগুলো ধ্বংস করে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এর ফলে ভিয়েতনাম চীনবিরোধী কার্যক্রম থেকে বিরত থাকেনি। ১৯৮০ এর দশক জুড়ে চীন ও ভিয়েতনামের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল।
খেমাররুজরা যখন প্রিন্স নরোদম সিহানুকের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, তখন একপর্যায়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে খেমাররুজদের শীর্ষ নেতাদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে খেমাররুজরা কম্বোডিয়ার রাজধানী নম পেন দখল করে নেয়, তারপর পল পট যে কৃষি বিপ্লব বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেন সেটি ছিল চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অনুরূপ। কম্বোডিয়ার সাথে দিনকে দিন মাও পরবর্তী চীনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতা লাভ করতে থাকে, অপরদিকে ভিয়েতনাম সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ‘ট্রিটি অব ফ্রেন্ডশিপ’ নামে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। খেমাররুজরা নিজেদের সীমান্ত পেরিয়ে এসে ভিয়েতনামের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে নিয়মিত আক্রমণ করতে শুরু করেছিল। তারা যুক্তি দেখাচ্ছিল যে পূর্বের খেমার প্রজাতন্ত্রের অধীনে যেসব জায়গা রয়েছে ভিয়েতনাম সীমান্তের মধ্যে, সেসব জায়গা পুনর্দখলের জন্য তারা আক্রমণ পরিচালনা করছে। ১৯৭৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর ভিয়েতনামের সৈন্যরা সীমান্ত দিয়ে কম্বোডিয়ায় আক্রমণ চালায়। খেমাররুজদের প্রতিরোধ টিকেছিল মাত্র ১৩ দিন। ১৯৭৯ সালের ৭ জানুয়ারিতে কম্বোডিয়ার রাজধানী নম পেনের পতন ঘটে ভিয়েতনাম সেনাবাহিনীর হাতে। খেমাররুজরা পলায়ন করে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্তবর্তী গহীন অঞ্চলে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, রাজধানীর পতন হলেও ভিয়েতনামের নিয়ন্ত্রণাধীন পুতুল সরকারের বিরুদ্ধে তারা গেরিলা পদ্ধতিতে সংগ্রাম পরিচালনা করে যাবেন। ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি রাজধানী নম পেম দখলের পর কম্বোডিয়া থেকে নির্বাসিত রাজনীতিবিদ যারা ভিয়েতনামের প্রতি অনুগত ছিলেন, তাদেরকে নিয়ে পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে। সেই সরকারের প্রধান ছিলেন হেং সামরিন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Heng_Samrin
এই পুতুল সরকারই মূলত পল পট ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে নানা মনগড়া প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর পিছে প্রধানত দায়ী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খেমাররুজ শাসনের ইতি টানবার চেয়ে ভিয়েতনামের কাছে (পেছনে ছিল সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী সোভিয়েত ইউনিয়ন) গুরুত্বপূর্ণ ছিল চীনপন্থী সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে এমন এক সরকার গঠন করা, যারা ভিয়েতনামের প্রতি অনুগত থাকবে। তাদের এই উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। কিন্তু দিনের পর দিন কম্বোডিয়ার রাজনীতিতে মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করায় কম্বোডিয়ান জনগণের কাছে ভিয়েতনামের সৈন্যরা ‘দখলদার’ এবং ‘স্বাধীনতা হরণকারী’ হিসেবে চিত্রায়িত হতে শুরু করে। চীন ও আমেরিকার মতো দেশগুলোর (পিংপং ডিপ্লোম্যাসি) কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়ে থাইল্যান্ডের সীমান্তে আত্মগোপন করা খেমাররুজরা ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে শুরু করেছিল।
https://www.history.com/this-day-in-history/pol-pot-overthrown
তারা ভিয়েতনামের সেনাবাহিনীর উপর নিয়মিত অতর্কিত হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করতে শুরু করে। আমেরিকা যখন দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে ভিয়েতনামের গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তখন মার্কিন সৈন্যরা ভেবেছিল উত্তর ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষ তাদের সাদরে বরণ করে নেবে।
https://www.khmertimeskh.com/50673/why-did-vietnam-overthrow-the-khmer-rouge-in-1978/
বাস্তবে দেখা গিয়েছিল, উত্তর ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষে উল্টো মার্কিনিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রেও উত্তর ভিয়েতনামের সেনাবাহিনীর একই অবস্থা হয়েছিল। উত্তর ভিয়েতনামের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ভেবেছিলেন তাদেরকে কম্বোডিয়ার সাধারণ মানুষ সাদরে বরণ করে নেবে, যেহেতু তারা সেই মানুষদের খেমাররুজদের থেকে বাঁচাতে এসেছেন! কিন্তু বাস্তবে হয়েছিল ঠিক উল্টোটা। প্রায় এক দশক ধরে কম্বোডিয়ায় ভিয়েতনাম সেনাবাহিনী ও খেমাররুজদের যুদ্ধ চলেছিল। কম্বোডিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রিন্স নরোদম সিহানুক জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গিয়ে ভিয়েতনামের সামরিক আক্রমণের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই প্রস্তাবে জাতিসংঘের চীনা প্রতিনিধি সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং ভিয়েতনামের সামরিক আক্রমণকে হিটলারের আক্রমণের সাথে তুলনা দেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভিয়েতনামের পুতুল সরকারকে আসন গ্রহণের পরিবর্তে খেমাররুজদের প্রতিনিধিদের আসন গ্রহণ করতে দেয়া হয়েছিল। আমেরিকা এই আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, সেই সাথে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেয় (মূল কারণ সোভিয়েত বিরোধিতা)। এক দশক ধরে গৃহযুদ্ধ চলার পর কম্বোডিয়া থেকে ভিয়েতনাম সৈন্য অপসারণ করে নেয় এবং কম্বোডিয়ায় জাতিসংঘের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে তারা সম্মতি জ্ঞাপন করে।
https://www.bbc.com/news/world-asia-29106034
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Sino-Soviet_split
১৯৩০ এর দশকে মাও সে তুং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব গ্রহণ করার পর কমিন্টার্নের ভূমিকা ছোট হয়ে আসে, মাও সে তুং বিপ্লবের জন্য চীনা কৃষকদের প্রস্তুত করেন। ১৯৪৯ সালে কুয়োমিনতাং সরকারকে তাইওয়ানে হটিয়ে মাও সে তুং কমিউনিস্ট চীনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই বছরের শেষের দিকে তিনি স্তালিনের সাথে মস্কোতে দেখা করেন। এই সফরের সময় স্তালিনের সাথে মাও সে তুং দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিতে দুই দেশ যদি বিদেশি আক্রমণের শিকার হয়, তবে একে অপরকে সামরিক সহায়তার বিধান রাখা হয়। এছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা ও কমিউনিজম এগিয়ে নিতে দুই দেশের যৌথ প্রচেষ্টার কথা বলা হয়েছিল। চীন চুক্তির পর ৩০০ মিলিয়ন ডলার লাভ করে। এছাড়া হাজার হাজার সোভিয়েত গবেষক, বিজ্ঞানী ও ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্টকে চীনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এদের কাজে লাগিয়ে চীনে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে, টেকসই অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে উঠতে থাকে। কোরিয়া উপদ্বীপের যুদ্ধের সময় উত্তর কোরিয়ার পক্ষে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন অংশগ্রহণ করে। মার্কিন সহায়তাপ্রাপ্ত পুঁজিবাদী দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে চীন সেনাবহর ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়ে দিয়ে উত্তর কোরিয়াকে সহায়তা করে। অপরদিকে রাশিয়া চীনের অনুরোধে সেনাবহর না পাঠিয়ে শুধু সামরিক যুদ্ধবিমান ও অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে। অসংখ্য চীনা সৈন্য উত্তর কোরিয়ার পক্ষে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের গা-ছাড়া ভাব চীনকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। স্তালিনের মৃত্যুর পর নিকিতা ক্রুশ্চেভ সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে পার্টির ২০তম কংগ্রেসে 'অন দ্য কাল্ট অব পার্সোনালিটি এন্ড ইটস্ কনসিকোয়েন্সেস' নামে একটি গোপন ভাষণে তিনি স্তালিনের কড়া সমালোচনা করেছিলেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Anti-revisionism
নিকিতা ক্রুশ্চেভের বক্তৃতা চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। চীনের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে স্তালিনের নীতিগুলোকেই অনুসরণ করা হয়েছিল। মাও সে তুং অসংখ্যবার প্রকাশ্যে স্তালিনের প্রশংসা করেছেন। ক্রুশ্চেভ যখন বাজেভাবে স্তালিনের সমালোচনা করেন, তখন মাও সে তুং ক্ষুব্ধ হন। তার মতে, ক্রুশ্চেভ তার পূর্বসুরির রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। এতে চীন-সোভিয়েত সম্পর্কে ভাটা পড়ে। ১৯৬২ সালে কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক মিসাইল স্থাপন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের আশঙ্কা ছিল ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কিউবায় আমেরিকা সামরিক আগ্রাসন চালাতে পারে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Cuban_Missile_Crisis
পরে আমেরিকা যখন সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিশ্চয়তা দেয় যে তারা কিউবায় সেরকম কিছু করবে না তখন সোভিয়েতরা মিসাইলগুলো সরিয়ে নেয়। এই ঘটনায় চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়। মাও সে তুং এই ঘটনাকে আখ্যায়িত করেন 'পুঁজিবাদী মার্কিনীদের হুমকিতে সোভিয়েতদের ভীত হওয়ার ঘটনা' হিসেবে। বাস্তবেও নিকিতা ক্রুশ্চেভের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন পুঁজিবাদী আমেরিকা ও তার মিত্রদের সাথে সরাসরি সামরিক সংঘাত এড়িয়ে চলার নীতি গ্রহণ করে। কোরিয়া যুদ্ধের সময় ক্রুশ্চেভ সরাসরি সামরিক সংঘাত এড়িয়ে চলার যুক্তি প্রয়োগ করে সোভিয়েত সৈন্যদের কোরিয়া উপদ্বীপে পাঠাননি। তার আশঙ্কা ছিল আমেরিকার সাথে যেকোনো সংঘাত পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নেবে। নিকিতা ক্রুশ্চেভ যখন ১৯৫৮ সালে চীনে আসেন, তখন দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সময় মাও সে তুং ক্রুশ্চেভের যৌথ সামরিক প্রকল্পের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ক্রুশ্চেভ পরবর্তীতে যে সোভিয়েত সামরিক ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা চীনে অবস্থান করছিলেন, তাদের দেশে ফিরিয়ে নেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Sino-Soviet_border_conflict
চীনের অবকাঠামোগত অনেক প্রকল্প থমকে গিয়েছিল এতে। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার মতাদর্শিক মিত্র চীনকে ছেড়ে ভারতকে সমর্থন দেয়। ১৯৬৪ সালে মাও সে তুং মস্কোর সাথে চীনের সমস্ত কূটনৈতিক বন্ধনের ইস্তফা টানেন ও মস্কোতে কর্মরত চীনা কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করে নেন। সেই সাথে রাশিয়ার অধীনে থাকা বিতর্কিত পুরোনো জায়গার দাবি নিয়ে হাজির হন। সামরিক সংঘাত এড়াতে দুই পক্ষ অনেকবার আলোচনার টেবিলে বসলেও সবগুলো আলোচনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯৬৮ সালে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উশুরি নদীর দুই পাশে দুই দেশের প্রায় দেড় মিলিয়ন সেনা অবস্থান নিলে সামরিক সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালের দিকে ঝেনবাও দ্বীপে প্রথম সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। পরবর্তীতে দুই পক্ষ বড় ধরনের যুদ্ধ এড়িয়ে যায়। মিখাইল গর্বাচেভের সময় আবার চীন-সোভিয়েত সম্পর্ক পুন:প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৮৯ সালে গর্ভাচেভের চীন সফরের পরিকল্পনাকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। আমেরিকার নেতৃত্বে থাকা পুঁজিবাদী সমাজ চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বকে শুরু থেকে উপভোগ করেছে।
Comments