মরিচঝাঁপি গণহত্যা
মরিচঝাঁপি হলো রায়মঙ্গল ও বাগনা নদীর পলি দ্বারা সৃষ্ট এক দ্বীপ। সুন্দরবনের শেষ জনবসতি কুমিরমারি দ্বীপের ঠিক বিপরীতে মরিচঝাপি। মূল বন্য জগৎ ও মনুষ্য জগতের মধ্যে একটি বাফার এলাকা এটি। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার সময় ভাগ হয়ে যায় এলাকাটি। এর ফলে বর্তমান বাংলাদেশ থেকে বহু বাঙালি শরণার্থী হিন্দু পরিবার পাড়ি দেয় পশ্চিমবঙ্গে। তাদের মধ্যে যারা উঁচুশ্রেণির এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির তারা সহজেই আশ্রয় পায় কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায়। কিন্তু বিপদে পড়ে নম:শূদ্র উদ্বাস্তুরা।ভদ্রলোকদের (!) উদ্বাস্তুদের কলোনিতে তাদের ঠাঁই হয় না। ‘দণ্ডকারণ্য প্রজেক্ট’ এর আওতায় এদের পাঠানো হয় দণ্ডকারণ্য, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যার মালকানগিরি এবং ভারতের ১৬৪টি দুর্গম প্রান্তে। এরা মূলত হতদরিদ্র কৃষিজীবী, মুচি কিংবা দিনমজুর। দণ্ডকারণ্যের পাথুরে জমি, শুকনো মাটি এবং খরায় তপ্ত বনভূমি বাসের অযোগ্য।
https://bn.m.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%9A%E0%A6%9D%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%AA%E0%A6%BF_%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A6%B9%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE
এছাড়া তাদের অনেককে এমন সব পাহাড়ি এলাকায় ফেলে আসা হতো, যেখানে ছিলো হিংস্র প্রাণীর আনাগোনা। সেখানে থাকতো না সুপেয় জলের ব্যবস্থা। এজন্য মারা যায় সেখানকার অনেক বাসিন্দা। সেখান থেকে ১৯৬৪ সালে বেশ কিছু পরিবার কুমিরমারি নামক এলাকা পেরিয়ে প্রথম জনবসতি হিসেবে আশ্রয় নেয় মরিচঝাঁপিতে। দেশভাগের পর তাদের অধিকার নিয়ে বেশ জোরালো আওয়াজ তুলেছিল পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী দলগুলো। এই দলের বুদ্ধিজীবীরা তখন ব্যক্তিগত, সরকারি ও বেসরকারি জমি দখল করে এসব উদ্বাস্তু শরণার্থীদের জন্য বস্তি নির্মাণের পক্ষে আন্দোলন করেছে। জ্যোতি বসুসহ আরও অনেক নেতা সরকারের নিকট চিঠি দিয়েছিলো। ১৯৭৬ সালের ২৫ জানুয়ারি বামফ্রন্ট নেতা জ্যোতি বসু দণ্ডকারণ্যের সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু শিবির মানা ক্যাম্পের কাছে ভিলাই শহরে এক জনসভায় প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন-
"আপনারা আমাদের ভোট দিয়ে কেন্দ্রে আমাদের শক্তিশালী করুন। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত আপনাদের এই অবস্থার পরিবর্তন হবে না।"
তিনি আরও বলেছিলেন-
"আমরা ক্ষমতায় এলে উদ্বাস্তুদের সুন্দরবনে বসতি স্থাপনের ন্যায্য দাবি অবশ্যই মানা হবে।"
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসলে সারা ভারত উদ্বাস্তু সম্মেলনে উপস্থিত থেকে সমর মুখার্জি, হরিদাস মিত্র, রাম চ্যাটার্জি, কিরণময় নন্দ, জম্ববন্ত রাও ধৌতে উদ্বাস্তুদের সুন্দরবনে চলে আসার জন্য আহ্বান জানালেন। ফরোয়ার্ড ব্লকের অশোক ঘোষ সেদিন বলেছিলেন-
"আপনারা সব তৈরি থাকুন, আমরা ডাকলেই আপনারা বেরিয়ে পড়বেন।"
কিরণময় নন্দ মালকানগিরির সভা থেকে বলেছিলেন-
"আপনারা পশ্চিমবঙ্গে চলে আসুন, পাঁচ কোটি বাঙ্গালির দশকোটি হাত আপনাদের অভ্যর্থনা জানাবে।"
১৯৭৭ সালের শেষের দিকে দণ্ডক বাস্তুহারা উন্নয়নশীল সমিতির পরিচালনায় পশ্চিমবঙ্গের প্রতিমন্ত্রী রাম চ্যাটার্জি ও উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতির নেতা সতীশ মণ্ডল একটি সভার আয়োজন করেন এবং ওই সভায় উদ্বাস্তুদের দণ্ডকের জীবনের অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচার নিয়ে আলোচনা হয়। মন্ত্রী রাম চ্যাটার্জি প্রতিশ্রুতি দেন সমস্যা সমাধানের। সেদিন পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু দরদি সরকারের একজন মন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতি পেয়েই স্বভূমে ফিরতে মরিয়া উদ্বাস্তুরা সতীশ মণ্ডলের নেতৃত্বে আওয়াজ তুললো-
“চলো সুন্দরবন চলো।"
"মরবো তো বাঙ্গলার মাটিতেই মরবো।"
১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় বামফ্রন্ট আসীন হলে তাদের প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেয় সতীশ মণ্ডল। কিন্তু তার আবেদনের জবাবে আগের অবস্থান থেকে সরে আসে জ্যোতি বসু। এই পদক্ষেপ সরকার নিতে পারবে না বলে জানান তিনি। তবে বাধা না দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। সরকারের আশ্বাসে ১৯৭৮ সালের মার্চে ৩০,০০০ উদ্বাস্তু আশ্রয় নেয় মরিচঝাঁপিতে। এর আগে তাদের একটি দল সেখানকার মাটি এবং জল পরীক্ষা করে আসে। ১৯৭৮ সালের প্রথমদিক থেকেই উদ্বাস্তুর দল দণ্ডক থেকে ধেয়ে আসে হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ হয়ে সুন্দরবনের জনমানবশূন্য ঝোপঝাড়, কাদা ও নোনাজল বেষ্টিত মরিচঝাঁপি দ্বীপে। এই খেটে খাওয়া মানুষজনের নিজেদের চেষ্টায় মরিচঝাঁপি হয়ে উঠতে থাকে আদর্শ বসতি। সরকারের তরফ থেকে সাহায্য না পেলেও বিভিন্ন সংস্থা কিংবা গানের জলসা থেকে সামান্য সাহায্য পেতো তারা। নিজেদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তারা তৈরি করলো পথ-ঘাট, উচু বাঁধ দিয়ে মাছচাষের ব্যবস্থা। নৌকা তৈরির কারখানা, পাউরুটির কারখানা, কামারশালা, কুমোরশালা, বিশ্রামের জায়গা, আর সন্তানদের শিক্ষার জন্য গড়ে তুললো বিদ্যালয়। যার নাম নেতাজীনগর বিদ্যাপীঠ। এই জনপদটির নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর স্মরণে নাম দেয়া হয়েছিল নেতাজী নগর। কিন্তু ১৯৭৮ সালের ১লা জুলাই সিপিএমের রাজ্যসভার বৈঠকে তাদের এই জায়গা ছেড়ে দিতে বলা হয়। তারা না ছাড়লে তাদের দেখাদেখি অন্যরাও সেখানে যেতে উৎসাহ পাবে বলে যুক্তি দেয়া হয়। বলা হয়, তাদের দখল করা মরিচঝাঁপি হচ্ছে সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্টের অংশ। সেখানে তাদের অবস্থান বেআইনী। কিন্তু মানচিত্র অনুযায়ী তা বেআইনী ছিলো না। আশপাশের দ্বীপবাসীদের বলা হতে থাকে যে, মরিচঝাঁপির এসব শরণার্থী তাদের জীবনে বিপর্যয় বয়ে নিয়ে এসেছে। তাদের বিতাড়িত না করলে এই দ্বীপবাসীরা স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবে না। বলা হতে থাকে মরিচঝাঁপিতে একটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলছে, সেখানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, তারা সুন্দরবনের গাছ কেটে পরিবেশের ক্ষতি করছে! জ্যোতি বসু বিধানসভায় দাঁড়িয়ে সংবাদমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী ও বিরোধীদের সব তথ্য অস্বীকার করে বলেছিলেন যে এই উদ্বাস্তু মানুষগুলিকে কোনোমতেই পশ্চিমবঙ্গে থাকতে দেয়া চলবে না। কারণ তারা মনে করেন মরিচঝাঁপির মানুষরা রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এরা শুধু চোরাচালানকারী নয়, সংরক্ষিত বনাঞ্চলকেও ধ্বংস করে চলেছে। এরা বাম সরকারের স্থিতিশীলতা নষ্টকারী শক্তি! পত্রিকাগুলোকে বলা হয় সরকারকে সাহায্য করতে। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে সরাসরি আক্রমণ করে এসব উদ্বাস্তুদের বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৩০টি লঞ্চ দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় দ্বীপটি। এসব লঞ্চে অবস্থান করে সরকারের মোতায়েন করা পুলিশ। বন্ধ করে দেয়া হয় এই দ্বীপের সাথে বাইরের যোগাযোগ। চালানো হয় কাঁদানে গ্যাস, উপড়ে ফেলা হয় নলকূপগুলো। যেসব নৌকা দিয়ে দ্বীপবাসীরা বাইরে থেকে খাবার আনতে যায়, সেগুলো লঞ্চের সাহায্যে মাঝনদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয় কিংবা ভেঙে ফেলা হয়। চলতে থাকে অর্থনৈতিক অবরোধ। ১৯৭৯ সালের ৩১ জানুয়ারি উদ্বাস্তুদের উদ্দেশ্য করে প্রথম গুলি চালানো হয়। বাসিন্দাদের মতে, ৩৬ জন এই ঘটনায় মারা যায়। তৎকালীন বিচারপতি এসব উদ্বাস্তুদের পক্ষে রায় দেয়। এতে নির্যাতনের পরিমাণ কমলেও দ্বীপটিকে ঘিরে রেখে অচলাবস্থা চালু রাখে সেখানকার পুলিশ। খাদ্য না পেয়ে ঘাস-লতা-পাতা খেতে থাকে সেখানকার মানুষ। পানিও বন্ধ করে দেয়া হয়। মরিচঝাঁপির নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুরা এরপরও ঘাস-পাতা খেয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। বর্ষার পানি ধরে রেখে সেখানকার মানুষ সেই পানি দিয়ে তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ করতো। কিন্তু তাদের পানিতে রাতের বেলা বিষাক্ত দ্রব্য মিশিয়ে দেয়া হয়। এতে সেখানকার পানি ব্যবহারকারীরা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়। খাদ্য আনতে যাওয়ার সময় ২০-৪০ জন যুবককে গুলি করে মারা হয়। প্রায় পাঁচমাস অবরুদ্ধ করে রাখার পরও যখন দ্বীপবাসী জীবন বিসর্জন দিয়েও টিকে আছে, তখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সরাসরি এই দ্বীপে আক্রমণ করে তাদের বিতাড়িত করা হবে। ১৯৭৯ সালের ১৩ই মে শুরু হয় চূড়ান্ত আক্রমণ। জ্বালিয়ে দেয়া হয় বাসিন্দাদের কুঁড়েঘর। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় অনেককে। গ্রেফতার করা হয় সেখানকার যুবকদের। নারীরা শিকার হয় গণধর্ষণের। যারা নৌকা নিয়ে পালাচ্ছিল, তাদের নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয়। কমপক্ষে ১০০-১৫০ জনকে মেরে ফেলে দেয়া হয় নদীর জলে। তিনদিন ধরে তাণ্ডব চালানোর পর ১৯৭৯ সালের ১৬ই মে মরিচঝাঁপি উদ্বাস্তুশূন্য হয়। সরকারি হিসেবে, সেখানে মোট নিহতের সংখ্যা মাত্র ২ জন! অথচ বিভিন্ন হিসেবে দেখা যায়, মৃতের সংখ্যা প্রায় ১৫০ জন। তুষার ভট্টাচার্যের ডকুমেন্টারি ‘মরিচঝাঁপি ১৯৭৮-৭৯: টর্চার্ড হিউম্যানিটি’তে দেখানো হয়-
#অনাহারে মৃত শিশুর সংখ্যা ৯৪ জন
#বিনা চিকিৎসায় মৃত শিশুর সংখ্যা ১৭৭ জন
#ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা ২৪ জন
#মৃতের সংখ্যা ২৩৯ জন।
দণ্ডকারণ্য থেকে যারা এসে জনপদ তৈরি করেছিল, তাদের মধ্যে ১২% আর ফিরে যেতে পারেনি। এখানেই মরে গেছে কিংবা আশেপাশের কোথাও আশ্রয় নিয়েছে। নারীরা আশেপাশের এলাকার পতিতা হিসেবে কাজ শুরু করেছে। ফিরে আসা অনেকে বসতি স্থাপন করেছে অনিরাপদ রেললাইনের পাশের খুপরিতে। মরিচঝাঁপি গণহত্যার আগে ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জনতা দলের মোরারজি দেশাইকে চিঠি লেখেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। তিনি লিখেছিলেন জনতা দলের ২ জন বিধায়ক ও এক সাংসদ উদ্বাস্তুদের সাহায্য করছে। পরে জানা যায় এদের মধ্যে একজন জনতা দলের নেতা হরিপদ ভারতী। জবাবে মোরারজি দেশাই লেখেন-
"আপনার যা ভালো মনে হয় করুন। সঙ্গে আছি। আমাকে এই নিয়ে আর কেউ কিছু জানায়নি। কেউ কিছু বললে আমি আমার জবাব দিয়ে দিবো।"
এই জবাব মহাকরণে পৌঁছানোর পরের দিন ঘটে মরিচঝাঁপি গণহত্যা।
https://bn.m.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%A3

Comments