সোভিয়েত বেঈমান (পর্ব-তিন)

কাজবেক আখতেমিরোভিচ হুদালভ ১৯৬১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের রুশ যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রের অন্তর্গত উত্তর ওসেতীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্রের আলাগিরস্কি জেলায় জন্মগ্রহণ করে। তার পরিবার ছিল জাতিগতভাবে ওসেতীয় এবং ধর্মগতভাবে মুসলিম। তার পিতা আখতেমির হুদালভ উত্তর ওসেতিয়ার রাজধানী ওর্দঝোনিকিদজে শহরে চাকরি করতো এবং হুদালভ ওর্দঝোনিকিদজেতে বেড়ে ওঠে। ১৯৭৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ১৮ বছর বয়সে হুদালভ সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। সে প্রথমে ওর্দঝোনিকিদজে শহরে অবস্থিত কমান্ড স্কুলে এবং পরবর্তীতে সোভিয়েত কাজাখ প্রজাতন্ত্রের রাজধানী আলমাআতা শহরের সামরিক একাডেমিতে প্রশিক্ষণ লাভ করে। ১৯৮৩ সালের আগস্টে হুদালভকে আফগানিস্তানে প্রেরণ করা হয়। সেসময় সে সিনিয়র লেফটেন্যান্ট পদে ছিল। মধ‍্য আফগানিস্তানের পারওয়ান প্রদেশের একটি সোভিয়েত ইউনিটে তাকে মোতায়েন করা হয়। আফগানিস্তানে দায়িত্ব পালন করা সর্বমোট ৬ লক্ষ সোভিয়েত সৈন‍্যের মধ‍্য থেকে দলত‍্যাগ করেছিল মোট ৬৪ জন। হুদালভ ছিল এসব বেঈমানদের মধ‍্যে একজন। ১৯৮৩ সালের আগস্ট থেকে ১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরের বেশি সময় ধরে আফগানিস্তানে দায়িত্ব পালন করে সে। ১৯৮৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হুদালভের ইউনিটের এক সৈনিক নিখোঁজ হয়। তাকে খুঁজে বের করার জন‍্য হুদালভ সোভিয়েত ঘাঁটি থেকে বের হলেও সে আর কখনো ফিরে আসেনি। সেসময় ঘাঁটির বাইরে একাকী চলাচল করা সোভিয়েত সৈন‍্যদের জন‍্য মোটেই নিরাপদ ছিল না এবং হুদালভ ফিরে না আসায় তার ইউনিটের সদস‍্যরা ধরে নেয় যে হুদালভ আফগান জঙ্গিদের হাতে বন্দি হয়েছে। সোভিয়েত সেনাবাহিনীর কাগজপত্রে হুদালভকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। হুদালভ সোভিয়েত সেনাবাহিনী থেকে দলত‍্যাগ করে স্থানীয় একটি জঙ্গি গ্রুপে যোগদান করে। হুদালভের দলত‍্যাগ ছিল আফগান জঙ্গি ও তাদের সমর্থক পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর জন্য বড় ধরণের প্রচারণামূলক বিজয়। তা সত্ত্বেও প্রথমদিকে তারা এই তথ‍্যটি গোপন রাখে, কারণ হুদালভের পরিকল্পনা ছিল অন‍্য রকম। আফগান যুদ্ধ চলাকালে খুব কম সময়ই জঙ্গিরা সোভিয়েত সৈন‍্যদের বড় কোনো ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাতো, কারণ এই ঘাঁটিগুলোর প্রতিরক্ষা ব‍্যবস্থা ছিল অত‍্যন্ত শক্তিশালী। জঙ্গিরা মূলত আক্রমণ করতো ছোট ছোট সোভিয়েত ইউনিটগুলোর ওপর এবং পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারী সোভিয়েত কনভয়গুলোর ওপর। আফগান যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে সোভিয়েত সৈন‍্যরা দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ছোট ছোট ফাঁড়ি স্থাপন করেছিল। এই ফাঁড়িগুলোর ওপর জঙ্গিরা প্রায়ই আক্রমণ চালাতো, কিন্তু আফগান যুদ্ধের পুরো সময়ে এরকম একটি ফাঁড়িও জঙ্গিরা দখল করতে পারেনি, কারণ সোভিয়েত সৈন‍্যদের ছিল উন্নততর অস্ত্রশস্ত্র ও উচ্চমানের প্রশিক্ষণ। হুদালভ পারওয়ান প্রদেশে এই ছোট ছোট ফাঁড়িগুলো আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। আফগান সেনাবাহিনী থেকে দলত‍্যাগকারী প্রায় এক ডজন আফগান তাজিক সৈন‍্যকে নিয়ে সে ছোট্ট একটি জঙ্গি ইউনিট গঠন করে। এই ইউনিটের সদস‍্যরা সোভিয়েত সেনাবাহিনীর উর্দি পরিধান করতো এবং সোভিয়েত সৈন‍্য সেজে বিভিন্ন সোভিয়েত ও আফগান সেনা ফাঁড়িতে আক্রমণ করতো। আফগানিস্তানে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন‍্যদলে বহু তাজিক সৈন‍্য ছিল, যারা আফগান তাজিকদের সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাগতভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ, এজন্য এই জঙ্গিদের দেখে কেউ সন্দেহ করতো না। এই পদ্ধতিতে হুদালভ ও তার সৈন‍্যরা ১৯৮৫ সালের প্রথমদিকে বাগরাম অঞ্চলের বিভিন্ন ফাঁড়ি আক্রমণ করে সোভিয়েত ও আফগান সৈন‍্যদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করেছিল। কেজিবির তদন্তের ফলে প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসে। সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ হুদালভকে 'বিশ্বাসঘাতক' হিসেবে ঘোষণা করে এবং তার ছবি আফগানিস্তানে নিযুক্ত সোভিয়েত সৈন‍্যদের মধ‍্যে প্রচার করে। হুদালভের বিশ্বাসঘাতকতার সংবাদ পশ্চিমা গণমাধ্যম লুফে নেয়, কারণ এসময় আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনাবাহিনী থেকে দলত‍্যাগী সৈন‍্যদের নিয়ে ব‍্যাপক প্রচারণা চালানো ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মার্কিন ও অন‍্যান‍্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের চালানো তথ‍্যযুদ্ধ এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অংশ। হুদালভের কৃতিত্বকে পশ্চিমা গণমাধ্যম ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করে। তারা দাবি করে যে, হুদালভের সঙ্গে আরো ১২ জন সোভিয়েত তাজিক সৈন‍্য আফগান জঙ্গিদের সঙ্গে যোগদান করেছে! কিন্তু MIA (Missing in Action) Advocacy Group এর তথ‍্যমতে, আফগান যুদ্ধে মোট ২৭০ জন সোভিয়েত সৈন‍্য নিখোঁজ হয়, যাদের মধ‍্যে মাত্র ৪ জন ছিল তাজিক।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Missing_in_action

হুদালভের সঙ্গে ১২ জন সোভিয়েত তাজিক সৈন্যের দলত‍্যাগ এর দাবীর উদ্দেশ‍্য ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এটা বোঝানো যে, সোভিয়েত মুসলিমদের সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য নেই! সোভিয়েতরা তার কৌশল সম্পর্কে জেনে যাওয়ায় তার আক্রমণের কার্যকারিতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। ১৯৮৮ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে সৈন‍্য প্রত‍্যাহার শুরু করে, তখনও হুদালভের গ্রুপটি বাগরাম অঞ্চলে সক্রিয় ছিল এবং সোভিয়েত সৈন‍্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পরও আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকার টিকে ছিল এবং সেখানকার গৃহযুদ্ধ পুরোদমে চলছিল। এসময় হুদালভ এক পশ্চিমা সাংবাদিককে সাক্ষাৎকারে জানায়, কাবুল থেকে কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত না করা পর্যন্ত তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। ১৯৯২ সালের এপ্রিলে কাবুলের কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটে এবং কাবুল দখল নিয়ে আফগান জঙ্গিদের মধ‍্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই গৃহযুদ্ধে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ ছিল বুরহানউদ্দিন রাব্বানী ও আহমদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বাধীন জামিয়াত এ ইসলামি এবং গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ারের নেতৃত্বাধীন হেজব এ ইসলামি দল।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Burhanuddin_Rabbani

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ahmad_Shah_Massoud

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Gulbuddin_Hekmatyar

হুদালভ এই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। যতদূর জানা যায়, কোনো কারণে হেকমাতিয়ার হুদালভের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। ১৯৯৬ সালে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর হুদালভকে মুক্তি প্রদান করা হয় বলে ধারণা করা হয়। প্রখ‍্যাত রুশ সাংবাদিক আর্তিওম বোরোভিকের আফগান যুদ্ধ নিয়ে লিখিত বই 'The Hidden War' এ হুদালভের ঘটনার বিবরণ রয়েছে।

https://www.amazon.com/Hidden-War-Russian-Journalists-Afghanistan/dp/080213775X














Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]