তেভাগা আন্দোলন- যে বিপ্লব সংশোধনবাদীদের জন্য চপেটাঘাত হয়ে থাকবে আজীবন

 


ভারতবর্ষ কৃষিনির্ভর হলেও বেশিরভাগ কৃষক ছিল ভূমিহীন। তারা কোনো জমিদার বা জোতদারের অধীনে জমি বর্গা নিয়ে চাষ করতো। চাষাবাদ শেষে উৎপন্ন ফসলের তিনভাগের দু'ভাগ দিতে হতো জমির মালিক তথা জমিদার বা ভূস্বামীদের। অবশিষ্ট একভাগ পেতো বর্গাচাষী। অথচ উৎপাদন ব্যয় সংশ্লিষ্ট সকল খরচ এবং কায়িক শ্রম দিতো চাষীরা। মালিক ও বর্গাচাষীদের মধ্যে প্রচলিত ফলন ভাগ করার প্রচলিত ব্যবস্থা ১৯৪৬ সালের দিকে হুমকির মুখে পড়ে, যখন বর্গাচাষীরা একে অন্যায় বলে অভিহিত করে। তারা দাবি জানায়, উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের একভাগ পাবে জমির মালিকরা আর বাকি দু’ভাগ দিতে হবে বর্গাচাষীদের। তাদের এই তিনভাগের এক ভাগ দাবী থেকে আন্দোলনের নাম হয়ে যায় 'তেভাগা আন্দোলন'। ভারতবর্ষে কৃষক সম্প্রদায় নিঃস্ব হতে থাকে ব্রিটিশ আমল থেকে। এর আগেও বিদেশি বণিক গোষ্ঠীর দ্বারা শোষণের শিকার হয়েছে। মোগল শাসনামলে জমির মালিক বা শাসনকর্তাদের জমির এক-তৃতীয়াংশ বা তার চেয়েও কম পরিমাণ খাজনা প্রদান করলেও চলতো। ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ গভর্নর কর্নওয়ালিস কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালুর পর থেকে জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। কৃষকরা পরিণত হয় ভাড়াটে মজুরে। জমিদারের সাথে ফসল উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক না থাকায় কৃষক ও জমিদারদের মাঝে জোতদার নামক মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরা জমিদারদের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে কৃষকদের মাধ্যমে চাষ করাতো এবং খাজনা আদায় করতো। জমির জরিপ না করেই রাজস্ব নির্ধারণ করা হতো। ফলস্বরূপ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জমির তুলনায় রাজস্বের হার অনেক বেশি হতো।

http://www.weeklyekota.net/?page=details&serial=3034

একসময় ফসলের বিনিময়ে খাজনা হিসেবে অর্থ নেয়া শুরু হয়। মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে হলেও অতিরিক্ত খাজনা প্রদান করতে বাধ্য করা হতো। অত্যাচার ও নিপীড়নের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করা হতো। এভাবে পর্যায়ক্রমিক শোষণ ও কৃষকের দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে বর্গাচাষীদের উপর বর্গার একভাগ ফসল চাপিয়ে দেয়া হয়৷ সর্বস্বান্ত চাষীদের জমিদার ও জোতদারদের উপর ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৩৬ সালে সোচ্চার কৃষকদের নিয়ে গঠিত হয় 'নিখিল ভারত কৃষক সভা'। তাদের নীতি ছিল 'লাঙল যার জমি তার'। ১৯৪০ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দেয় 'ফ্লাউড কমিশন'। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, কৃষকদের জমির মালিকানা প্রদান এবং উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দু'ভাগ মালিকানা চাষীদের প্রদান করতে সুপারিশ করে এ কমিশন। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ মারা যায়। মাঝারি ও প্রান্তিক কৃষকরা অবশিষ্ট জায়গাজমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। ১৯৪৬ সালে বাংলার প্রাদেশিক কৃষক সভা ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সূচনা হয় তেভাগা আন্দোলনের। তেভাগা আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল বর্গাচাষীদের দ্বারা উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দু'ভাগ দিতে হবে চাষীদের এবং বাকি এক ভাগ পাবে ভূস্বামীরা। যেসব মালিক দিতে রাজি হবে না, তাদের জমিতে কোনো কৃষক কাজ করবে না। সেই সাথে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, উচ্চবর্ণ হিন্দুদের বাড়িতে কোনো নমঃশূদ্র বা মুসলমান কৃষিকাজ করবে না। তাছাড়া যেসব কৃষক পান খায়, তারা নিজেরাই পান চাষ করে খাবে অথবা পান খাওয়া ছেড়ে দেবে। বারুইদের কাছ থেকে আর পান কিনবে না।

https://www.historydiscussion.net/history-of-india/provisions-of-the-permanent-settlement-act-of-1793/2557

তারা আরো সিদ্ধান্ত নেয় এবার ধান উঠবে কৃষকের ঘরে। তারা সংঘবদ্ধভাবে ধান কাটবে। এক দল ধান কাটবে আর আরেক দল তীর, ধনু, বল্লম নিয়ে পাহারা দেবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ধান কাটা হবে। প্রতিটি তেভাগা আন্দোলনের কেন্দ্রে এভাবে স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করা হয়েছিল। ১৯৪৬-৪৭ সালে দুই বাংলা মিলিয়ে মোট ১৯টি জেলায় তেভাগা আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল। আন্দোলনটি সংগঠিত হয় দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, যশোর, খুলনা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, পাবনা, ফরিদপুর, হাওড়া, হুগলী, মালদহ, বাঁকুড়া, নদীয়া, চব্বিশ, পরগণা, মেদিনীপুর ও জলপাইগুড়ি ইত্যাদি জেলায়। তবে দিনাজপুর, রংপুর, জলপাইগুড়ি, খুলনা, ময়মনসিংহ, যশোর এবং চব্বিশ পরগনা জেলায় এ আন্দোলনের সর্বাধিক তীব্রতা অনুভূত হয়। তেভাগা আন্দোলনে সম্মুখভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ, চিয়ার সাঁই, ময়মনসিংহের কমরেড মণি সিংহ, আলতাফ আলী, জহুর উদ্দিন মুন্সি ও মৌলভী আব্দুল হান্নান, বগুড়ার ডা. আব্দুল কাদের, রংপুরের তগনারায়ন, রাজশাহীর রমেন মিত্র, ইলা মিত্র, কাছিম মিয়া ও যশোরের নূর জালালসহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। ৬০ লক্ষ বর্গাচাষী এ আন্দোলনে অংশ নেয়। দিনাজপুর জেলার তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমা ছিল তেভাগা আন্দোলনের মূল সূতিকাগার। তৎকালীন দিনাজপুরের ৩০টি থানার মধ্যে ২২টি থানাতেই ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের প্রভাব। দিনাজপুরে তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ। তাকে তেভাগা আন্দোলনের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে। নেত্রকোনার সিংহের বাংলা, রামেশ্বরপুর এবং কাইলাটিতে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত কিষাণ সম্মেলন। রংপুরের নীলফামারি মহকুমায় তেভাগা আন্দোলন ব্যাপক ভয়ঙ্কর আকার লাভ করে। কৃষকরা আন্দোলনের অংশ হিসেবে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে যৌথভাবে ধান কাটছিল। ঠিক তখনই জোতদারদের লাঠিয়াল বাহিনী নৃশংসভাবে কৃষকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কৃষকরা সাহসিকতার সঙ্গে লাঠিয়াল বাহিনীকে হটিয়ে দেয়। লাঠিয়াল বাহিনী রংপুরের কৃষক নেতা তগনারায়ণকে গুলি করে এবং বাচ্চু মামুদকে গুরুতরভাবে জখম করে। কৃষকরা পুলিশের কাছ থেকে তগনারায়ণের লাশ কেড়ে নিয়ে পরের দিন ২৫ হাজার জনতার এক ঐতিহাসিক মিছিলে সারা শহর কাঁপিয়ে তোলে। এর প্রভাব পড়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে। কিছুদিন পর দিনাজপুর জেলার পতিরাম থানার খাঁ পুরে কৃষক নেতা চিয়ার সাঁইসহ মোট ২৬ জন কৃষককে হত্যা করা হয়। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে চিচির বন্দরে কৃষক শিবরাম ও জমিরউদ্দীনকে, ময়মনসিংহের সর্বেশ্বর ডালুকে হত্যা করা হয় এবং সাঁওতাল, হিন্দু, মুসলমান কৃষকদের উপর বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়। কৃষকরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জলপাইগুড়ির বোদা, দেবীগন্থ, পচাগড়, সুন্দরদিঘী এবং মেদিনীপুর জেলার তমলুক, কেশপুর, দাসপুর, চন্দ্রকোণা, নন্দীগ্রাম, পাঁশকুড়া ও মহিষাদলে তেভাগা আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে। এভাবে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব বাংলা মিলিয়ে ১৯টি জেলায় তীব্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। সরকার সৈন্য নামিয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, নারীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। পুলিশের হাতে অনেক আদিবাসী ও কৃষক নিহত হয়, জেলাগুলোকে বন্দীশিবিরে রূপান্তর করা হয়। সারাদেশে প্রায় তিন হাজার কৃষক গ্রেফতার হয় এবং ৫০ জন কৃষককে হত্যা করা হয়। কমরেড মণি সিংহ তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে তার 'জীবন সংগ্রাম' গ্রন্থে বলেছেন-

"ষাট লাখ বর্গা বা ভাগচাষী, হিন্দু-মুসলমান, উপজাতি মেয়ে-পুরুষ জীবনকে তুচ্ছ করে ঐ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাংলার মাটি হিন্দু-মুসলমান ও কৃষকদের রক্তে লালে লাল হয়ে বিখ্যাত এক আন্দোলনের সৃষ্টি করেছিল। সারা পৃথিবীতে যত কৃষক আন্দোলন হয়েছে বাংলার তেভাগা আন্দোলন তার মধ্যে অন্যতম।"

তেভাগা আন্দোলন পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গে এমন অগ্রসর হয়েছিল, যে কৃষকেরা সেসব অঞ্চলকে তেভাগা এলাকা হিসাবে ঘোষণা করে। সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিধানসভায় ১৯৪৭ সালের ২২ জানুয়ারি ‘বঙ্গীয় বর্গাদার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ বিল-১৯৪৭' উত্থাপন করে। আন্দোলনের চাপের মুখে ভূস্বামীগণ প্রায় ৪০% বর্গাচাষীকে স্বেচ্ছায় তেভাগা দেয় এবং ভূস্বামীরা আন্দোলনকারীদের সাথে আপোস করে মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। আন্দোলনে তীব্রতায় খাজনার নামে বলপূর্বক অর্থ আদায় বন্ধ বা সীমিত করা হয় এবং ১৯৫০ সালের ‘জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০’ বিলের মধ্য দিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটানো হয়। তেভাগা আন্দোলনে নারীরা কখনো পুরুষের ধান কাটায় পাহারা দিয়েছে, কখনোবা শত্রুদের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, আবার কখনো তীর-বল্লম হাতে তোলে নিয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাজবংশী মেয়ে ভাগুনী, জয়বর্মনী, দীপপুরী, মাতিবর্মনী, শিখা বর্মনী এবং নড়াইলের নমশূদ্র কৃষকবধূ সরলাদি প্রমুখ। কিন্তু তেভাগা আন্দোলনের অগ্রভাগের নেতৃত্বে ছিলেন ইলা মিত্র। সাঁওতালদের কাছে তিনি 'রানীমা' নামে পরিচিত। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি তিনি রোহনপুরে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। গ্রেফতার অবস্থায় পুলিশের বর্বর পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হন ইলা মিত্র। ইলা মিত্র কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নির্যাতনের বিবৃতি দিয়েছেন-

"সেলের মধ্যে আবার এসআই সিপাইদের গরম সিদ্ধ ডিম আনতে হুকুম দিলো এবং বললো, 'এবার সে কথা বলবে'। তারপর চার পাঁচজন সিপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরে চিৎ করে শুইয়ে রাখলো। একজন আমার যৌনাঙ্গের মধ্যে একটি গরম সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দিলো। আমার মনে হচ্ছিলো আমি যেন পুড়ে যাচ্ছিলাম। এরপর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। ৯/১/৫০ তারিখে সকালে আমার জ্ঞান ফিরে এলো, তখন উপরোক্ত এসআই এবং কয়েকজন সিপাই আমার সেলে এসে তাদের বুট দিয়ে আমার পেটে লাথি মারতে শুরু করলো। এরপর আমার ডান পায়ের গোড়ালিতে একটি পেরেক ফুটিয়ে দেয়া হলো। সেসময় আধা-চেতন অবস্থায় পড়ে থেকে আমি এসআইকে বলতে শুনলাম, 'আমরা আবার রাত্রিতে আসছি এবং তুমি যদি স্বীকার না করো তাহলে সিপাইরা একে একে তোমাকে ধর্ষণ করবে। গভীর রাত্রিতে এসআই এবং পুলিশরা ফিরে এলো এবং তারা আমাকে সেই হুমকি দিলো। কিন্তু আমি যেহেতু তখনও কাউকে কিছু বলতে রাজি হলাম না, তাদের মধ্যে তিন-চারজন আমাকে ধরে রাখলো এবং একজন সিপাই সত্য সত্যই ধর্ষণ করতে শুরু করলো। এরপর আমি আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। পরদিন ১০/১/৫০ তারিখে যখন জ্ঞান ফিরে এলো তখন আমি দেখলাম যে, আমার দেহ থেকে দারুণভাবে রক্ত ঝরছে আর আমার কাপড়-চোপড় রক্তে সম্পূর্ণ ভিজে গিয়েছে। সেই অবস্থায় আমাকে নাচোল থেকে নবাবগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নবাবগঞ্জের জেল গেটের সিপাইরা জোরে ঘুষি মেরে আমাকে অভ্যর্থনা জানালো।"

তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকদের ভেতর আন্দোলনটি সংগঠিত করে তোলে কম্যুনিস্ট পার্টি। ইলা মিত্রের স্বামী রামেন্দ্র মিত্রকে তেভাগার আদর্শ ছড়িয়ে দিতে মনোনীত করে পার্টি। তখন তিনি স্বামীর সাথে পায়ে হেঁটে কাদা-জঙ্গল পেরিয়ে কৃষকদের একত্র করতে কাজ করে গিয়েছেন। যশোর, দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, চব্বিশ পরগণা, খুলনাসহ মোট ১৯টি জেলায় আন্দোলন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লেও তীব্র হয়ে ওঠেনি পূর্ববাংলায়। ১৯৪৮-৫০ সালে দ্বিতীয় দফায় তেভাগা আন্দোলন শুরু হলে পাকিস্তান সরকার তেভাগা আন্দোলনকে ভারতের ষড়যন্ত্র বলে ঘোষণা দেয়। বৃটিশ সরকারের অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল নগেন্দ্র সেনের গ্রামের বাড়ি ছিল যশোরে (বর্তমান ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রাম)। চাকরির কারণে পরিবার নিয়ে কলকাতায় থাকতেন। সেখানে ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর জন্ম হয় তার মেয়ে ইলার। ইলা সেন লেখাপড়া করেছিলেন বেথুন স্কুল আর বেথুন কলেজে। প্রথম বাঙালি মেয়ে হিসেবে ১৯৪০ সালের জাপান অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেবার অলিম্পিকের আসর বসেনি। হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে কলকাতা মহিলা সমিতির সক্রিয় সদস্য হিসেবে আন্দোলন শুরু করেন তিনি। ১৮ বছর বয়সে কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৫ সালে ইলা সেনের বিয়ে হয় রামেন্দ্র মিত্রের সাথে। জমিদার বংশের ছেলে হয়েও কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন রামেন্দ্র। জমিদার বাড়ির বউ হয়ে ইলা মিত্রকে অনেক দিন অন্দরমহলে কাটাতে হয়েছিল। রামেন্দ্র মিত্রের বন্ধু আলতাফ মিয়ার বালিকা বিদ্যালয় করার উদ্যোগ ইলা মিত্রের জীবনে পরিবর্তন নিয়ে এলো। মাত্র চারজন ছাত্রী আর নানারকম বাধা নিয়ে প্রথমদিকে কাজ শুরু করলেও দ্রুত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। মুসলীম লীগ ক্ষমতায় আসার পর কম্যুনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় অনেক নেতাকর্মী। সবকিছুর প্রতিকূলে শোষিত কৃষকদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তখনও ইলা মিত্র স্বামী রমেন্দ্র মিত্রের সাথে করে চলেছেন তেভাগার আন্দোলন। অবশেষে তাদের আত্মগোপন করতে হয় চন্ডীগড় গ্রামে। পাকিস্তান সরকার নিপীড়ন করে তেভাগা আন্দোলন চিরতরে বন্ধ করে দিতে চায়। জ্বালিয়ে দেয় গ্রামের পর গ্রাম। হত্যা করা হয় ১৫০ কৃষককে। চন্ডিগড় গ্রামে সাঁওতালদের একত্র করে তাদের ভেতর প্রতিরোধের মনোভাব গড়ে তোলেন ইলা মিত্র। পুলিশ খবর পায় এখানে লুকিয়ে আছে তেভাগার বিদ্রোহীরা। ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি পুলিশ গ্রামে হানা দিয়ে তেভাগা আন্দোলনে জড়িত অভিযোগে গ্রেফতার করতে আসে দু'জন কৃষককে। গ্রামের কৃষকদের ভয় দেখাতে গুলি ছুঁড়লে মৃত্যু হয় এক কৃষকের। উত্তেজিত গ্রামবাসী হত্যা করে ৬ জন পুলিশকে। পুলিশ আর মিলিটারী মিলে ৭ জানুয়ারি গ্রাম ঘেরাও করলে শেষমুহুর্তে দলবলসহ ধরা পড়ে যান ইলা মিত্র। "ইলা মিত্রের জবানবন্দি" বইটিতে ইলা মিত্র বলেছেন-

“প্রচণ্ড তর্জন গর্জনের শব্দ শুনে চমকে উঠলাম, চেয়ে দেখি হরেককে দলের মধ্য থেকে মারতে মারতে বার করে নিয়ে আসছে। ওদের মুখে সেই একই প্রশ্ন, 'বল, ইলা মিত্র সে-ই পুলিশদের হত্যা করবার আদেশ দিয়েছিল। না বললে মেরে ফেলবো, একদম মেরে ফেলবো।' আমি চেয়ে আছি হরেকের মুখের দিকে। অদ্ভুত ভাববিকারহীন একখানি মুখ। অর্থহীন দৃষ্টিতে শূন্যপানে তাকিয়ে আছে। ওদের এতসব কথা যেন ওর কানেই যাচ্ছে না। ক্ষেপে উঠলো ওরা। কয়েকজন মিলে ওকে মাটিতে পেড়ে ফেললো। তারপর বুট দিয়ে বুকে পেটে সজোরে লাথি মেরে চললো… আমাদের ছেড়ে চলে গেছে হরেক। আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। একটু আগেই আমি কেঁদেছিলাম। কিন্তু এখন আমার সমস্ত কান্না শুকিয়ে গেছে। তার পরিবর্তে ভিতর থেকে প্রচন্ড একটা জেদ মাথা তুলে জেগে উঠেছে। আমার মন বলছে, মারুক, মারুক, ওরা আমাকেও এমনি করে মারুক। আর মনে হচ্ছে, এই যে আমাদের কয়েকশো সাথী এদের কাউকে দিয়ে ওরা কথা বলাতে পারবে না, কিছুতেই না। ওদের হার হয়েছে। ওদের হার মানতে হবে।”

http://www.amarboi.com/2016/04/elamitrer-jobanbondi.html?m=1

রাজশাহী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিচার চলাকালে নিজের উপর চলা অত্যাচারের বর্ণনা দেন তিনি। বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় তার। মাওলানা ভাসানীসহ সাধারণ ছাত্রজনতা তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। অবশেষে চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি দিতে রাজি হয় পাকিস্তান সরকার। ঢাকা থেকে চলে যান কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কংগ্রেস প্রথমে তাকে ভারতের নাগরিকত্ব দিতে রাজি না হলেও রমেন্দ্র মিত্রের স্ত্রী হিসেবে নাগরিকত্ব প্রদান করে। ১৯৬৭-৭৮ সাল পর্যন্ত পর পর চারবার পশ্চিমবঙ্গের লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে রমেন্দ্র ও ইলা মিত্র বাংলাদেশের হয়ে কাজ করেছেন। তিনি শত শত বিঘা জমি দান করে গেছেন কৃষকদের নামে।












Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]