জাতিসংঘের প্রতিনিধি হত্যা
কাউন্ট ফোক বার্নাডোট ছিলেন সুইডিশ রাজপরিবারের সদস্য। ১৮৯৫ সালে স্কটহোমে জন্মগ্রহণ করা ফোক বার্নাডোটের দাদা ছিলেন সুইডেনের রাজা দ্বিতীয় অস্কার। শিক্ষাজীবন শেষ করে বার্নাডোট সুইডিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে মেজর পদ পর্যন্ত উন্নীত হন। পরে তিনি সুইডেনের বয়স্কাউটের পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
https://www.jewishvirtuallibrary.org/count-folke-bernadotte
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সুইডিশ বয়স্কাউটকে সুইডেনের প্রতিরক্ষাবাহিনীর সাথে সমন্বিত করার উদ্দেশ্যে তাদের অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান পরিচালনার এবং উদ্ধারকর্মের উপর প্রশিক্ষণ দেন। ১৯৪৩ সালে তাকে সুইডিশ রেড ক্রসের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি যুদ্ধাহত সেনা ও যুদ্ধবন্দী নাগরিকদের উদ্ধার করার জন্য নাৎসি এবং মিত্র বাহিনীর মধ্যে অস্ত্রবিরতি কার্যকর করার প্রচেষ্টা চালান। তার মধ্যস্থতায় যুদ্ধ সমাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন বন্দীশালা ও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে প্রায় ৩১ হাজার বন্দী মুক্তিলাভ করে।
https://www.amazon.com/Curtain-Falls-Last-Third-Reich-ebook/dp/B01BXA10OK
তিনি হেনরিখ হিমলারকে আত্মসমর্পণের ব্যাপারে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন, যদিও মিত্রবাহিনী সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। এসব কারণে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ তাকে ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করে। ১৯৪৮ সালের ২০মে তার উপর এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
https://unispal.un.org/UNISPAL.NSF/0/A9A8DA193BD46C54852560E50060C6FD
তার দায়িত্ব ছিল ১৪ই মে পাশ হওয়া জাতিসংঘের রেজোল্যুশন ১৮৬ অনুসারে ফিলিস্তিনে বিবাদমান দুই পক্ষের সাথে আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য শান্তি প্রস্তাব উত্থাপন করা। কাউন্ট বার্নাডোট জুনের ১১ তারিখ থেকে দুই পক্ষের মধ্যে একমাসের যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে সক্ষম হন। তিনি কায়রো, বৈরুত, আম্মান ও তেল আবিবে গিয়ে বিবাদমান পক্ষগুলোর নেতাদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে আসেন যে, ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিনকে ভাগ করে পাশ হওয়া জাতিসংঘের রেজোল্যুশনটি ছিল দুর্ভাগ্যজনক।
https://www.jewishvirtuallibrary.org/the-assassination-of-count-bernadotte
তিনি সংকট সমাধানের উদ্দেশ্যে ভিন্ন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যেখানে ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল নামে দু'টি ভিন্ন রাষ্ট্রের পরিবর্তে আরব ও ইহুদী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ইউনিয়ন গঠন করার প্রস্তাব দেয়া হয়।
https://web.archive.org/web/20120622073547/http://unispal.un.org/UNISPAL.NSF/0/EA66369DAF3BE7E88025649E004395C8
বার্নাডোটের প্রস্তাবের প্রাথমিক খসড়ায় ইহুদীদের জন্য তুলনামূলকভাবে ছোট এবং আরবদের জন্য ফিলিস্তিন ও ট্রান্সজর্ডানের সমন্বয়ে অপেক্ষাকৃত বড় ভূমি বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। হাইফা এবং লাইডা এয়ারপোর্টকে শুধুমাত্র ইহুদীদের দখলে না রেখে মুক্ত এলাকায় রূপান্তরের কথা বলা হয়। নেগেভ ও জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ আরবদের হাতে ছেড়ে দেয়ার এবং গ্যালিলিকে ইহুদীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রস্তাব ছিল এতে। ইহুদীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ইউরোপ থেকে ইহুদী অভিবাসী প্রবেশের সীমার উপর কোনো নিষেধাজ্ঞা এতে ছিল না, কিন্তু ইসরায়েল থেকে বাস্তুচ্যুত তিন লাখ আরব শরণার্থীকে অবিলম্বে ইসরায়েলে ফিরতে দেয়ার শর্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল এই প্রস্তাবে। বার্নাডোটের প্রস্তাব ইহুদীরা প্রত্যাখ্যান করে। জায়নবাদী ইহুদীরা কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনের বুকে যে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে আসছিল, সেই স্বপ্ন সফল করতে স্থানীয় আরবদের উচ্ছেদ করা এবং জেরুজালেমসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর দখলে রাখাটা ছিল জরুরী। বার্নাডোটের প্রস্তাবের অনেকগুলো শর্ত ছিল তাদের এই স্বার্থের প্রতিকূলে। সেসময় যুদ্ধবিরতির আড়ালে ইউরোপ থেকে জাহাজ ভর্তি অস্ত্র এবং ইহুদী স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধাদের আগমনের ফলে ইহুদীদের মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস জন্মাতে থাকে যে, রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে সামরিক পদক্ষেপ তাদের পক্ষে বেশি সহায়ক হবে। জুলাইয়ের ৮ তারিখ থেকে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এরপর বার্নাডোট তার প্রস্তাবে কিছু পরিবর্তন আনেন এবং ব্রিটিশ, মার্কিন, ইসরায়েলি ও আরব বর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে তিনি প্রস্তাবের দ্বিতীয় খসড়া চূড়ান্ত করেন। ইসরায়েল দ্বিতীয় খসড়ার সাথেও একমত পোষণ করেনি। যেহেতু বার্নাডোটের সাথে মার্কিন এবং ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের আলাপ হয়েছিল, তাই সম্ভাবনা ছিল এটি কিছুটা পরিবর্তিত রূপে হলেও জাতিসংঘে পাশ হয়ে যেতে পারে। ঝুঁকিটা নিতে রাজি ছিল না ইহুদীদের সন্ত্রাসী সংগঠন লেহি। লেহি'র সদস্যরা ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে বার্নাডোটকে হুমকি দিতে শুরু করে "এজেন্ট বার্নাডোটের প্রতি পরামর্শ: আমাদের দেশ ছেড়ে বেরিয়ে যাও।" তারা বার্নাডোটকে ইহুদীবিদ্বেষী এবং নাৎসি বাহিনীর দালাল হিসেবে অভিযুক্ত করে। তাদের দাবি অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বার্নাডোট ইচ্ছে করে আরো বেশি সংখ্যক ইহুদীকে নাৎসিদের হাত থেকে মুক্ত করেনি এবং তার ইহুদী বিদ্বেষের কারণে তিনি সমঝোতা প্রস্তাবে এমন সব শর্ত আরোপ করেছেন, যা ইহুদী রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের স্বার্থের পরিপন্থী।
https://www.amazon.com/Rise-Kill-First-Targeted-Assassinations/dp/1400069718
লেহির রেডিও স্টেশন থেকে বার্নাডোটের বিরুদ্ধে একের পর এক হুমকি আসতে থাকে। সেখান থেকে ঘোষণা দেয়া হয়, বার্নাডোটের পরিণতি হবে লর্ড মোয়েনের মতো। লর্ড মোয়েন ছিলেন কায়রোতে অবস্থিত ব্রিটিশ রেসিডেন্ট মিনিস্টার, যার প্রকৃত নাম ওয়াল্টার এডওয়ার্ড গিনেস। ফিলিস্তিনে ইহুদী অভিবাসীদের অনুপ্রবেশের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করার কারণে লেহির প্রধান ইৎজাক শামিরের নির্দেশে লেহির দুই এজেন্ট তাকে গুলি করে হত্যা করেছিল। বার্নাডোট ভেবেছিলেন, আরব এবং ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের হত্যা করলেও জাতিসংঘের প্রতিনিধিকে হত্যা করার সাহস লেহি করবে না। তার প্রস্তাব পাশ হয়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে লেহি'র প্রধান ইৎজাক শামির বার্নাডোটের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। সে লেহি'র চার কর্মকর্তাকে নিয়োগ করে বার্নাডোটকে হত্যার উদ্দেশ্যে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য। ১৯৪৮ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর কাউন্ট বার্নাডোট এবং তার সহকর্মীরা যখন তিনটি জীপে করে জেরুজালেমে জাতিসংঘের হেডকোয়ার্টার থেকে রেহাভিয়া এলাকার দিকে যাচ্ছিলেন, তখন তাদের পথ আগলে বসে লেহি'র একটি জীপ। জীপ থেকে নেমে তিন সন্ত্রাসী ছুটে যায় জাতিসংঘের জীপগুলোর দিকে। তাদের মধ্য থেকে দু'জন জাতিসংঘের জীপগুলোর চাকা লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে সেগুলো অচল করে দেয়। ইহোশুয়া কোহেন দ্বিতীয় জীপটির দরজা খুলে সাব মেশিনগান দিয়ে এর ভেতরটা ঝাঁঝরা করে দেয়। মৃত্যুবরণ করেন ফরাসী কর্নেল আঁন্দ্রে সেরো এবং কাউন্ট বার্নাডোট। হাসপাতালে নেয়ার পর বার্নাডোটের বুকে ছয়টি বুলেটের ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ একে 'জেরুজালেমের ইহুদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক সংগঠিত কাপুরোষোচিত হত্যাকাণ্ড' হিসেবে অভিহিত করেছিল। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ন এর কিছুদিন আগে ইহুদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইরগুনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। বার্নাডোটকে হত্যার পরে তিনি লেহি'র বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। জেনারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের (পরবর্তীতে শাবাক) প্রধান ইসের হারেল কর্তৃক লেহির সদস্যদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো অভিযানে লেহি'র কয়েক শত সদস্য গ্রেপ্তার হয়, কিন্তু মূল হত্যাকাণ্ডে যে চারজন অংশ নিয়েছিল তাদের কেউ শেষপর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি। হত্যাকাণ্ডের পর তারা ধর্মীয় শহর শারেই পিনাতে গিয়ে সেখানকার হারেদি সম্প্রদায়ের আশ্রয়ে আত্মগোপন করেছিল। কয়েকদিন পর সেখান থেকে তারা মালবাহী ট্রাকের পেছনে লুকিয়ে তেল আবিবে চলে গিয়েছিল। লেহি'র প্রধান ইৎজাক শামির গ্রেপ্তার হয়নি। অভিযান চলাকালীন সময়ে কিছুদিন সে আত্মগোপনে থাকলেও দুইমাস পর গ্রেপ্তারকৃত সকল লেহি সদস্যকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমা ঘোষণা করে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হলে সে ফিরে আসে। পরবর্তীতে সে মোসাদে যোগদান করে এবং আরো পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়!
https://www.jewishvirtuallibrary.org/count-folke-bernadotte
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সুইডিশ বয়স্কাউটকে সুইডেনের প্রতিরক্ষাবাহিনীর সাথে সমন্বিত করার উদ্দেশ্যে তাদের অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান পরিচালনার এবং উদ্ধারকর্মের উপর প্রশিক্ষণ দেন। ১৯৪৩ সালে তাকে সুইডিশ রেড ক্রসের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি যুদ্ধাহত সেনা ও যুদ্ধবন্দী নাগরিকদের উদ্ধার করার জন্য নাৎসি এবং মিত্র বাহিনীর মধ্যে অস্ত্রবিরতি কার্যকর করার প্রচেষ্টা চালান। তার মধ্যস্থতায় যুদ্ধ সমাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন বন্দীশালা ও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে প্রায় ৩১ হাজার বন্দী মুক্তিলাভ করে।
https://www.amazon.com/Curtain-Falls-Last-Third-Reich-ebook/dp/B01BXA10OK
তিনি হেনরিখ হিমলারকে আত্মসমর্পণের ব্যাপারে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন, যদিও মিত্রবাহিনী সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। এসব কারণে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ তাকে ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করে। ১৯৪৮ সালের ২০মে তার উপর এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
https://unispal.un.org/UNISPAL.NSF/0/A9A8DA193BD46C54852560E50060C6FD
তার দায়িত্ব ছিল ১৪ই মে পাশ হওয়া জাতিসংঘের রেজোল্যুশন ১৮৬ অনুসারে ফিলিস্তিনে বিবাদমান দুই পক্ষের সাথে আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য শান্তি প্রস্তাব উত্থাপন করা। কাউন্ট বার্নাডোট জুনের ১১ তারিখ থেকে দুই পক্ষের মধ্যে একমাসের যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে সক্ষম হন। তিনি কায়রো, বৈরুত, আম্মান ও তেল আবিবে গিয়ে বিবাদমান পক্ষগুলোর নেতাদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে আসেন যে, ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিনকে ভাগ করে পাশ হওয়া জাতিসংঘের রেজোল্যুশনটি ছিল দুর্ভাগ্যজনক।
https://www.jewishvirtuallibrary.org/the-assassination-of-count-bernadotte
তিনি সংকট সমাধানের উদ্দেশ্যে ভিন্ন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যেখানে ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল নামে দু'টি ভিন্ন রাষ্ট্রের পরিবর্তে আরব ও ইহুদী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ইউনিয়ন গঠন করার প্রস্তাব দেয়া হয়।
https://web.archive.org/web/20120622073547/http://unispal.un.org/UNISPAL.NSF/0/EA66369DAF3BE7E88025649E004395C8
বার্নাডোটের প্রস্তাবের প্রাথমিক খসড়ায় ইহুদীদের জন্য তুলনামূলকভাবে ছোট এবং আরবদের জন্য ফিলিস্তিন ও ট্রান্সজর্ডানের সমন্বয়ে অপেক্ষাকৃত বড় ভূমি বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। হাইফা এবং লাইডা এয়ারপোর্টকে শুধুমাত্র ইহুদীদের দখলে না রেখে মুক্ত এলাকায় রূপান্তরের কথা বলা হয়। নেগেভ ও জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ আরবদের হাতে ছেড়ে দেয়ার এবং গ্যালিলিকে ইহুদীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রস্তাব ছিল এতে। ইহুদীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ইউরোপ থেকে ইহুদী অভিবাসী প্রবেশের সীমার উপর কোনো নিষেধাজ্ঞা এতে ছিল না, কিন্তু ইসরায়েল থেকে বাস্তুচ্যুত তিন লাখ আরব শরণার্থীকে অবিলম্বে ইসরায়েলে ফিরতে দেয়ার শর্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল এই প্রস্তাবে। বার্নাডোটের প্রস্তাব ইহুদীরা প্রত্যাখ্যান করে। জায়নবাদী ইহুদীরা কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনের বুকে যে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে আসছিল, সেই স্বপ্ন সফল করতে স্থানীয় আরবদের উচ্ছেদ করা এবং জেরুজালেমসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর দখলে রাখাটা ছিল জরুরী। বার্নাডোটের প্রস্তাবের অনেকগুলো শর্ত ছিল তাদের এই স্বার্থের প্রতিকূলে। সেসময় যুদ্ধবিরতির আড়ালে ইউরোপ থেকে জাহাজ ভর্তি অস্ত্র এবং ইহুদী স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধাদের আগমনের ফলে ইহুদীদের মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস জন্মাতে থাকে যে, রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে সামরিক পদক্ষেপ তাদের পক্ষে বেশি সহায়ক হবে। জুলাইয়ের ৮ তারিখ থেকে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এরপর বার্নাডোট তার প্রস্তাবে কিছু পরিবর্তন আনেন এবং ব্রিটিশ, মার্কিন, ইসরায়েলি ও আরব বর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে তিনি প্রস্তাবের দ্বিতীয় খসড়া চূড়ান্ত করেন। ইসরায়েল দ্বিতীয় খসড়ার সাথেও একমত পোষণ করেনি। যেহেতু বার্নাডোটের সাথে মার্কিন এবং ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের আলাপ হয়েছিল, তাই সম্ভাবনা ছিল এটি কিছুটা পরিবর্তিত রূপে হলেও জাতিসংঘে পাশ হয়ে যেতে পারে। ঝুঁকিটা নিতে রাজি ছিল না ইহুদীদের সন্ত্রাসী সংগঠন লেহি। লেহি'র সদস্যরা ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে বার্নাডোটকে হুমকি দিতে শুরু করে "এজেন্ট বার্নাডোটের প্রতি পরামর্শ: আমাদের দেশ ছেড়ে বেরিয়ে যাও।" তারা বার্নাডোটকে ইহুদীবিদ্বেষী এবং নাৎসি বাহিনীর দালাল হিসেবে অভিযুক্ত করে। তাদের দাবি অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বার্নাডোট ইচ্ছে করে আরো বেশি সংখ্যক ইহুদীকে নাৎসিদের হাত থেকে মুক্ত করেনি এবং তার ইহুদী বিদ্বেষের কারণে তিনি সমঝোতা প্রস্তাবে এমন সব শর্ত আরোপ করেছেন, যা ইহুদী রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের স্বার্থের পরিপন্থী।
https://www.amazon.com/Rise-Kill-First-Targeted-Assassinations/dp/1400069718
লেহির রেডিও স্টেশন থেকে বার্নাডোটের বিরুদ্ধে একের পর এক হুমকি আসতে থাকে। সেখান থেকে ঘোষণা দেয়া হয়, বার্নাডোটের পরিণতি হবে লর্ড মোয়েনের মতো। লর্ড মোয়েন ছিলেন কায়রোতে অবস্থিত ব্রিটিশ রেসিডেন্ট মিনিস্টার, যার প্রকৃত নাম ওয়াল্টার এডওয়ার্ড গিনেস। ফিলিস্তিনে ইহুদী অভিবাসীদের অনুপ্রবেশের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করার কারণে লেহির প্রধান ইৎজাক শামিরের নির্দেশে লেহির দুই এজেন্ট তাকে গুলি করে হত্যা করেছিল। বার্নাডোট ভেবেছিলেন, আরব এবং ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের হত্যা করলেও জাতিসংঘের প্রতিনিধিকে হত্যা করার সাহস লেহি করবে না। তার প্রস্তাব পাশ হয়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে লেহি'র প্রধান ইৎজাক শামির বার্নাডোটের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। সে লেহি'র চার কর্মকর্তাকে নিয়োগ করে বার্নাডোটকে হত্যার উদ্দেশ্যে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য। ১৯৪৮ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর কাউন্ট বার্নাডোট এবং তার সহকর্মীরা যখন তিনটি জীপে করে জেরুজালেমে জাতিসংঘের হেডকোয়ার্টার থেকে রেহাভিয়া এলাকার দিকে যাচ্ছিলেন, তখন তাদের পথ আগলে বসে লেহি'র একটি জীপ। জীপ থেকে নেমে তিন সন্ত্রাসী ছুটে যায় জাতিসংঘের জীপগুলোর দিকে। তাদের মধ্য থেকে দু'জন জাতিসংঘের জীপগুলোর চাকা লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে সেগুলো অচল করে দেয়। ইহোশুয়া কোহেন দ্বিতীয় জীপটির দরজা খুলে সাব মেশিনগান দিয়ে এর ভেতরটা ঝাঁঝরা করে দেয়। মৃত্যুবরণ করেন ফরাসী কর্নেল আঁন্দ্রে সেরো এবং কাউন্ট বার্নাডোট। হাসপাতালে নেয়ার পর বার্নাডোটের বুকে ছয়টি বুলেটের ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ একে 'জেরুজালেমের ইহুদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক সংগঠিত কাপুরোষোচিত হত্যাকাণ্ড' হিসেবে অভিহিত করেছিল। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ন এর কিছুদিন আগে ইহুদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইরগুনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। বার্নাডোটকে হত্যার পরে তিনি লেহি'র বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। জেনারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের (পরবর্তীতে শাবাক) প্রধান ইসের হারেল কর্তৃক লেহির সদস্যদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো অভিযানে লেহি'র কয়েক শত সদস্য গ্রেপ্তার হয়, কিন্তু মূল হত্যাকাণ্ডে যে চারজন অংশ নিয়েছিল তাদের কেউ শেষপর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি। হত্যাকাণ্ডের পর তারা ধর্মীয় শহর শারেই পিনাতে গিয়ে সেখানকার হারেদি সম্প্রদায়ের আশ্রয়ে আত্মগোপন করেছিল। কয়েকদিন পর সেখান থেকে তারা মালবাহী ট্রাকের পেছনে লুকিয়ে তেল আবিবে চলে গিয়েছিল। লেহি'র প্রধান ইৎজাক শামির গ্রেপ্তার হয়নি। অভিযান চলাকালীন সময়ে কিছুদিন সে আত্মগোপনে থাকলেও দুইমাস পর গ্রেপ্তারকৃত সকল লেহি সদস্যকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমা ঘোষণা করে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হলে সে ফিরে আসে। পরবর্তীতে সে মোসাদে যোগদান করে এবং আরো পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়!
Comments