তথাকথিত সমাজতন্ত্রের আড়ালে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ (পর্ব-এক)
https://www.theguardian.com/cities/ng-interactive/2018/jul/30/what-china-belt-road-initiative-silk-road-explainer
পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গাদার বন্দর এলাকাটি কয়েক বছর আগেও ছিল জেলেদের কিছু গ্রামের সমষ্টি। কিন্তু ৬২ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর প্রকল্পের আওতায় চীনের সহায়তায় দ্রুত এখানে নির্মিত হয় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর। এই বন্দরের মাধ্যমে আরব সাগর থেকে কারাকোরাম মহাসড়ক হয়ে আরব সাগরের সাথে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের সংযোগ ঘটেছে।
https://www.csis.org/analysis/pakistans-gwadar-port-new-naval-base-chinas-string-pearls-indo-pacific
উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিত এই প্রদেশের বাণিজ্যের প্রসারের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা। চায়না ওভারসিজ পোর্ট হোল্ডিং কোম্পানি বন্দরটি নির্মাণ করে এবং নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় পাকিস্তান সরকার ২০১৭ সালে এই প্রতিষ্ঠানকে বন্দরটি ৪০ বছরের জন্য লিজ দেয়। হরমুজ প্রণালী এবং লোহিত সাগরের নিকটে গাদার বন্দরের অবস্থানের কারণে এই বন্দরের নিয়ন্ত্রণ পাওয়াকে চীনের আধিপত্য বিস্তারের ধাপ বলে দেখছে ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। একই কারণে গাদার বন্দর থেকে ১৭২ কিলোমিটার পশ্চিমে ইরানের চাবাহার এলাকায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে ভারত।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের হাম্বানটোটা বন্দর এবং বন্দর সংলগ্ন ১৫,০০০ একর জমি চীনের সরকারী প্রতিষ্ঠান চায়না হারবারকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয় শ্রীলঙ্কা সরকার। এলটিটিই গেরিলাদের দমন করতে গিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মাহিন্দ্রা রাজাপাক্ষের শ্রীলঙ্কা সরকার যখন একঘরে হয়ে পড়ে, তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় চীন। রাজাপাক্ষের নিজের শহর হাম্বানটোটায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পে অর্থ ঢালে চীন সরকার।
https://www.nytimes.com/2018/06/25/world/asia/china-sri-lanka-port.html
স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকে এই বন্দর নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছিলেন, কেননা ইতোমধ্যে রাজধানী কলম্বোতে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর রয়েছে এবং বন্দরটি সম্প্রসারণ করা সম্ভব। সম্প্রসারণের উদ্যোগ না নিয়ে ২য় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ শ্রীলঙ্কার মতো একটি ছোট দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না, এই হুঁশিয়ারিতে টলেনি রাজাপাক্ষের সরকার। চীনের রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে ৩০৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ২০০৭ সালে শুরু হয় হাম্বানটোটা বন্দরের নির্মাণকাজ। ঋণের শর্ত হিসেবে বন্দর নির্মাণের কাজ পায় চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার এবং চীনা নির্মাণশ্রমিক এবং প্রকৌশলীদের আধিক্য থাকে প্রকল্পজুড়ে। প্রকল্পের চুক্তিস্বাক্ষরের সাথে জড়িত শ্রীলঙ্কান কূটনৈতিকদের মতে, শুরু থেকে চীনের অলিখিত শর্ত ছিল এই বন্দর ব্যবহারকারী সব জাহাজের এবং বন্দর পরিচালনার কার্যক্রমের তথ্য সংগ্রহ করবে চীন। এই বন্দরের কাজ পাইয়ে দেয়া রাষ্ট্রপতি মাহিন্দ্রা রাজাপাক্ষেকে ২০১৫ এর নির্বাচনে বিজয়ী করার জন্য অর্থ ঢালে চীন।
https://www.reuters.com/article/sri-lanka-china-submarine/chinese-submarine-docks-in-sri-lanka-despite-indian-concerns-idINKBN0IM0LU20141102
রাজাপাক্ষের নির্বাচনী প্রচারণা তহবিলে চায়না হারবার কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে অন্তত ৭৬ লাখ ডলার জমা হয়েছে বলে জানা যায় শ্রীলঙ্কা সরকারের অপ্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে। চীনের এই অর্থব্যয়ের মূল কারণ ছিল রাজাপাক্ষের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্বাচনী ম্যান্ডেট, যেখানে শ্রীলঙ্কাকে চীন সরকারের ঋণের জাল থেকে মুক্ত করা ছিল একটি বড় ইস্যু। ২০০৭ সালে নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর ২০১০ সালে এসে তড়িঘড়ি করে উদ্বোধন করা হয় হাম্বানটোটা বন্দর। কিন্তু শুরু থেকে বন্দরটি জাহাজ আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছিলো। ২০১২ সালে এসে শ্রীলঙ্কা সরকার বন্দরটি সম্প্রসারণের জন্য আবার চীনের কাছে ঋণ চায়, এবার চীন ৭৫৭ মিলিয়ন ডলার দেয় উচ্চ সুদে। চীনের এই ঋণ রাজাপাক্ষের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৫ সালের নির্বাচনে রাজাপাক্ষে পরাজিত হন। কিন্তু চীনের এই বিশাল ঋণ শোধের দায় নতুন সরকারের ঘাড়ে এসে পড়ে। আগের সরকারের রেখে যাওয়া ৪৪ বিলিয়ন ডলারের রাষ্ট্রীয় দেনা শোধ করতে গিয়ে আবারও চীন থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয় শ্রীলঙ্কা সরকার। অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমানে শ্রীলঙ্কার কাছে চীনের পাওনা গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৬ সাল থেকে শ্রীলঙ্কা সরকারের প্রতিনিধিরা চীন সরকারের সাথে আলোচনা শুরু করেন এই বিপুল দেন শোধ করার উপায় খুঁজতে, বিশেষ করে হাম্বানটোটা বন্দরের ব্যাপারে। কিন্তু চীন সরাসরি দাবি জানায় বন্দর নির্মাণের জন্য নেয়া ঋণ মওকুফের বদলে চীনকে লিখে দিতে হবে বন্দরটির সিংহভাগ অংশ। চায়না মার্চেন্ট পোর্ট বন্দর পরিচালনার কাজটি পায় এবং এবার তারা দাবি করে বন্দর সংলগ্ন আরও ১৫,০০০ একর জমি তাদের লিখে দিতে হবে, যেখানে নির্মিত হবে শিল্পাঞ্চল। দাবির স্বপক্ষে তাদের যুক্তি ছিল যে, এই বন্দরের জন্য নেয়া ১.১ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করার জন্য কেবল বন্দরের নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট নয়। শ্রীলঙ্কা সরকার দাবি মেনে নিয়ে ২০১৭ এর জুলাইতে চুক্তি স্বাক্ষর করে, চুক্তিটি কার্যকর হয় একই বছরের ডিসেম্বরে। এই বন্দরের মাধ্যমে চীন ভারতের উপকূলের মাত্র কয়েকশ কিলোমিটার দূরে নিজেদের রণতরী রাখার জায়গা নিশ্চিত করলো। ভারতের ক্রমাগত আপত্তির মুখে শ্রীলঙ্কা সরকার চীনের সাথে চুক্তিতে একটি ধারা যুক্ত করে, যেখানে বলা আছে শ্রীলঙ্কা সরকারের অনুমতি ব্যতীত বন্দরটি সামরিক কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কলম্বো বন্দরে চায়না হারবার একটি নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করেছে, যার অংশ হিসেবে ৫০ একর জমি পেয়েছে চৈনিক প্রতিষ্ঠানটি এবং যেখানে শ্রীলঙ্কার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ২০১৪ সালে জাপানী প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে যেদিন শ্রীলঙ্কা আসেন ঠিক সেদিনই কলম্বো বন্দরে ভেড়ে চীনের দু'টি যুদ্ধজাহাজ। ভারতের আশঙ্কা, দক্ষিণে হাম্বানটোটা এবং পশ্চিমে গাদার বন্দরে চীন স্থায়ী নৌবহর রাখার পরিকল্পনা করছে।
মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের কিয়াকপিউ অঞ্চলে ৭.৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য চীন এবং মায়ানমারের মধ্যে সমঝোতা হলেও শেষ মুহূর্তে প্রকল্প থেকে পিছিয়ে গিয়েছিল মায়ানমার। নির্মাণ ব্যয়কে অতিরিক্ত উল্লেখ করে মায়ানমার সরকার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চীনের ঋণের ফাঁদে আটকা পড়তে হবে এই আশংকায় মায়ানমার শেষ মুহূর্তে অবস্থান পরিবর্তন করে। আলোচনার মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় ৬ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে আনা হয়েছে ১.৩ বিলিয়নে।
https://www.reuters.com/article/us-myanmar-china-port-exclusive/exclusive-myanmar-scales-back-chinese-backed-port-project-due-to-debt-fears-official-idUSKBN1KN106
এছাড়া বন্দরটিতে চীনের অংশীদারিত্ব নামিয়ে আনা হয়েছে ৭০ শতাংশে।
https://www.globaltimes.cn/content/1125585.shtml
বাংলাদেশের সোনাদিয়াতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল চীন।
https://m.bdnews24.com/en/detail/business/1448195
কিন্তু প্রকল্পটি আর এগোয়নি। হাম্বানটোটা বন্দর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার কোম্পানিকে সরকারী কর্মকর্তাদের ঘুষ সাধার দায়ে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে বাংলাদেশ সরকার।
Comments