কিউবায় যা হচ্ছে

 

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ১৯৬০ এর দশকের মতো আবার ফিরে এসেছে রাষ্ট্রপতি মিগুয়েল ডায়াজ-ক্যানেলের সরকার এবং কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির শাসনের পতনের জন্য। রাজধানী হাভানা এবং কিউবার আরও কয়েকটি অঞ্চলে জ্বালানী, বিদ্যুৎ কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিনের ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করতে সম্প্রতি সিআইএ কয়েকশো গুন্ডা এবং তাদের এজেন্টকে উস্কানিদাতা হিসেবে মোতায়েন করেছে। মূলত ৬ বছর ধরে মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইরত ১১ মিলিয়ন লোকের ক্যারিবিয়ান দ্বীপ দেশটির উপর চাপানো ছয় দশক দীর্ঘ আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার কারণে এই অভাব দেখা দিয়েছে।

https://www.reuters.com/world/americas/street-protests-break-out-cuba-2021-07-11/

যুদ্ধবাজ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আমেরিকান অর্থনীতির যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বাইডেন তার তথাকথিত "বাম" ভোট ব্যাংককে আকাশকুসুম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন (যারা অন্যান্য দেশে উগ্র ডানপন্থী হিসাবে বিবেচিত হয়), তারা এখন আফগানিস্তানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য পরাজয় জনগণ যাতে ভুলে যায় তা নিশ্চিত করার জন্য একটি বলির পাঠা খুঁজছে।

https://www.bbc.com/news/world-us-canada-51470131

https://www.theglobalist.com/united-states-democratic-party-progressives-joe-biden-2020-presidential-elections/

https://www.vox.com/21322478/joe-biden-overton-window-bidenism

ইরান সমর্থিত সিরিয়ান আর ইরাকিরা মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রকে ভেঙে দিচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনারা আমেরিকান নৌবহরকে প্রচুর ঝামেলায় ফেলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন দখল করতে পারে এমন একমাত্র জায়গা লো কিউবা, যা তাদের উপকূল থেকে ৬০ মাইল দূরে অবস্থিত। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা এক বিবৃতিতে বলেছিল-

"আমরা কিউবার জনগণ এবং মুক্তির জন্য তাদের বলিষ্ঠ কন্ঠের পাশে দাঁড়িয়েছি, সেই সাথে মহামারীর করুণ থাবা থেকে উপশম পেতে এবং কয়েক দশক ধরে যে নির্যাতন ও অর্থনৈতিক দুর্দশাগুলোর মধ্য দিয়ে তারা কিউবার কর্তৃত্ববাদী শাসনের দ্বারা নিপীড়িত হয়েছে তা থেকে মুক্তি পেতে।”

https://www.whitehouse.gov/briefing-room/statements-releases/2021/07/12/statement-by-president-joseph-r-biden-jr-on-protests-in-cuba/

কিউবার অর্থনীতি ধ্বংস করার জন্য সামরিক নিষেধাজ্ঞাকে আরও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকার কথা একবারও উল্লেখ না করেই কিউবার সরকারী কর্মকর্তাদের এবং রাষ্ট্রপতি ডায়াজ ক্যানেলকে জনগণের কথা না ভেবে নিজেদের "ধনবান" করার জন্য দোষারোপ করা হয় এই বিবৃতিতে! ২৯ বছর ধরে চলা কিউবার উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অবসানের পক্ষে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন ১৮৪টি দেশকে নিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়।

https://news.un.org/en/story/2021/06/1094612

কিউবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রড্রিগেজ পারিলা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বলেছিলেন যে এই অবরোধ ছিল কিউবার জনগণের উপর বিশাল, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অগ্রহণযোগ্য মানবাধিকার লঙ্ঘন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জায়নবাদী সন্ত্রাসী বাহিনী জাতিসংঘের এই প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেছিল। ফোর্বস ম্যাগাজিন অনুসারে, বাইডেন এবং তার স্ত্রী জিল ১৯৯৮ এবং ২০১৯ সালের মধ্যে ২২.৫ মিলিয়ন ডলার আয় করেছেন, যা বছরে প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার। 

https://www.forbes.com/sites/michelatindera/2020/10/22/how-the-bidens-earned-167-million-after-leaving-the-white-house/?sh=37dfb50e1e42

ব্যুরো অফ লেবার স্ট্যাটিস্টিকস এর মতে, ২০২১ সালে একজন পূর্ণকালীন মার্কিন কর্মীর সাপ্তাহিক আয় ৯৮৯ ডলার, অর্থাৎ তারা বছরে প্রায় ৪৭,৪৭২ ডলার উপার্জন করে এবং বাইডেন এক বছরে যা আয় করেছে তা অর্জন করতে প্রত্যেকের ২১ বছর সময় লাগবে।

https://www.bls.gov/news.release/pdf/wkyeng.pdf

এই একটি পরিসংখ্যান মার্কিনিদের ভন্ডামি প্রমাণ করে দেয় যারা কিনা অন্য রাষ্ট্রের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। যখন বাইডেন এবং সকল মার্কিন পলিসি প্রস্তুতকারী শকুনরা শ্রমিক শ্রেণির ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া তো দূরের কথা, মহামারীর কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে জনগণের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা পর্যন্ত করেনি; কিউবার সরকার আমেরিকার চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও মজুরি ৫ গুণ বাড়িয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে।

https://hr.economictimes.indiatimes.com/amp/news/hrtech/payroll-and-benefits/cuba-to-increase-minimum-salary-fivefold/79697206/

মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ঘাটতি এবং সঙ্কট সত্ত্বেও বিশ্ব দেখছে কিউবানরা কোভিড-১৯ সংকটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কতটা সফল। পারিলার মতে, ২০২০ সালে কিউবার আনুমানিক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ৯.১ মিলিয়ন ডলার। দ্বীপপুঞ্জটির অর্থনীতি ২০২০ সালে ১০.৯% এবং ২০২১ সালের জুনের মধ্যে ২% সংকুচিত হয়ে যায়। দেশটি প্রয়োজনীয় পণ্য, জ্বালানী এবং ওষুধের মারাত্মক ঘাটতির মুখোমুখি হয়। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করা কিউবার পর্যটন শিল্পও ২০২০ সালের মার্চ থেকে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। এই সামরিক অবরোধ পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘতম। হাভানার সাম্প্রতিক আন্দোলন কোনও নতুন জিনিস নয়, বড়োজোর নতুন বোতলে পুরানো মদ। সিআইএ-র ফাইলগুলো দেখায় যে তারা ফিদেল কাস্ত্রোকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে কত ধরনের কৌশল গ্রহণ করেছিল অতীতে।

https://en.wikipedia.org/wiki/Operation_Northwoods

https://en.wikipedia.org/wiki/Operation_Mongoose

https://en.wikipedia.org/wiki/Bay_of_Pigs_Invasion

ইত্যাদি ইত্যাদি………………………………..

এমনকি ১৯৬০ এর দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসনের অজুহাত হিসাবে কিউবান শরণার্থী বোঝাই একটি নৌকা ডুবিয়ে দেয়ার পরিকল্পনাও তৈরি হয়েছিল। এই ছয় দশকে সিআইএ এবং ওয়ালস্ট্রিটের নেতৃত্বাধীন আমেরিকান প্রশাসন কিউবাকে আত্মসমর্পণ করাতে ব্যর্থ হয়েছে। ক্যাস্ট্রোর পর তার ভাই রাউল ক্যাস্ট্রো এবং বর্তমানে ডায়াজ ক্যানেল তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম পরিমাণে মার্কিন ক্রোধের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে, বিশেষত ব্রাজিলে কিউবা এবং ভেনেজুয়েলা দ্বারা সমর্থিত বামপন্থীদের পুনরুত্থান হওয়ায় সিআইএ সমর্থিত জেইর বলসোনারো তার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা বাম এবং গণতান্ত্রিক বাহিনীর কাছ থেকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। ইকুয়েডর, মেক্সিকো এবং অন্যান্য দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী মনোভাবের শক্তিশালী পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে দেখেই সিআইএ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে এবং এজেন্টদের লেলিয়ে দিয়েছে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির কাজে। কিউবায় বিশ্বের অন্যতম সেরা জনস্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা ভিত্তি ডাঃ আর্নেস্টো চে গুয়েভারা তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন, যা কোভিড-১৯ মহামারীজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ২০২০ সালে ইরান ও ইতালির মতো দেশে রোগীদের সেবা দেয়ার জন্য ডাক্তারদের দল পাঠানো সত্ত্বেও ডায়াজ ক্যানেলের সরকার কিউবার অভ্যন্তরে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা পায়নি বললেই চলে। কোভিড-১৯ এর ডেল্টা রূপটির কারণে ২০২১ সালের ১১ জুলাই একদিনেই ৬৯২৩ জন সংক্রমিত হয় এবং ৪৭ জন মারা গিয়েছিল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা চাপানো অমানবিক নিষেধাজ্ঞা বিদেশী সহায়তা এবং ভ্যাকসিন পর্যন্ত কিউবায় পৌঁছাতে বাধা দিয়েছে। দেশীয় ভ্যাকসিন তৈরিও এজন্য ধাক্কার মুখোমুখি হয়েছে। একারণে কিউবা ১১ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ১.৭ মিলিয়ন অধিবাসীকে টিকা দিতে সক্ষম হয়েছে। এই সংকটের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কিউবায় চলমান তথাকথিত প্রতিবাদের দু'টি দিক লক্ষণীয়। একদিকে বাইডেন চেষ্টা করছেন যে ক্যাস্ট্রো কিংবা গুয়েভারার মতো আইকনিক ব্যক্তিত্ব না হওয়া ডায়াজ ক্যানেলকে অভ্যন্তরীণ এবং বাইরে থেকে শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতাচ্যুত করা। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিওলিবারেল অর্থনৈতিক মডেল গ্রহণ এবং পরিকল্পিত অর্থনীতি বর্জন করতে বাধ্য করা। বিশ্বব্যাংকের কুবুদ্ধি অনুসারে ওয়াশিংটন ডিসি ভাবছে যে অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো ডায়াজ ক্যানেল এবং কিউবার কমিউনিস্ট পার্টিকে তাদের অর্থনীতিতে সংস্কার করতে বাধ্য করবে। হাভানা দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর ডায়াজ ক্যানেল কিউবান বিপ্লবের সমর্থক শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষার্থী ও যুবকদের একত্রিত করে মার্কিনি অর্থায়নে চালিত নিরাপত্তা বাহিনীর উপর আক্রমণকারী এবং সহিংস তাণ্ডবকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখতে বলেছেন। দাঙ্গাকারী এবং তাদের আমেরিকান গুরুদের বিরুদ্ধে বিশাল সমাবেশ হয়েছে যেখানে প্রতিবাদকারীরা ক্যাস্ট্রোর বিশাল প্রতিকৃতি বহন করেছে। বাইডেনের বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা বাড়াতে মেক্সিকো, রাশিয়া এবং ভেনেজুয়েলা দৃভাবে কিউবার পিছনে দাঁড়িয়েছে। হাইতির রাষ্ট্রপতির হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তীকালে আমেরিকান দখলদার বাহিনীকে ক্যারিবীয় দ্বীপে মোতায়েন করার কারণে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ শুরু হয়ে গেছে বলে মেক্সিকো এবং রাশিয়া উভয়ই কিউবায় যে কোনও ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে মার্কিনিদের সতর্ক করেছে। যদি ডায়াজ ক্যানেল বা অন্যান্য কিউবানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালিত হয়, তবে এটি এই অঞ্চলে বৃহৎ আকারে সংঘাতের সূত্রপাত করবে, যা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে উঠবে, যারা কিনা ২০ বছরের মধ্যে তালেবানের মতো প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি দ্বারা বিধ্বস্ত হয়েছে। বর্তমানে কিউবার জন্য শ্রমিক শ্রেণি ও কৃষকদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক সংহতি দরকার, যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং এর দালালদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ডায়াজ ক্যানেলের নেতৃত্বে কিউবার বৈধ সরকারের পাশে দাঁড়ানো এবং বাইডেনের শয়তানি পরিকল্পনার বিরোধিতা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য কিউবার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পাশাপাশি মার্কিন পরাজয় জরুরি। আমেরিকা বিশ্বে শান্তি বিরাজ করতে কখনোই দিবে না এবং ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখবেই, তাই কিউবার পক্ষে বৈশ্বিক সংহতির সংগ্রামকে শক্তিশালী করা এবং মার্কিনিদের কুৎচাল পরাজিত করা গুরুত্বপূর্ণ।

 

 

 

 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]