অভিজিৎ এর ভক্তদের প্রতি (পর্ব-দুই)


অভিজিৎ রায় নতুন কোনো জ্ঞানের সৃষ্টি করেননি
। তিনি পশ্চিমা দেশে পড়াশোনা করেছেন এবং তাদের বিজ্ঞানের নামে তৈরী অনেক অপবিজ্ঞানের অনুবাদ এবং পক্ষে কিছু কথা লিখেছেন মাত্র। এসব অপবিজ্ঞানের অন্যতম হচ্ছে নারী ও পুরুষের আচরণগত পার্থক্যকে বিজ্ঞানের নামে প্রাকৃতিক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা এবং গণধর্ষণকে জীববিজ্ঞান দিয়ে স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা! খোদ পশ্চিমা বিশ্বে বিতর্কিত এসব গবেষণার সমালোচনাকারী বিজ্ঞানীদের (বিশেষ করে বামপন্থী) অভিজিৎ সাহেব সমালোচনা করেছেন তার বইগুলোতে! সমাজতন্ত্রে শোষণকে নারীর উপর পুরুষের শোষণ হিসেবে দেখা হয় না, দেখা হয় শোষক কর্তৃক শোষিত হিসেবে; অথচ পুঁজিবাদী কাঠামোতে শোষক কর্তৃক বর্বরতাকে নারী-পুরুষ ব্যবধান বানিয়ে মানুষকেই মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিভক্ত করে এবং সুন্দরী প্রতিযোগিতার মুলা ঝুলিয়ে মুক্তির লোভ দেখানো হয়!

যুগ যুগ ধরে সমাজে নারী ও পুরুষকে যে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য, ভূমিকা ও মর্যাদা দেয়া হয় তা করা হয় মূলত তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে এবং এ ব্যাপারটি প্রাকৃতিক ধরে নিয়ে তা অপরিবর্তনযোগ্য হিসেবে বিশ্বাস করা হয়! নারীদের শরীরকে সমাজে তাদের অধস্তন অবস্থানের জন্য দায়ী করা হতো এবং এখনো তাই হয়। একবার যদি এই বিষয়কে প্রাকৃতিক হিসেবে কবুল করে নেয়া যায়, তাহলে আর সমাজে বিদ্যমান জেন্ডার অসমতা ও অন্যায্যতা নিয়ে আলাপের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। প্রতিটি সংস্কৃতিতে ছেলে ও মেয়ে শিশুকে স্বতন্ত্র উপায়ে মূল্যায়নের এবং তাদের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা, দায়িত্ব ও চরিত্র প্রদানের প্রচলন রয়েছে। প্রতিটি সমাজ ধীরে ধীরে একটি ছেলে বা মেয়ে শিশুর মধ্যে বিভিন্ন পুরুষালি কিংবা মেয়েলি বৈশিষ্ট্য সন্নিবিষ্ট করে তার বিভিন্ন গুণাবলী, আচরণিক ধরন, ভূমিকা, দায়িত্ব, অধিকার ও আকাঙ্ক্ষার মাধ্যমে। সেক্স একটি জৈবিক বিষয় হলেও নারী ও পুরুষের জেন্ডার পরিচয় নির্ধারিত হয় ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে। নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যসূচক শরীরের কারণে অনেক নারী গর্ভে সন্তান ধারণ করে, সন্তানকে বুকের দুধ পান করায় এবং প্রতিমাসে ঋতুস্রাবের অভিজ্ঞতা লাভ করে। এই বিষয়গুলো বাদে আর কিছুই নেই যেগুলো নারী-পুরুষ উভয়ে করতে পারে না। একটি পুরুষের বা নারীর শরীর থাকার কারণে আমাদের বৈশিষ্ট্য, ভূমিকা বা নিয়তি পূর্ব নির্ধারিত হতে পারে না। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে একটি বাচ্চা জন্মগ্রহণের পর থেকে তার পরিবার ও সমাজ তার জেন্ডারিংয়ের প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতিতে পুত্রসন্তানের জন্মগ্রহণ সাড়ম্বরে উদযাপিত হলেও কন্যাসন্তানের জন্মগ্রহণে হা-হুতাশ করা হয়। পুত্রসন্তানকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, ভালো খাবার ও ভালো স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। তাকে শক্তপোক্ত ও বহির্মুখী হতে উৎসাহী করা হয়। কন্যাসন্তানকে বলা হয় শান্তশিষ্ট, সংযমী ও সংসারী হতে। একটি মেয়ের শরীরে এমন কিছুই নেই যার ফলে তাকে শর্টস পরা, গাছে চড়া বা সাইকেল চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে এবং একটি ছেলের শরীরেও এমন কিছুই নেই যে কারণে সে পুতুল খেলতে, ছোট ভাই-বোনের দেখভাল করতে অথবা রান্না ও ঘর পরিষ্কারের কাজে সাহায্য করতে পারবে না। একটি শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মেয়ের জীবন হয়তো নিজের বাড়িতে ও স্কুলে সীমাবদ্ধ; অথচ একটি আদিবাসী মেয়ে অবাধে ঘুরে বেড়াতে পারছে জঙ্গলে, যেতে পারছে পশু চরাতে, গাছে চড়তে পারছে ফল-পাতা-ডালপালা সংগ্রহের লক্ষ্যে। এখানে তারা উভয়ই মেয়ে এবং তাদের উভয়ের শরীর একই রকম; তারপরও তাদের মাঝে গড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী সক্ষমতা, আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন। আগে অনেক পরিবারে মেয়েদের স্কুলে পাঠানো হতো না, বয়স ১০-১১ হওয়ার পর ঘরের বাইরে পা রাখতে দেয়া হতো না এবং বয়ঃসন্ধিকালে বিয়ে দিয়ে দেয়া হতো। কিন্তু এখন এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছেএমনকি আমরা প্রশিক্ষণ, ব্যবহার, অব্যবহার, অপব্যবহার কিংবা নির্যাতনের মাধ্যমে আমাদের শারীরিক আকার-আকৃতি, কাঠামো ও শক্তিমত্তায় পরিবর্তন আনতে পারি। নারী ও পুরুষ কুস্তিগীর, বডি বিল্ডার, অ্যাথলেট, নৃত্যশিল্পী, যোগী প্রমুখ শারীরিক পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত। আবার নারীদের শরীর সন্তান জন্মদানে সক্ষম হলেও আমরা এখন সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে সন্তান জন্ম দেবো কিনা, দিলে কয়টি সন্তান জন্ম দেবো এবং প্রতিটি সন্তান জন্মদানের মাঝে কতটুকু বিরতি নেবো। সমাজে নারী ও পুরুষ কেমন পদমর্যাদা উপভোগ করবে, তা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নির্ধারিত হয়। এটি মানবসৃষ্ট, এখানে প্রকৃতির দায় খুব কম। এটি অবশ্যই জেন্ডার, যা নির্ধারণ করে দিয়েছে যে প্রায় সকল সম্প্রদায়ে নারীরা পুরুষদের চেয়ে হীনতর হিসেবে বিবেচিত হবে। ফলে পুরুষদের তুলনায় নারীরা প্রায়ই কম অধিকার, কম সংস্থানের নিয়ন্ত্রণ পায়। তারা দৈনিক পুরুষদের চেয়ে বেশি কর্মঘণ্টা অতিবাহিত করলেও তাদের সেই কাজের অবমূল্যায়ন করা হয় কিংবা কোনো মূল্যায়ন ও মজুরি জোটে না। তারা পুরুষ ও সমাজের হাতে নিয়মতান্ত্রিক সহিংসতার শিকার হয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই বললেই চলে। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, পুরুষরাই হলো দুর্বলতর সেক্স এবং Y ক্রোমোসোম (যেটি কেবল পুরুষদের থাকে) অনেক শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য দায়ী। অ্যাশলে মন্টাগু তার 'দ্য ন্যাচারাল সুপেরিয়রিটি অভ উইমেন' বইয়ে একটি তালিকা প্রণয়ন করেছেন, যেখানে নির্দিষ্ট ৬২টি ডিজঅর্ডারের পেছনে প্রায় সম্পূর্ণরূপে দায়ী সেক্স-লিঙ্কড জিন এবং সেগুলোর অধিকাংশ পুরুষদের মাঝে দেখা যায়।

https://www.amazon.com/Natural-Superiority-Women-5th/dp/076198982X

মানুষের শরীর যেন সংক্রমণের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে সেক্ষেত্রে শরীরের কলকব্জাকে যেসব জিন নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলো পরিবাহিত হয় X ক্রোমোসোম দ্বারা। এজন্য জৈবরাসায়নিক ভিত্তি অনুসারে পুরুষের অসুস্থতার প্রবণতা বেশি। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের জৈব শ্রেষ্ঠত্ব ঢাকা পড়ে গেছে তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধীনস্থতার নিচে। সে কারণে প্রায় সকল ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে রয়েছে এই অঞ্চলে। নারী ও পুরুষের মধ্যে কিছু জৈবিক পার্থক্য অবশ্যই বিদ্যমান। কিন্তু বিজ্ঞানের একটি সহজ নিয়ম মনে রাখতে হবে যে চলককে (জেন্ডারভিত্তিক ভূমিকা) ধ্রুবক (জননাঙ্গ) দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। যদি কেবল জীববিজ্ঞানই এককভাবে আমাদের ভূমিকা ও কার্যকলাপ নির্ধারণ করে দিতো তাহলে জগতের সকল নারীই রান্না করতো, কাপড় কাচতো, সেলাই করতো। কিন্তু বাস্তব জীবনে অধিকাংশ পেশাদার রাঁধুনি, ধোপা কিংবা দর্জি পুরুষ। সেক্স বা প্রকৃতি কোনোভাবেই সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান অন্যায্য অসমতার পেছনে দায়ী নয়। বিভিন্ন বর্ণ, শ্রেণি, জাতি ইত্যাদির মধ্যে বিদ্যমান অসমতার মতো নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান অসমতাও মানবসৃষ্ট। একজন নারী গর্ভে সন্তান ধারণ করার মানে এই নয় যে সে কারো অধস্তন বা অনুগত হতে বাধ্য। তাছাড়া এই বিষয়টি দ্বারা তার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ কিংবা চাকরির সুযোগকে প্রভাবিত করা অযৌক্তিক। দু'জন মানুষকে সমান হতে, সমানাধিকার লাভ করতে এবং সমান সুযোগ পেতে পরস্পর অভিন্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। মারিয়া মিস তার 'দ্য সোশ্যাল অরিজিনস অভ দ্য সেক্সুয়াল ডিভিশন অভ লেবার' এ লিখেছেন-

"পুরুষত্ব বা নারীত্ব জৈবিকভাবে প্রদত্ত নয়, বরং এগুলো দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফসল। ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে পুরুষত্ব ও নারীত্বকে নতুন নতুন রূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এবং প্রতিটি সংজ্ঞায়নই নির্ভর করেছে ওই নির্দিষ্ট কালের উৎপাদন ব্যবস্থার মূলনীতির উপর ভিত্তি করে তাই নিজেদের শরীরের সঙ্গে নারী-পুরুষের গুণগতভাবে ভিন্ন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে কারণেই মাতৃতান্ত্রিক সমাজগুলোতে নারীত্বকে দেখা হতো যাবতীয় উৎপাদনের দৃষ্টান্ত হিসেবে এবং সেখানে পুরুষ ছিল জীবন উৎপাদনের সক্রিয় প্রভাবক। সকল নারীকেই সংজ্ঞায়িত করা হতো 'মা' হিসেবে। কিন্তু তখন 'মা' এর ছিল এক ভিন্ন অর্থ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আওতায় সামাজিকভাবে সকল নারীই সংজ্ঞায়িত হয় গৃহবধূ হিসেবে (এবং পুরুষরা উপার্জনক্ষম হিসেবে)। এবং এই ব্যবস্থায় মাতৃত্ব পরিণত হয়েছে 'হাউজওয়াইফ সিন্ড্রোম'-এর অবিচ্ছেদ্য অংশে। নারীত্বের ব্যাপারে অতীতের মাতৃতান্ত্রিক সংজ্ঞায়নের সঙ্গে আধুনিক সময়ের সংজ্ঞায়নের তফাৎ এই যে, দ্বিতীয়টিতে নারীর যাবতীয় সক্রিয়তা, সৃজনশীলতা ও উৎপাদনক্ষমতা তথা মানবিক গুণাবলিকে কেড়ে নেয়া হয়েছে।"

https://repub.eur.nl/pub/38083/Mies1981TheSocialOriginsOfTheSexualDevisionOfLabour_IssOccPap85.pdf

একটি শিশুকে তাৎক্ষণিকভাবে কেবল একটি নির্দিষ্ট সেক্সের শ্রেণিভুক্ত করা হয় না, বরং তাকে একটি নির্দিষ্ট জেন্ডার গছিয়ে দেয়া হয়। এরপর একটি শিশুকে কীভাবে ডাকা হবে, তার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা হবে, তাকে কীভাবে পোশাক পরানো হবে, এই সকল ক্ষেত্রে ছেলেশিশু ও মেয়েশিশুর মধ্যে তফাৎ দেখা যায়। সমাজে তাদের কেমন আচরণ হবে, তা শেখানো হয় 'সামাজিকীকরণ' এর নামে। আপনি একটি শিশুর সাথে কী করছেন বা কেমন ব্যবহার করছেন, তা তার মনস্তত্ত্বে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। একদম শুরু থেকে ছেলেশিশুদের শক্তিশালী, স্বাধীনচেতা হিসেবে গণ্য করা হয়। আবার মায়েরা তাদের মেয়েশিশুর চুল নিয়ে নানাবিধ আদিখ্যেতা করে, তাকে মেয়েলি সাজে সজ্জিত করে, বারবার বলতে থাকে সে কত সুন্দর। এভাবে শৈশবের শুরুতেই শিশুরা তাদের চেহারা বা গুণাবলি সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা লাভ করে, তা তাদের অবচেতন মনে গেঁথে যায় এবং নিজেদের ব্যাপারে তারা এই ধারণাগুলো আঁকড়ে ধরে। বাবা-মায়েরা নিজে থেকেই মেয়েশিশুদের হাতে খেলনা পুতুল বা হাঁড়িপাতিল ধরিয়ে দেয় কিংবা ছেলেশিশুদের হাতে বন্দুক, খেলনা গাড়ি, বিমান ইত্যাদি; যেন তারা ঐসব খেলনা দিয়ে খেলতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এবং বড় হয়ে একই ধরনের কাজকে আপন করে নেয়। শৈশবের এসব খেলনা দিয়ে খেলার অভিজ্ঞতা শিশুদের ভবিষ্যৎ বিনোদন বা কাজের কাঠামো গড়ে দেয় এবং যখন তাদের নিজেদের স্বাধীনভাবে পছন্দ করার সুযোগ আসে তখনো তারা এগুলোকেই বেছে নেয়। শৈশবে কোনো জিনিসের সঙ্গে শিশুর পরোক্ষ ইচ্ছায় পরিচয় ঘটলেও পরবর্তীতে সেগুলো তাদের প্রত্যক্ষ ইচ্ছাতে রূপান্তরিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় অবশ্য মেয়েশিশুদের খুব বেশিদিন খেলনা হাঁড়িপাতিল কিংবা পুতুল নিয়ে খেলতে হয় না। খুব কম বয়সে তাদের রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হয় সত্যিকারের রান্না করতে কিংবা তাদের দায়িত্ব দেয়া হয় ছোট ভাই-বোন দেখভালের। আর ছেলেশিশুদের স্কুলে পাঠিয়ে বা বাইরে খেলতে বা অন্য কোনো কাজ করতে দিয়ে তাদেরক বহির্জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। আমরা প্রায়ই ছেলে শিশুদের বলি, "তুমি কত লম্বা হয়ে গেছ," আবার মেয়ে শিশুদের বলি, "তুমি দেখতে কত সুন্দর।" গবেষণার ফলাফল থেকে জানা গেছে, এই ধরনের বাচনিক স্তুতি ছেলে ও মেয়ে শিশুদের নির্দিষ্ট আত্মপরিচয় গঠনে সাহায্য করে। এসব স্তুতিবাক্য বা বিশেষণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শিশুরা নিজেদের পুরুষ বা নারী ভাবতে শুরু করে এবং অন্যান্য নারী-পুরুষের সঙ্গে নিজেদের মিল-অমিল খুঁজতে থাকে। পরিবারের সদস্যরা ক্রমাগত শিশুদের তাদের জেন্ডারভিত্তিক ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যাকে শিশুরা একপর্যায়ে পরম সত্য হিসেবে ধরে নেয়। ছেলেশিশু ও মেয়েশিশু উভয়ই শৈশবের একদম শুরু থেকে চিরাচরিত পুরুষালি ও মেয়েলি কাজকর্মের সঙ্গে পরিচিত হয়। মেয়েশিশুকে বলা হয় তার মাকে গৃহস্থালির কাজে সাহায্য করতে এবং ছেলেশিশুকে বাবা সঙ্গে করে নিয়ে যায় বাজারে বা অন্য কোথাও। এভাবে ছেলে ও মেয়ে শিশুরা নতুন নতুন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং নিজেরা সেগুলোতে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ হয়। যেসব সম্প্রদায়ে নারী ও পুরুষদের বিচরণক্ষেত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়, সেখানে ছেলে ও মেয়ে শিশুরা নিজ সেক্স ভিন্ন অন্য সেক্সের কাজকর্মের ব্যাপারে তেমন কিছু জানতে পারে না। তারা কেবল নিজস্ব সেক্সের উপর আরোপিত কাজগুলো জানে ও শেখে এবং সে অনুযায়ী তাদের মাঝে নিজেদের অজ্ঞাতে তথাকথিত পুরুষালি বা মেয়েলি কাজের প্রতি অভ্যস্ততা গড়ে ওঠে। কোনো শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির কর্মকাণ্ডে যখন তার উপর আরোপিত জেন্ডারভিত্তিক ভূমিকা থেকে বিচ্যুতি দেখা দেয়, তখন তাকে যেভাবে সাজা বা অননুমোদন দেয়া হয় সেটি একটি শক্তিশালী উপায় কারো কাছ থেকে প্রত্যাশিত পুরুষসুলভ বা নারীসুলভ আচরণ বের করে আনার। এক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রচলিত সাজা হলো ঐ ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে হেনস্থা করা। সামাজিক সাজার পাশাপাশি আরো আছে অর্থনৈতিক সাজা। যেসব নারী সিঙ্গেল মাদার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, সমাজে তাদের পদে পদে অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় এবং এর মাধ্যমে সমাজ মূলত এই বার্তাই দেয় যে ওই নারীদের সমাজ অনুমোদন দিচ্ছে না। আবার অনেক সময় কেউ যদি নিজের জেন্ডারভিত্তিক ভূমিকা পালন থেকে সরে আসে, তখন তার পরিবার থেকেও তাকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য বন্ধ করে দেয়া হয় কিংবা বন্ধের হুমকি দেয়া হয়। মনকে ভাবা হয়ে থাকে শরীরের চেয়ে শ্রেয় এবং সংস্কৃতিকে বলা হয় প্রকৃতির উন্নত রূপ। যারা যুক্তিবাদী ও স্বাধীন, তাদের আবেগি ও পরাধীনদের চেয়ে উঁচুদরে মূল্যায়ন করা হয়। ধরে নেয়া হয় নারীরা হলো শরীর (তারা পশুর মতো বংশবৃদ্ধি করে)। অন্যদিকে পুরুষরা হলো মন; তারা চিন্তাশীল, যুক্তিবাদী, সক্রিয়। তারা প্রকৃতি নিয়ে কাজ করে এবং একে সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করে। তাই পুরুষরা বিবেচিত হয় প্রকৃতির চেয়ে শ্রেয় হিসেবে এবং তারা প্রকৃতির সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। একই বৈশিষ্ট্য মেনে নেয়া হয় আদিবাসী ও গরিবদের ক্ষেত্রেও। এ কারণে পাহাড়ি, জঙ্গলবাসী, কৃষক কিংবা জেলেদের মতো পশ্চাৎপদ সম্প্রদায়ের মানুষদের অসম্মানের দৃষ্টিতে দেখে উন্নয়ন পরিকল্পকরা। এ কারণে জঙ্গলবাসীদের না জানিয়ে, তাদের সম্মতি ছাড়া কেটে নেয়া যায় গাছ, দখল করা যায় ভূমি। এভাবে লক্ষ লক্ষ জঙ্গলবাসী পরিণত হয় শরণার্থীতে। তাদের ঠাঁই হয় কোনো শহুরে বস্তিতে, যাপন করতে হয় মানবেতর জীবন। একইভাবে তৃতীয় বিশ্ব বিবেচিত হয় শরীর হিসেবে, যেখানে প্রথম বিশ্ব হলো মন; তৃতীয় বিশ্ব হলো প্রকৃতি, প্রথম বিশ্ব হলো সংস্কৃতি; তৃতীয় বিশ্ব হলো আবেগি ও যুক্তিহীন, প্রথম বিশ্ব হলো যুক্তিবাদী, বৈজ্ঞানিক ও আধুনিক। বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ সৃষ্টির সময় একই সমান্তরালে চলেছে ডাইনি নিধন, আর এভাবে তৃতীয় বিশ্ব ও নারীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে ক্ষমতা, অর্থনীতি ও জ্ঞান। এরপর তাদের এমনভাবে সামাজিকীকরণ করা হয়েছে, যার ফলে তারা আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। এই গৃহবধূ কিংবা অনুন্নত অবস্থান একটি কৃত্রিম পণ্য, যার জন্ম হয়েছে সহিংস উন্নয়ন হতে এবং এরই উপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সমগ্র অর্থনীতি, আইন, রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিজ্ঞান, শিল্প, রাজনীতি, পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং সকল আধুনিক প্রতিষ্ঠান। তৃতীয় বিশ্ব হলো ডাইনি নিধনের 'ডাইনি'। সেই সঙ্গে তারা হলো 'সাধারণ গৃহবধূ', কিংবা 'বিশ্ব গৃহবধূ', যার অন্তর্ভুক্ত তৃতীয় বিশ্বের পুরুষরাও। পাব, ফুটবল স্টেডিয়াম, নির্জন রাস্তা, চায়ের দোকান, পানের দোকান, সিনেমা হল ইত্যাদি সবই পুরুষ অধ্যুষিত পরিসর। নারীরা মাঝেমধ্যে এসব পরিসরে পা রাখে, তবে তখন তাদের সঙ্গী হিসেবে থাকে কোনো পুরুষ। যদি তারা একান্তই বাধ্য হয় এসব পরিসরে একাকী যেতে, তাহলে তাদের কাছে আশা করা হয় যেন তারা যত দ্রুত সম্ভব এসব পরিসর ত্যাগ করে। আর যদি তারা তা না করে, তাহলে তারা বিপদে পড়তে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই তাদের অনুমোদন দেয়া হয় না যে পুরুষদের মতো তারাও অবাধে ঘুরে বেড়াতে পারবে এসব পরিসরে। একইভাবে রান্নাঘর বা নলকূপ হলো সম্পূর্ণরূপে নারীদের পরিসর। এমনকি বাড়িতেও একটি নিরিবিলি ঘর বা পরিসর সংরক্ষিত থাকতে পারে পরিবারের কর্তা বা কোনো পুরুষের জন্য, যেন সে সাংসারিক কুটকাচালির শব্দে বিরক্ত না হয়। ঘরের নানা সরঞ্জামও জেন্ডারাইজড হয়ে থাকে। যেমন- বড় গ্লাস, চেয়ার কিংবা বিছানা সংরক্ষিত থাকে পরিবারের কর্তার জন্য। কর্মজীবী শ্রেণির বাড়িতেও বাইসাইকেল, রেডিও বা হাত ঘড়ির মালিক হয় পুরুষরা। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জেন্ডারাইজড শব্দগুচ্ছ হচ্ছে যেখানে পুরুষরা যৌনতা বা নারীর যৌনাঙ্গ বিষয়ক গালি দিয়ে থাকে। যদিও পুরুষরা নির্দ্বিধায় সেগুলো ব্যবহার করতে পারে, নারীরা সেগুলো ব্যবহার করলেই তারা হকচকিয়ে যায়। দক্ষিণ এশীয় ভাষাগুলোতে অনেক প্রবাদ-প্রবচনও রয়েছে, যেগুলোতে নারীকে পুরুষের চেয়ে খাটো করে কিংবা তাকে পাপিষ্ঠ, নীচ মনের কিংবা ঝগড়াটে হিসেবে দেখানো হয়। পুরুষালি শব্দকে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি বা নিয়ম মানারও প্রচলন হয়েছে। ইংরেজিতে 'mankind', 'he' ও 'his' শব্দগুলো নারীদের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। এছাড়া 'chairman', 'newsman', 'sportsman', 'one-man-show' প্রভৃতিও নারীদের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। এমন অনেক পরিভাষা, সম্বোধন বা পদবি আছে যেগুলো জেন্ডার আরোপিত না হলেও সাধারণভাবে তা-ই ধরে নেয়া হয়। যেমন- সেক্রেটারি, নার্স, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক ইত্যাদি শুনলে অনেকেই ধরে নেয় তারা সকলে নারী। আবার বস, পাইলট, ম্যানেজার, রাজনীতিবিদ, সার্জন বা কৃষক শুনলেই ধরে নেয়া হয় তারা সকলে পুরুষ। পুরুষতন্ত্রকে একটি ব্যবস্থা হিসেবে অনুধাবন করতে পারলে জৈব নির্ধারণবাদকে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব; যার মূল কথা হলো নারী ও পুরুষ প্রাকৃতিকভাবে ভিন্ন তাদের জৈবিক কারণে এবং সে কারণে তাদের সমাজে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা প্রদান করা হয়। পুরুষতন্ত্রকে ব্যবস্থা হিসেবে অনুধাবনের ফলে সেই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব, যা দাবি করে প্রতিটি পুরুষ ব্যক্তিবিশেষ সবসময় আধিপত্যশীল অবস্থায় থাকবে এবং প্রত্যেক নারী থাকবে অধীনস্থ পর্যায়ে। এই ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সেই আদর্শ যা বলে থাকে পুরুষরা নারীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সে কারণে নারীকে সবসময় পুরুষের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকতে হবে এবং নারী হলো পুরুষের সম্পত্তি। কিছু দক্ষিণ এশীয় ভাষায় ব্যবহৃত হয় স্বামী, পতি, মালিক প্রভৃতি শব্দ- যাদের প্রত্যেকের আক্ষরিক অর্থ হলো 'প্রভু'। একই সমাজের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিতে এর প্রকৃতি হতে পারে ভিন্ন ভিন্ন। একই রকম ভিন্নতা লক্ষণীয় ইতিহাসের বিভিন্ন সমাজ কিংবা সময়কালে। তবে সামগ্রিক মূলনীতি সবসময় একই, অর্থাৎ ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ থাকবে পুরুষদের হাতে। সেই নিয়ন্ত্রণের ধরন কেমন হবে, সেক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকতে পারে। পুরুষরা নারীদের উৎপাদন ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে ঘরের বিনামূল্যের কাজ কিংবা বাইরের উপার্জনশীল কাজ- দুই জায়গাতেই। ঘরে নারীরা কোনো পারিশ্রমিক ছাড়া তাদের সন্তান, স্বামী এবং পরিবারের সকল সদস্যকে সারা জীবনভর সেবা দিয়ে থাকে। গৃহবধূদের নিরন্তর পুনরাবৃত্তিমূলক খাটুনিকে কাজ বলে গণ্য করা হয় না। পুরুষরা নারীদের ঘরের বাইরের শ্রমকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তারা হয় নারীদের তাদের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য করে, নয়তো নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করতে বাধা প্রদান করে। অনেক সময় নারীরা যা উপার্জন করে তা পুরুষরা জোর করে কেড়ে নেয়, কিংবা তারা ঠিক করে দেয় নারীরা কখন কতটুকু কাজ করবে। আবার নারীদের ভালো বেতনের চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাদের বাধ্য করা হয় তাদের শ্রমকে স্বল্প মজুরিতে বিক্রি করতে। কখনো কখনো তাদের ঘরে বসে কাজ করতে বাধ্য করা হয় গৃহভিত্তিক উৎপাদন এর বুলি আউড়ে। তারা নারীদের অধস্তনতার সুযোগ নিয়ে তাদের অর্থনৈতিক প্রাপ্তি ছিনিয়ে নেয়। পুরুষরা নারীদের প্রজনন ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক সমাজে নারীদের স্বাধীনতা নেই সিদ্ধান্ত নেয়ার যে তারা কয়টি সন্তান নিতে চায়, কখন নিতে চায়, গর্ভনিরোধক ব্যবহার করতে চায় কি না কিংবা গর্ভপাত করতে চায় কি না। ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কিংবা রাষ্ট্র নিয়ম বেঁধে দেয় নারীর প্রজনন ক্ষমতার ব্যাপারে। ক্যাথলিক চার্চের পুরুষ ধর্মীয় যাজকরা ঠিক করে দেয় নারী ও পুরুষরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবে কি না, কোন কোন পদ্ধতি ব্যবহারের অনুমতি পাবে, নারীরা গর্ভপাত করতে পারবে কি না। আধুনিক সময়ে রাষ্ট্র ঠিক করে দেয় দেশের সন্তোষজনক জনসংখ্যার আকার এবং সে অনুযায়ী নারীদের উৎসাহিত বা অনুৎসাহিত করে সন্তান জন্মদানে। মালয়েশিয়ায় নারীদের প্রতি আহবান জানানো হচ্ছে কয়েকটি সন্তান নেয়ার, যেন দেশে উৎপাদিত শিল্পদ্রব্যের জন্য মোটামুটি বড় ঘরোয়া বাজার সৃষ্টি করা যায়। ইউরোপে (যেখানে জন্মহার কম) সেখানে নারীদের বিভিন্ন ইনসেনটিভের প্রলোভন দেখানো হয় যেন তারা বেশি বেশি সন্তান নেয়। সেখানে তাদের লম্বা সময়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া হয় এবং ছুটির সময়ে পুরো বেতন দেয়া হয়। এছাড়া রয়েছে খণ্ডকালীন চাকরির সুবিধা, চাইল্ডকেয়ার সুবিধা ইত্যাদি। কোনো কোনো দেশ আবার পিতৃত্বকালীন ছুটি দিয়ে থাকে। রাষ্ট্রের আদর্শ ও নীতিমালা শ্রম অর্থনীতির চাহিদার উপর ভিত্তি করে বদলাতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে যখন প্রচুর শ্রম শক্তির প্রয়োজন পড়ে দেশটিকে পুনর্গঠন করতে, তখন নারীদের আহবান জানানো হয় চাকরি করতে এবং জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে। অন্যদিকে যুদ্ধের সময় অনেক নারী সক্রিয়ভাবে সম্মুখভাগে কাজ করে গেলেও একবার যখন ব্রিটেন যুদ্ধে জিতে গেলো, তখন সেসব নারীদের বলা হলো ঘরে ফিরে যেতে, কেননা পুরুষরাই যথেষ্ট শান্তিপূর্ণ সময়ের কাজ সামলাতে! ১৯৫০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে 'বেবি বুম' ঘটে একই কারণে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Baby_boom

প্রয়োজনীয় গর্ভনিরোধ বিষয়ক তথ্যাবলি সম্পর্কে অবহিত না করে কমবয়সী নারীদের উপর মাতৃত্বকে চাপিয়ে দেয়া হয়। গর্ভনিরোধক প্রাপ্তি নারীদের জন্য সহজ ও সুবিধাজনক ব্যাপার নয়। যেসব গর্ভনিরোধকের নাগাল তারা পায় সেগুলো হয়ে থাকে অনেক দামি, অবিশ্বস্ত অথবা ক্ষতিকর। তাছাড়া পুরুষতন্ত্র গর্ভপাতের সুযোগ কমিয়ে দেয়, অনেক সময় সেটাকে অস্বীকৃতি জানায়। একইসঙ্গে পুরুষতন্ত্র নারীর উপর তীব্র ও অবিরাম চাপ প্রয়োগ করে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে। পুরুষতন্ত্র নারীদের শুধু মা হতে বাধ্য করে না, মাতৃত্বের স্বরূপ কেমন হবে তা-ও নির্ধারণ করে দেয়। যখনই পুরুষদের প্রয়োজন বা আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়, তখনই নারীরা তাদের যৌন পরিষেবা দিতে বাধ্য হয়। প্রতিটি সমাজে একটি পূর্ণাঙ্গ নৈতিক ও আইনি শাসন জারি থাকে বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে নারীদের যৌনতার বহি:প্রকাশকে বাধা দিতে। পুরুষদের বেলায় সমাজ অনেকটা চোখ বন্ধ করে রাখে। ধর্ষণ এবং ধর্ষণের হুমকি হলো আরেকটি পদ্ধতি নারীদের যৌনতার উপর আধিপত্য বিস্তার করার, এর সঙ্গে তাদের 'সম্মান' এর প্রশ্ন জুড়ে দেয়ার। নারীদের যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, আচরণ ও গতিশীলতাকে সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হয় পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নিয়মকানুনের উপর ভিত্তি করে। পুরুষতান্ত্রিক আদর্শ সাধারণ নারীর মাতৃত্বের চেয়ে তার যৌন সত্তাকে অধিক এগিয়ে রাখে। মাতৃত্বের আংশিক ব্যতিক্রমকে বাদ দিলে পুরুষালি সংস্কৃতি নারীকে পুরুষের সুখের নিমিত্তে ব্যবহার্য যৌন বস্তু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। পুরুষতন্ত্র ধর্ষণকে দেখে কার্যকরী রাজনৈতিক যন্ত্র হিসেবে। ধর্ষণ হলো নিপীড়নের রাজনৈতিক ধারা, যা ক্ষমতাবান শ্রেণির সদস্যরা ক্ষমতাহীন শ্রেণির সদস্যদের উপর অনুশীলন করে। নারীদের যৌনতা, উৎপাদন ও প্রজননকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পুরুষদের প্রয়োজন হয় নারীদের গতিশীলতা নিয়ন্ত্রণ করার। নারীদের উপর নির্দিষ্ট পোশাক চাপিয়ে দেয়া, তাদের ঘরের বাইরে যেতে বাধা দেয়া, তাদের ব্যক্তিগত ও প্রকাশ্য জীবনকে কঠোরভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা, অন্য সেক্সের মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় বাধা দেয়াসহ আরো অনেক কিছু নারীদের গতিশীলতা ও মুক্তিকে নিয়ন্ত্রণের স্বতন্ত্র উপায়। এগুলো একেবারেই জেন্ডার নির্দিষ্ট। পুরুষদের কখনো এ ধরনের বিধিনিষেধের সম্মুখীন হতে হয় না। অধিকাংশ সম্পত্তি এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল খাত পুরুষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং তারা এই নিয়ন্ত্রণ এক পুরুষ হতে আরেক পুরুষে হস্তান্তর করে। এমনকি যেসব জায়গায় নারীদের অধিকার রয়েছে আইনীভাবে এসব সম্পদের মালিক হওয়ার, সেখানেও নানাভাবে তাদের বঞ্চিত করার চেষ্টা চলতে থাকে। প্রথাগত নিয়মের দোহাই, আবেগিক চাপ, সামাজিক নিষেধাজ্ঞার হুমকি এবং সরাসরি সহিংসতার মাধ্যমে তাদের প্রাপ্য হতে বঞ্চিত করা হয়। জাতিসংঘের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী নারীরা বিশ্বব্যাপী মোট কর্মঘণ্টার ৬০% এর বেশি সময় কাজ করে থাকে, কিন্তু বিনিময়ে তারা পায় বিশ্বের মোট উপার্জনের ১০% এবং অধিকার লাভ করে বিশ্বের মোট সম্পদের ১℅! একজন পুরুষ বিবেচিত হয় পরিবারের মাথা হিসেবে; পরিবারের মধ্যে নারীদের যৌনতা, শ্রম বা উৎপাদন, প্রজনন ও গতিশীলতাকে সে নিয়ন্ত্রণ করে। পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মকে পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধে দীক্ষিত করতে। পরিবার থেকে আমরা অর্জন করে থাকি শ্রেণিবিভাজন, অধীনস্থতা, বৈষম্যের প্রাথমিক শিক্ষা। ছেলেরা শেখে কীভাবে নিজেদের জাহির করতে হবে, কর্তৃত্ব ফলাতে হবে। মেয়েরা শেখে নতিস্বীকার করতে, অসমতাকে স্বাভাবিক ধরে নিতে। অধিকাংশ আধুনিক ধর্ম পুরুষতান্ত্রিক এবং তারা পুরুষের কর্তৃত্বকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। তারা পুরুষতান্ত্রিক শ্রেণিবিন্যাসকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন সেটি অতিপ্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকীকৃত ধর্মের বিবর্তনের পূর্বে ক্ষমতার যে নারী নীতি বিদ্যমান ছিল, ক্রমশ সেটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। দেবীদের জায়গা দখল করেছে দেবতারা। সবগুলো প্রধান ধর্মের সৃষ্টি, ব্যাখ্যা ও নিয়ন্ত্রণ ঘটেছে পুরুষদের হাত ধরে। তারা নৈতিকতা, মূল্যবোধ, আচরণ ও আইনকে সংজ্ঞায়িত করেছে; নারী-পুরুষের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং অধিকার ভাগ করে দিয়েছে; নির্ধারণ করে দিয়েছে নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্কের স্বরূপ। তারা রাষ্ট্রীয় নীতিমালাকে প্রভাবিত করেছে এবং এখনো অধিকাংশ সমাজে সেই প্রভাব অক্ষুণ্ণ রয়েছে। প্রায় সকল ধর্ম নারীদের হীন, অপবিত্র ও পাপী হিসেবে বিবেচনা করে। প্রায় সকল ধর্মে নারী-পুরুষের নৈতিকতা ও আচরণের দ্বৈত মানদণ্ড সৃষ্টি করা হয়েছে এবং ধর্মীয় আইন প্রায় সময় 'পথভ্রষ্ট' নারীদের উপর সংঘটিত সহিংসতাকে বৈধতা দান করে। অধিকাংশ দেশের আইনি ব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক ও বুর্জোয়া, সেগুলো পুরুষ ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান শ্রেণির পক্ষপাতিত্ব করে। পরিবার, বিয়ে ও উত্তরাধিকার বিষয়ক আইনগুলো ঘনিষ্ঠভাবে সম্পদের উপর পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি আইনি ব্যবস্থা পুরুষকে বিবেচনা করে পরিবারের প্রধান, শিশুদের প্রাকৃতিক অভিভাবক এবং সম্পদের প্রাথমিক উত্তরাধিকারী হিসেবে। আইনশাস্ত্রীয় ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, বিচারপতি ও উকিলরা প্রায় সকলে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বিদ্যমান আইনসমূহের ব্যাখ্যা করে। পুরুষতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে পুরুষরা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করে, অধিকাংশ সম্পদের মালিক হয়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয় এবং বিভিন্ন উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডের মূল্য নির্ধারণ করে। ফলে নারীদের করা অধিকাংশ উৎপাদনশীল কাজ স্বীকৃতি পায় না এবং সেজন্য তারা পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হয়। নারীদের গৃহকর্মের কোনো মূল্যায়ন হয় না। সন্তানদের গর্ভে ধারণ, তাদের জন্মদান ও তাদের লালন-পালনে নারীদের ভূমিকা ও শ্রম শক্তি কোনো অর্থনৈতিক অবদান হিসেবে বিবেচিত হয় না। রাজনৈতিক দল কিংবা সংস্থাগুলোতে মুষ্টিমেয় নারীর উপস্থিতি দেখা যায়। যখন নারীরা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদে আসীন হয়, প্রাথমিকভাবে তারা সেই পদাধিকার লাভ করে কোনো শক্তিশালী পুরুষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় এবং তারা পুরুষদের সৃষ্টি করা কাঠামো ও নীতিমালা অনুসরণ করেই কাজ করে। গোটা বিশ্বের মধ্যে এই অঞ্চল থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নারী রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার সংসদে নারীদের উপস্থিতি কখনো ১০% এর উপর ওঠেনি। গণমাধ্যমও সমাজের উঁচু শ্রেণির পুরুষদের দখলে থাকে এবং এর মাধ্যমে তারা শ্রেণি ও জেন্ডার বিষয়ক নিজস্ব মতবাদ প্রচার করে। চলচ্চিত্র, টেলিভিশন থেকে শুরু করে ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র, রেডিও সর্বত্র নারীদের উপস্থাপন গৎবাঁধা ও বিকৃত। এসব জায়গায় পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব ও নারীদের হীনতার কথা বারবার বলা হয়; নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার উপস্থিতি অবাধ ও প্রচুর। গণমাধ্যমে নারীদের পেশাগত প্রতিনিধিত্ব খুব কম। তাছাড়া সংবাদের কাভারেজ, বিজ্ঞাপন এবং সামগ্রিক বার্তা এখনো অনেক বেশি সেক্সিস্ট। অনেক সংস্কৃতিতে নারীদের পদ্ধতিগতভাবে ধর্মগ্রন্থ পাঠের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হতো। বর্তমান সময়েও নারীদের ধর্মীয় ও আইনি লিপির নিজস্ব ব্যাখ্যা সৃষ্টির সুযোগ খুব কম দেয়া হয়। নানা ধরনের সহিংসতাকে ব্যবহার করা হয় নারীদের নিয়ন্ত্রিত ও আয়ত্তাধীন রাখতে। পুরুষ কর্তৃক এ ধরনের সহিংসতাকে অনেক ক্ষেত্রে বৈধ ও আইনসঙ্গত মনে করা হয়। বস্তুত কোনো অসম ব্যবস্থা পুরোপুরি শোষিতের অংশগ্রহণ ছাড়া অব্যাহত থাকতে পারে না। আর তাই শোষিতরাও এই ব্যবস্থা থেকে কিছু কিছু সুবিধা লাভ করে। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক নারী ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছে রানী কিংবা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মাধ্যমে। তারা মাঝে মাঝে ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, ছোট-বড় নানা ধরনের ফায়দা লুটেছে। কিন্তু এই ব্যবস্থাটি চলছে পুরুষদের কর্তৃত্বে, নারীদের নিছক অল্প কিছু জায়গা দেয়া হয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তারা মাঝে মাঝে ব্যবস্থাপনা পর্যায়েও অংশগ্রহণ করে। কিন্তু তার মানে এই না যে শ্রমিকদের হাতেই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এটি সমস্যা নয় যে নারীরা তারা কী করে। সমস্যাটি হলো নারীরা কীভাবে মূল্যায়িত হয় এবং সেই মূল্যায়নের অধিকার রয়েছে কাদের কাছে। সমস্যা কাঠামোতে, এবং সেই কাঠামো নির্ধারণ করেছে পুরুষরা। স্থানীয় সৈন্য, পুলিশ, সরকারি কর্মচারী ছাড়া মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্রিটিশ শাসকের পক্ষে বিশাল বিশাল দেশ বা মহাদেশ শাসন করা সম্ভব ছিল না। দাসদের নীরব সহযোগিতা ছাড়া দাস ব্যবস্থা এত লম্বা সময় ধরে চলতো না। একই কথা প্রযোজ্য নারীদের ক্ষেত্রে। তারাও এই ব্যবস্থার অংশ, তারাও এই ব্যবস্থার মূল্যবোধকে নিজেদের অন্তঃকরণে ঠাঁই দিয়েছে এবং তারাও পুরুষতান্ত্রিক আদর্শ থেকে মুক্ত নয়। নারীদের মধ্যে কেউ কেউ এই ব্যবস্থা থেকে সুবিধা লাভ করে। নারীরা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি তাদের সহযোগিতা বা অংশগ্রহণকে সক্রিয় রাখে।

গের্ডা লার্নারের মতে-

"এই সহযোগিতাকে নিশ্চিত করা হয়েছে বেশ কিছু বিষয়ের মাধ্যমে: জেন্ডার দীক্ষা; পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব; নারীদের নিজেদের ইতিহাসকে অস্বীকৃতি; নারীদের মাঝে বিভাজন, যৌন কর্মকাণ্ডের উপর ভিত্তি করে কাউকে 'সম্মানিত' আর কাউকে 'পথভ্রষ্ট' আখ্যা প্রদানের মাধ্যমে; নারীদের সংযম কিংবা সরাসরি জোরজবরদস্তি; অর্থনৈতিক সংস্থান ও রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের ক্ষেত্রে বৈষম্য; এবং কাউকে কাউকে শ্রেণি সুবিধা প্রদান করে, যার ফলে নারীদের পুরুষতন্ত্রকে আখ্যায়িত করা যায় পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্য হিসেবে। যতক্ষণ পর্যন্ত নারীরা পুরুষদের 'নিরাপত্তা'র অধীনে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারাও পুরুষদের শ্রেণি সুবিধা সমানভাবে ভোগ করে। নারীদের জন্য (নিচু বর্ণের নারী ব্যতীত) পুরুষদের সঙ্গে 'পারস্পরিক চুক্তি'র ব্যাপারটি এমন যে : নারীরা পুরুষদের নিকট তাদের যৌন, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অধীনস্থতা স্বীকার করবে, বিনিময়ে তারা পুরুষদের কাছ থেকে পাবে সেই শ্রেণি ক্ষমতা, যাকে কাজে লাগিয়ে তারা তাদের শ্রেণি অপেক্ষা নিচু শ্রেণির নারী-পুরুষ উভয়কে শোষণ ও নিপীড়ন করতে পারবে।"

নিজেদের সুবিধাপ্রাপ্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য নারীরা ক্রমাগত তাদের দর-কষাকষি ক্ষমতার সঙ্গে রফা করতে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা করে থাকে অন্য নারীদের ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে। নারীরা অনেক সময় পুত্র সন্তানের প্রতি অধিক যত্ন নেয়, কন্যা সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে, তাদের স্বাধীনতা হরণ করে এবং ছেলের বউদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। অন্যদিকে শ্রমিক শ্রেণির পুরুষরা, যারা বুর্জোয়া পুরুষদের বিপরীতে ক্ষমতাহীন, তারাও তাদের নিজেদের শ্রেণির নারীদের উপর ক্ষমতা জাহির করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় পুরুষ হিসেবে তারা খাদ্য ও স্বাস্থ্যের মতো প্রাথমিক বিষয়গুলোতেও বেশি সুযোগ পেয়ে থাকে। সামাজিক, ধর্মীয়, আইনি ও সাংস্কৃতিক চর্চাসমূহ পুরুষ হিসেবে তাদেরকে কিছু বাড়তি সুবিধা দেয়। ব্যবহারিকভাবেও তারা সকল ক্ষেত্রে বেশি অধিকার লাভ করে থাকে। আবার যেসব পুরুষ নরম স্বভাবের এবং আগ্রাসী নয়, তাদের নানাভাবে হেনস্থা ও উপহাসের শিকার হতে হয়। যারা তাদের স্ত্রীদের সমান চোখে দেখে, তাদের বলা হয় 'স্ত্রৈণ'।





Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]