সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মুসলমান সম্প্রদায়ের অগ্রযাত্রা (পর্ব-এক)
কারিম আব্বাস আলী ওগলু কারিমভ ১৯১৭ সালের ১৪ নভেম্বর তদানীন্তন রুশ প্রজাতন্ত্রের বাকু শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বাকু বর্তমান আজারবাইজানের রাজধানী। কারিমভের বাবা আব্বাস আলী কারিমভ ছিলেন তেল প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ।
https://www.independent.co.uk/news/obituaries/lt-gen-kerim-kerimov-36414.html
মা সুরাইয়া কারিমোভা ছিলেন প্রখ্যাত আজারবাইজানি রাজনীতিবিদ আসাদুল্লা আখমেদভের মেয়ে। আখমেদভ ১৯১৮-২০ সালে 'আজারবাইজান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' এর আইনসভার সদস্য ছিলেন। কারিমভ ১৯৩৬ সালে 'আজারবাইজান শিল্প ইনস্টিটিউট'-এ ভর্তি হন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Azerbaijan_State_Oil_and_Industry_University
সেখানে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি বেশ কয়েকটি রেডিও রিসিভার তৈরি করেন এবং 'আজারবাইজান রেডিও'-তে যোগদান করেন। ছাত্র থাকাবস্থায় তিনি মারদাকান রেডিও স্টেশনের পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৪১ সালে তিনি ইনস্টিটিউট থেকে ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এর কিছুদিন পর জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। এসময় সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীতে রেডিও ইঞ্জিনিয়ারদের খুব চাহিদা ছিল। কিন্তু কারিমভের মেধার কথা বিবেচনা করে তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ না করে লাল ফৌজের 'ফেলিক্স জেরঝিনস্কি আর্টিলারি অ্যাকাডেমি'-তে ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। সেসময় জার্মান আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য অ্যাকাডেমিকে সোভিয়েত উজবেকিস্তানের সমরখন্দ শহরে স্থানান্তর করা হয়। কারিমভ সেখানে চলে যান এবং তাকে সরাসরি অ্যাকাডেমির ৫ম বর্ষে ভর্তি করা হয়। ১৯৪৩ সালে তিনি সেখান থেকে আর্টিলারি ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন এবং তার ডিপ্লোমার বিষয়বস্তু ছিল মর্টার উৎপাদন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাকি সময়টা তিনি 'কাতিউশা' রকেট লঞ্চারের পর্যবেক্ষণের কাজে ব্যয় করেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Katyusha_rocket_launcher
যুদ্ধে অবদানের জন্য তাকে সোভিয়েত সরকার 'অর্ডার অফ দ্য রেড স্টার' পদক প্রদান করে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Order_of_the_Red_Star
কারিমভ সোভিয়েত মহাকাশবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার প্রথম থেকে এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৪৬ সালে কারিমভ জার্মানির সোভিয়েত অধিকৃত অংশে অবস্থিত নর্ডহাউসেনে যান। সেখানে জার্মানির 'ভি-২' রকেট নির্মাণের একটি কারখানা ছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/V-2_rocket
কারিমভ অন্যান্য সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে জার্মান রকেট প্রোগ্রামের অবশিষ্টাংশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। ১৯৪৬ সাল থেকে কারিমভ আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য রেডিও মেজারমেন্ট সিস্টেম তৈরির গবেষণায় লিপ্ত ছিলেন। তিনি 'দন' রেডিও মেজারমেন্ট সিস্টেম উদ্ভাবন করেন এবং পরবর্তীতে এটি সোভিয়েত স্পেস প্রোগ্রামে ব্যবহার করা হয়। এই উদ্ভাবনের জন্য তাকে ১৯৫০ সালে সোভিয়েত 'রাষ্ট্রীয় পুরস্কার' প্রদান করা হয়।
https://www.azer.com/aiweb/categories/magazine/33_folder/33_articles/33_sovietaero.html
সোভিয়েত কাজাখস্তানের বাইকোনুরে মহাকাশযান উৎক্ষেপণ কেন্দ্র নির্মাণের পর থেকে কারিমভ 'মহাকাশযান সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় কমিশন' এর সদস্য ছিলেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Baikonur_Cosmodrome
পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণ করে। উভয় প্রকল্পে কারিমভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই সময় তিনি অস্ত্রাখান প্রদেশের কাপুস্তিন ইয়ার শহরে মহাকাশযান গবেষণা কেন্দ্রে গবেষণার কাজে ব্যয় করেন। সোভিয়েত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১৯৫৯ সালের মধ্যে তিনি 'ইঞ্জিনিয়ার-কর্নেল' পদে উন্নীত হন এবং মন্ত্রণালয়টির 'মহাকাশ সংক্রান্ত বস্তু নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে'র পরিচালক নিযুক্ত হন। এসময় জুড়ে তার তত্ত্বাবধানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন গোপন মহাকাশযান উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে রকেট উৎক্ষেপিত হয়, যেগুলোর মধ্যে ছিল বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ 'স্পুৎনিক-১'।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Sputnik_1
১৯৬০ সালের অক্টোবরে কারিমভের ছোট ভাই এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হলে তাকে ভাইয়ের শেষকৃত্যে যোগদানের জন্য কয়েক দিনের ছুটি দেয়া হয়। এসময় বাইকোনুরে 'আর-১৬' আইসিবিএম উৎক্ষেপণকালে বিস্ফোরিত হয় এবং এর ফলে সোভিয়েত স্ট্র্যাটেজিক রকেট ফোর্সের কমান্ডার মার্শাল নেদেলিনসহ ১২৬ জন সোভিয়েত সেনা কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী নিহত হন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Nedelin_catastrophe
কারিমভের এই পরীক্ষার সময় উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও অনুপস্থিত থাকায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৬১ সালে ইউরি গ্যাগারিন প্রথম মানুষ হিসেবে 'ভোস্তক-১' মহাকাশযানে করে মহাশূন্যে গমন করেন। এই সাফল্যের পেছনে কারিমভের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল এবং এজন্য তাকে মেজর জেনারেল পদ প্রদান করা হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Vostok_1
পরবর্তী কয়েক বছরে তিনি বিভিন্ন নতুন কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন, যেগুলোর মধ্যে ছিল 'জেনিৎ' গোয়েন্দা উপগ্রহ।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Zenit_(satellite)
১৯৬৪ সালে কারিমভ 'মহাকাশ সম্পদ কেন্দ্রীয় ডিরেক্টরেটে'র কমান্ডার ইন চিফ নিযুক্ত হন। এসময় তিনি সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। তিনি মহাশূন্যে আরো মানুষ প্রেরণে ইচ্ছুক থাকলেও সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে রাজি ছিল না। শাস্তিস্বরূপ কারিমভসহ আরো কয়েকজন কর্মকর্তাকে 'সাধারণ যন্ত্রনির্মাণ মন্ত্রণালয়'-এ বদলি করা হয়। ১৯৬৬ সালে বিখ্যাত সোভিয়েত মহাকাশবিজ্ঞানী সের্গেই করোলিয়োভের সুপারিশক্রমে কারিমভকে 'সয়ুজ' মনুষ্যবাহী মহাকাশযান প্রকল্পের জন্য সৃষ্ট রাষ্ট্রীয় কমিশনের সভাপতি নিযুক্ত করা হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Soyuz_(spacecraft)
ইতোপূর্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের যেকোনো রাষ্ট্রীয় কমিশনের সভাপতি হতে পারতেন কেবল মন্ত্রী পদমর্যাদার কেউ। কারিমভ প্রথম ব্যক্তি, যিনি মন্ত্রী না হয়েও পরবর্তী ২৫ বছরের জন্য এই কমিশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের অল্প দিনের মধ্যে 'কসমস ১৩৩' নামক সয়ুজ সিরিজের পরীক্ষামূলক রকেটটির উৎক্ষেপণ ব্যর্থ হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Kosmos_133
১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে সয়ুজ সিরিজের আরেকটি রকেট উৎক্ষেপণের সময় বিস্ফোরিত হয় এবং কারিমভ অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। পরবর্তীতে সয়ুজ সিরিজের আরেকটি রকেট সফলভাবে উৎক্ষেপিত হলেও উৎক্ষেপণের কিছুক্ষণের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আরাল সাগরে পতিত হয়। ১৯৬৭ সালের এপ্রিলে 'সয়ুজ-১' রকেটটি বিধ্বস্ত হয়ে নভোচারী ভ্লাদিমির কোমারভ নিহত হন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Vladimir_Komarov
১৯৬৭ সালের অক্টোবরে 'কসমস ১৮৬' ও 'কসমস ১৮৮' রকেট দু'টি মহাকাশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযুক্ত হয় এবং এই সাফল্যের জন্য কারিমভকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Kosmos_186_and_Kosmos_188
১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকে কারিমভের তত্ত্বাবধানে 'সালিউৎ' ও 'মির' সিরিজের মহাকাশ স্টেশন মহাশূন্যে স্থাপিত হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Salyut_programme
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mir
কারিমভ ১৯৭৫ সালে মার্কিন-সোভিয়েত যৌথ 'অ্যাপোলো-সয়ুজ টেস্ট প্রোজেক্ট' সাফল্যের সঙ্গে তত্ত্বাবধান করেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Apollo%E2%80%93Soyuz
১৯৮৭ সালে 'প্রাভদা' পত্রিকায় কারিমভের জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয় এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কারণে গোপনীয়তা বজায় রাখা এই বিজ্ঞানী জনসমক্ষে আসেন। তাকে সোভিয়েত সরকার 'হিরো অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন', 'হিরো অফ সোশ্যালিস্ট লেবার' ও 'অর্ডার অফ লেনিন'সহ নানাবিধ পুরস্কার ও পদক প্রদান করেছে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Hero_of_the_Soviet_Union
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Hero_of_Socialist_Labour
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Order_of_Lenin
১৯৯৫ সালে তিনি 'The Way to Space' নামক একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেন।
Comments