সোভিয়েত আজারবাইজান

 

১৮০৪-১৮১৩ এবং ১৮২৬-১৮২৮ সালের রুশ-ইরানি যুদ্ধদ্বয়ে রুশ সাম্রাজ্যের নিকট ইরান পরাজিত হয়ে আজারবাইজানের ভূমি রুশদের নিকট হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Russo-Persian_Wars

১৯১৮ সালের আগে আজারবাইজানিদের 'ককেশিয়ান তাতার' বা 'ককেশিয়ান তুর্কি' হিসেবে অভিহিত করা হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় রাষ্ট্রের অংশগ্রহণের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ককেশাস ও মধ্য এশিয়ার তুর্কি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে ওসমানীয় শাসনাধীনে নিয়ে আসা। ১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতনের পর আজারবাইজানিরা জর্জীয় ও আর্মেনীয়দের সঙ্গে মিলে ট্রান্সককেশিয়ান ফেডারেশন নামক যুক্তরাষ্ট্র গঠন করলেও জাতি তিনটির মধ্যে তীব্র মতবিরোধের কারণে ব্যবস্থাটি পরিত্যক্ত হয়ে ১৯১৮ সালের ২৮ মে আজারবাইজানিরা মুসাভাৎ দলের নেতৃত্বে স্বাধীন 'আজারবাইজান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Musavat

রাষ্ট্রটি ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং ওসমানীয় সৈন্যদের সহায়তায় দাশনাক ও বলশেভিকদের কাছ থেকে বাকু দখল করে। ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ওসমানীয়, আজারবাইজানি ও অন্যান্য ককেশিয়ান মুসলিম জাতির সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত 'ককেশিয়ান ইসলামি সৈন্যবাহিনী' বাকু দখল করে শহরটিকে আজারবাইজানের নিয়ন্ত্রণাধীনে নিয়ে আসে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Islamic_Army_of_the_Caucasus

১৯১৮ সালের অক্টোবরে ওসমানীয় সাম্রাজ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলে ব্রিটিশ সৈন্যরা বাকু দখল করে নেয়। তারা আজারবাইজানি সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে এবং আজারবাইজানি সরকার ব্রিটেনসহ মিত্রশক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। ১৯১৯ সালের আগস্টে ব্রিটিশ সৈন্যরা বাকু ত্যাগ করলেও আজারবাইজান ও মিত্রশক্তির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তারা আর্মেনিয়ার সঙ্গে প্রলম্বিত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং জর্জিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। তদুপরি রাষ্ট্রটির অভ্যন্তরে আর্মেনীয়রা বিদ্রোহ ঘোষণা করে, আজারবাইজানি বলশেভিকরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটানোর জন্য প্রচেষ্টা চালাতে থাকে এবং কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ তীব্র হতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে সংঘটিত অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি, রুশ রাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সংযোগের বিচ্ছিন্নতা, খাদ্য সঙ্কট, কৃষিখাতে বিপর্যয় এবং সর্বোপরি তেল উৎপাদন বহুলাংশে হ্রাস পাওয়ার কারণে আজারবাইজান তীব্র সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটে নিপতিত হয়। ক্ষমতাসীন মুসাভাৎ দলের মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আজারবাইজানি সরকারকে প্রায় অকার্যকর করে ফেলে। দলটির ডানপন্থী ও বামপন্থী অংশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত তীব্র বিরোধ এই পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। দলটির ডানপন্থী অংশ (ফাতালি খান খোয়স্কি) মিত্রশক্তির সঙ্গে মৈত্রী বজায় রাখতে এবং বৃহত্তর তুর্কি ও মুসলিম বিশ্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে আগ্রহী ছিল।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Fatali_Khan_Khoyski

অন্যদিকে দলটির বামপন্থী অংশ (মাম্মাদ হাসান হাজিনস্কি) সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে এবং অর্থনৈতিক সংযোগ পুন:স্থাপন করতে আগ্রহী ছিল।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mammad_Hasan_Hajinski

বৈদেশিক যুদ্ধ, জাতিগত ও শ্রেণি সংঘাত এবং সশস্ত্র দস্যুদলগুলো তাণ্ডবের কারণে আজারবাইজানের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা মুসাভাৎ সরকারের জন্য ক্রমশ অসম্ভব হয়ে ওঠে। ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ আজারবাইজানের কারাবাখ অঞ্চলের আর্মেনীয়রা আর্মেনিয়ার সক্রিয় সমর্থনে বিদ্রোহ করে। আজারবাইজানি সরকার তাদের সেনাবাহিনীর সিংহভাগকে আর্মেনীয় বিদ্রোহ দমনের জন্য কারাবাখে প্রেরণ করে। এসময় আজারবাইজানে বলশেভিকরা শক্তিশালী হয়ে উঠছিল এবং তাদের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। বিশেষত বাকু শহরের তেল শ্রমিক ও সৈনিকদের মধ্যে তাদের বিশেষ জনপ্রিয়তা ছিল। আজারবাইজানি বলশেভিকরা সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে নিজেদের কার্যক্রম সমন্বয় করছিল। ১৯২০ সালের ২৭ এপ্রিল আজারবাইজানি বলশেভিকরা বাকুতে অভ্যুত্থান ঘটায় এবং একই দিনে লাল ফৌজের ১১তম আর্মি ও ভোলগা-কাস্পিয়ান সামরিক নৌবহর আজারবাইজান আক্রমণ করে। আজারবাইজানে বলশেভিক অভ্যুত্থানের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন 'মুসলিম সামাজিক গণতন্ত্রী দল' এর প্রাক্তন সভাপতি নারিমান নারিমানভ এবং আজারবাইজানি লাল নৌবহরের প্রধান চিঙ্গিজ ইলদিরিম।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Muslim_Social_Democratic_Party

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Nariman_Narimanov

https://tr.m.wikipedia.org/wiki/Cengiz_Y%C4%B1ld%C4%B1r%C4%B1m

ইলদিরিম আজারবাইজানি সরকারকে একটি চরমপত্র প্রদান করে অবিলম্বে বলশেভিকদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানান। আজারবাইজানি আইনসভা জরুরি অধিবেশনের পর এই চরমপত্র গ্রহণ করে আজারবাইজানি বলশেভিকদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। আজারবাইজানি প্রধানমন্ত্রী মাম্মাদ হাসান হাজিনস্কি পদত্যাগ করে বলশেভিক দলে যোগদান করেন। ১৯২০ সালের ২৮ এপ্রিল 'আজারবাইজান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নারিমান নারিমানভের সভাপতিত্বে আজারবাইজানি বিপ্লবী কমিটি রাষ্ট্রটির শাসনভার গ্রহণ করে। রাষ্ট্রটি আইনত স্বাধীন ছিল এবং তাদের নিজস্ব সরকার, সশস্ত্রবাহিনী ও পররাষ্ট্রনীতি ছিল। ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগদান করে। বলশেভিকরা সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের তীব্র বিরোধী ছিল এবং খোদ রুশ সাম্রাজ্যের কঠোর সমালোচক ছিল। লেনিন রুশ সাম্রাজ্যকে 'জাতিসমূহের কারাগার' হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। বক্সার বিদ্রোহ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রুশ সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার কঠোর সমালোচক ছিলেন তিনি। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বলশেভিকরা আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার প্রতিটি জাতিকে সোভিয়েত রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অধিকার প্রদান করেছিল। আজারবাইজান কর্তৃক রুশ রাষ্ট্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল বলশেভিকদের জাতীয়তা নীতির বাস্তবায়ন। বলশেভিকরা সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরোধী ছিল যা ছিল পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর বৈশিষ্ট্য। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা এবং নতুন ও স্থায়ী বাজার সৃষ্টির জন্য সাম্রাজ্য বিস্তার করে এবং বিভিন্ন অঞ্চলকে উপনিবেশে পরিণত করে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেহেতু সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জনসাধারণের কল্যাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়, সেহেতু সমাজতান্ত্রিক কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী হওয়া সম্ভব নয়। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো অধিকৃত ভূখণ্ডের সম্পদ যেভাবে শোষণ করে এবং সেখানকার অধিবাসীদের প্রতি যেভাবে বৈষম্য করে, কোনো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সেটা করবে না। বরং কোনো ভূখণ্ড সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হস্তগত হলে তারা সেই ভূখণ্ডের সম্পদকে ভূখণ্ডটির অধিবাসীদের মধ্যে সুষমভাবে বন্টন করবে এবং মূল রাষ্ট্রের অধিবাসীদের প্রতি যেরূপ আচরণ করা হয়, অধিকৃত ভূখণ্ডের অধিবাসীদের প্রতি একই আচরণ করবে। বলশেভিকরা ছিল আন্তর্জাতিকতাবাদী। তারা জাতীয়তাবাদের তীব্র বিরোধী ছিল এবং জাতীয়তাবাদের বিস্তারের ফলে কোনো জাতির সদস্যদের মধ্যে যে জাত্যাভিমান, শ্রেষ্ঠত্ববোধ ও অন্য জাতির প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি হয় সেটিকে মানবজাতির মুক্তির পথে অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করতো। পুঁজিবাদী জাতীয়তাবাদী ব্যবস্থার অধীনে কোনো জাতির প্রকৃত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন সম্ভব নয়, বরং সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকতাবাদী ব্যবস্থার অধীনে জাতিসমূহের প্রকৃত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন করা সম্ভব। এই আদর্শিক অবস্থান থেকে বলশেভিকরা প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের কোনো ভূখণ্ডকে পুঁজিবাদী ও জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলোর হাতে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র রুশ সাম্রাজ্যের বিস্তৃত ভূখণ্ডে বসবাসকারী সকল জাতিকে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিকতাবাদী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু বলশেভিক বিপ্লবের পর অক্ষ শক্তির আক্রমণ, গৃহযুদ্ধ ও মিত্রশক্তির আক্রমণের ফলে বলশেভিকরা প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের বেশকিছু প্রান্তিক অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এরকম একটি অঞ্চল ছিল আজারবাইজান। আজারবাইজানের পশ্চিমাপন্থী, বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদী ও আর্মেনীয় বিদ্বেষী মুসাভাৎ সরকার ছিল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বর্ধিতাংশ মাত্র। এজন্য বলশেভিকরা আজারবাইজানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। আজারবাইজানে সমাজতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল পশ্চাৎপদ, প্রায় নিরক্ষর ও কৃষিপ্রধান আজারবাইজানি জাতির প্রকৃত উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব ছিল। ১৯২০ সালে যখন রুশ গৃহযুদ্ধের তীব্রতা স্তিমিত হয়ে আসছিল এবং আজারবাইজান রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক সঙ্কটে নিপতিত ছিল, তখন বলশেভিকরা আজারবাইজানের ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাত করে সেখানে বলশেভিক শাসন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আজারবাইজানের মুসাভাৎ সরকার পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষত ব্রিটেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল এবং পশ্চিমাদের উদ্দেশ্য ছিল আজারবাইজানকে একটি বলশেভিক বিরোধী ঘাঁটিতে পরিণত করা।আজারবাইজান আক্রমণের আগে সোভিয়েত রাশিয়া দক্ষিণ রাশিয়ায় আন্তন দেনিকিনের নেতৃত্বাধীন শ্বেত ফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Anton_Denikin

দেনিকিন পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট ছিলেন। তিনি আজারবাইজানের ওপর অবরোধ আরোপ করেছিলেন এবং ১৯২০ সালের প্রথম দিকে আজারবাইজানে সৃষ্ট খাদ্য সঙ্কটের পেছনে এই অবরোধ ছিল অন্যতম কারণ। ১৯২০ সালের প্রথমদিকে লাল ফৌজের নিকট দেনিকিনের শ্বেত ফৌজ ক্রমশ পরাজিত হয়ে পশ্চাৎপসরণ করছিল। বলশেভিকরা ক্রমশ ককেশাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। এমতাবস্থায় মিত্রশক্তি আশঙ্কা করতে থাকে যে, ককেশাসে যদি বলশেভিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় সেক্ষেত্রে পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে কমিউনিস্ট মতবাদের বিস্তার ঘটবে এবং এতদঞ্চলে পশ্চিমা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেবে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড জর্জ কার্জন প্রস্তাব করেন, মিত্রশক্তির উচিত অনতিবিলম্বে আজারবাইজান ও জর্জিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/George_Curzon,_1st_Marquess_Curzon_of_Kedleston

রাষ্ট্র দু'টি বলশেভিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকলে বলশেভিকদের পক্ষে প্রাচ্যের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে না। এই উদ্দেশ্যে ১৯২০ সালের ১১ জানুয়ারি মিত্রশক্তি আজারবাইজানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯২০ সালের ২০ জানুয়ারি সোভিয়েত রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিওর্গি চিচেরিন আজারবাইজানি সরকারকে বার্তা প্রেরণ করে দেনিকিনের বিরুদ্ধে মিত্রতা স্থাপনের জন্য তাদের প্রস্তাব দেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Georgy_Chicherin

আজারবাইজানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফাতালি খান খোয়স্কি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। প্রত্যুত্তরে প্রেরিত একটি চিঠিতে চিচেরিন আজারবাইজানি সরকার অসহযোগিতামূলক ও শত্রুভাবাপন্ন আচরণের দায়ে অভিযুক্ত করেন। ফেব্রুয়ারিতে খোয়স্কি এর জবাবে জানান, যেকোনো ধরনের আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে সোভিয়েত রাশিয়াকে আজারবাইজানের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। চিচেরিন এর পাল্টা জবাব দিয়ে জানান, স্বীকৃতি দেয়া বা না দেয়ার ফলে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে না। মিত্রশক্তির সর্বোচ্চ পরিষদ সোভিয়েত রাশিয়ার প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আজারবাইজানকে সামরিক সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। এর ফলে আজারবাইজানি সরকার ধারণা করে যে, সম্ভাব্য সোভিয়েত রাশিয়ার আক্রমণের ক্ষেত্রে মিত্রশক্তি আজারবাইজানকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করবে। আজারবাইজানে সোভিয়েত রাশিয়ার আক্রমণের পশ্চাতে আজারবাইজানি বলশেভিকদের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯১৮-১৯২০ সালের মধ্যে তারা নিজেদের আজারবাইজানের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু তাদের সমর্থকরা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক। গ্রামাঞ্চলে তাদের বিশেষ প্রভাব ছিল না এবং এজন্য সম্পূর্ণভাবে নিজেদের শক্তির ওপর নির্ভর করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটানো তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এজন্য তারা আজারবাইজানে সামরিক অভিযান পরিচালনা করার জন্য সোভিয়েত রাশিয়াকে উৎসাহিত করে। আজারবাইজানি বলশেভিক নেতা নারিমান নারিমানভ লেনিনের সঙ্গে আলোচনার পর সমঝোতায় পৌঁছান। নারিমানভ মনে করতেন, সোভিয়েত রাশিয়াকে ছাড়া আজারবাইজানের উন্নয়ন সম্ভব নয় এবং আজারবাইজানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিদেশি শক্তিগুলোর মধ্যে একমাত্র সোভিয়েত রাশিয়া আজারবাইজানের আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে প্রকৃত অবদান রাখতে সক্ষম। এসময় বাকুর তেলশিল্পের সঙ্গে বাকুর পশ্চাৎভূমিতে বসবাসকারী গ্রামীণ কৃষক শ্রেণির কোনো সংযোগ ছিল না। নারিমানভের পরিকল্পনা ছিল, এই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন এনে আজারবাইজানের তেলসম্পদ জনসাধারণের বৃহত্তর অংশের কাজে লাগাতে হবে। তবে আজারবাইজান আজারবাইজান প্রতিষ্ঠায় কামাল পাশার সরকারের অবদানও আছে (নিজেদের স্বার্থে)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত রাশিয়া বলশেভিক বিরোধী বিভিন্ন শক্তি এবং মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। অন্যদিকে গ্র‍্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সরকার তুরস্কের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এই প্রেক্ষাপটে তাদের মধ্যে এক ধরনের বিনিময়ভিত্তিক মৈত্রী স্থাপিত হয়। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে কোনো সাধারণ সীমান্ত ছিল না বিধায় রুশ বলশেভিক বা তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে সরাসরি একে অপরকে সহায়তা করা সম্ভব ছিল না। উত্তর ককেশাস অঞ্চলে তখনো বলশেভিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চলছিল এবং ট্রান্সককেশাসে তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্র (আজারবাইজান, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া) অবস্থান করছিল। মিত্রশক্তি (বিশেষ করে ব্রিটিশরা) চাইলো ট্রান্সককেশিয়ান রাষ্ট্রগুলোকে রুশ বলশেভিক ও তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের মধ্যবর্তী 'বেড়া' হিসেবে ব্যবহার করতে। এর মধ্য দিয়ে তারা রুশ বলশেভিকদের পতন ঘটাতে এবং নিজেদের মধ্যে তুরস্কের বিভাজন করতে ইচ্ছুক ছিল। এক্ষেত্রে আজারবাইজানের ব্রিটিশপন্থী মুসাভাৎ সরকার সোভিয়েত রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছিল। মাম্মাদ আমিন রাসুলজাদে এবং ফাতালি খান খোয়স্কি আজারবাইজানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং এজন্য আজারবাইজানি ভূখণ্ড দিয়ে বলশেভিক সৈন্যদের যাতায়াত করা সম্ভব ছিল না। ফলে রুশ বলশেভিকদের পক্ষে তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের সরাসরি সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছিলো না। এজন্য রুশ ও আজারবাইজানি বলশেভিকদের পাশাপাশি তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা আজারবাইজানের ব্রিটিশপন্থী মুসাভাৎ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পক্ষপাতী ছিল। মিত্রশক্তির নিকট ওসমানীয় রাষ্ট্রের আত্মসমর্পণের পর আজারবাইজান ওসমানীয় সুরক্ষা হারায়, কিন্তু আঙ্কারা সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারা আঙ্কারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। আঙ্কারা সরকার এসময় শত্রুবেষ্টিত ও যুদ্ধরত অবস্থায় ছিল, ফলে আজারবাইজানকে কার্যকরী সুরক্ষা প্রদান করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ১৯১৯ সালের নভেম্বরে তুরস্ক ও আজারবাইজানের মধ্যে গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে বহুসংখ্যক তুর্কি সামরিক কর্মকর্তা আজারবাইজানের মাটিতে উপস্থিত ছিল এবং আজারবাইজানি সেনাবাহিনীতে অফিসার, প্রশিক্ষক ও সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছিল। ১৯১৯ সালের নভেম্বরে আজারবাইজানে অবস্থানরত তুর্কি সামরিক কর্মকর্তারা গোপন বৈঠকে জমায়েত হন। এই বৈঠকে তারা মুসাভাৎ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আজারবাইজানি বলশেভিকদের সহায়তা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। তুর্কি সামরিক কর্মকর্তা হুলুসি মামেদজাদে আজারবাইজানি সেনাবাহিনীর শিরভান রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। ১৯১৯ সালের শেষভাগ থেকে ১৯২০ সালের প্রথম ভাগ পর্যন্ত রেজিমেন্টটি লাঙ্কারান গ্যারিসনের প্রধান অংশ ছিল। মামেদজাদে আজারবাইজানি সৈন্যদের মধ্যে আজারবাইজানি বলশেভিকদের পক্ষে প্রচারণা চালান। ১৯২০ সালের প্রথম দিক নাগাদ এটি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, ব্রিটেন আজারবাইজানকে কূটনৈতিক সমর্থন দিলেও ট্রান্সককেশাসে সোভিয়েত রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যকার প্রাচীর টিকিয়ে রাখার জন্য এই অঞ্চলে সৈন্য প্রেরণ করতে তারা প্রস্তুত নয়। এর ফলে তুর্কি জাতীয়তাবাদী নেতারা প্রকাশ্যে ও স্পষ্টভাবে রুশ বলশেভিকদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। ১৯২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মুস্তফা কামাল পাশা তুর্কি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজিম কারাবেকিরকে সাঙ্কেতিক বার্তা প্রেরণ করে মন্তব্য করেন যে, মিত্রশক্তি তুরস্ককে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং এটি এড়ানোর জন্য চরম পদক্ষেপ নিতে তারা বাধ্য হচ্ছেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/K%C3%A2z%C4%B1m_Karabekir

আতাতুর্ক কারাবেকিরকে সৈন্য সমাবেশ করে ট্রান্সককেশাস প্রাচীর ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। তিনি নির্দেশ দেন, কারাবেকির যেন জরুরি ভিত্তিতে ককেশিয়ান রাষ্ট্রগুলোর এবং বিশেষত আজারবাইজান ও দাগেস্তানের মতো মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে মিত্রশক্তির পরিকল্পনা সম্পর্কে তাদের মনোভাব পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি আরো নির্দেশ দেন যে, ককেশিয়ান রাষ্ট্রগুলো যদি সোভিয়েত রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেয়, সেক্ষেত্রে কারাবেকির যেন রুশ বলশেভিকদের সঙ্গে মিলে রাষ্ট্রগুলোর ওপর যৌথ আক্রমণ পরিচালনার ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করেন। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ কাজিম কারাবেকির ওসমানীয় সমরনায়ক হালিল পাশা এবং নূরী পাশার কাছে চিঠি প্রেরণ করেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Halil_Kut

হালিল পাশা 'কুত আল আমারা'র যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাজিত করেছিলেন এবং নূরী পাশা বাকুর যুদ্ধে আর্মেনীয়দের পরাজিত করেছিলেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Nuri_Killigil

তাদের কাছে প্রেরিত চিঠিতে কারাবেকির মন্তব্য করেন যে, তুর্কি সীমান্তে উপস্থিত হতে হলে রুশ বলশেভিকদের অবশ্যই তাৎক্ষণিকভাবে সমগ্র ককেশাস অঞ্চল দখল করে নিতে হবে। তিনি মত প্রকাশ করেন যে, রুশ বলশেভিকরা যদি ক্ষুদ্র একটি সৈন্যদল নিয়েও আজারবাইজানে আসে এবং আজারবাইজানি সৈন্যদের নিয়ে তুর্কি সীমান্তে পৌঁছায়, সেটি তুর্কিদের স্বার্থে কাজ করবে। তুর্কি সীমান্তে বলশেভিক সৈন্যদের উপস্থিতি তুরস্কে মিত্রশক্তির গোটা সমীকরণ পাল্টে দিতে পারতো। কারাবেকির আরও মন্তব্য করেন আজারবাইজান, দাগেস্তান ও জর্জিয়ায় বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করতে পারলে সেটি তুরস্কের জন্য লাভজনক হবে। তুর্কি প্রতিনিধিরা রুশ বলশেভিকদের কাছে প্রস্তাব করেন যে, আজারবাইজান দখল করার জন্য হালিল পাশার সৈন্যদলকে ব্যবহার করা হোক। হালিল পাশা দাগেস্তানে স্থানীয় মুসলিমদের সমন্বয়ে একটি সৈন্যদল গঠন করেছিলেন। রুশ বলশেভিকদের দ্বারা গঠিত ককেশিয়ান আঞ্চলিক কমিটি এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করে যে আজারবাইজান অভিযানের সময় লাল ফৌজের ইউনিটগুলোর সম্মুখভাগে হালিল পাশার মুসলিম সৈন্যদলকে রাখা উচিত, কারণ আজারবাইজানি সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে হালিল পাশা ব্যাপক জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী। এই অভিযানে তার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাকুর তেলক্ষেত্র ও তেলের মজুদ ধ্বংস করে দেয়া থেকে আজারবাইজানি সরকারকে বিরত রাখা যাবে। একই সময়ে আঙ্কারা সরকার বাকুতে অবস্থানরত সকল তুর্কি নাগরিককে বলশেভিক নিয়ন্ত্রিত ককেশিয়ান আঞ্চলিক কমিটির সকল নির্দেশ মেনে চলার জন্য নির্দেশনা প্রদান করে। ১৯২০ সালের ১৫ এপ্রিল কাজিম কারাবেকির এবং আজারবাইজানি উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল আলী আঘা শিখলিনস্কি ১৯১৯ সালের নভেম্বরে স্বাক্ষরিত গোপন তুর্কি-আজারবাইজানি চুক্তিতে একটি অতিরিক্ত গোপন সামরিক প্রোটোকল সংযোজন করেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Aliagha_Shikhlinski

এই ধারা অনুযায়ী, তুরস্ক ও আজারবাইজানের মধ্যে কেউ তৃতীয় কোনো পক্ষ দ্বারা আক্রান্ত হলে রাষ্ট্রদ্বয় একে অপরকে সামরিক সহায়তা প্রদান করবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও হালিল পাশার নেতৃত্বাধীনে একদল তুর্কি সামরিক কর্মকর্তা সক্রিয়ভাবে আজারবাইজানের অভ্যন্তরে লাল ফৌজের অগ্রযাত্রায় সহায়তা করে। তারা স্থানীয় জনসাধারণকে বলশেভিকদের বাধা প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্য আহ্বান জানায়। তুর্কি সামরিক কর্মকর্তা ও গুপ্তচররা আজারবাইজানের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে একটি করিডোর নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যে প্রচারণা চালাচ্ছিল, তাতে ইত্তিহাদ দল এবং মুসাভাৎ দলের বামপন্থী অংশ বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। সক্রিয় তুর্কি সহায়তায় বলশেভিক লাল ফৌজ ১৯২০ সালের ২৭-২৮ এপ্রিল আজারবাইজানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং সেখানে বলশেভিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ৩ মে 'তুর্কি বলশেভিকদের পক্ষ থেকে আজারবাইজানি জনসাধারণের নিকট' শিরোনামে একটি ঘোষণা আজারবাইজানে প্রচারিত হয় এবং এই ঘোষণায় আজারবাইজানিদের নতুন বলশেভিক সরকারকে সমর্থন প্রদানের জন্য আহ্বান জানানো হয়।





Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]